আবদুর রব
কবি কামরুল হাসান: দৃশ্যের বাইরে যে আঁধার আছে তাকে দেখতে পান এমন একজন দ্রষ্টা।
আশির দশকের অন্যতম কবি কামরুল হাসানের জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কাটে শরীয়তপুরে। মামাবাড়ির উদার ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশে তার বিকাশ। কবিতা লিখছেন স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকে । প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় কবি বেলাল চৌধুরী সম্পাদিত ‘সচিত্র সন্ধানী’ পত্রিকায়, ১৯৭৮ সালে। সেই আশির দশকেই বিখ্যাত দেশ ও জিজ্ঞাসা’র মতো পত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হয় । গত চার দশক ধরে তিনি নিরলস লিখে চলেছেন, ফলে সাহিত্য অঙ্গনে তিনি এক অতি পরিচিত নাম। পেশাগত জীবনে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। পড়ানোটা পেশা হিসেবে নিলেও লেখালেখিটা তাঁর প্যাশন। এ পর্যন্ত ১২টি কাব্যগ্রন্থ, ৫টি ভ্রমণকাহিনী, ২টি প্রবন্ধ, ৩টি অনুবাদ, ১টি ছোটগল্প ও ১টি সম্পদনা গ্রন্থসহ সব মিলিয়ে প্রায় ৩০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৯১ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয়। বইটির ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন কবি বেলাল চৌধুরী। কবি শামসুর রাহমানকে বইটি উপহার দিলে তিনি কবি কামরুল হাসানের ব্যক্তিত্ব, কাব্যপ্রতিভা ও কবিতা সম্পর্কে মূল্যবান কয়েকটি কথা বলেন। তিনি বলেন কামরুল হাসান ছোট ছোট কবিতা, সংযত, সংহত পঙক্তিমালায় একজন সত্যিকারের কবির স্বাক্ষর। তিনি এই গ্রন্থভুক্ত ট্রেন, পুতুল, চিড়িয়াখানার দর্শক ও ক্যাফেটেরিয়ার কাক কবিতার প্রশংসা করেন।
ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার মেধা তালিকায় স্থানলাভ করেছিলেন । চিকিৎসক হবার আকাঙ্ক্ষায় ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। কিন্তু আবেগতাড়িত হয়ে মেডিকেল পড়াশানা ছেড়ে সরকারি বৃত্তি নিয়ে চলে যান ভারতে। সেখানকার বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুরে অধ্যয়ন করেন বিমান প্রকৌশলবিদ্যায় । পরবর্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া ব্রিটেনের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরি বদল করেছেন। করপোরেট জগৎ থেকে এসে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৬ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সটিতে।
তিনি অত্যন্ত ভ্রমণপিপাসু। ভ্রমণের উপর লিখেছেন ‘বিলেতের দিনলিপি। উজবেকিস্তান ভ্রমণের উপর লিখেছেন আমি তিমুরের দেশে। অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের স্মৃতি থেকে লিখেছেন মহাদেশের মতো এক দেশে (২০১৯)। ভারত ভ্রমণের উপর রয়েছে তাঁর দুটি বই, সিমলা মানালির পথে (২০২০) ও হায়দ্রাবাদের যাত্রী ((২০২১)। ভ্রামণিকদের সাথে নিয়মিত সঙ্গ করার জন্য তাঁর আছে ব্রেকফাস্ট আড্ডা। দেশের প্রখ্যাত ভ্রামণিকরা এসে প্রায়ই জড়ো হয় আড্ডায়। সৈয়দ জাফর, কবি মাহমুদ হাফিজ এবং তিনি এই আড্ডার নিউক্লিয়াস।
তাঁর ছোটগল্পের বই ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প (২০০৫)’তে যেসব গল্প আছে তা মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম, ভালোবাসা, আশা নিরাশাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।
দৃশ্যের বাইরে আভূম অন্তরবর্তী এক টানেল আঁধার।
নিরন্তর রৌদ্রপাটে পুড়ে যায় চিল্কা হ্রদের পিঠ
হেসে খেলে উড়ে আসে বায়ুমুগ্ধ হাঁস,
মানবিক ঐ কিছু জানালা খোলা থাক
ফের নির্মাণ আর পূণ্যস্নান হবে পূর্নিমায়
আমরা যার গন্তব্যে পৌঁছে যাব ঠিক।
তাঁর কবিতা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অনুভূতি, চারিত্র্যলক্ষণ, ছন্দ, জীবন , জিজ্ঞাসা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মানবিকতা আর জনপদ মূল উপাদান হিসেবে বিরাজ করে। ফলে এসব উপাদনকে কেন্দ্র করে যে ভালো লাগা তৈরি হয়, তার ভিতর একটা পাঠকশ্রেণী গড়ে উঠেছে। তাঁর কবিতার কল্পরাজ্য জুড়ে আছে চেতনা, অবচেতনা, স্বপ্ন, ব্যক্তির যৌন মনস্তত্ত্ব ও আকাঙ্ক্ষা। তাঁর কবিতা বাংলাসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার থেকে যেমন নেয় তেমনি ইংরেজী বা ল্যটিন সাহিত্যের ভেতর থেকে রস সংগ্রহ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় তাঁর বেশ দখল থাকায় তাঁর কবিতা সমসাময়িক কবিদের থেকে বেশ আলাদা আর পোক্ত।
জীবনসঙ্গী লুবনা হাসান ও চার সন্তানের জনক কবি কামরুল হাসানের বসবাস মিরপুর, ঢাকায়। তাঁর ষাটতম জন্মবার্ষিকীতে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন!