আড্ডাপত্র

২৫ ভাদ্র, ১৪৩১; ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪;রাত ১:২৪

গুচ্ছকবিতা | সৌম্য সালেক

আড্ডাপত্র

জুলা ৩, ২০২২ | গুচ্ছ কবিতা

বন-সুন্দরের পালা

বনকোকিল বনমালী আর কানাকোয়ো পাখিদের সাথে
ঝোঁপের আড়ে আড়ে
ওরা গান গায় বনের চুপকথায়
সেই সুরে বৃষ্টি ঝরে মোহনায়…

কাছে দূরে কে আছে বা নেই কেউ
কোথায় সরছে ছায়া, কোথায়-বা কোলাহল
ওদের চলায় নেই ছেদ
কেবল রাত্রি এলে দীপাধার হাতে
সঙ্গ দেবে পুত্ররা, ওদের এইটুকু চাওয়া ।

প্রাণের জোয়ারে ওরা দাঁড় ফেলে- ছুটে চলে
শ্বাসমূল, বাইন, বেত, কেওড়ার-ঝাড় পেরিয়ে
আরও কোনও দূরবনে-
নির্মল-নির্জনে
যেখানে অচিন পাখিরা গায় অপরূপ শাখে শাখে…

গোলপাতা সুন্দরীর ছনে-
গৃহকোনে
ধীবর, মৌয়াল, ঘরামীর আদিবাস
কবে কোন আতুর-অতীতে-
জাল-নৌকা-কাস্তে লয়ে ওদের যাত্রা শুরু বনে
তার কোনও বিবরণ লেখা নেই নগরের পুস্তকে
ভাবি-ইতিহাসে কেবল কীর্তি নয়, রাজনীতি নয়
লেখা হোক মানুষের কথা-
যারা মধু আহরণে, যারা মৎস আনে-
জলে ভেসে জাগায় জীবন।

কারুবাসনা

কিছুদিন কিছুকাল
রাঙা সকালের স্নেহে কিছুক্ষণ
একবার দুইবার-
কাছে আসতেই ভালোবাসতেই
ছোঁয়া জাগতেই অধরে-নধরে
জীবনের দম এলো ফুরিয়ে

তারপর দীর্ঘদহনে পুড়ে
জলে-বর্ষণে কদাকার হলো দেহ
ঘোলাটে চোখের নিচে দেখা দিলো সময়ের ছাই
পলকা পৃষ্ঠার মতো ওড়ে গেলো বাসনারা

ভুলে
জীবনের জয়-জাল-
কাজলের কারুলেখা যেসব চোখের কোণে এঁকেছিল ফাগুনের পারিজাত-
ওরা কই, কোন অতলের অধিবাসী ওরা আজ
কেনো গুটিয়েছে সুখের শরীর!
মধু মোহ-তীরে
প্রিয় পুরুষের কামে
যে ছিল দিশেহারা
অঘোর ঘুমের যামে
তার সব ব্যথা হলো লীন!

এখন
দুইতীরে জীবনের ক্ষয় ও ক্ষরণ
মাঝে বয় নদী নীল…

মাটির শিথানে

মানুষ এত কই যায়
পতনে দহনে স্খলনে
সমরে সংগ্রামে-
অবিরাম;
অশ্বে-বিমানে-জলযানে…

মানুষ এত কই যায়
শোকে অসুখে অবসাদে
বিষ ও বিষাদে-
অবিকার
অবিরোধ আত্মহননে…

মানুষ এত কই যায় প্রাণছুটে
কি আছে সেখানে
আছে কি ফাল্গুন, সূর্যমুখী-
বর্ণিল রঙের বেসাতি
আছে কি মেঠোপথ আনত নারীর মুখ
আছে কি পারাপার, ভাটিয়ালী
রাতের উজানে ভাসা চারণের বাঁশি
আছে কি নীলখাম- প্রথম প্রেমের দ্বিধা
আছে কি মায়ের ছোঁয়া, কোমল রসনা

মানুষ কই এত যায়
একবারও চায় না ফিরে
দেখে না কেমন আছে বিরাণ ভূমিটি
মানুষ কিসে এত ভুলে থাকে-
কীসের আশ্বাসে ডুবে!
আমিও সেখানে যাবো-
মাটির শিথানে দেবো ঘুম।

১৮/০৪/২০২১

বিজয় এসেছে বলে

ভোরের পাখির মতো প্রাণজাগা স্বাধীন ভাষা আমাদের ছিল না।
বিজয় এসেছে বলে নতুন সূর্য হাসে বাংলার ঈশানে-নিশানে
বিজয় এসেছে বলে ইথারে পাথারে ভাসে সুকণ্ঠ পাখিদের গান

প্রজাপতির মতো স্বপ্নময় পাখা আমাদের ছিল না।
বিজয় এসেছে বলে ফসলের সোনাদেহে জেগেছে প্রাণের মেলা
বিজয় এসেছে বলে স্বাধীন পতাকা হাতে মুক্তদেশে ফিরেছে দামাল

রংধনু-আঁকা মুক্ত আকাশ কোনোদিন আমাদের ছিল না।
বিজয় এসেছে বলে ফিরেছে মায়ের হাসি, সোনালি ঊষার- স্নেহ ফিরেছে বোনের মুখে
বাংলার নদীকূলে- বাউলের মুখে ফিরেছে প্রাণের-সারি

গোলাপের মতো রঙিন আকাক্সক্ষা আমাদের ছিল না।
বিজয় এসেছে বলে বিভেদের আঁধার কেটেছে, দিকে দিকে জেগেছে সুরের ধারা
মিলনের আবাহনে বাংলার গ্রাম ও নগরে জেগেছে নতুন সাড়া-
বিজয় এসেছে বলে…

কিছু ঘর বালিয়াড়ি

বালুকায় মুখ রেখে পাখি
বালিবালি জল ঢালে পাখি;
গভীর যুক্তস্নান চলে তটে

বালুকার প্রেমে পড়ে গিয়ে
বালিয়াড়ি ঘর তোলে কেউ-
ভীষণের বুকে ঝড় তোলে!

একটি বিষম গান

নিমেষেই জৌলশ হারিয়ে ফেলে সুবর্ণ ফুলেরা
দেহে বাঁধে রোগ বাসা
নতুন ঘরে ঘরে সারারাত ঘুন করে গুনগুন
সব নীল, শাপে-সন্তাপে নীল সব বেদনার পারা

অমোঘ আশ্বাস বলে কিছু নেই
যেসব মন্ত্রগুণে দিন গুজরায় লোকে-
স্বপ্ন আঁকে সারাক্ষণ
দিনশেষে সব মিছে-
চুপেচুপে কথার ধ্বনিরা করে আলোহীন আঁধারের পালা!

জীবনের ঔরষে জন্ম নেয় মরনের অপরূপ রঙ-লীলা-সাজ
মতিনের মৃত দুহিতার দিকে চেয়ে এ খবর পেয়েছি আজ!

হাড়ের পেখম

এবং ওরা কাছে এলো
চোখের পর্দা গেলো বুজে
দৃষ্টি খোঁজে হৃদয় অতল
বুকে ছুটে তরুণ মৃগপাল

এবং সুপ্তি এলো
পুষ্পশাখে ছড়ায় মৌতাত
ওর টুপি গেলো খসে-
উড়তে লড়ে হাড়ের পেখম

এবং দেহ জ্বলে
স্বপ্ন ঝরে ঘাত-প্রতিঘাতে
চরম পুলকে নাচে শিরা-উপশিরা-
জমে ওঠে রসের-প্রাশন…

মাতামহীর জন্য গাথা

আশৈশব মিহি মাতৃস্বর
ঘুমে-জাগরণে-তৃষ্ণায়
অন্তরে বাহিরে দিয়েছে স্নেহের ছোঁয়া;
সময়ের নির্মম আগ্রাসে
পত্র-পুষ্পের মতো ঝরে ঝরে
এক দীর্ণ দুপুরে সে ঝরে যায়…

পত্রমোচনের দিন শেষে শাখায় শাখায়-
দেখা দেয় সবুজের নির্মল-ভাষা
মুকুলে-অঙ্কুরে মুখরিত চারদিক
পাড়ায় পাড়ায় নতুন পুষ্পের সাড়া;
তবু যেনো ছায়াহীন-
পড়ে আছি ঊষর প্রবাসে কোনো!

হে প্রাজ্ঞ-মাতৃকা, দেখে যাও
ইট-কাঠ-কলহের সংসারে কী বেহাল হয়েছে দশা
বিপণী ও বণিকের হাটে বন্ধ আজ করুণার পাঠশালা
নিরুপায় লগ্নিহীন আছি বড় সংকটে
দেখে যাও, রুক্ষ আজ অমল সে মুখ
সুকোমল সান্ত¡নায় মলিন মাথায় এসে দখিন হাতটি বুলাও।

১২/০৫/২১

কাক ও কেরানি

অতর্কিত অপঘাতে কাকের মতো পথপার্শ্বে মরে যাবার মাঝেও কিছু শিল্প আছে
শ্রান্ত পথিক তাকে দেখে বিরতি নেয়, বিগলিত হয়!

বিবাগী বাউলের মতো ঘুরে ঘুরে শেষকালে শীতে ছেঁড়াকাঁথার নিচে মরে যাবার মাঝেও মুক্তি আছে,
কেউ না কেউ তার অনুগামী হয়, ভাবে তার কথা, কাঁদে কিছুকাল।

মানুষের কথা ভেবে সংগ্রামে-সংক্ষোভে বন্দুকের নলে প্রাণসঁপে মরার মাঝে তো মহামুক্তি-
তার ত্যাগ, তার ঋণ স্মরে চিরদিন লোকে

কিন্তু সারাক্ষণ স্যার স্যার… বলে মুখে ফেনা তোলা সন্ত্রস্ত কেরানীর মতো দিনজপে,
রাতে বেঘোরে উদর পুরিয়ে অভ্যস্ত রমণীর খাঁজে দু’ঘা চার-ছক্কা হাঁকিয়ে মোশের মতো ঘুমিয়ে
জীবন পার করার কোনও মানে নেই।
তার জন্য করুনা, শুধুই করুনা!

স্ত্রী বিষয়ক টীকা

বিবাহের দ্বিতীয়বর্ষে এক অষ্টাদশী রমণীর পায়ের গোছা ও ঘনচুল বাংলারেলের টিকিট কালেক্টর কমরুদ্দিনের মনোযোগ আকর্ষণ করে, ফলে টিকিট চেকের উছিলার বারকতক ফিরে ফিরে সে ঠ-বগির যাত্রীদের বিরক্ত করে। যাত্রীরা সর্বদা নিরীহ তাই তৃতীয় দফাতেও কেউ উত্তেজনা প্রকাশ করলো না। যেহেতু নিশিথ-যাত্রীনির নম্বর বা ঠিকানা জিজ্ঞাসাটা সৌজন্যের সর্বসীমা লঙ্ঘন করে তাই ইচ্ছে-সত্ত্বেও সে নিজকে সংযত রাখে। তারপর দিনকতক ঘনচুল আর রম্ভার-বগলির মতো গোছাদুই স্বপ্নেও হানা দিয়েছিল এবং কিছুদিন সে ছিল অচিন উর্বসীর স্বপ্ন-ঘোরে আচ্ছন্ন। আর ঘোরের বশেই একদিন প্রাত:রাশের মুহূর্তে স্ত্রীর কাছে সে ঘনচুল ও মোটাগোছার বর্ণনা করে বসে! সেই থেকে শুরু সন্দেহের লাল নীল বিচিত্র গ্রন্থনা, সেই থেকে মাছি-ভনভন সকাল-দুপুর-অষ্টপ্রহর! সেই থেকে স্বপ্ন ও সুন্দরের পিঠে অবিরাম কাকের কীর্তন!

বিবাহের যুগপূর্তি শেষেও যখন একমাত্র বধূটির আক্ষেপ ও হাহাকার ঘোছলো না তখন কমরুদ্দিন ভাবলো এসব হা-হুতাশ, স্বপ্ন ও সংকট থেকে বহুদূরে নির্বাসনে কেমন হয় একাকী সংসার, দিনগুনে- গুণে গুণে তসবির মালা কোনও তীর্থবিজনে জীবন কেমন?

সুতরাং সে এমন এক তীর্থের উদ্দেশে বাড়ে যার অবস্থান সম্পর্কে কেউ জানে না! এবং পরদিন ভোরসকালে জেগে বধূ যখন পাশের সজ্জাটি খালি এলোমেলো পড়ে থাকতে দেখলো তারপর থেকেই সূচনা ঘটলো এক বিরতিহীন কান্নার, যেহেতু লোকটি দূরদেশে ছিল তাই সহধর্মিণীর ভালোবাসা বিষয়ক এমতো অশ্রু ও বিষাদ সম্পর্কে একটুও জানার অবকাশ পেলো না!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বু বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০