আড্ডাপত্র

৩১ আশ্বিন, ১৪৩১; ১৬ অক্টোবর, ২০২৪;দুপুর ২:৩৫

জন্মদিনে শাহীন রেজা’র দশ কবিতা

আড্ডাপত্র

যে নামেই ডাকি

যে নামেই ডাকি জানি তুমি সাড়া দেবে
হোক তা সে পক্ষির অথবা পুষ্পের
হোক তা সে কোন বৃক্ষ কিংবা প্রাণীর
নামে কি’বা এসে যায়
ব্রক্ষ্মপুত্র কিংবা তিতাস নাম যাই হোক
তার অস্তিত্ব শুধু জলে আর আনন্দ বয়ে চলায়

তোমাকে যে নামেই ডাকি না কেন
তুমি নিশ্চিত বুঝে নেবে মেঘের ঘ্রাণ আর জেনে যাবে
এতো সেই বৃষ্টির আহ্বান এবং তুমি সাড়া দেবে

ভালবাসার ধর্ম এই একটাই
জলের উচ্চারণে সে আহ্বান জানাতে পারে পর্বতকে
আর রৌদ্রের আমন্ত্রণে উড়ে যেতে পারে আটলান্টিক
অবলীলায় শরীর ভাসাতে পারে উড্ডয়নশীল ডলফিনে

ভালবাসা সেতো মেহেদী পাতার কোণ থেকে তীর্যক ভেসে আসা আষাঢ়ের কোন রোদ
যার উষ্মতায় মাতাল প্রজাপতি প্রগলভ উড়ে যায় শূন্যলতায়

ভালোবাসা ডাকলেই সাড়া দেবে মায়াবী দুপুর
দিগন্তে ক্ষনিক ভাসা রংধনু আর সেই প্রাণের ঘুঙ্গুর

যে নামেই ডাকি না কেন
শালিক তোতা টিয়া মল্লিকা অথবা মালতী
কিংবা ডাহুক ইলিশ হরিণ অথবা বাঘিনী
জানি তুমি সাড়া দেবে
ভালোবাসার একটাই ধ্বনি, ভালোবাসি – ভালোবাসি
সেই ধ্বনি টানবে তোমাকে।

২৬.০৫.২০১৮

কেউ জানে না

কোথায় তুমি কোথায় তুমি মোহন জাম
বুক পকেটে লুকিয়ে আছে হলুদ খাম

সাতক্ষীরা সেই অনেক দূর বৃষ্টি-বাসে
স্মৃতির কদম কেমন সুবাস ছলকে আসে

পেয়ারা গাছে বুলবুলিটা করুণ ডাকে
এত খুঁজি তবুও আমি পাই না তাকে

অরূপ শালিক কোথায় থাকে কোন গলিতে
শিকড় ছাড়ে বকুল সে গাছ কোন পলিতে

কোথায় তুমি কেমন আছ কেউ জানেনা
উদোম বুকে হাওয়ার কুমীর আর টানেনা

যেথায় থাক যেমন থাক ভালই থেকো
সেই চুমুটা গোপন গালে লুকিয়ে রেখো

ছিলাম আমি ছিলাম সেদিন বড্ড আপন
উদাস রোদে পেখম মেলে ময়ূর যাপন

সেই আমিটা তেমনি আছি মেঘের পাখি
তিরিশ ফাগুন ছাতিম ডালে লুকিয়ে রাখি

বড়শীটা নেই বড়শীটা নেই মাছের ভীড়ে
মুখ লুকিয়ে পঁচিশ কাঁদে আস্তে ধীরে

কেউ জানেনা কেউ জানেনা গোপন ঘুড়ি
উড়তে গিয়ে হয়েই গেল কখন চুরি।

২৪.০৫.২০১৮

কলকাতা

শ্যামাচরন স্ট্রিট দিয়ে হেঁটে যাবার সময় হলুদ শেমিজকে দেখলাম, আহা ট্রামের পাশে যেন একখানা শর্ষে ক্ষেত। আমি চোখ বন্ধ করতেই কানে এসে বাড়ি দিল সেই আলো-ফুলের মাদক গন্ধ; একটা ইন্দ্রিয় অচল থাকলে অপর ইন্দ্রিয়গুলো না’কি বেশি কার্যকর হয়।

আমি শর্ষে ফুলের পিছু পিছু হাঁটা শুরু করলাম।
আমার মাথার উপর তখন সূর্য স্থির,
প্রচন্ড তাপেও সমস্ত শরীরে যেন মাঘের থাবা,
আমি কাঁপতে কাঁপতে ঘামে ভেজা শেমিজের
নীচে ঢুকে পরলাম একখন্ড উষ্ণতার জন্য।

আহা হলুদ শেমিজ পুরুষ-ছোঁয়ায় গলে গলে কেমন একথালা আইসক্রিম হয়ে গেল।
হলুদের ভেতর চোখ ডোবাবার জন্য ছুটে এলে
একঝাঁক হুলোমৌমাছি, আমি মনের দরজা বন্ধ করে হঠাৎ বাতাস হয়ে উঠলাম।
পৃথিবীর সকল বাতাসে ঘুড়ি ওড়ে, মেঘ-গুড়গুড় আওয়াজ বৃষ্টি নামায়।

শেমিজের দেহ নিয়ে আমার সামনে দিয়ে
উড়ে যাওয়া হলুদ দুপুর আমাকে শোনালো
মাছির অর্কেস্ট্রা আর আমি যেন বৃশ্চিক বাঁশি ;
কেবলই ডাকের পালা, বিষন্ন যোনীতে আঁকা কলকাতা-কলকাতা।

০৬.০৯.২০১৯

বাতিঘর

তাঁর নিত্যদিনের কাজগুলোর একটি ছিল হ্যারিকেনের চিমনি মুছে ফিতা ঘষে তাতে তেল ভরে আসন্ন সন্ধ্যার জন্য ঠিকঠাক করে রাখা।
তাঁর পবিত্রতার সাথে এই বিশ্রী কাজটিকে আমি কিছুতেই মেলাতে পারতামনা।
কেরোসিনের গন্ধ আমার পছন্দ ছিলো না একদম।
একদিন সেটা তাঁকে বলতেই তিনি হেসে ফেলেছিলেন।বলেছিলেন, বাবা কাউকে না কাউকে তো বাতি জ্বালাতেই হবে, হাতে তুলে নিতে হবে অন্ধকার তাড়ানোর কাজ।
আমার মা একান্তে বাতি জ্বালানোর কাজটাই হাতে তুলে নিয়েছিলেন, বোধহয় সব মায়েরাই এমনটি করেন। আজ মা নেই, হ্যারিকেনের জায়গায় এসেছে বিজলী। বাতি জ্বলে, ঝরঝর আলো এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘরে বারান্দায় উঠোনে। শুধু দূরের ঝোপে কয়েকটা জোনাকি ভিজে চোখে তাকিয়ে থাকে আরও দূরে গভীর অন্ধকারের দিকে। ওদের নিভুনিভু ঘুমআলোয় কেমন মায়াবী তাঁর চিরনিদ্রাঘর। নক্ষত্র ছড়ানো রাতে মায়েরা বুঝি টিমটিম হ্যারিকেন হয়, জেগে থাকে সকল শিথানে – যেন অপরিহার্য বাতিঘর।

১০.০৫.২০২১

মোমঘর

দেহ এক মোমঘর
কখনও গলে পড়ে কখনও বা স্থির
যেন সৌরসৌধ–

মমিদের কথা মনেপড়ে?

মোমঘরে
আয়নায় আলতার চোখ;
কান্না ধূসর হলে পৃথিবীতে
শুধু এক গানিতিক বোধ
বিয়োগ – বিয়োগ

এসো মোমঘরে যাই
জ্বলে উঠি মমি হই

তারপর পৃথিবীটা শুধু পিরামিড।

জলের ঈর্ষায়

জলের ঈর্ষায় ভেঙ্গে পড়া চাঁদ
কী নিপুন কাটে বায়ুর করাতে
এবং তনুরা
ধর্ষণের অপঘাতে
লাশ হতে হতে
অবশেষে
মেঘের বিবেক

লজ্জায় নত হয় গন্ধমালতি
ইলশেগুড়ি অভিশাপ নামে পৃথিবীতে।

১০.০৪.২০১৮

মাকড়সা

মাকড়সাগুলো রোদ খেতে খেতে উঠে আসতো দাওয়ায় আর খয়েরী পালক খুলে ভীত আরশোলাগুলো পালিয়ে যেতো অন্ধকারে, মিটসেফের নীচে।

আমাদের বাড়ির সামনে এবং পেছনের দৃশ্যগুলো তখন ছিলো একদম আলাদা। সামনের উঠোনে একগাদা রাজাকারের সাথে মুক্তির খোঁজে হঠাৎ হঠাৎ হানা দিতো কিছু পাকি, ঠিক তখনও ঘরের পেছনের কাঠঘরে এবং দোতলার চিলেকোঠায় গা ঢাকা দিয়ে থাকতো চার চারটে হিন্দু পরিবার।
মাঝখানে সুতোর দেয়াল হয়ে ঝুলতেন একা এবং একমাত্র আমার দাদু।

এই একটি দেয়ালের জন্য সামনের বাড়ির সাথে পেছন বাড়ির দেখা হয়নি কখনও। দেয়ালের স্মৃতি বেশীদিন টেকে না।
আমার দাদুর দাড়ি স্বর্গ থেকে উড়ে উড়ে আজও মাকড়সা তাড়াচ্ছে।

রাত নামলে মাকড়সাগুলো এখনো কেমন শকুন হয়ে যায়।

০৯.০৪.২০২০

দেয়ালে আটকে গেছে আস্ত দুপুর

দেয়ালে আটকে গেছে আস্ত দুপুর
রোদের নরুন আঁটা মেয়ে পালিয়েছে আধখানা ভুট্টার ক্ষেতে
তিতিরের ডাক শুনে বাড়িয়েছে ছায়াহাত ঘুমের কৃষক, তুমিও তুলছো হাই
আজ তবে নেই কোনো দোয়েল উৎসব?

মেনকার রূপ আঁকা সজনের ডালে
একটি শালিক লুকিয়ে হলুদ ঠোঁট খুঁজে যাচ্ছে প্রণয়ের বিভা
নদীটির নাম যদি কালীগঙ্গা হয়
তবে তার সানুদেশে মেঘেরা লিখেছে নাম
সিঁদুর-কালিতে
ছায়ার স্তন জুড়ে কিলবিল মনসার নীল
সে দুগ্ধ জানায় টা টা তোমাকে আমাকে
বসন্ত বাতাসে লীন জীবন অচিন।

১৫.০৩.২০২০

অন্ধরাত

ভয় পেওনা–
চলে যাবো বলেছি বলেই যে
আজই চলে যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই,
যাওয়ার সে পথটা কেমন সরু ও ধূসর; ঝরা আর মরা পাতার মর্মরে অদ্ভুত এক বিরান ধ্বনি,
বাতাসে কদমের সাথে গন্ধ লোবানের।

ফুল ঝরে যায়, পাখি উড়ে যায়, জল সরে যায়–
কোনো শূন্যতাই হয়না চিরস্থায়ী ,
আমার অভাব পূরণ করবে বাতাস, আগুন অথবা তীব্র বুটের নীচে বাদাম খোসার ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যাবার কিছু করুণ আর্তনাদ–

ভয় কিসের?
আজ রাতটা থমথমে
চাঁদের চশমায় বাদুড়ের ভয়াল থাবা,
আহ কি বিষন্নতা, কি নিঃসীম অন্ধকার –
চাঁদের ছায়ার মতো মায়ায় তোমাকে ঢেকে দিয়ে
নিশ্চয়ই পালাবোনা আমি।

চির অমাবশ্যার হাত ধরে একজন কবি
আজ তোমার পাশে জেগে থাকবে একটি অন্ধরাত।

ক্ষমা

যদিও ডাকের বাক্সে ধরেছে জং
কাহিল ক্ষুধায় দুপুরের হরকরা
তবুও তোমায় লিখতে বসেছি আজ
কালির সাথে জলের ফোয়ারা মিশে
ফোঁটা ফোঁটা সব মৃত্যুর কলরব

চাইনা এমন নীলের ঠিকানা আমি
পরিজনহীন একাকি ফেরার রথ
চারিদিকে শুধু বিষাদের ধ্বনি আঁকা
ভেন্টিলেটরে জীবনের বুদবুদ
পেয়ালা পেয়ালা করোনার হেমলক

লিখতে বসেছি না বলা দিনের সব
প্রকৃতির সাথে বিরূপের কথকতা
মানুষের সাথে মানুষের বিদ্বেষ
পারমানবিক ভয়াল লড়াই আর
লোভে ও পাপে পরাজিত মানবতা

পৌঁছে দেবে এই চিঠিখানা সময়ের হরকরা
ঠিকঠাক মতো তোমারই সে ঠিকানায়
সময় পেলে দেখে নিও তুমি প্রভু
ক্ষমাতেই জানি মহত্ব তোমার আঁকা
দিও দিও তুমি তাই দিও ঈশ্বর।।

২২.০৪.২০২০

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১