[প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে]
স্নানের জন্য // হুমায়ুন আজাদ
মরুভূমির মতো নদী বয়ে যায় দিকচিহ্নহীন
আমি কি ক’রে ভাসাই নৌকো জলে নামি
স্নান করি
স্নানের যোগ্য জল নেই কোনো নদী সরোবরে
পেছনে স্বভাব কবির কণ্ঠনিসৃত পদ্যের মতোন ধুঁয়ো ওঠে
কারখানার চিমনি চিরে
তার স্তবে মগ্ন হ’লে বুঝতে পারি ড্রেনে ড্রেনে পদ্ম ফোটে
ডাস্টবিনে জন্ম নেয় সুর্যমুখি
অবশ্য কারো বন্দনা দিতে
পারে না তৃপ্তি
কোনো বিশ্বাস অনির্বচন
দেয় না দীপ্তি
আমি শুধু বমনার্ত সংকলিত মলভাণ্ড সামনে রেখে
বলি: জননী তো প্রজননী পিতৃদেব অস্তিত্বঘাতক
জ্ঞান শুধু ধ্যানে আছে কীটদষ্ট বটবৃক্ষতলে
আমার চৌদিকে আজ লাখ লাখ সার্চলাইট জ্বলে
অথচ কী অন্ধকারে আমি
পৃথিবীটা সংবাদপত্র বড়োজোর সিনেমামাসিক
স্থূলদেহী তারকার ভুরুউরুবাঁকভরা বেদিত শরীর
আমার শরীরখানি তুলে ধরো হে মরমা হৃদয়মন্দির
নাম জপে কি যে সুখ কতো কাল আগে
বুঝেছিলো রাধা
কেননা নামের শব্দ প্রিয়তম নাম
অস্তিত্বের আধা
আমি যাকে অস্তিত্বের অংশ ভাবি সে শুধু ধ্বংস করে পুষ্পচন্দ্র
বড্ডো ময়লা যেনো জমে গেছে এ-শরীরে
স্নান তাই অতি আবশ্যক
অথচ স্নানের যোগ্য জল কই নদীতে বা গৃহে
স্নান স্নান চিৎকার শুনে থাকো যদি
নেমে এসো পূর্ণবেগে ভরাস্রোতে হে লৌকিক অলৌকিক নদী
——————————
[হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান কবি, ঔপন্যাসিক, সমালোচক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক। জন্ম: ২৮শে এপ্রিল, ১৯৪৭ (১৪ই বৈশাখ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ), রাড়িখাল, বিক্রমপুর; মুন্সিগঞ্জ। মৃত্যু: ১১ই আগস্ট, ২০০৪, মিউনিখ, জার্মানি। ।স্ত্রী- লতিফা কোহিনুর। দুই কন্যা- মৌলি আজাদ, স্মিতা আজাদ এবং একমাত্র পুত্র- অনন্য আজাদ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ষাট এর অধিক। ধর্ম, প্রথা, প্রতিষ্ঠান ও সংস্কারবিরোধিতা, নারীবাদিতা, রাজনৈতিক বক্তব্য এবং নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য তিনি ১৯৮০’র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হুমায়ুন আজাদ রাড়িখালের স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ইন্সটিটিউশন থেকে ১৯৬২ সালে মাধ্যমিক, ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৭৬ সালে তিনি এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ’।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থঃ
অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩); জ্বলো চিতাবাঘ (১৯৮০); সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫); যতোই গভীরে যাই মধু যতোই উপরে যাই নীল (১৯৮৭); আমি বেঁচে ছিলাম অন্যদের সময়ে (১৯৯০); হুমায়ুন আজাদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৯৩); আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৯৪); কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু (১৯৯৮); কাব্য সংগ্রহ (১৯৯৮); পেরোনোর কিছু নেই (২০০৪); কাব্যসমগ্র (২০০৫, ২য় মুদ্রণ ২০০৮)
পুরস্কার এবং সম্মাননা :
বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮৬; অগ্রণী ব্যাংক-শিশু সাহিত্য পুরস্কার ১৯৮৬; মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার ২০০৪; একুশে পদ ২০১২ ।
২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীতে অনুষ্ঠিত বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে ঘাতকদের আক্রমণের শিকার হন তিনি। বিদেশে নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে তিনি কিছুটা সুস্থ হন। এর কিছুদিন পরেই জার্মান সরকার তাকে গবেষণা বৃত্তি প্রদান করে। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিশ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান। ২০০৪ সালের ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর মরদেহ কফিনে করে জার্মানি থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাযার নামাজশেষে তাঁর মরদেহ জন্মস্থান রাড়িখালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই দাফন করা হয়।]