প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে]
ঝিনুক মুহূর্ত্ত সূর্যকে
আজীজুল হক
আজন্ম দুহাতে এক অদৃশ্য প্রেতের সাথে যুদ্ধ ক’রে ক’রে
আমিও অদৃশ্য। এই লোকালয় থেকে
কিছুদূরে গেলে এক ধূসর প্রান্তরে
পিছু-পিছু হাঁটি, অন্ধকারে তাকে তাড়া করি,
যদিও নিশ্চিত জানি সে
আয়ুর নিষিদ্ধ রেখা অতিক্রম করে না কখনো।
বন্ধুর শীতল হাতে হাত রেখে বন্ধুরা যখন
হলুদ বাতির নীচে কথা বলে, ‘ফের দেখা হবে
আসি তবে,’ এবং বিশ্লিষ্ট হয় জুতোয় মাড়িয়ে
চিনেবাদামের খোসা,
বরফকুচির ধুলো ওড়ে ছায়াপথে,
নির্বিকার নক্ষত্র সমাজ,
প্রত্যেকে প্রত্যক্ষ করি কোনো এক দুর্ঘটনাকে,
প্রত্যেক নক্ষত্র এক দূরত্বের নিঃসঙ্গ শিকার।
ভূমিতে প্রোথিত দেখি অর্ধাঙ্গ আমার,
নদীর নিকটে
সুতীক্ষ্ণ শব্দের স্রোত, কঠিন রূপালী ঢেউ, ইস্পাত মসৃণ
চাকা, দ্রুত ফেলে গেছে,
দ্রুত, আরও দ্রুত
সোনালী কাঁকড়া দাঁতে, হলুদ পতঙ্গে খাবে
ছিঁড়ে ছিঁড়ে উদ্বৃত্ত আমাকে।
আমি তবে প্রেতটাকে কী করে ফেরাবো। তার প্রেম
অনিবার্য, অদৃশ্য শীতল,
সমাধি স্তম্ভের ছায়া
আত্মার শিয়রে,
সময়ের যক্ষ্ম দেয় অনন্ত আয়ুকে পাহারা,
কী করে ফেরাবো।
ঘৃণার বুদ্বুদ আর ক্ষোভের তরঙ্গ আর স্রোতের আবর্ত দিয়ে যাকে
সমুদ্র লুকিয়ে রাখে অতল গভীরে
তাকে প্রেম দেবে বলে ঝিনুকের ঠোঁটে
ঠোঁট রাখে সূর্যের হৃদয়;
আযুর সীমান্তে এলে পর
তুষার তাড়িত ফল বীজের ভিতরে আনে
কী গাঢ় ইচ্ছাকে, কিছুক্ষণ রঙ মাখে
কী বিষণ্ন সবুজ শরীরে।
কবি আজীজুল হক পঞ্চাশ দশকের কম উজ্জ্বল কবি। আজীজুল হক একজন আঙ্গিক ও প্রকরণসিদ্ধ কবি। অল্পলিখেও তিনি কবিতার পাঠকের মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ।
জন্ম ১৯৩০ সালের ২ মার্চ তদানীন্তন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার শ্রীপুর থানার তারাউজাল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সী মোহাম্মদ জবেদ আলী এবং মাতা রহিমা খাতুন। তিনি ১৯৬২ সালে সাতক্ষীরা জেলার সুলতানপুর গ্রামের সেলিনা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্র এম. এম. সবজুল হক ও এম সীমাউল হক।
আজীজুল হক এর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় নিজ গ্রামের আপার প্রাইমারী স্কুলে এবং পরে আম তৈল মধ্য ইংরেজী স্কুলে। ১৯৪৭ সালে তিনি শ্রীপুর মহেশচন্দ্র উচ্চ ইংরেজী স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে বাগেরহাট পি. সি. কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৪৯ সালে আই. এ. পাশ করেন। ১৯৫১ সালে আজীজুল হক ঢাকা কলেজ থেকে বি. এ এবং ১৯৫৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম. এ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৫৭ সালে সাতক্ষীরা ডিগ্রী কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে যোগদান করেন এবং দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৮ সালে অবসরগ্রহণ করেন।
আজীজুল হকের কাব্যজীবনের সূচনা হয় বিদ্যালয়ে পাঠকালীন ‘শিশু সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় প্রথম রচনা। পরবর্তী পর্যায়ে কলকাতার ‘ইত্তেহাদ’ এর কিশোর মজলিসে তাঁর লেখা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে।
পঞ্চাশের দশকের সূচনালগ্ন কবি আজীজুল হক কবিতায় রাজধানী ঢাকাতে পা রাখেন। এ সময় ঢাকায় তখনকার সময়ের বিখ্যাত কবিদের সাথে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় কবিতা প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে, ইত্তেফাক, ইত্তেহাদ, মাসিক মাহেনও এবং এই আজাদ নিয়মিত তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হয় ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: ঝিনুক মুহূর্ত্ত সূর্যকে (১৯৬৯); বিনষ্টের চিৎকার (১৯৭৬); ঘুম ও সোনালী ঈগল (১৯৮৯)। ১৯৯৪ সালে ‘আজীজুল হকের কবিতা’ নামে প্রকাশিত হয় তাঁর নির্বাচিত কবিতা।
প্রবন্ধ: অস্তিত্ব চেতনা ও আমাদের কবিতা (১৯৮৫, বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত)
অন্যান্য রচনা: আজীজুল হক বেশ কিছু নাটক, গীতিনাট্য ও ছায়ানাট্য রচনা করে মঞ্চস্থ করেছেন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী অবলম্বনে ‘অগ্নিবীণা’ ছায়া নাট্য রূপায়ণের সার্থক রূপকার আজীজুল হক। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত ‘কৃষ্ণ চূড়ার তৃষ্ণা’ তাঁর সমাজ সচেতনতার ও শিল্প রূপায়নের অপূর্ব বহিঃ প্রকাশ।
সম্মাননা:
সুহৃদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫); যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৬); বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৯); মধুসূদনের একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৯); যশোর শিল্পী গোষ্ঠীপদক ( ১৯৯৪; চাঁদের হাট পদক ( ১৯৯৬)
পরলোক গমন: কবি আজীজুল হক ২৭ আগস্ট ২০০১ মৃত্যুবরণ করেন। যশোর কারবালাস্থ গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
…………………..
তথ্য সূত্র :
১) যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক, লেখক: কাজী শওকত শাহী
২) কবি আজীজুল হক ও তাঁর কবিতা, খসরু পারভেজ/ mangrovesahitya.com
৩) দৈনিক জনকণ্ঠ: আগস্ট ২১, ২০২০