আড্ডাপত্র

২৫ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪;সকাল ৭:১৪

জন্মদিনে তুষার কবির এর দশ কবিতা

আড্ডাপত্র

ফেব্রু ২, ২০২১ | গুচ্ছ কবিতা, জন্মদিন

পিয়ানো

প্রেমের কথাই যদি বলো তবে একবার গানঘরে ঘুরে আসো!

বাইরে সুরেলা বৃষ্টি আর রেস্তোরাঁয় বাজছে একটানা মেঘের পিয়ানো! এখানে চায়ের কাপে প্রেমিকাদের ঠোঁটের দাগ লেগে যায়! এখানে বৃষ্টির শব্দে প্রেমিকাদের নতুন শেমিজ ভিজে যায়!

কোনো এক প্রেমিক কবিকে দ্যাখো, সে ভুলে গেছে তার শেষ স্বরগ্রাম—সে হারিয়ে ফেলেছে তার নোটবুক—বৃষ্টিভেজা জলের লিরিক!

প্রেমের কথাই যদি ভাবো তবে একবার পিয়ানোর ঘুমসুরে নেচে ওঠো!

প্রেম ও প্র্যাকটিস

এতদিন ঘুরে ঘুরে তুমি বুঝে নিয়েছ যেনবা প্রেম কিছু নয়; কেবল একটা প্র্যাকটিস!

যেমন চায়ের কাপে তুমি রোজ যে ক’চামচ চিনি খাও, আপেলে কামড় বসানোর পর তা যতক্ষণ চিবোতে থাক, পপকর্ন খেতে খেতে উড়ে যাও হালকা হাওয়ার ভেতর, রেস্তোরাঁয় বসে বসে বিড়বিড় করে সুর ভাঁজ, ভাঁটফুলে বুঁদ হয়ে যেমন খুঁজতে থাক কোনো ভ্রমরের পদচ্ছাপ!

ভুলে যাওয়ার পর প্রেমিকাকে মনে হতে পারে ওটা এক সাদাকালো আর্কাইভ—যেমন কবিতা লেখা ভুলে গেলে একদিন তোমারও মনে হতে পারে ওগুলো আর কিছুই নয়—খালি টুকরো টুকরো ছন্দ আর শব্দের ফসিল!

জঙ্গলে বেড়াতে এলে

জঙ্গলে বেড়াতে এলে আমি তোমার শরীরেই
নিঃশব্দে ভ্রমণ করি!

জঙ্গলের বুকঝিম্ পথে হেঁটে গিয়ে
আমি খুঁজে পাই দূরের ছড়ানো ভাঁটফুল
পাতাঝরা আমলকীবন—
কোথাও যেনবা ভেসে আসে তিতিরের ডাক
ঝোপ থেকে উঠে আসে ময়ূরীর মনোলগ
আর জলডাহুকীর গান—

জঙ্গলে বেড়াতে এসে তোমার শরীর জুড়ে লেখা হতে থাকে
আরণ্যিক নোটবুক!

জঙ্গলের কিছুটা দূরে তাঁবুর ভেতর থেকে
উঠে আসে হালকা পালক, শালপাতা, ঘুমহরিণীর চোখ—
আরো দূরে কালো জিপ, পোড়া ডিজেলের ঘ্রাণ,
ছায়া ও ছাতিমতলায় ডুবে যায়
হাওয়া হ্রেষার গান—

জঙ্গলে বেড়ানো মানে তোমার শরীরের অরণ্যের ভেতর
নিঃশব্দে হেঁটে যাওয়া!

জঙ্গল ও তাঁবু

তোমাকে আগেও আমি বলেছি প্রেমের জন্যে আমার একটা নিঝুম জঙ্গল চাই! অথবা প্রেমের জন্যে আমার একটা নিঃশব্দ রিসোর্ট চাই! কমপক্ষে আমার একটা সুনসান তাঁবু চাই!

অথচ তোমার পাশে বসতেই কোত্থেকে যেনবা কিছু ছায়াশরীর এসে জুড়ে যায়—তারা আচমকা ঘিরে ধরে আমাদের—তাদের চোখের লেন্স ধরে ফেলে রেস্তোরাঁর আলোআঁধারিতে হাত ধরে বসে থাকা আমাদের!

জঙ্গলের গহিন ভিতরে একটা তাঁবুর জন্যে অপেক্ষা করছে আমাদের প্রেম!

বর্ষাভ্রম

ঘুম দুপুরে উঠছে জেগে ধূম্র স্মৃতি
ঝুম বর্ষায় আবার তুমি পড়লে এসে—
মেঘের মেয়ে আঁকছে দ্যাখো সরস্বতী
জলের বুকে জাগছে ভূমি রাস্তা ঘেঁষে।

ঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মারে বজ্র চেরা
ঢেউ তোমাকে দেয় ডুবিয়ে আস্তে করে—
নদীর তীরে হাঁটছ তুমি রাত্রি ছেঁড়া
জলের সিঁড়ি ভাঙছি আমি ভগ্ন সুরে।

ভুল বেহালা বাজছে বুকে শব্দ যতি
ঝুল বারান্দা ভিজছে শুধু দুঃখক্রমে—
প্রেমের খাতা খুলেই দেখি আস্ত ক্ষতি
লিখছি তাই জলের গাথা বর্ষাভ্রমে।

জল ও জানালা

এ বর্ষায়, দ্যাখো জানালার কাচে আমি লিখে চলেছি শুধু তোমার নাম! বৃষ্টির ঝাপটা জানালায় যতই আছড়ে পড়ে আমি আঙুল চালিয়ে লিখে চলেছি তোমার নাম! জানি, একটু পরই জলের প্রপাতে ধুয়ে মুছে যাবে তোমার এ নাম—আমি সম্মোহিত হয়ে তবু লিখে চলি তোমারই নাম। বুঝি, তুমিও তোমার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছ জলের প্রিজম কণা, শুনছ বৃষ্টির গান—আর ধোঁয়াওড়া কফির পেয়ালা হাতে মনে মনে জঁপছ একটি নাম! বর্ষালীনা, তুমি জানবে না, হিমেল ঠান্ডায় ভিজে ভিজে আমি লিখে চলেছি শুধু তোমারই নাম!

ধূলিখাম

ধূলিখামে এসেছিল তোমার সকল চিঠি—যা ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে অরণ্যের পোস্টম্যান নিয়েছিল দু’দিনের নৈমিত্তিক ছুটি!

ডাহুকের ঝিমপথে সে পড়েছিল তার কয়েকটি গোপন হরফ—তাতেই সে শুনতে পেয়েছে জগতের সব মনোব্যথা, পালক হারানো স্বর আর সরোদের আর্তকান্না!

ধূলিখাম খুলে দেখি তাতে শুধু শূন্যতার গান, কয়েকটি রক্তে ভেজা হরফের ঘ্রাণ আর সমুদ্রের স্বরগ্রাম!

ছাপ

এই বিকেলের শেষ রোদে, জঙ্গলের ধূলিপথে, পা ছড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেখি কার যেন পায়ের ছাপ—মুদ্রিত পায়ের রেখা!

তবে এই পথেই হেঁটে গিয়েছ তুমি জঙ্গলের নিঝুম ময়ূরী হয়ে?

আর আমি গুনে গুনে দেখি সেই নিরীহ শীতল ছাপ—ঠিক যেন তোমার পায়ের মাপ—আমি আঙুল ছড়িয়ে গুনি তোমার পায়ের রেখা।

সামনেই এক তৃণভূমি—দিগন্তের শেষ বাড়ি—প্রান্তরের হরিৎ হাওয়া; আমি সেই পথে হেঁটে চলি, দেখি জঙ্গলের বুনো ঘাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেই পথরেখা—তোমার মুদ্রিত পা!

রেস্তোরাঁ

বরং তুমি সেই রেস্তোরাঁর কথাই বলো যার ঝাড়বাতিগুলো জেগে ওঠে মাঝরাতে কোনো ভগ্ন বেহালার সুরে—যার আবলুশ রেকাবির পর জেগে থাকে নীলচে নরম নাশপাতি—ফেটে যাওয়া আনারের দানা—রক্তিম গেলাসে যার ঘুরতে থাকে আঙুরের রস, মদ, মোহ, মায়া—ঘুমের গহিনে যাতে বেজে যায় সুরময় ক্যানেস্তারা! বরং তুমি সেই রেস্তোরাঁর কথাই ভাবো যেখানে বিষাদমাখা প্রেমিকাগণ বসে থাকে ঠান্ডা রিস্টওয়াচ হাতে—যেখানে ঘুরতে থাকে সারি সারি মেঘের পয়ার—পিরিচে আর চায়ের কাপে যেখানে উড়তে থাকে চকমকি প্রজাপতি—রাতভর বেজে যায় যে রেস্তোরাঁয় শুধু প্রেমের প্রমাদ—গহিনে বাজতে থাকে শুধু এক ঘুমচেরা সেরেনাদ!

দরজা

দরজার নামফলকের মাঝে চাপা পড়ে থাকে
হারানো প্রেমিকাদের নাম!

দরজার কাঠ থেকে জেগে ওঠে কান্না
ধাতব চেরাই শব্দ—
বুক ঝিম হাহাকার—বিলাপ ও নৈঃশব্দ্য!
দরজার আড়াল থেকেই জেগে ওঠে
যত জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস!

জানি এ দরজার ওপাশেই ঘটেছিল
যত পাপ ও প্রহেলিকা—
মোহ ও মায়া—মধু ও মাধুকরী—
সব ভিড় করেছিল এ দরজার ওপারেই।

তোমার শরীর জুড়ে
কীটদষ্ট চুম্বনের ছাপ—
যা আমি সযত্নে এঁকেছিলাম
সমূহ ভূগোল জুড়ে;
তাও ঘটেছিল এ দরজার আড়ালেই!

দরজার ওপাশে এখনো দেখি
সটান দাঁড়িয়ে আছে কেউ—
যার রাতচেরা দীর্ঘশ্বাসগুলো
এখনো ভাসতে থাকে কার্নিশের ছায়াভ্রমে!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১