কবরের বাসিন্দা
বকুলের ম্লান ছায়ায়, নিস্তব্ধতায়
ছেয়ে আছে সুবিশাল গোরস্থান।
কয়েকটি কাক কা কা করে ক্লান্ত স্বরে
সমস্ত নীরবতা খান খান করে জানান দিচ্ছে
তোমরা ক’জন শুধু একা নও-
আমরাও আছি তোমাদের সাথে, ভয় পেয়ো না সাথী,
আমরাও আজ মানুষদরদী,
পরিবেশবাদী তোমাদেরই মতো।
অথচ তাদের অবসর নেই কান পেতে শোনে,
পা মেলে বসে, অনায়াসে গল্প জমায় আয়েশে তাদের।
একটি লাশ দাফন করা শেষ না হতেই আর একটি লাশ এসে দাঁড়ায় সমুখে।
একটি কবর খোঁড়া শেষ হতে না হতেই লাশবাবাহী গাড়িতে
ধীর গতিতে আর একটি লাশ এসে জানান দিচ্ছে-
সময় নাই, সময় নাই।
সারাদেশে লকডাউন কিন্তু কবরস্থান, শ্বশানের ভিড় ভিন্ন ধরনের
সেখানে কোন লকডাউন নেই, নেই কোনো কোয়ারান্টাইন।
সেখানে শুধু তাড়া আছে পৃথিবীর লেনাদেনা চুকিয়ে দেবার।
যেভাবে হঠাৎ করে মৃত্যু কেঁড়ে নিয়েছে তাদের জীবন,
সেভাবেই তাড়াহুড়ো যেতে চায় তারা।
আত্মীয়- স্বজনহীন, ভালোবাসাহীন, আতঙ্কিত
পৃথিবীর
আলো হাওয়া, ছায়া মায়া পিছু আর টানে না তাদের।
তাইতো এভাবেই এক দুই তিন করে ত্রিশটি কবর খুঁড়ে রাখা হচ্ছে প্রতিদিন।
এর আগে প্রজন্মের দেখেনি কেউ কবরের এমন আকাল
যেখানে সারা বিশ্বের জনগণ আজ বেকার
শুধু গোরখোদকের খালি নেই হাত।
তারা জানে না, যে কবরটি এইমাত্র খোঁড়া হচ্ছে,
কিংবা এর পরেরটায় কে হবেন বাসিন্দা কিংবা ঠিকানা কী তাঁর!
তারা শুধু জানে, আজ গোরখোদকের নেই কোন বিশ্রাম;
কবরের গহীন ভিতর বাসিন্দা ঘুমাবে নিয়ে শান্তি অপার।
ক্ষমা করি শুধু
কে সমাদর করলো, কি করলো না, তাতে কী এসে যায়!
শুধু জেনে রেখো,
মানুষ মানুষকে চেনে, জুহুরী চিনে নেয় মুক্তা তামাম
রতনে রতন চেনে, বৃক্ষ ছায়া দেয় পৃথিবীর দাম!
জ্ঞানীকে জ্ঞানীই চেনে, আকাশ জানে তার সীমানা সকল!
অন্ধ চেনে না আলোক,
যে জানে না, অবুঝ সে
পার্থক্য বুঝবে কি, কাঠ না বাকল?
সম্মান তিনি দেন, যিনি পান সমীহ আদর
সমানে সমান হলে সম্মান জানে
অসম্মান সেই করে, চেনে না যে
রোদের ঝিলিক কিবা মেঘের চাদর।
ভালোবাসা জানি বলেই, ভালোবাসি অকাতর সেই জনে
কুকুর মানুষ কামড়ায়,
মানুষ কামড়ায় না কুকুর
করুণার সিঞ্চনে ভুলে যাই, ভালোবাসি ফের মনে।
বিরহ বেলায়
এ বছর ঈদে শাড়ি দেখবো না
কসমেটিকস, জুতা, চুড়ি, ঘড়ি
লিষ্টে নেই কিছুই
করোনার দ্বিতীয় ঝাপটায় চুপসে গেছি
বদলে গেছে জীবন যাত্রার দিনলিপি
লকডাউন, আইসোলেশান, সেনিটাইজার
মাস্ক আর প্রার্থনায় কাটানো সময়
গা ঘেঁষে থাকা হয় না আর
সবখানেই দূরত্ব, দূরে থাকা চাই
দূর্দান্ত দুরন্ত শৈশব এক ঘরে কাটে
মায়ের ঘরের দোরে চোখরাঙা করোনার বাসা
বিরহ বেলায় আর ফোটে না তো ফুল
ঈদের আনন্দে নেই খসবু আকুল।
রাতজাগা কবিতার বই
জীবনটা যেন চাকরির সিভি না হয়,
মাসে মাসে দপ্তরে দপ্তরে সংরক্ষিত না হয় কোনো ড্রয়ারে কারো
তারপর সময় শেষে আলগোছে
পড়ে থাকে পুরনো কাগজের বাক্সে নিথর।
জীবন যেন শেকড়বিহীন বৃক্ষ না হয় আর,
অল্প ঝড়ে মুচড়ে পড়ে কেড়ে নেয় অন্য জীবন
জীবন হোক ধোঁয়া ওঠা কফির পেয়ালা,
রাতজাগা কবিতার বই
সত্য, সুন্দর, সততা, দরদের সমাহার
যেখানে সকাল বিকাল ভরে থাকে প্রেম, অবসর।
দুরন্ত ঈগল।
ডানার উঁচুতে ওড়ে থাবার আগুন
তাই যতোই তোমরা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলতে চাও
ততই ভালোবেসে দিনশেষে
আরও দূরে, বহু দূরে, সুরে– সুরে মুগ্ধ ছায়ায়
প্রত্যহ নতুন এক পৃথিবীর পথ খুঁজে পাই।
কথা ছিল পরাজয় আসবে, দুর্মর হৈ হুল্লোড়ে
তোমরা ঘি ঢেলে, তার তেজে মাছ ভেজে খাবে!
কিন্তু দেখো তো!
অথচ বিজয় আসে ধীরপায়ে, বিজ্ঞাপন হয়ে
ইউনিকোড ফ্রন্টের প্রিন্টে
সামহোয়্যার ব্লগের প্রতিক্রিয়ায়
কম্পিউটারের মাউসে মাউসে
তাই তারা উড়ে বেড়ায় গ্লোবাল নেটওয়ার্কে
ইনোভেশন ইনডেক্সে পৃথিবীময়!
তোমরা যতই মাথা কুটে মরো
যতই নিজের চুল নিজে ছিড়ে মরো
ডানার আগুনে যতোই ভস্মীভূত হও
তাতে আজ আর কিছুই যায় আসে না কারো!
কে দেখে তা পিছনে ফিরে? কে শোনে তা কান পেতে?
দূরন্ত ডানার ঈগল
সে শুধু উড়িবারে চায়
সমস্ত যাতনা সয়ে বারে বার! বারে বার!
চারিদিকে শুধু প্রেতপুরি যেন
চারিদিকে শুধু প্রেতপুরি যেন, পিষিছে পাটার তলে–
অজগর আর আজদাহা মিলে, ছলে, বলে, কৌশলে।
ছোবল মারিছে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে- কণ্ঠ, চিবুক ও বুকে–
সুখে আজ কেহ পাশে নাই, শুধু ধুকিছে মরণ দুখে।
দুই পায়ে দড়ি টানিছে নীচে, কভু কি উপরে উঠি?
টানিয়া নামাও মাটির অতলে, পুতিয়া পাঠাও টুঁটি।
এই সমাজেই বাস করি আমি, নষ্ট সময়ের কবি–
কবিতা লিখতে পারব না তাই, আঁকবো না কোন ছবি।
ক্ষমা করে দিও বন্ধু তোমরা, যদি কেহ থেকে থাকো–
আমি তোমাদেরই বন্ধু ভেবেছি, শত্রু ছিলাম নাকো।
তবু কেন আজি শত্রুর মতো আচরণে আমি ক্ষত,
দগ্ধ এবং বিভীষিকাময় গন্ধে হয়েছি নত!
ভাল থেকো তবু বন্ধু তোমরা, চিরদিন ভাল থাকো–
ভালবেসে সুখে থেকো আর শুধু দুঃখটা নিও নাকো।
মুনিয়া পাখি
তোমার তো সাধ ছিল চিল হতে রোজ!
তোমার তো সাধ ছিল উড়িবার তরে
একটুও নিয়েছো খোঁজ ছিল কি সে ডানা?
কেউ কি শিখিয়ে তা, করেছিল মানা?
মুনিয়া পাখি শোনো,
অকারণ করেছিলে কিচিরমিচির!
তুমি তো পোষ মানা ডানা পাখি এক–
তবু কেনো খাঁচা রেখে উড়িবারে চাও;
শিকারী থাবায় পড়ো অসম অচির?
মুনিয়া মনি জানো,
শিকারীর তীরে থাকে বিষ মাখা রাগ
হজম করিতে তুমি তাহা অপারগ।
শিকারী তো ঠিক দেখো মসনদে বসে
সুখটান দেয় ফের তীর ভালোবেসে!
চলে যাবো
নিস্তব্ধ রজনীতে সেইসব দেখাইয়াছো তুমি
মানুষ কেবল মৃত্তিকার নীচে হাঁটা চলা করে
উবু হয়, রুজু হয়ে যাপনের কৌশল জেনে যায়
সেইসব জেনে গেছি পূর্ববর্তী পর্বে তোমার।
তুমিই জানাও সব বিস্তারিত ও বিস্তৃত বর্ণনার শব্দে
যাকে ইচ্ছা বুঝিবার দাও
আর যাকে ইচ্ছা অজ্ঞতায় চেপে রাখো বুক।
চলে যাবো। কে আর রয়ে যাবো? তবু বুঝিনা সে সব।
সৃর্যের সাথে পৃথিবীর কথোপকথন
আমি হয়তো নিজেই ভয়টা তোমাকে পাইয়ে দিয়েছিলাম।
কিন্তু বিশ্বাস করো, ওটি সম্পূর্ণই আমার মনের কথা ছিল।
এক চিলতে ভনিতা কিংবা অভিনয় ছিল না সেখানে,
না ছিল প্রতারণা, কিংবা অবিশ্বাস।
পরিপূর্ণ বিশ্বাসেই চোখে চোখ রেখে তোমাকে আমি বলেছিলাম–
পৃথিবীর সবকিছুরই একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা আছে।
তার লঙ্ঘন কারোই কাম্য নয় কখনও ।
তুমি তো জানোই চোখে চোখ রেখে কখনও কেউ মিথ্যে বলতে পারে না।
মিথ্যে বলতে গেলে চোখ থেকে চোখ নামাতে হয়।
কেননা, সত্যের উজ্জ্বল রশ্মি মিথ্যের কারুকাজ খেয়ে ফেলে নিমিষেই।
তাই চোখে চোখ রেখে সত্য করে তোমাকে আমি বলতে পেরেছিলাম–
বৃষ্টি? ছোঁয়া যাবে না।
মেঘ? অসম্ভব!
জল? সে তো মহামারী!
কে আর এতো নিয়ম কানুনের শর্ত মেনে ভালবাসতে পারে, বলুন?
তাতেই আপনি ভয় পেয়ে গেলেন সত্যিকারের!
জল, বৃষ্টি না ছুঁলে কি জীবন হয়?
জলই তো সৃষ্টির প্রধান শর্ত–
আবারও অহেতুক প্রশ্নে প্রশ্নে বিচলিত করলেন আমাকে–
ফুল?
ছোঁয়া যাবে না একবারও!
পাতা?
তা ছুঁতে পারো দু’একবার–
কিন্তু ছেড়া যাবে না একটিও।
প্রেম?
উঁহু কি যে বলো না!
বয়সের একটা ব্যাপার আছে না?
কোটি কোটি বছরের এই বয়সটা এখন বৈষয়িক!
এখানে আবেগ, অনুরাগ, মান, অভিমানের কোনও স্থান আছে…?
বুকের ভেতর ঝড়?
সে তো কালবোশেখী।
উপড়াতে আসে, ভাঙতে আসে, গড়ে না কিছুই।
ভালবাসা?
তা যেমন তিলতিল করে গড়ে ওঠে,
তেমনি ধীরে ধীরে থিতিয়েও যায় এক সময়।
তারপর শুধু সময় কে ধারণ করে ভয়ঙ্কর এক ক্ষত বিক্ষত আঁচড়;
বিক্ষুব্ধ স্রোতের মতো আছড়ে পড়ে পাড়ে।
তারপর সময়ের নির্দিষ্ট জোয়ার শেষে টেনে নেয় পাড়ের সবকিছু…
অবলীলায়…।
তখন সে অত্যাচার সহ্য করতে হয় হাসিমুখে চিরকাল।
কারণ, পৃথিবীতে ভালবাসার অত্যাচার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।
নতমুখে সবকিছু মেনে নিতে হয়।
কখনওই উদ্ধত প্রতিকার পায় না কেহই।
ভাল থেকো সৃর্য।
হু, তুমিও। পৃথিবী আমার…
একদিন
বিশ্বাসের কাছে সমর্পণ করেছি হৃদয়
আত্মার কাছে প্রার্থনা করি রোজ
এই হেমন্ত, শরতের শিউলি কাকডাকা ভোর
মধ্য রাত্রির অপরুপ সৌন্দর্য
নিবিড় ধ্যানমগ্ন জীবনের জলছবি, বিমুগ্ধ হৃদয়
আহা! জীবন এমন কেন?
কলেরা, প্লেগ, কালাজ্বর,
নিউমোনিয়ার মতোই একদিন
এ পৃথিবীতে টিকা আবিস্কার হবে,
থোরাই কেয়ার হবে করোনা;
মানুষ আবারও ভুলে যাবে হাত ধুতে
মাস্ক চালান হবে ভ্যানিটিতে
সেদিনও হিমঘরে কাটা হবে লাশ
ঘুনি জালে ধরা হবে ছোট, ছোট মাছ
খেপলা জালে উঠে আসবে শোল, বোয়াল
আর স্বচ্ছ পানির নিস্তব্ধতায় কুট কুট কামড়াবে কুচো চিংড়ির ঝাঁক।
মাচানে মাচানে ঝুলে থাকবে লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা বরবটি, করোলার মতো সুন্দর অনুভব
আমি থাকবো না, তুমিও থাকবে না
যেইভাবে চলে গেছেন আমার নির্ভরতার প্রথম পুরুষ আমার পিতা,
প্রথম রমনী আমার মা
যেইভাবে খুঁজে পাই না আমার প্রিয় নানীজান
যার কোলে মাথা রেখে অনন্য হয়েছিলো আমাদের দুখিনী শৈশব।
সেইভাবে একদিন আমিও থাকবো না,
তুমিও থাকবে না
শুধু থেকে যাবে এই সবুজ, এই বন্য গন্ধ, এই ধানের সোনালী, এই পাখি, এই আকাশ
আর আমাদের অনন্য ইতিহাস।