সাহিত্যের কোনো বিষয়ে ব্যাকরণধর্মী বই লেখার তাগিদ আমাকে কখনো তাড়িত করে নি, যদিও বহু কবির কবিতায় ছন্দ-প্রকরণ ও রূপকল্পের ব্যবহার বিষয়ে বই রয়েছে আমার তিনটি। খুব সহজে ছন্দ শেখার একটি নতুন পদ্ধতি সম্পর্কে ফেসবুক ও কিছু ওয়েব পোর্টালে আমার কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর নবীন-প্রবীণ অনেকের আগ্রহে প্ররোচিত হয়েছি ছন্দ বিষয়ে ব্যাকরণধর্মী এই বইটি লিখতে। নাম রেখেছি ‘ছন্দের সহজপাঠ’ কারণ প্রচলিত বইগুলো থেকে এর ভিন্নতা হলো পাঠক-বান্ধব ভাষায় সহজে ছন্দ শেখার জন্য কিছু নতুন পদ্ধতির ব্যবহার।
কবিতা, ছড়া ও গান রচনায় ছন্দের গুরুত্ব অপরিসীম। অজস্র ছন্দোবদ্ধ কবিতা, ছড়া ও গানের জন্য নন্দিত হলেও বাঙলায় গদ্যকবিতা প্রথম লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বৃদ্ধ বয়সে কিন্তু রবীন্দ্রোত্তর যুগে, বিশ-শতকের তিরিশের দশকে আবির্ভূত পাঁচজন বড় কবি (যাদেরকে আমরা ‘তিরিশি পঞ্চপ্রধান’ বলে থাকি): জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত , বিষ্ণু দে এবং অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের শেষ বয়সে রচিত গদ্যকবিতাকে তাঁদের উত্তরাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তাঁরা প্রচলিত বাঙলা ছন্দের রীতিরীতিকে মান্য করেই কবিতা লিখেছেন। এই পাঁচজনের প্রধান তিনজন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বুদ্ধদেব বসু। জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসু’র গদ্যকবিতা গুনে দেখলে এর সংখ্যা হবে অত্যন্ত নগণ্য। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একটিও গদ্যকবিতা লিখেন নি এবং ছন্দকেই কাব্যকৃতির একমাত্র মানদন্ড বলে অমোঘ সত্যটি প্রকাশ করেছেন এভাবে: “আমার বিবেচনায় কবি-প্রতিভার একমাত্র অভিজ্ঞানপত্র ছন্দ-স্বাচ্ছন্দ্য, এবং মূল্যনির্ণয় যেহেতু মহাকালের ইচ্ছাধীন আর অর্থগৌরবের আবিষ্কর্তা অনাগত সমধর্মী, তাই সমসাময়িক কাব্যজিজ্ঞাসার নির্বিকল্প মানদন্ড ছন্দোবিচার…।” তিরিশি কবিরা সম্মিলিতভাবে যে কয়েকটি গদ্যকবিতা লিখেছেন তা যোগ দিলেও রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার সমান হবে না। তাই বলে এমন কথা কেউ বলবেন না: রবীন্দ্রনাথ গদ্যরীতির কবি।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে বিশ-শতকীয় ‘তিরিশি পঞ্চপ্রধান’দের পর আবির্ভূত বড় কবিদের মধ্যে আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ কেউই গদ্যরীতিকে কবিতার একমাত্র বাহন হিসেবে বেছে নেন নি। বৈচিত্র্যের প্রয়োজনে কিংবা বৃদ্ধ বয়সে কেবল অস্তিত্বের জানান দিতেই অনায়াস কাব্যচর্চা হিসেবে ছিটেফোঁটা গদ্যকবিতা লিখেছেন। শামসুর রাহমান যখন তাঁর প্রায় বৃদ্ধবয়সে এক-পর্যায়ে কেবল সনেট লিখলেন এবং এগুলো নিয়ে ‘মাতাল ঋত্বিক’ নামের একটি কবিতার বই বের করলেন, তখন এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন: “সনেটে প্রত্যাবর্তন আমার একধরনের প্রতিবাদ…অনেকে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা আমার কবিতাকে গদ্য বলে ভুল করেন…” (জনকণ্ঠ সাময়িকী, ২৩ অক্টোবর ১৯৯৬)। শামসুর রাহমান তাঁর এই সাক্ষাতকারে বুঝাতে চেয়েছেন: কেবল গদ্যকবিতার চর্চা একটি ‘প্রতিবাদ’যোগ্য প্রবণতা। কবি আল মাহমুদ তাঁর একাধিক লেখা ও সাক্ষাতকারে কবিতায় ছন্দের গুরুত্ব নিয়ে এবং নবীনদের কবিতায় গদ্যরীতির প্রাবল্য দেখে আরো স্পষ্ট ও তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন এভাবে: “যে-কবি ছন্দ জানে না, সে [কবিতার] কিছুই জানে না…” (ইনকিলাব সাহিত্য, ৩ অক্টোবর ১৯৯৭)।
বিশ-শতকের ষাটের দশকে আবির্ভূত আমাদের কবিদের মধ্যেও যারা পাঠক-সমালোচকদের কাছে স্বীকৃত ও নন্দিত হয়েছেন তাঁরা তাঁদের রচনাকর্মে ছন্দের অনুশাসন মেনে চলেছেন। তিরিশি কবিদের যেমন নন্দনতাত্ত্বিক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু, তেমনি ষাটের দশকে তাত্ত্বিকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনজন: হুমায়ুন আজাদ, মাহবুব সাদিক ও আবদুল মান্নান সৈয়দ। আধুনিক কবিতায় ছন্দের গুরুত্ব সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ লিখে গেছেন:
“আগামী কালের কবি তাঁর বিষয় স্থির করবেন যাতে, হঠাৎ-জাগা প্রেরণার প্রাবল্যে নয়…আমাদের কবিদের হাতুড়ি ঠুকতে হবে বাক্যসৃষ্টিকৌশলের ওপর…. বাক্যবিন্যাসের দিকে চোখ ফেরাতে হবে…..বাঙলা কবিতায় ছন্দ [যেন] একটি অক্ষরবৃত্ত; অপর দু’টি স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত শোভা: তবু ওই শোভা দু’টির কাছে যেতে হবে ঘনঘন; অক্ষরবৃত্তের ওপর চাপ বর্তমানে মারাত্মক হয়ে উঠেছে…অন্ত্যমিল সাম্প্রতিক কবিতার সর্বাধিক অবহেলিত ও অব্যবহৃত সোনা। তিরিশের কবিতায় অন্ত্যমিলের ব্যবহার হয়েছে প্রচুর, কিন্তু তারপরে এলো দুর্দিন…অন্ত্যমিলকে অনাধুনিক ভেবে ভয় পেয়েছিলেন অনেকে, তাই একে অবহেলা করেছেন ….অন্ত্যমিলকে পুনর্বাসিত করতে হবে….কবিতার ভাষাকে মুক্তি দিতে হবে অতি-মৌখিক বাচালতা থেকে…”
[আধার ও আধেয়, পৃ. ৩৬-৩৯]।
হুমায়ুন আজাদ-এর শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’-এর শিরোনামেই তিনি বুঝাতে চেয়েছেন কবিতায় ছন্দ ও প্রতিতুলনাজাত রূপকল্প নির্মাণে পেরোনোর কিছু নেই। তাঁর কথার মানে: হাজার বছরের বাঙলা কবিতার মৌলিক শিল্প-উপাদানের পথ ধরেই আমাদের এগোতে হবে সামনের দিকে কেবল নতুন ভাষাভঙ্গির সন্ধানে, কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য, কিন্তু ছন্দকে অস্বীকার করে নয়।
ষাটের দশকের অন্যতম তাত্ত্বিক মাহবুব সাদিক পূর্বাপর ছন্দ রক্ষা করে কবিতা লিখেছেন এবং ছিটেফোঁটা গদ্যকবিতা লিখলেও কবিতায় ছন্দের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রবন্ধের ভাষায় এখনও লিখে চলেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ কেবল প্রবেশলগ্নেই গদ্যকবিতা লিখেছেন ছন্দ তখনও শিখেন নি বলে এ-কথা তিনি নিজেই স্বীকার করে গেছেন। দ্বিতীয় কাব্য থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখেছেন।
অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের কবি ও প্রাবন্ধিক আশির দশকের সুব্রত অগাস্টিন গমেজ ও নব্বই-দশকের ড. তপন বাগচী’র ভাষ্য দিয়ে এই ভূমিকার ইতি টানবো। এর কারণ আমি দেখাতে চাই: একশ্রেণির কবিদের হাতে অবাধ গদ্যরীতির চর্চার যুগেও কবিতাবিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিগণ একালেও ছন্দের গুরুত্ব কতটা অনুধাবন করেন। সুব্রত অগাস্টিন গমেজ তাঁর সতীর্থ কবি সাজ্জাদ শরিফ-এর সাথে একমত পোষণ করতে গিয়ে উষ্মার সঙ্গে লিখেছেন: “আমাদের কবিদের ছন্দ শিখতে-শিখতে কবিতা লেখার বয়স পার হয়ে যায়…ছন্দ যে একটা শেখার মতো ব্যাপার, ছন্দ মানে যে লাইনের শেষে মিল নয় এটা বুঝবার আগেই ১০-১৫টি বই বের করে প্রতিষ্ঠিত কবি হয়ে যান, আর তারপর এমনসব কথা বলেন যে, মনে হয় ছন্দ-ফন্দ সব পুরানা বস্তাপচা বিষয়, এবং আজকের আধুনিক-উত্তরাধুনিক কবিতার জন্য একটা নিষ্প্রয়োজনীয় জিনিস” (কবিসভা ২০০৪)।
ড. তপন বাগচী আরো বিশ্লেষণাত্মক ভাষায় প্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেছেন: “আমাদের পাঠকসমাজে একটি কথা শোনা যায় যে, রবীন্দ্র-নজরুল-সত্যেন দত্তের পর বাঙলা কবিতা থেকে ছন্দ বিদায় নিয়েছে। ছন্দবিষয়ে অজ্ঞ নবীন কবিরাও এই বিভ্রান্তিকে সম্বল করে নিজেরা যে যেমন ইচ্ছে বাক্যের পর বাক্য লিখে এগুলোকে ‘আধুনিক’ কবিতা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। ঘটনাটি বরং কিছুটা উল্টো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বৃদ্ধ বয়সে অনেক গদ্যকবিতা লিখেছেন; তিরিশি আধুনিক কবিরা পুরোনো ছন্দেই নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন…তিরিশি কবিরা এত অল্পই গদ্যকবিতা লিখেছেন যে, পঞ্চপ্রধানের সবগুলো যোগ দিলেও রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার সমান হবে না। কিন্তু তাঁর সময়ে ছন্দ চেনা যেতো কবিতার শরীর দেখে, এখন শরীর থেকে ছন্দ ঢুকে গেছে কবিতার অন্তরে, একে খুঁজে পান কেবল তারাই যারা ছন্দবিষয়ে শিক্ষিত। সত্য কথা এই যে, আমাদের প্রকৃত কবিরা কখনো ছন্দকে অবহেলা করেন নি এবং অধুনার ছন্দশিক্ষিত নবীন কবিদেরও কেউ আধুনিক কবিতা মানেই গদ্যকবিতা বলে মনে করেন না; মনে করেন তারাই যারা ছন্দ কিংবা তার বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যেকোনো যুগের কবিতায় ছন্দ ছিলো কবিতার প্রাণ এবং তা-ই থাকবে অনাগত কাল। পরিবর্তন ঘটবে কেবল প্রয়োগ-কৌশলে, যেমন ঘটিয়েছেন জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমান, শক্তি-সুনীল-আল মাহমুদ তাঁদের নিজ নিজ উপায়ে” (মুক্তমনা ও কবিসভা ২০০৬)।
বলতে গেলে অনেকটা নতুন প্রজন্মের কবি ও প্রাবন্ধিক সুব্রত অগাস্টিন গমেজ ও ড. তপন বাগচী’র বক্তব্য দেখে এবং আমি আমার নিজের অভিজ্ঞতায় জেনেছি: বর্তমান কালেও সম্ভাবনাময় অনেক কবিই ছন্দ শিখে কবিতা লিখতে আগ্রহী।
তপন বাগচী’র ভাষ্য থেকে “যেকোনো যুগের কবিতায় ছন্দ ছিলো কবিতার প্রাণ এবং তা-ই থাকবে অনাগত কাল” কথাটির পুনরুল্লেখ করে এবার দৃষ্টি দিতে চাই ইউরোপীয় কবিতাঙ্গনে। এখনও পর্যন্ত যাকে বলা হয় ‘কবিদের রাজা’, ‘আধুনিক কবিতার জনক’, সেই শার্ল বোদলেয়র-এর কবিতার একজন বিজ্ঞ বিশ্লেষক ক্যারল ক্লার্ক লিখেছেন [আমার অনুবাদে যার অর্থ দাঁড়ায়]:
“বিষয়বস্তুতে ও বক্তব্য উপস্থাপনায় আধুনিক হয়েও বোদলেয়র তাঁর কবিতার নির্মাণকলায় কখনো ফরাশি কবিতার প্রচলিত ছন্দ-প্রকরণকে অমান্য করেন নি; সপ্তদশ শতকে প্রবর্তিত ছন্দ-প্রকরণ থেকে তিনি কখনো বিচ্যুত হন নি…এমনকি লক্ষণীয় যে, ১৮৬৬ সালে, যখন তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং কিছু লিখতে অক্ষম, তখনও তাঁর ডিকটেশন-দেয়া একটি পত্রে কবিবন্ধু প্র্যাঁর-এর একটি নতুন কাব্যসংকলনের প্রশংসা করতে গিয়ে কোনো একটি কবিতার একটি পঙ্ক্তিতে সামান্য ছন্দপতনের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ভোলেন নি…অবশ্য বোদলেয়র নিজেও, যে-কারণেই হোক, ১৮৬২ সালের পর সামান্যকিছু গদ্যকবিতা লিখেছেন…১৮৫৯ সালে বোদলেয়র লিখেছেন: ছন্দ ও প্রচলিত অলঙ্কারের ব্যবহার কখনো আধুনিকতার বিকাশকে রুদ্ধ করে না বরং এর উল্টোটাই সর্বাংশে সত্য অর্থাৎ এগুলো আধুনিকতার বিকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে।”
বোদলেয়র-প্রবর্তিত সেই আধুনিক রচনাশৈলি কিছুকাল পর ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপীয় কবিতারাজ্যে এবং ১৯৩০ সালে কবিতায় নোবেল পুরস্কারজয়ী টি এস এলিয়ট ঘোষণা দেন: “পৃথিবীর যেকোনো ভাষার জন্য বোদলেয়র-এর কবিতার রচনাশৈলি হতে পারে অনুসরণীয় আদর্শ…।” টি এস এলিয়টের আগেই বোদলেয়র-এর কবিতার সংস্পর্শে এসেছিলেন আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস। এরা দু’জন মিলে ইউরোপীয় আধুনিক কবিতার যে ভিত নির্মাণ করে গেছেন তা আজও পৃথিবীব্যাপী প্রকৃত আধুনিক কবিরা রক্ষা করে চলেছেন, যেখানে ছন্দের সঙ্গে কোনো আপোস করছেন না। একটি অতি-উৎসাহী তরুণ সম্প্রদায় ‘উত্তরাধুনিক কবিতা’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে চেষ্টা করে বোধগম্য নতুন কোনো দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে আন্দোলনটি মুখ থুবড়ে পড়েছে কিন্তু কথিত ‘উত্তরাধুনিকতা’র আন্দোলনেও ছন্দের প্রতি আরো বেশি নিবিষ্ট থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে।
ছন্দ সম্পর্কে বোদলেয়র-এর সেই বাণী ও কাব্যকুশলতা বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন প্রক্রিয়ায়ও অক্ষরে-অক্ষরে পালিত হয়েছে এবং হয়ে চলেছে।
‘বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন’ নামে আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে। বইটির এখন দ্বিতীয় সংস্করণ চলছে এবং তৃতীয় সংস্করণও প্রকাশের অপেক্ষায়। বইটিতে আছে নির্মাণকলার ক্ষেত্রে কী প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় আধুনিকতা বাঙলা কবিতায় এসেছে তার বিষদ বিশ্লেষণ। লক্ষ করা গেছে: বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বাঙলা ভাষায় বই রচিত হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতেই প্রাধান্য পেয়েছে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তুনির্ভর আলোচনা, যেমন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের নৈরাশ্য, অবক্ষয়-চেতনা, বিনষ্টি, বিমানবিকীকরণ, ইত্যাদি। রবীন্দ্রোত্তর যুগে আমাদের আধুনিক কবিতায় নির্মাণকলার ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন ঘটেছে এ-বিষয়ে তেমন কোনো বই ছিলো না বললেই চলে, যদিও কারো কাব্যকৃতির মূল্যায়নে বিষয়বস্তু ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার নির্মাণকলার বৈশিষ্ট্য। আমি প্রায়ই বলে ও লিখে থাকি: মল নিয়ে যেমন রচিত হতে পারে একটি উৎকৃষ্ট কবিতা, তেমনি ফুল নিয়ে লেখা হতে পারে একটি নিকৃষ্ট মানের কবিতা। কাজেই, কারো কাব্যকৃতির মূল্যায়নে বিষয়বস্তু কোনো নিরিখ নয়; নির্মাণকলার বৈশিষ্ট্যই একজন কবির রচনাকর্মের মূল্য নির্ধারণ করে। নির্মাণকলার নিরিখে আধুনিকতার নতুন বিশ্লেষণ দেখেই বোধ করি আমার ‘বাঙলা কবিতার আধুনিকায়ন’ বইটি বহু সুধিজনের দৃষ্টি কেড়েছে; আমাদের কবিতার আধুনিকায়ন বিষয়ে নতুন ধরনের বিশ্লেষণ দেখে সাহিত্যিক শওকত ওসমান বইটি সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শুরু করেছিলেন এভাবে: “কিছুদিন আগে একটি আকস্মিকতা আমাকে বুঁদ করে রেখেছিলো…দেশে মননের অনুশীলন তো নেই বললেই চলে, বিশ্বাস যাচাই ধাতে নেই, সেখানে এমন একটি গ্রন্থের আবির্ভাব (হ্যাঁ, আবির্ভাবই বলবো!) সত্যিই অভাবনীয় বৈকি…বইটি পড়তে-পড়তে একটি প্রাচীন ঋষিবাক্য মনের ভেতরে গুঞ্জর তুললো…‘বিশ্বাসে মিলায় হরি’র দেশ থেকে [লেখক] অনেকদূর অগ্রসর…” (জনকণ্ঠ সাময়িকী, ৪ এপ্রিল ১৯৯৭)। ড. হুমায়ুন আজাদ সাপ্তাহিক বিচিত্রাকে-দেয়া একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন “আবিদ বেশ চমৎকারভাবে আমাদের কবিতার বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করেছেন…” (সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ২১ মার্চ ১৯৯৭)। বইটি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক ব্যবহার করছেন জানতে পেরে ও দেখতে পেয়ে আরো একটি আলোচনাগ্রন্থ ‘চিত্রকল্প ও বিচিত্র গদ্য’ বের করতে প্রলুব্ধ হই ২০০৫ সালে। এটিরও প্রকাশক আগামী প্রকাশনী। বইটিতে আছে বিজ্ঞপ্তি কয়েকজন কবির রচনাকর্মের বিশ্লেষণ এবং শিল্পসাহিত্যের বহু বিচিত্র বিষয়ে আলোচনা। আগামী থেকেই প্রকাশিত আমার তৃতীয় প্রবন্ধগ্রন্থের নাম ‘বরেণ্য কবিদের নির্মাণকলা’, যাতে রয়েছে আমাদের বিখ্যাত আটজন আধুনিক কবির মানসলোক, ছন্দ-প্রকরণ ও রূপকল্প ব্যবহারের বৈশিষ্ট্য নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষণ। এগুলোর কোনোটিই ব্যাকরণের ভাষায় লেখা নয়। হঠাৎ করেই প্ররোচিত হলাম ছন্দবিষয়ে ব্যাকরণধর্মী এই বইটি লিখতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনুরুদ্ধ হয়ে ফেসবুকভিত্তিক কিছু গ্রুপ ও ওয়েব পোর্টালে ছন্দ বিষয়ে শিক্ষামূলক কিছু পোস্ট প্রকাশ করার পর অনেকেই জানিয়েছেন তাঁরা ছন্দ শিখতে চান কিন্তু অনেক বই পড়েও বাঙলা ছন্দের রীতিনীতি তেমন আয়ত্ত করতে পারছেন না কিন্তু আমি যে-উপায়ে ছন্দ শেখানোর চেষ্টা করছি তা তারা খুব সহজেই বুঝতে পারছেন। আমার কাছে মনে হয়: যে-কারণে তারা এতসব বই পড়েও ছন্দ শিখতে পারছেন না এবং নিজেদের রচনায় তার যথাযথ প্রয়োগ ঘটাতে পারছেন না তার মূলে কাজ করছে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: বাঙলা ছন্দশাস্ত্রের আদিগুরু প্রবোধচন্দ্র সেনসহ অন্য যারা ছন্দের ওপর ব্যাকরণগ্রন্থ লিখেছেন, তাঁরা প্রায় সবাই রবীন্দ্র-নজরুল যুগের, এমনকি মধ্যযুগের কবিতার পঙ্ক্তিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন; আধুনিক কালের কবিদের রচনাকর্ম থেকে উদাহরণ চয়ন করা হয় নি। ফলে, পঠিত বিদ্যা দিয়ে আধুনিকদের কবিতায় আটপৌরে (মুখের) ভাষায় রচিত পঙ্ক্তিতে নবীন পাঠক সেই ছন্দ সনাক্ত করতে পারছেন না। এ-কারণে অনেকের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ছন্দ শিখতে ও নিজেদের রচনায় তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হিমসিম খাচ্ছেন। লক্ষ্য করেছি: কেবল এ-কারণেই বিষয় ও প্রকরণের দ্বন্ধে বিক্ষত হয়ে অনেকের কাব্যপ্রতিভার অপমৃত্যু ঘটছে। এ-বিষয়টি মাথায় রেখে আমার এই বইতে বাঙলা ছন্দের তিন রীতির ক্ষেত্রেই উদাহরণ চয়ন করা হয়েছে কেবল আধুনিক কবিদের রচনাকর্ম থেকে, এমনকি তরুণ কবিদের কবিতা থেকেও, যাতে পঠিত বিদ্যা দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীগণ একালের আটপৌরে ভাষায় লেখা কবিতায় ব্যবহৃত ছন্দও সনাক্ত করতে সক্ষম হন। দুয়েকটি ক্ষেত্রে ছন্দের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজন দেখা দিলেই কেবল মাইকেল-রবীন্দ্র-নজরুল যুগ এবং মধ্যযুগের কবিতার প্রসঙ্গ যৎসামান্য আলোচনায় এসেছে।
সবাই স্বীকার করবেন: পাঠককে বুঝানোই একজন আলোচকের দায়; কাজটি করতে গিয়ে কোথা থেকে কার কোন রচনা থেকে উদাহরণ চয়ন করা হলো তা বিবেচ্য নয়; বুদ্ধদেব বসুসহ বহু আলোচক কোনো বিষয়ে পাঠককে ধারণা দিতে নিজের রচনাকর্ম থেকেও প্রচুর উদাহরণ চয়ন করেছেন। উদাহরণের জন্য বাঙলা কবিতার বিশাল রচনাসমুদ্রে হাবডুবু খেয়েও যথাসময়ে যুৎসই উপাত্তটি না-পেয়ে আমি আমার নিজের কবিতা, ছড়া ও গান থেকেও মাঝেমধ্যে কিছু উদাহরণ ব্যবহার করেছি। অনেক ক্ষেত্রে ছন্দের কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য বুঝাতে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত কিছু পঙ্ক্তিও ব্যবহার করতে হয়েছে।
আমি প্রাণপণ চেষ্টা করেছি পাঠক-বান্ধব ভাষায় বাঙলা ছন্দের তিন রীতির মৌলিক রীতিনীতি তুলে ধরতে এবং ক্ষেত্রবিশেষে নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে ছন্দবিষয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মিটাতে। যাদের ছন্দবিষয়ক জ্ঞানপিপাসা ও তাগিদ আমাকে এই কাজটি করতে প্ররোচিত করেছে অন্তত তাদের প্রয়োজন মিটলেও আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো।