আড্ডাপত্র

১১ পৌষ, ১৪৩১; ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪;রাত ১১:২১

আড্ডাপত্র : প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা– ৩৬

প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে..

হায় কৃষ্ণ ঘৃণার পাথর

সায়ীদ আবুবকর

কাঁসার থালার মতো ঘষেমেজে একখণ্ড কবিকাঠ ধোও, কয়লার সারাংশই শুধু পাবে।
কবিদের সারা দেহে পাপ, কবিদের রোমকূপে-কূপে কোটি কোটি শরণার্থী পাপ।
কবিরা পাপের জন্মদাতা। কবিরা পাপের সাথে এক থালে খায়। পাপ পুণ্য ভাই ভাই’ বলে শান্তিসভা করে।
হায় কৃষ্ণ ঘৃণার পাথর; তুমি বুঝি পাপিষ্ঠ এ কবির চেয়েও বেশি-পাপী ছিলে?
সমস্ত আকাশ যাঁর মাথার উপর পেতে দিতো মেঘরঙ ছায়ার চাদর;
বনের হরিণ যাঁর রক্তজবা পায়ে এঁকে দিতো ভালবাসা, নাত আর চুমো;
পাখি আর বৃক্ষ যাঁর পায়ের ধুলোয় শ্রদ্ধায় ছড়িয়ে দিতো অজস্র সালাম;
কোন পাপে বলো তুমি দজ্জালের মতো ছুঁয়েছিলে শুভ্র তাঁর সোনার শরীর?
ফুলেল শরীর কেটে তায়েফের পাপপূর্ণ পথে ঢেলেছিলে আমাদের হৃদয়ের রঙ?
এমনও তো অগ্নি আছে, কি-আশ্চর্য হিম হয়ে যায় গজবের ভয়ে; এবং আল্লাহর ভয়ে,
এমনও তো মৎস্য আছে, কাঙ্খিত আহার গিলেও হজম করতে করে না সাহস;
বলো তবে তুমি কোন্ ভয়হীনতায়, ফুটন্ত ফুল না হয়ে, নেকড়ের দন্ত হয়ে, হায়েনার
থাবা আর শকুনের মাংসাশী চঞ্চু হয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলতে লাগলে; সীমারের
ছুরি হয়ে ফালি ফালি করে ফেলতে লাগলে আমাদের সমুদয় আত্মার তরমুজ?
কত পাপ করলে এমন হীন হওয়া যায়? কত পাপ করলে পাথর দোজখের
ভয় ভুলে হয়ে যায় এরকম নিজেই জেহেল?
হায় রে পাথর, আমি এক, বাংলাদেশের পাপপোড়া কবি। তবু এই চোখ ফেটে যায়।
শুধু তার শান্তিরঙ সোনার চরণ ঘুমঘোরে একটাবার দেখবো বলেই চৈত্রের অসহ্য
খাইখাই রোদে ফেঁটে যাওয়া কাঁকুড়ের মতো ফাটতে ফাটতে, ফাটতে ফাটতে ফেটে যায়
কি-ভীষণ ক্ষধার্ত আমার দুচোখের ভুঁই! এই আমি ‘তুই’ যদি হতো, আমি তো অনন্ত
ঘাসফুল হয়ে রাখতাম ঢেকে তাঁর দেহের জমিন; বিমুগ্ধ বকুল হয়ে ফুটে ফুটে থাকতাম
তাঁর রোমকূপে-কূপে; তারপর গুনগুন গুনগুন গাইতে গাইতে অজস্র সালাম, বলতাম,
“হে রসুল, কোনোদিন আমি আর ফেরদৌস হতে এই, যাবো না তো ঝরে?” বলতাম,
“হে রসুল, আমি এক কবি। কবিদের সারা দেহে পাপ। বদী ও নেকীর কোনো
বুঝিনে হিসেব। হাশরের মহাআদালতে হিসেব নিকেশ আমি পারবো না দিতে।
ঘাসফুল হয়ে এই, অনন্ত বকুল হয়ে, আমি কি পারবো যেতে হুরের মেলায়?” এই বলে
অতঃপর শিশুর মতোই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু কাঁদতাম আর কাঁদতাম।
হায় কৃষ্ণ ঘৃণার পাথর; আমি তো বুঝি না, যাঁর পাপধোয়া প্লাবনআলোয়
অন্ধকারপোড়া এক ওমর-কয়লাও হয়ে যায় মুহূর্তেই সোনার চেরাগ; এবং বুঝি না,
যাঁর প্রেমরঙ চরণধুলোয় মহাকালপাপে পোড়া জাহান্নামভুঁইও হয়ে যায় মুহূতেই
বেহেস্তবাগন; কোন্ পাপে তুই তাঁর আমপাকা শরীর ছুঁয়েও, ফেরদৌসের
আত্মা আর শান্তিলাল নহরের হৃদয় ছুঁয়েও হয়ে গেলি এরকম নীল হাবিয়ার

অনন্ত আহার?

সায়ীদ আবুবকর নব্বই দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি।মাইকেল মধুসূদন দত্ত-এর কবিতা ইংরেজি থেকে বাংলায় ও কবি আল মাহমুদ-এর সোনালি কাবিন ইংরেজিতে The Golden Kabin নামে অনুবাদ করেও তিনি খ্যাতিমান হয়েছেন। ছড়া দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও তার সৃষ্টিভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ। রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই প্রথম তার ছড়া ছাপেন ১৯৮৮ সালে ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রণয়ের প্রথম পাপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালে, যা তাকে শক্তিশালী মৌলিক কবিরূপে প্রতিষ্ঠিত করে। কবিতা ছাড়াও প্রবন্ধ ও অনুবাদসাহিত্যে তার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। জন্ম: ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৭২ যশোর জেলায়। পিতা নূর মোহাম্মদ বিশ্বাস; মাতা আমেনা খাতুন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে। কর্মজীবন শুরু করেন পাক্ষিক পালাবদল পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসেবে। বছর খানেক পর ঢাকা ছেড়ে যোগদান করেন চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ইংরেজির প্রভাষক পদে। এরপর বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান করেন ঝিনাইদহের সরকারী লালন শাহ কলেজে। বর্তমানে সহযোগী অধ্যাপক পদে কর্মরত আছেন সিরাজগঞ্জ সরকারী কলেজে।
প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
কাব্যগ্রন্থ : প্রণয়ের প্রথম পাপ (১৯৯৬), জুলেখার শেষ জাল (২০০৪), সাদা অন্ধকারে কালো জ্যোৎস্নায় (২০০৬), মেসোপটেমিয়ার মেম (২০০৭), বঙ্গেতে বসতি (২০০৮), এবার একটিবার একসাথে (২০১০), কপোতাক্ষ পাড়ের রোদ্দুর (২০১২), কাগজ কুসুম (২০১৪), তুমি বলো তুমি বৃষ্টি ভালবাসো (২০১৫), আমার কোথাও যাওয়ার নেই (২০১৭), মহাকালের কান্না (২০১৮), মুজিবনামা (মহাকাব্য, ২০১৮), তোমার পৃথিবী চালায় দস্যুরা (২০২০)। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তার ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (২০১৫)।
ছড়াগ্রন্থ : ছড়াছড়ি (২০০৯), খোকার জামা বাঘের গায়ে (২০১৬), হেমিলনের বংশীঅলা (২০১৭), স্বর্গের ঢেঁকি (২০০৯)।
প্রবন্ধগ্রন্থ: কবিতা কমল (২০০৬), কবিতার আধুনিকতা (২০১০), সাহিত্যের সাত-সতের (২০১৮)।
অনুবাদগ্রন্থ: মধুসূদনের ইংরেজি কবিতা (২০০৯), ঞযব এড়ষফবহ কধনরহ (২০১০, যুক্তরাষ্ট্র), ভিন্ন ভাষার শ্রেষ্ঠ গল্প (২০১৪), নির্বাচিত বিদেশী কবিতা (২০১৮), বেহেস্তের বাগান (২০১৮)।
সম্পাদিত সংকলন : আধুনিক বাংলা কবিতা (২০০৯, ২০১৯), Anthology of the World poetry ( ২০১১, যুক্তরাষ্ট্র)।
পুরস্কার ও সম্মাননা : শব্দশীলন সাহিত্য পুরস্কার ২০০৮, লালন পদক ২০০৯, ডিসিএল সাহিত্য পুরস্কার ২০১৪, সৈয়দ আলী আহসান সাহিত্য পদক ২০১৭, রক পেবলস ইন্টারন্যাশনাল লিটারেরি এওয়ার্ড ২০১৭ (ভুবনেশ^র, ভারত), দেশজ সাহিত্য পুরস্কার ২০১৮, উত্তর কোলকাতা বাংলা ভাষা চর্চাকেন্দ্র সম্মাননা ২০১৮ (কোলকাতা, ভারত) প্রভৃতি। এছাড়া ২০১২ সালে কবির ৪০ বছরপূর্তিতে উৎসঙ্গ সৃজন চিন্তন তাকে প্রদান করে বিশেষ সম্মাননা।
সায়ীদ আবুবকরের কবিতা অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, স্প্যানিশ, চাইনিজ, আরবি, উড়িয়া, মালয়ালম ও রাশিয়ান ভাষায়। বিশে^র বিভিন্ন লিটারেরি জার্নাল ও এ্যান্থলোজিতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ইংরেজি কবিতা। পোয়েমহান্টারের জরিপে তিনি বিশে^র শীর্ষ ৫০০ কবির অন্যতম।

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১