প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে..
কারাবন্দী
আল মুজাহিদী
আমি কারাবন্দী
আমিার অস্থি পাঁজর প্রজ্জ্বল মাংসের তোরণ
অন্ধকার কড়িবর্গার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে
পৃথিবীর চিলেকোঠার ভেতর
আমি সে-দিন রাত্রির বুকের ব্রেসিয়ার খুলে
ঘুমন্ত পুষ্পিত স্তনযুগলের ওপর হাত বুলালাম
নক্ষত্রের স্তূপীকৃত অন্ধকার, -প্রগাড় রহস্যময় দিনরাত্রি
আমাকে জিজ্ঞেস করো না তোমার বিধিনিষেধের কথা
আমি কারাবন্দী।
হে পৃথিবীর প্রথম আলোকচিহ্ন
আমাকে জিজ্ঞেস করো না তোমার অন্তহীন প্রাণময়তার কথা
অনেক বছর কেটে গেছে আমি তোমাকে দেখিনি
পে পূর্ণ তিথির চাঁদ; অন্তরীণ
আমাকে জিজ্ঞেস করো না তোমার স্বপ্নিল মুহূর্তের কথা
হে সমুদ্র
আমি অনেক দিন দেখিনি তোমার সফেন উত্তাল হৃদয়
জলরাশি
জলজবীথির পারিজাত সবুজ ঘাসের দ্বীপমালা উপত্যকা
আমি অনেকদিন নিঃশ্বাস নিতে পারিনি তোমার সফেন
স্তনপুঞ্জের ভেতর
নিঃসীম নীলিমা
তোমার নক্ষত্রের ঘাসফুল পাখি পতঙ্গের চলাফেরা
অনেকদিন দেখিনি
আমি দ্রাঘিমার সুতো টেনে ধরে বসে রয়েছি
অক্ষরেখা আরো অন্ধকার
লকআপ করা আত্মা
আমি অনেক দিন মুখোমুখি হইনি বন্দীদশাহীন আত্মাদের
আমার শ্যামল প্রেয়সী
আমাকে জিজ্ঞেস করো না তোমার হৃদয়ের আতিশয্যের কথা
আমি অনেক দিন দেখিনি তোমার প্রত্যুষের রাজধানী
আমি অনেক দিন দেখিনি হরিৎ পত্রালি শৈশবের তেপান্তর মাঠ
আলতামিরার অশ্বের ক্ষুরধ্বনি শুনিনি অনেক দিন
হাজার বছর
তোমার নাক্ষত্রিক জীবযোনির স্পর্শে শিহরণ জাগেনি
অনেক দিন
আমার নিঃসঙ্গ ছাউনি
আমি এখন সূর্যের নিচে বসবাস করি
আমি এখ চাঁদের নিচে বসবাস করি
হ্রদের পাড়ের ঘাসের শয্যায় চোখ বুজে শুয়ে থাকি
সমুদ্র-পাখির চিৎকার অরণ্যমর্মর শুনতে শুনতে
কেটে যায় দিনরাত সহস্র প্রহর যাম, পল-অনুপল
আমি বন্দী
আমাকে আর কখনো গরাদের বাইরে যেতে বলো না
কারণ তুমি কখনো দেখোনি মানুষের স্বাধীন ভূ-খণ্ড
স্বাগত’ স্বাগত কারাগার তুমি আমাকে আর
মুক্ত করতে পারবে না
আমি এখন আমার আত্মার শেকলে বন্দী
আমি অনন্তকালীন আতিশয্যে বেঁচে আছি।
……………………………………
২১.০২.১৯৬৮, ঢাক কেন্দ্রীয় কারাগার
[বিশ শতকের বাংলাভাষার খ্যাতিমান কবিদের একজন আল মুজাহিদী। সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি খ্যাতিমান।তিন দশকেরও অধিক সময় ধরে তিনি দৈনিক ইত্তেফাক এর সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন কবি। কবিতা ছাড়াও আল মুজাহিদী গল্প, উপন্যাস, সমালোচনা, অনুবাদ ও শিশুসাহিত্যে অবদান রেখেছেন।
আল মুজাহিদী ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহন করেন। পিতা আবদুল হালিম জামালী ও মাতা সাখিনা খান ও স্ত্রী পলিন পারভীন।তিনি ১৯৫৮ সালে ভিক্টোরিয়া হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা ও ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে টাঙ্গাইলের করটিয়া সা’দত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৬৪ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে স্নাতক (কলা) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে সমাজবিজ্ঞানে ও ১৯৯৭ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।দীর্ঘকাল সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত থেকে বর্তমানে অবসর জীবনযাপন করছেন কবি আল মুজাহিদী।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলীঃ
কাব্যগ্রন্থ: হেমলকের পেয়ালা; ধ্রুপদ ও টেরাকোটা; যুদ্ধ নাস্তি; মৃত্তিকা অতি-মৃত্তিকা; প্রিজন ভ্যান; দিদেলাস ও ল্যাবিরিস্থ; ঈডের হ্যামলেট; প্রাচ্য পৃথিবী; পৃথিবীর ধুলো; সৌর জোনাকি; ভিতা নুওভা; অ্যাকাডেমাসের বাগান;
আল মুজাহিদীর শ্রেষ্ঠ কবিতা; আল মুজাহিদীর প্রেমের কবিতা; সন্ধ্যার বৃষ্টি; কালেরবন্দীতে; পাখির পৃথিবী; আলবাট্রাস; ভঙুর গোলাপ; কাঁদো হিরোশিমা কাঁদো নাগাসাকি।
উপন্যাস : প্রথম প্রেম; চাঁদ ও চিরক’ট; মিলু এট ও স্যোন্যাটা; লাল বাতির হরিণ; রূপোলি রোদ্দুর; আলোর পাখিটা; ছুটির ছুটি; খোকার আকাশ; খোকার যুদ্ধ।
ছোটগল্প: প্রপঞ্চের পাখি; বাতাবরণ; ভরা কটাল মরা কটালের চাঁদ।
শিশুসাহিত্য: পালকি চলে দুলকি তালে; হালুম হুলুম; তালপাতার সেপাই; শেকল কাটে খাঁচার পাখি; সোনার মাটি রূপোর মাটি; ইস্টিশানে হুইসেল।
গবেষণা গ্রন্থ: কালান্তরের যাত্রী। প্রবন্ধ: সমাজ ও সমাজতত্ত্ব।
অনুবাদ : কাইফি আজমির কবিতা; পৃথিবীর কবিতা; আহমদ ফরাজের কবিতা; ঊর্দূ কবিতা; হিন্দি কবিতা; হাইনরীশ হাইনে-র কবিতা।
পুরস্কার ও সম্মাননা: জীবনানন্দ দাশ একাডেমী পুরস্কার; কবি জসীমউদ্দীন একাডেমী পুরস্কার; মাইকেল মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার; শেরে বাংলা সংসদ পুরস্কার; জয়বাংলা সাহিত্য পুরস্কার; একুশে পদক (২০০৩); বাসাসপ কাব্যরত্ন পদক (২০১৮)।