সময়টা দ্রোহের। সময়টা তারুণ্যভরা শ্লোগানের। একঝাঁক তরুণের ফুঁসফুঁস ভরা বিদ্রোহী বাতাস। মুখ গহবর থেকে বের হওয়া ধ্বনি কাঁপিয়ে দেয় শাসকের মসনদ। নিঃশ্বাসের ঝড়ো বাতাসে নিভিয়ে দেয় দুঃশাসনের বাতি। চোখের চাহনিতে উল্কার হল্কা। বুকের ভিতরে বসবাস সাহসের রাজহাঁস। শ্লোগানের শব্দকোরাস সাঁতার কাটে রাজপথে। দ্রোহের জলোশ্বাস ছড়িয়ে পড়ে শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কুল- কলেজ-মাদ্রাসায়। ভেদাভেদ ভুলে যায় কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। কে কওমী কে আলিয়া। কে ধনির দুলাল কে কৃষকের সন্তান। প্রত্যেকেই মুক্তপ্রাণ তরুণ। তরতাজা কিশোর-যুবকের হুঙ্কারে কেঁপে ওঠে অত্যাচারী শাসকের দেড় দশকের গদি। পতন হয় এক স্বৈরশাষকের।
ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে হাজার তরুণ-তাজা প্রাণের ঝরে যায়। রক্তের ভিতর জেগে ওঠে মানবমুক্তি। জুলাই ২০২৪ এর ছাত্র-গণআন্দোলেনর এই বীরত্বগাথাকে দেশপ্রেমী-বিপ্লবী কবিগণ তুলে ধরেছেন তাদের কবিতায়। কবিতার সেইসব দ্রোহীপঙক্তি আড্ডাপত্র ধারাবাহিকভাবে মেলে ধরছে পাঠকের সামনে। আজ প্রকাশিত হলো ‘গণঅভ্যুত্থানের কবিতা’ ২০তম পর্ব। লিখেছেন কবি রহমান হেনরী, কবি জুলফিকার শাহাদাৎ, কবি আবিদ আজম, কবি শাদমান শাহিদ ও কবি মনিরুজ্জামান বাদল ।
উদ্বেগের মুখবন্ধ
রহমান হেনরী
চাঁড়াল পাড়ায় খুব ওঠাবসা আছে— সাঁতালের সঙ্গ পেলে উঠে
যাই মাদিমর্দা দোনো তালগাছে, রাজারাও জানে সেই কথা—
উভরসে দু’প্রকার আছে মাদকতা; তবু যারা সিংহাসনে উকুন,
এঁটুল— তারা যদি না নামিলো; আমার কী ভুল? আমি তো—
শরম নাই। বৃষ্টিকে ছাদে ডেকে গৃহকোণে ভিজি একা একা;
লাইলিকে শিরি ডাকি, শিরিকেও রেডিও-জুলেখা!
শ্মশানগালিচা পেলে, ডোমে ও চ-ালে মিশি মাসতুতো ভাই—
মাটির হাঁড়িতে জ¦লে তরল-দর্পন-বাহাদুরি; তাতেই নয়ন
পেতে দেখে নিচ্ছি কত জারিজুরি! শব্দে, অশব্দে, বাক্যে,
সহিত্যবোধের মধ্যে কার কত দ্যুতি ও রোশনাই; কার কত
মনোঋদ্ধি, মসির মর্দামি—
কী ভেবেছো? খুঁজে-খুঁড়ে দেখি
নাই আমি!
অবশেষে, ঠোঁট সেঁটে বসে আছি— নির্লিপ্তের নির্জন নিপলে;
কইতে দাও— শব্দময় ছিদ্রগুলো যা খুশি বা যত কথা বলে…
এই আমাদের বিজয় মিছিল
জুলফিকার শাহাদাৎ
রক্তকনায় আগুন জ্বলে, আগুন জ্বলে নদীতে
রক্তসাগর পেরিয়ে কারা বসতে আসে গদিতে।
রক্ত-মানুষ জীবন দিল
স্বপ্নে তাদের কী কী ছিল
সেই স্বপ্নের সিঁড়ি কোথায়, কে নিয়েছে সুড়কি,ইট
আড়ালে কে বাঁধছে বসে, নতুন নতুন সুঁতোর গীট
একাত্তরের স্বপ্নপাহাড় কে ভেঙেছে মাড়িয়ে
কে কে ছিল গুলির মুখে শপথ নিয়ে দাঁড়িয়ে
আসাদ ছিল, কামাল ছিল, ছিল হাজার তরুণ মুখ
শত্রুসেনার সামনে গিয়ে পেতেছিল বীরের বুক।
হয়নি তাদের স্বপ্নপূরণ। তাই এসেছে পঁচাত্তর।
স্বপ্ন দেখা বাঙালিদের চক্ষে হঠাৎ নতুন ঝড়
একাশিতে গোর্কি আরেক। ঘরের চালা কী নড়বড়
বেদখলের স্বৈর তুফান কাটিয়ে দিল এক দশক
বীর জনতা উঠল জেগে , ফিরিয়ে নিতে নিজের হক
ফের রক্তের হোলি হল, রক্ত দিল কত্তো ভাই
শহিদ মিলন, নূর হোসেনের রক্ত-ঋণের মূল্য চাই।
রক্তে কেনা নব্বইয়ে ফের স্বাধীনতার সুখপাখি
উড়তে থাকে ডানা মেলে, হাতে হাতে হাত রাখি।
সেই পাখি ফের বন্দি করে স্বৈরাচারী হার্মাদে
বীর বাঙালির পায়ে পায়ে ফ্যাসিবাদের তার বাঁধে।
ফ্যাসিবাদের হার্মাদেরা দেশকে বানায় জেলখানা
জ্বলে উঠে আবু সাঈদ, কণ্ঠে আওয়াজ, না,না,না
মুগ্ধ,ওয়াসীম দাঁড়িয়ে গেল, দাঁড়িয়ে গেল লক্ষ লোক
সবার মুখে এক শ্লোগান, হার্মাদের পতন হোক।
জান বাঁচাতে ফ্যাসিস্ট খুনি পালিয়ে গেল, পালিয়ে
স্বাধীনতার পুণ্যভূমি দেড়টি দশক জ্বালিয়ে
আমরা পেলাম স্বাধীনতা। আমরা পেলাম মুক্তবাক
এই আমাদের বিজয় মিছিল লক্ষ বছর অটুট থাক।
হয় স্বদেশ নয় মৃত্যু
আবিদ আজম
স্বদেশ জুড়ে গোলা বারুদ, হাজার অস্ত্রধারী
আমি থাকি সংগ্রামে তাই। জন্মভূমি-বাড়ি।
একটি দেশে গুপ্ত ঘাতক নিত্য চালায় গুলি,
কালেমায়ে শাহাদাতের তুলি যে আঙ্গুলি।
দিন দুপুরে গণহত্যা বয় রক্তের বন্যা,
একাই তবে দাঁড়াই আমি অকুতো অনন্যা।
যে রাজপথে হাজার শহীদ, গাজী ওঠে গর্জে,
‘দেশের জন্য জীবন দেয়া ফরজে আইন ফরজে’।
লক্ষ গ্রেনেড গুলির মুখে যে পাতেনি বুক,
বুঝবে কী সে স্বাধীনতার জন্যে মরার সুখ?
যার কাছে খুব জীবন প্রিয় নামেনি রাজপথে,
কেমনে দেবে সে উপশম শহীদ বীরের ক্ষতে!
যে শোনে নি নতুন আজান, ওই ওঠে পাঞ্জেরী,
তার জন্যে ভালবাসা কেমনে করি ফেরী?
কাকে বলে যুদ্ধ জিহাদ যার কাছে নেই সংজ্ঞা,
কেমন করে সে বাজাবে প্রেম ও দ্রোহের ডংকা?
দেশটা জুড়ে ঘোর ফ্যাসিবাদ এখন গহীন রাত্রি,
আমিও হবো আবু সাইদ আলোর পথযাত্রী।
৫ আগষ্ট ২০২৪
বলির প্রাণ
শাদমান শাহিদ
ত্রিপুরার মাতার বাড়ি মন্দির
বলির পাঁঠা
কচি কচি বাচ্চার দ্বিখণ্ডিত দেহের স্তূপ
কী করে সম্ভব!
এমন কচি কচি! …
মহিলা পুলিশের হাসিমাখা মুখ
“এটাই মা কালীর আদেশ
বলির প্রাণ নিখুঁত হওয়া চায়”
১৬ জুলাই, বাংলাদেশ
এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
কচি কচি মুখ
কচি কচি দেহ
চোখের ভেতর
মাতার বাড়ি
মহিলা পুলিশ
“এটাই মা কালীর আদেশ
বলির প্রাণ নিখুঁত হওয়া চায়।”
শহীদের রক্তাক্ত শার্ট!
মনিরুজ্জামান বাদল
চারিদিকে কাঁদানে গ্যাসের বিচ্ছিরি দুর্গন্ধ!
পায়ের নিচে আবু সাঈদ, ওয়াসিম, আদনান,
রাফির মত শতাধিক লাশের রক্তাক্ত শার্ট !
পথের ওপর ইট পাটকেলের স্তুপ!
ফুটপাতে আঁকাবাঁকা নদীর রেখার মতো ছোঁপ ছোঁপ রক্তের দাগ,
প্রতিদিন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়
মৃত্যুর রোদে পুড়ে ছারখার হচ্ছে
হলুদ সূর্যমুখি ফুলের মতো মগজগুলো।
কি করে যে প্রতিদিন গিলে গিলে খাচ্ছে
শকুনের দলেরা মৃত গণতান্ত্রিকের হাঁড়গোড়।
কতোগুলো বিভৎস বেপরোয়া আমলারা
গলাবাজি করছে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে।
কোথাও নেই বিন্দুমাত্র আপোষহীনতা!
ওদিকে পুঁজ গলেগলে ভিজে জবুথবু হাসপাতালের বিছানা,
হাতে পায়ে আপাদমস্তক শুধু ব্যন্ডেজের গিট।
চারিদিকে তাকালে শুধু মনে হয় সুকান্তের
ঝলসানো রুটির এপিঠ- ওপিঠ।
একজন সন্তানহারা নারীর আকুতি ‘হামার বেটাক মারলু কেনে’ !
হুদাহুদি অহেতুক মানববন্ধন কর্মসূচি
টিয়ার সেল, পেট্রোল বোমা, কাঁদানেগ্যাস ছুড়ে
কেন ঝলসে দিচ্ছে দিনমজুর হকারের শরীর!
কেন পাখির মতো গুলি করা হলো ব্রীজের নিচে পথচারীকে?
আসুন বন্ধুগণ! আসুন!
সকলে একসাথে রাজাকারের দলে
নাম লিখিয়ে কলঙ্কিত করি একনায়কতন্ত্র
স্বৈরাচার রাজার বিরুদ্ধে মিথ্যা উন্নয়নের প্রাচীর!
ভয় পাবেন না, কারফিউ তুলে নিলে আমরা আরও দশগুণ বৃদ্ধি পাবো!
দুমড়ে মুচড়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো
হেলমেট বাহিনী কুত্তারগুলোর ।
গলা টিপেটিপে হত্যা করা হবে বুনোশুয়োরের বাচ্চাগুলোকে! আর একটি প্রাণও যেন না ঝড়ে!
আসুন বন্ধুগণ!
আসুন রাজাকারের দলে ফিরে গিয়ে অনিয়ম ভাঙ্গার পুনরাবৃত্তি করি,
প্রয়োজনে রাক্ষসী থাবায় গিলে ফেলি
সোনার বাংলার অর্ধমৃত মানচিত্র।
কারণ আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি আমি ২৪ এর ছাত্র আন্দোলন দেখেছি।