আড্ডাপত্র

২৬ মাঘ, ১৪৩১; ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫;সকাল ১১:৩০

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ১৮

আড্ডাপত্র

জানু ২৩, ২০২৫ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

সময়টা দ্রোহের। সময়টা তারুণ্যভরা শ্লোগানের। একঝাঁক তরুণের ফুঁসফুঁস ভরা বিদ্রোহী বাতাস। মুখ গহবর থেকে বের হওয়া ধ্বনি কাঁপিয়ে দেয় শাসকের মসনদ। নিঃশ্বাসের ঝড়ো বাতাসে নিভিয়ে দেয় দুঃশাসনের বাতি। চোখের চাহনিতে উল্কার হল্কা। বুকের ভিতরে বসবাস সাহসের রাজহাঁস। শ্লোগানের শব্দকোরাস সাঁতার কাটে রাজপথে। দ্রোহের জলোশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল- কলেজ-মাদ্রাসায়। ভেদাভেদ ভুলে যায় কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কে কওমী কে আলিয়া। কে ধনির দুলাল কে কৃষকের সন্তান। প্রত্যেকেই মুক্তপ্রাণ তরুণ। তরতাজা কিশোর-যুবকের হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারী শাসকের দেড় দশকের গদি। পতন হয় এক স্বৈরশাষকের।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাজার তরুণ-তাজা প্রাণের ঝরে যায়। রক্তের ভিতর জেগে ওঠে মানবমুক্তি। জুলাই ২০২৪ এর ছাত্র-গণআন্দোলেনর এই বীরত্বগাথাকে দেশপ্রেমী-বিপ্লবী কবিগণ তুলে ধরেছেন তাদের কবিতায়। কবিতার সেইসব দ্রোহীপঙক্তি আড্ডাপত্র ধারাবাহিকভাবে মেলে ধরছে পাঠকের সামনে। আজ প্রকাশিত হলো ‘গণঅভ্যুত্থানের কবিতা’ ১৮তম পর্ব। লিখেছেন কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ , কবি জামিল জাহাঙ্গীর, কবি সোহেল মাহবুব, কবি রাসেল রায়হান ও কবি সুলতান মাহমুদ।

বিশল্যকরণী

জাহাঙ্গীর ফিরোজ

শুধু কি রাতেই নামে অন্ধকার?
দেশ জুড়ে হাহাকার

দেশজুড়ে বসেছে আঁধার
তুমি কার কে তোমার?

কালনাগিনীটি দংশিল ভালে
বিশল্যকরণী কে আনবে একালে?

আমাদের রাতদিন একাকার
অন্ধকার! অন্ধকার!!

ভানু গেছে হনুর বগল তলে
সব লোকে এই কথা বলে!

আমি জানি তুমিও তো জান খুব
থাক চুপ দাও ডুব
ভয়ের সাগরে;
কান্নার রোল ঘরে ঘরে।

কার কাছে বাতি
কে ধরেছে ছাতি?

সবই জানা
হায়! রাতকানা!
গন্ধমাদনে খুঁজে পাবে কি বিশল্যকরণী?

মানি সবই মানি
নিভৃতে কেঁদে মরে বিচারের বাণী।

তবু আশা মরেনি এখনো
দেখি শিশু নারী কিশোর কিশোরী
অগণিত ছাত্র-জনতা
ভয়ের দরজা ভেঙে ফেলে ;

সহসাই আদিত্য বেরিয়ে এলো
আট-পাঁচে ডাকিনী পালালো।

আগস্ট ২০২৪

প্রজ্জ্বলিত বাংলাদেশ

জামিল জাহাঙ্গীর

সবক‘টি দোয়েল জানে কালো শরীরের
শাদা দাগ এখন ভালো নেই
কাঁঠাল থেকে সরে গেছে আঠা
বাঘের শরীর থেকে উধাও হলদে ডোরাদাগ
জলে ভাসা শাপলার চারপাশে সাপ আর সাপ
পাপে ডুবে আছে ধর্মতলা বণিক সময়।

শিশুও জেনে গেছে এখন জন্ম নেয়া ঠিক হয়নি
পিঁপড়াও জানে তার খাদ্য নিশ্চিত নয়
অতর্কিতে মৃত্যুর বরাভয় কাঁধে নিয়ে দৌড়ুচ্ছে পতাকা
বিকলআগামী নকশাখচিত আতঙ্কিত বর্তমান জেঁকে বসেছে
চোখ থেকে উধাও ঘুম বৃষ্টির নামে ঝরছে রক্তের ফোঁটা
বাতাসে নিষ্কলুষ বিষ যুবকের পকেটে নিষিদ্ধ স্বপ্নবীজ
নৃশংস নাশকতা শহরে গ্রামে উন্নয়নে সিরিজ আগুন।

মেট্রোরেলস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
ডাটা সেন্টার, রামপুরা টেলিভিশন, সেতু ভবন
আগুনের লেলিহান ট্রেলর পথে পথে সাঁজোয়াযান
আকাশ ভেঙে সাউন্ডগ্রেনেড টিয়ার সেল
রাবার বুলেট গান পাউডার সারাদেশে কারফিউ
দেখামাত্র গুলির নির্দেশ মায়ের বুকখালি পলকেই।

পিতার বুকফাটা আর্তনাদ, বোনের আহাজারি
মর্গে মর্গে লাশের সারি কার পাপে এতো মৃত্যু
কার কর্তব্যহেলায় এতো রক্তপাত
কার ইশারায় এতো আহাজারি কেউ কিছু বলছে না
বোবা মিডিয়া ! কর্পোরেট ক্যামেরা !
দলদাস কবি, ক্রীতদাস বুদ্ধিজীবী, চাটুকার শিক্ষক
সুবিধার সোনারূপায় ডিজিটাল পেরিয়ে
কি ভয়ঙ্কর স্মার্ট বাংলাদেশ।

আর কতদিন সবুজ সতেজ পাতারা হাসবে না
আর কতদিন পাখিরা গুনগুন গাইবে না
আর কতদিন ফুলেরা সহাস্য ফুটবে না
মাছেরা ছড়াবে না প্রাকৃতিক ডিম
বীজশস্য গজাবে না অঙ্কুর চারার তাগিদে
কেউ জানে না।

কোটর থেকে সরিয়ে রাখছি চোখ
ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছি মাথা
শরীর থেকে দূরবর্তী কোথাও চলে গেছে পা
হাতগুলো এখন অন্যপক্ষের রিমোটে চলছে
এই মরণখেলা আমাদের নয়
এই আগুনের ভেলা আমাদের নয়
লহমার মৃত্যুপুরী আমার সুফলা দেশ নয়।

আমরা দেখতে চাই
বিমানবাহিনী আকাশ থেকে ছুঁড়ে দেবে শান্তির ফুল
নৌবাহিনী জলসীমায় আনবে নিশ্চিত সুসংবাদ
সেনাবাহিনী নিরাপদে পৌঁছে দিবে গন্তব্যে
দুপুরের রৌদ্রস্নাত শ্রমিক ঘাম শুকোবার আগেই
হাতে পাবে নায্য পারিশ্রমিক।

কবি ও কণ্ঠশিল্পী সমস্বরে গাইবে বর্ণিল আগামীর গান
শিক্ষক ও ছাত্র সম্মিলিত হবে মর্যদার ময়দানে
চিকিৎসকের বাসায় আতিথ্য নেবে রোগী
সরকারি পরিষেবা পৌঁছে যাবে নাগরিক দোরগোড়ায়
আদালত শাস্তির পরিবর্তে দেবে আশ্চর্য পুরস্কার।

একটি শ্রাবণ কী নিলাজ রক্তঝরা কুকীর্তির ইতিহাস
একটি দুশ্চরিত্র বর্ষাকাল কালো কালো কফিনেমোড়া
সভ্যতার কাফনে আবারো বাদুড়ের মলত্যাগ
হিমালয় হতে সুন্দরবন বরাক, খোলপেটুয়ার বাঁক
পৃথিবী অবাক হতে চিরনির্বাক
শঙ্কাহীন মুখের জিজ্ঞাসায় শেকলেশেকলে প্রহর হেঁটে যায়
কখন সকাল হবে কখন সূর্য উঠবে
কখন পাখিরা শিখে নেবে সমুহ সারেগামা পাঠ।

উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট
আমাদের তেত্রিশ লক্ষ শহীদের দোকান
আবারো খুলেছি হাট
তুমি কি ঘুমিয়েছো পতাকা আমার
তোমার কি চিরঅসুখ বলো প্রিয় মানচিত্র
ও আমার বাংলাদেশ তুমি কি এমনই রবে
সমুদ্রগর্জনে পাহাড়ক্রন্দনে নদী ও নাব্যতা হননে
এইবার জ্বলে ওঠো কোটিগুণ প্রজ্জ্বলণে।

ছলনার ব্যবসা

সোহেল মাহবুব

হঠাৎ বাতাসের কামড় খেয়ে নগ্ন হয়ে বসে তৃষ্ণা।
অলঙ্কার কিনলেও বিবসন হতে দেখে শব্দ করে ওঠে দূরের মেঘ
শীতল অভ্যাস ভুলে বিমুগ্ধ স্নান সেরে নেয় রমণী কাক…

জোছনার চোখে এখনো ঘুম লেপটে আছে
পেটপুরে খেয়ে এসে উদাম অন্ধকার আওড়ায়-
মানবতার শ্লোগান।
চোখ থাকলেও সে উদ্ভিদ রমণী
ঘোরলাগা বর্ষাতে ক্ষীরের মত মাটিতে সে পিতলের নদী বানায়
প্রতিবেশী তুফানে পালক উদাম করে কাশফুলের
একের পর এক স্বপ্নের ছকে আঁকড়ে ধরে সকাল দুপুর রাত।

গাপিনীর উলঙ্গ অঙ্গ আর তপ্ত আঙ্গুলের ছোঁয়ায়
কেঁপে কেঁপে ওঠে অতৃপ্ত বিকেল
ছলনার ব্যবসা দেখতে পায়না পৃথিবী
দেখেছে তাম্রবর্ণ ঘাস আর ক্ষুধার্ত মাটি।
অশ্রুসংঘ তুলুল জোয়ারে ভেসে গেছে
ছলনাময়ী মমতার…

রাসেল রায়হান

একটি মৃত দেয়ালঘড়ি

শোবার ঘরে এলইডি বাল্বের ঠিক পাশে ছিল দেয়ালঘড়িটা—রোজ একটা টিকটিকি ঝিমাত কাছাকাছি এসে। যখন কিছু ভাবনা করি, ঘড়ির সুদৃশ্য কাঁটাগুলি দেখি, দেখি টিকটিকির সামান্য কম্পিত লেজ। সেই ঘড়িটাই বন্ধ হয়ে গেল কদিন আগে। নতুন ব্যাটারিতেও কাজ হলো না দেখে নামিয়ে ফেললাম।

এখন রোজ শুতে গেলেই শূন্য দেয়ালে চোখ পড়ে। মাত্র বছর দুয়েকের অভ্যস্ততা, তবু বুকের কোথাও একটা সূক্ষ্ম শূন্যতা টের পাই, কী যেন নেই, কী যেন নেই! তবে যার সাড়ে একুশ বছরের ছেলেটা গুলি খেয়ে মরে যায়…?

জুলাই দু’হাজার চব্বিশ

সুলতান মাহমুদ

অমাবস্যার রাতে পরিকল্পিত ঢিল ছুঁড়ে দিলাম
আগ্রাসী নমরুদের কপালে তা পরিণত বুলেট
অর্ধেক বুলেট; রক্তজবায় অঙ্কিত লালকপাল
অর্ধাঙ্গিনীর মতো ঝাপটে ধরো অধরা বিপ্লব
সবকথা আজ স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত ইতিহাস–

ঐতিহ্য যথাপি মুদ্রনযোগ্য নয়; অমূল্য অনুভব
মহানুভবতায় ফিরে আসা ঝাঁকঝাঁক শীতের পাখি
পাখিদের প্রেরণায় ফের রাষ্ট্রকাঠামো উজ্জীবিত
উত্থিত যৌবন ঢেলে সাজাও পল্টন ময়দান
প্যারেডগ্রাউন্ডের অগুনতি সবুজ তসবির দানা
ফেরাউনের পিঠে আচানক টোমাহক বোমা!

আগে ভালো ছিলাম? সুশীলদের কুঠুরিতে সাপ
পতিতসাপে ধর্ষণের স্বীকার চেতনাবাজের রেটিনা
আহা জন্মান্ধ দলান্ধ; কুৎসিত ষড়যন্ত্র প্রসবিনী পশু
দুপুরেও ফেরাতে প্রস্তুত গত অমাবস্যার শাপ
বাপ অবিচার করলেও শূলে চড়ানোর দিন আজ
ভুলেও দেশের আগে কেউ নয়; না কোনো দল
দলেদলে যোগ দিতে পারো অদলীয় মহোৎসবে!

জুলাই দুহাজার চব্বিশ দৃশ্যত চলে যায়
অক্ষয় থেকে যায় একাত্তরের সুযোগ্য অনুজা
উন্মোচিত হচ্ছে অমীমাংসিত সবই রহস্যজাল
খাল কেটে কুমীর এনে ছেড়ে দাও নরককুণ্ডে
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক; বিদ্রোহীর দাবানল
সংসার থেকে সংসদে ভস্ম করুক বৈষম্য–
সাম্যবাদ জিন্দাবাদ; সংগ্রাম উৎকৃষ্ট যুগাবতার!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭