আড্ডাপত্র

৮ চৈত্র, ১৪৩১; ২২ মার্চ, ২০২৫;রাত ১২:২৪

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ২৬

আড্ডাপত্র

ফেব্রু ২২, ২০২৫ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

মনসুর আজিজ

জমিনের আবাবিল

বাংলাদেশের জমিনে নাজিল হয়েছে ঝাঁক ঝাঁক আবাবিল পাখি
ক্ষমতার নাভিমূলে দিয়েছে ঠোঁকর
কাঁপিয়ে দিয়েছে নয়া আবরাহার মসনদ
তীকক্ষ্ণ ঠোঁটে ছিন্ন করেছে দাম্ভিক শাসকের জুলুমের জাল

কোথা থেকে উড়ে এলো এইসব আবাবিল পাখি
পবিত্র আত্মা- যারা ক্বলবে জমা রেখেছিলো কোরানের আয়াত
যাদেরকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো শাপলা চত্বরে!
এরা কি সেইসব মজলুম বান্দা- যাদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো পল্টনে
নাকি ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলানো সেইসব ঈমামের রুহু
যারা সবুজ জমিনে ফলাতে চেয়েছিলো ইনসাফের শস্যবীজ

কোথা থেকে উড়ে এলো ঝাঁক ঝাঁক অচেনা নিষ্পাপ জমিনের আবাবিল
যাদের জন্য মোনাযাতে ফরিয়াদ ঝরেছিলো প্রতি ঘরে ঘরে
চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়েছে অসহায় অশ্রু
বুক থেকে জমাট রক্তের কষ্টের দলা
একজন ত্রাতার আবির্ভাবের জন্য প্রতিরাতে যারা
জায়জামাতে বিলিয়ে দিতো প্রভুর প্রতি হৃদয় উৎসারিত প্রার্থনা
পবিত্র ক্বাবার গেলাফ ধরে যারা চেয়েছিলো আজাদী
নাকি মজলুমের প্রতিটি কান্নার ফোঁটা থেকে জন্ম নিয়েছে
ঝিনুকের শুক্তির মতো জমিনের আবাবিল!

জামিনের আবাবিল তারা-
যাদের জন্য প্রতীক্ষা করেছে-
সেইসব অসহায় পিতা; যার সন্তানকে গুলি করে হত্যা করেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী
সেইসব অসহায় মা; যার পুত্রকে ভাতের থালা থেকে

তুলে নিয়ে গেছে সরকারের পোষাবাহিনী
সেইসব অসহায় বোন; যার ভাইকে কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে
নিয়ে গেছে চাঁদা না দেবার জন্য
সাদা পোষাকের লোকেরা স্ত্রীর বাহুবন্দ থেকে স্বামীকে
তুলে নিয়ে গেছে অচেনা গুমের দেশে
শিশুকে করেছে পিতার স্নেহ-মায়া থেকে বঞ্চিত
বিচারহীনতার জো-হুকুম জনপদে
মুক্তির দূত হয়ে নেমে এসেছে জমিনের আবাবিল।

অবরুদ্ধ জনপদে আশাহীন মানুষের আর্তি শুনে,
জমিনের আবাবিল তাই নেমে এসেছে-
ক্ষমতার মোহে অন্ধ এক রক্তপিপাসু শাষকের জুলুমের অবসানে
উজির-নাজির-কোতোয়ালরূপী
হৃদয়হীন রাক্ষসপুরীর রাজত্ব খানে খান করার জন্য
বছরের পর বছর ধরে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য।

জামিনের আবাবিল কারা?
যারা ট্যাংক, কামান, বন্দুক আর গুলির সামনে
অস্ত্রহীন বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে যায় নির্ভীক
কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে যারা এগিয়ে যায় অসীম সাহসে
এক আকাশ সাহসের ফুঁসফুঁস বহনকারী তরুণের দল যারা
না-ফেরার প্রত্যয় নিয়ে বের হয় ঘর থেকে
যাদের সেøাগান থেকে বের হয় শত্রুর প্রতি ভয়ার্ত সাইরেন
সামান্য ইটের টুকরো যেনো অস্ত্রধারী নব্য হায়েনার চোখে দেখা দেয়
আণবিক বোমার চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপে
এ যেনো নিষ্ঠুর ইসরাইলী বাহিনীর সামনে
নিরস্ত্র ফিলিস্তিনী মুক্তিপাগল মানুষের যুদ্ধ
দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায় টিএসসি থেকে শাহবাগ,
মিরপুর থেকে উত্তরা, উত্তরা থেকে রামপুরা, যাত্রাবাড়ি থেকে নারায়ণগঞ্জ…
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, শহর গ্রাম-গঞ্জ…

ছাত্র-জনতার সাথে নেমে পড়ে খেটে খাওয়া মানুষ,
দোকান কর্মচারি, হকার, রিকশা ও ভ্যান চালক,
প্রতিটি ঘর থেকে অসীম সাহসে নেমে পড়ে মায়েরা-বোনেরা
নতুন বধু যার হাত থেকে এখনো মুছে যায়নি মেহেদির রঙ
যেনো এক অচেনা হ্যামেলিয়নের বাঁশিওয়ালা ফুঁ দিয়েছে মুক্তির শিঙ্গায়

রক্তে যদি আগুন লাগে তাকে আর নির্বাপন করা যায় না
পাপের বোঝা যদি জনপদের চেয়ে ভারি হয়ে যায়
তখন আর মাটি পারে না তাকে ধরে রাখতে
ক্ষমতার পাখনা ফড়িঙের মতো;
সামান্য জিকাগাছের আঠায় লেগে গেলে উড়বার শক্তি থাকে না তার
দম্ভ এমন এক আফিম যার নেশায় হারিয়ে যায় বিবেক ও উপলদ্ধি
নিষ্ঠুরতা যখন অতিক্রম করে মানবিকতার সীমা,
তখন জল্লাসের তলোয়ারও তার ভাগ্যে জোটে না
অনন্ত অসীম যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে-
শয়নে, স্বপনে, জাগরণে কাটাতে হয় তার জীবনপ্রহর!

নিপীড়িত জনপদ যখন মজলুমের কান্নায় ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে
প্রভুর আরশ থেকে তখন নেমে আসে মুক্তির বার্তা
আর দয়াময় তখন নাজিল করেন ঝাঁকে ঝাঁকে জমিনের আবাবিল।

সিদ্দিক আবু বকর

সাহস এক অমিয় সংক্রমণ

সাহস সে তো চিরায়ত সংক্রমণের নাম
রক্তেই চুকাতে হয় সেই সাহসের দাম।
এ সাহস জুড়ে গেলে মুড়ে ফেলা দায়
এ সাহস ঘুরে গেলে দূরে ঠেলা দায়
একবার গতি পেলে যতি টানা ভার
তখন সে বেগতিক অসীম অপার!
এ সাহস ডেকে-
এক থেকে এক-এ
আরও এক এক-এ, একাধিক হয়।
প্রাণ থেকে প্রাণে আরও বহুপ্রাণে
মুক্তির ঘ্রাণে
সাহসের স্রোতধারা স্রোতস্বিনী রয়।
পথ থেকে পথে বহুমতামতে
বহুহতাহতে
না থাকে সংশয় না থাকে ভয়।
এভাবেই প্রাণ থেকে জনপদে চাষ
এভাবেই সাহসের তুমুল সাবাস।

মৃত্যুও হেরে যায় সাহস কাবায়
ভয়ের মাতম জাগে জালিম-থাবায়-
“একটা মরে একটাই যায়
অন্যরা যায় না!”
জালিমের জুলুম আর
নয়া পথ পায় না।

কচিপ্রাণ আবাবিল সাহস প্রবণ
ছত্রিশ জুলাই সে অমিয় দ্রবন-
আবু সাঈদ মুগ্ধ ওয়াসিম আজ
নাফিসা ফাইয়াজরা সাহসের তাজ
সাহসের এই দল দমবার নয়
লালসার কাদাজলে কমবার নয়।

সায়মা ইসলাম

শ্যামলা পাতলা ভীরু চাহনির মেয়েটি

রোজ ছুটতো এ পথ দিয়ে,
আর দশটি কলেজপড়ুয়া মেয়ের মতোন, যারা
সচরাচর চোখ টানে না শ্রীকাতর পথচারীর।
সেদিন আমার চোখ টেনে নিয়েছিলো
প্ল্যাকার্ডের আড়াল থেকে চেয়ে থাকা তার জ্বলজ্বলে দুটি চোখ।
তারপর টিয়ার গ্যাস, ছররাগুলি, দিক-বিদ্বিগ ছাত্র-জনতার ছোটাছুটি
পথের পাশে ছিন্নভিন্ন পড়েছিলো তার হাতে ধরা স্লোগান

‘বুকের ভেতর দারুণ ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর’

না; বুলেট-বিদ্ধ হয়নি সে; হাসপাতাল থেকেও ফেরেনি আর!
খবর শুনে দুঃখ হলো আমার- এমন অল্পদমের একটি মেয়ে
আন্দোলনে তার কী দরকার!

জানা গেলো, মুদি-দোকানি বাবার স্নাতকে পড়া মেয়েটি
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেধাবী বড়ো ভাইটি তার হলের সিট বরাদ্দের
রাজনীতির শিকার। মিছিল-মিটিঙে মাথা নোয়াতে গিয়ে
একমাত্র সম্বল স্বপ্নটাই ফেলেছে খুয়ে।
ঘরে পয়সা নাই, কোটা নাই, চাকরিরও আশা নাই
সে এখন নেশাখোর, ছিঁচকে চোর।

স্বৈরাচার, গণতন্ত্রের আচার বুঝতো না মেয়েটি

হাঁপানির রোগী বাবা, চিররুগ্না মা, স্কুল পড়ুয়া ছোট দু’টি বোন,
ঔষধ-পথ্য আর অন্ন-বস্ত্রের যোগাড়- এই ছিলো মাথা ভরা চিন্তা তার।
তবে রোজ টিউশনের কাজ ফেলে
মৃত্যুর দূয়ারে কেনো এসে দাঁড়িয়েছিলে মেয়ে?
মৃত্যুভয়হীন চকচকে চোখ দু’টো নিয়ে!
দেখা হয়নি যে, সে ভীরু চোখে
হয়ত চোরা কোনো স্বপ্ন বুনতো সে মেয়ে!

সীমান্ত হেলাল

আমার নাম লেখা আছে বুলেটের গায়ে

সকল সংকোচ ও শঙ্কা ভুলে আমার ভাই হত্যার বিচারের দাবি নিয়ে নেমেছি
উত্তাল মিছিলে! বিমূর্ত প্রতিবিম্বের বিপরীতে শার্টের বোতাম খুলে ছুটে চলেছি
দুঃসাহসিক প্রতিবাদে!

রক্তচক্ষুর ভীতি উপেক্ষা করে ছুটে চলেছে আমাদের লংমার্চ! সাধ্যের চেয়েও
অধিক শক্তিতে আওয়াজ উঠছে আমাদের উচ্চারণ! প্রকম্পিত নগরের
বায়ুজুড়ে বুলেটের চামড়া পোড়া গন্ধ; আর ঝাঁঝালো টিয়ারশেলের শব্দে
আমরা স্বন্ত্রস্ত নই!

স্বৈরশাসকের ছোঁড়া একেকটি বুলেট কান ঘেঁসে যাচ্ছে বিজলীর গতিতে।
তবু এই দুর্দমনীয় বিপ্লব আমার ভাইয়ের খুনের বিচারের দাবীতে।
এই বিপ্লব আমাদের মুক্তির দাবীতে। রাজপথে দাঁড়িয়েছি দৃঢ় পায়ে;
হয়তো আমার নাম লেখা আছে রাষ্ট্রীয় বুলেটের গায়ে!

নোমান সাদিক

জুলাই এর কবিতা

বারবার হেরে যাচ্ছি প্রতিবার কোন এক ভূল
বারবার হেরে যাচ্ছি বারবার প্রাণের মাশুল
গুণে যাচ্ছি কোনবার ট্রিগারে অভ্যস্ত নয় হাত
তাই ভূল শ্যুট করে মেনে নিচ্ছি মরার বরাত

কোনবার হাতে লাঠি রাত বড় অন্ধকার তাই
হে শত্রু পালিয়ে যাস পালটা ঘাতে খুন হয়ে যাই
একবার ঠিকঠাক মাপজোকে যথার্থ সুযোগ
পেয়েও পারিনি, ছিলো নিজের দলেই হন্তারক
গুলি বুমেরাং হলো, নিজেই নিজের হাতে লাল
প্রতিদিন হেরে তাই প্রতিদিন শোকার্ত সকাল

একদা নিরস্ত্র যুদ্ধ বলে তুমি অস্ত্র নিলে ঠিক
আমাকে বানিয়ে বোকা যুদ্ধের শেখালে আরও দিক
ছিলো যে ছিলাম ভূলে আর তার নাম হলো ‘ধোকা’
বারবার মরে যাওয়া হেরে যাওয়া স্বদেশের খোকা
আমি। কিন্তু এই সত্যে শতোভাগ ভরসা আমার
হে বিজয়ী মরে বারবার বেঁচে উঠি বারবার

অথচ মরোনি তুমি চেলা বাইন গাড়ার শিয়াল
কুটচালে জিতে যাওয়া প্রতিবার ফাঁদো তুমি জাল
একশো কৌশলে, আমি শিখে গেছি নিরানব্বই
আর আমি মরবো না শেষাবধি বেঁচে উঠবই

পূরণ হবে না শ’ মুখস্ত হয়ে গেছে ছক
ফেসে যাবে যেমন শিকার হয় মাছধ্যানী বক
অত:পর শুনে নাও আগামীর হে পরাস্ত সেনা
মরবে আমার হাতে কোনোদিন বেঁচে উঠবে না।

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১