আজ সেই দিন, স্কটিশ হাইল্যান্ড ভ্রমণের চরমপ্রার্থিত দিন। এমনিতে প্রতিদিন ভোর ছটার আগেই আমার ঘুম ভেঙে যায়, কিন্তু আমি যেন জীবনে প্রথম শহরদর্শনে যাওয়া গ্রাম্যবালক, লঞ্চ ফেল করে ফেলার টেনশনে সারারাত নির্ঘুম! পড়ন্ত বয়সে বয়স্ক আমি অবশ্য উল্টোমুখী, শহর ছেড়ে পাহাড় দেখতে যাচ্ছি। উত্তেজনা ও আগ্রহে অবশ্য কোনো কমতি নেই। শরীর বা অবচেতনকে বিশ্বাস কী? ঘড়িতে তিনবার এলার্ম দিয়ে রাখি যথাক্রমে ৫:১৪, ৫:১৯ ও ৫:২৪ মিনিটে। দিলে কী হবে, আমি জেগে উঠেছি দুবার, প্রথমবার মধ্যরাতে ২:২৪; দ্বিতীয়বার ৪:১৪-এ। এরপর চোখের পাতা আর এক করিনি।
বেরিয়ে পড়ি ঠিক ছয়টায়। বাড়ির সমুখে ৬:২৪-এ আসা ৪৯ নম্বর বাস ধরি। কালও এই একই সময়ের বাস ধরেছি। কাল দেখা কিছু চেনা মুখ উঠলো বাসটায়। বুঝি এরা এ সময়ে এ বাস ধরে কাজে যায়। রয়েল মাইল ছাড়িয়ে সার্জন হলের কাছটায় নেমেছি সকাল সাতটারও আগে, হেঁটে আসতে পাঁচ মিনিট লাগলো। গাড়ি ছাড়বে সকাল আটটায়, পর্যটকরা এক এক করে আসতে শুরু করেছে। নীরো কফিশপটি ভরে আছে কফির সুঘ্রাণে, সেই দুই ফর্সা আর সুদর্শনা নারী তাদের কর্মব্যস্ততা আর প্রাণময় হাসি দিয়ে ভরে রেখেছে দোকানটি। কালো পোষাকে তাদের আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তাদেরই মোহে কিনা এক কাপ এসপ্রেসো কফি অর্ডার করে জানালার পাশে বসি। স্টুডেন্ট হিসেবে যে তিন পাউন্ড কনসেশন পেয়েছিলাম, তা অবলীলায় খরচ করে ফেলি সুন্দরী মৌতাতে। এমনিতে কফি আমার প্রিয় পানীয় নয়, কিন্তু এদেশে কফির জনপ্রিয়তা দেখে আমি হতবাক। হেঁটে চলা মানুষদের হাতে যেসব জিনিষ হরহামেশাই দেখা যায়, তার অন্যতম হলো কফিপাত্র। শূন্য কফিপাত্র নিয়েই ভিক্ষুকগুলো পথে বসে ভিক্ষা করে।
দুজন পর্যটক মেয়ে কাছের এডাম স্মিথ ও একটু দূরের ডেভিড হিউমের ভাস্কর্যের ছবি তুলছিলো ডিজিটাল ক্যামেরায়। আমি ওদের ক্যামেরায় ওদেরই ছবি তুলে দেই বিখ্যাত মানুষদের মর্মরের সমুখে। এই করতে করতে আমরা চলে গিয়েছিলাম সেন্ট জাইলস গির্জা ছাড়িয়ে এডিনবরা দুর্গের কাছাকাছি। ফিরে এসে দেখি আমার সহযাত্রীরা সমুখের সবগুলো ভালো সিট দখল করে বসে পড়েছে। বাধ্য হয়ে আমাকে একেবারে পেছনের সারির এক সারি সমুখে ইমার্জেন্সি এক্সিটের পাশে বসতে হয়। পর্যটকদলে একা যাত্রী বোধকরি আমিই, আমার পাশে একজন দীর্ঘকায় আমেরিকান ভদ্রলোক এসে বসলে বুঝি ইনিও দলছুট, একা। আমরা যখন পরস্পরের সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম, তিনি কেন্টাকি থেকে এসেছেন শুনে সমুখের সিটের দুটি মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বল্ল, তারাও কেন্টাকি থেকে এসেছে। বুঝলাম বিভিন্ন দেশের পর্যটকে ভরে আছে কোচখানি। আমেরিকান ভদ্রলোক বললেন, তার পূর্বপুরুষ এই স্কটল্যান্ড থেকেই নতুন ভূখণ্ড আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন এক শতাব্দী আগে। নাড়ির টানেই তার আসা।
আমাদের কোচের যিনি চালক, বেশ মোটাসোটা মানুষটি, খাঁটি স্কটিশ, হাস্যরসে ভরপুর। তিনিই আমাদের গাইড। গাড়িতে ওঠার সময়ে এ গাড়িই হাইল্যান্ড সফরে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে তিনি আমার পেটে আনন্দে হালকা খোঁচা মেরে বল্লেন, আর কোনো গাড়ি কী দেখছো আশেপাশে হাইল্যান্ড বা লোল্যান্ডে যাওয়ার? মজার মানুষ, ইতিহাস জানেন, সারাপথ আমাদের ইতিহাসবর্ণন ও হাস্যরসে মাতিয়ে রাখলেন।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলেছিল আজকের দিনটি রৌদ্রস্নাত হবে, কিন্তু সকালের মুখ গোমড়া, হালকা মেঘে ঢেকে আছে আকাশ, সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কেমন একটা ধোঁয়াটে ভাব। কী আর করা? বিধাতা যদি আমাদের কপালে সূর্য লিখে রাখেন তো সূর্য পাবো, নইলে পাবো না। এডিনবরা ছাড়াতে ফার্থ অব ফোর্থের উত্তরাংশের দেখা পাই, জল দৃষ্টিকে করে তোলে মায়াময়, দৃশ্যপটকে জলময়। এডিনবরার এ অঞ্চলে, ফার্থের তীরে অনেক শিল্প-কারখানা রয়েছে। পাহাড়ি প্রেক্ষাপটে তাদের বেশ গম্ভীর দেখালো। দিনটি ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে দেখে আমাদের মনও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
স্টারলিং এসে গেলো, দূর থেকে স্টারলিং দুর্গ আর স্কটল্যান্ডের জাতীয় বীর ওয়ালেসের টাওয়ার দেখা গেল, নিচে জল, উপরে পাহাড়শ্রেণির অনুপম প্রেক্ষাপটে। আমাদের যাত্রাপথে যে রুট ম্যাপ দেখেছিলাম তাতে স্টারলিং ছিলো, ভেবেছিলাম স্টারলিং থামবে বাসটি। আমাদের চালক কাম গাইড তখন ওয়ালেসের বীরত্বগাঁথা বলে চলেছে তার মুখের কাছে রাখা মাইক্রোফোনে। তার কণ্ঠে আশ্চর্য আবেগ, উইলিয়াম ওয়ালেস তো প্রতিটি স্কটিশের প্রাণে এক দুরন্ত আবেগেরই নাম। ইংরেজ রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো স্কটল্যান্ডের প্রথম স্বাধীনতাকামী ত্রয়োদশ শতাব্দীর এই স্কটিশ বীর একের পর এক যুদ্ধে ইংরেজদের প্রশিক্ষিত বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেই স্থানটি পেরিয়ে যাই যেখানে এন্ড্রু মোরের সাথে যৌথভাবে ১২৯৭ সালে ওয়ালেস ইংরেজ বাহিনীকে স্টার্লিং ব্রিজের যুদ্ধ পর্যুদস্ত করেন । এর পরের বছর ফলকার্কের যুদ্ধে তিনি পরাস্ত হলেও ১৩০৫ সালে গ্লাসগোর সন্নিকটে রবরয়স্টোন নামক স্থানে প্রতারিত হয়ে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি ইংরেজ বাহিনীকে সন্ত্রস্থ করে রাখেন। ধরা পড়ার পরে ক্রুদ্ধ ইংরেজরা যে অমানবিক বর্বরতায় ওয়ালেসকে খুন করে তা শেলের মতো বিঁধে আছে প্রতিটি স্কটিশের প্রাণে। চারজন অশ্বারোহীর হাতে বাঁধা ছিল মাটিতে পতিত ওয়ালেসের চার হাত-পা, তারা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গিয়েছিল চতুর্দিক আর মুহূর্তে ওয়ালেসের দেহ থেকে ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল অঙ্গসমূহ। এই অসমসাহসী বীরের তলোয়ারটি ওয়ালেস টাওয়ারে রাখা আছে। তাঁর জীবনালেখ্য নিয়ে মহাকাব্য লিখেছেন অন্ধ হ্যারি, যার উপর ভিত্তি করে একাডেমিজয়ী বিখ্যাত চলচ্চিত্র ব্রেভহার্ট নির্মাণ করেন পরিচালক মেল গিবসন । বাস যখন বাইপাস দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল আমার হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিলো, ইতিহাস তো কেবল শোনার নয়, সেই স্থানটির দেখা পেলে প্রেমিকার মতো বেশি করে দেখার।
আমরা একটি দারুণ সুন্দর ছোট্ট শহরে এসে পড়ি, এর নাম কালান্ডার, মনে হলো ‘দমাদম মাস্ত কালান্দার’, তবে এটিই বেশি মনে হলো যে ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে নেমে উপত্যকায় বসে আছে শহরটি। সেখানে নদীর উপরে সেতু পেরুবার সময়ে ডুন দুর্গের চূড়া দেখলাম। ক্যামেরা বের করতে করতেই আড়ালে চলে গেলো, অনেকক্ষণ ক্যামেরা বাগিয়ে বসে থাকি, যদি সে ধরা দেয়, কিন্তু জীবনে একবারই আসা অসংখ্য সুযোগের মতো সেও আর ফিরে এলো না।
আমরা নামার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। বাস অবশেষে থামলো পাহাড়বেষ্টিত একটি নয়নাভিরাম জায়গায়। জায়গাটির নাম জিজ্ঞেস করতে গাইডের হাতে পুনর্বার বন্ধুসুলভ খোঁচা খেলাম, সে আমার মুখখানি ধরে একটি সাইনবোর্ডের দিকে ঘুরিয়ে দিলো, সেখানে পরিষ্কার ইংরেজিতে লেখা কিলমাহগ। পাশেই একটি লোমওয়ালা পাহাড়ি গরুর ছবি, স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত বন্য পাহাড়ি গরু, এর নাম ‘হামাশ’। কোথায় পাবো তারে? না, আজ পৃথিবীতে একটি হামাশও বেঁচে নেই। প্রকৃতির বৈরীতা ও মানুষের ক্রুড়তায় বিলুপ্ত অসংখ্য প্রাণীর মতো হামাশও বিলুপ্ত। ছবি দেখে তৃষ্ণা মেটানো ছাড়া উপায় নেই। এই ছোট্ট গ্রামে রয়েছে একটি উইভিং মিল, নাম ট্রোসাডস, মিলে উৎপন্ন বিভিন্ন উলেন বস্ত্রাদি বিক্রি হচ্ছে বৃহৎ দোকানটিতে। ভেতরে একটি চমৎকার কফিশপও রয়েছে। কেবল আমরাই নই, আরও কিছু ট্যুর কোম্পানির বাস পার্কিংলটে থেমে আছে। তবে ভেতরের ওই সম্ভার নয়, আমাকে টানলো বাইরের দৃশ্য। বরফাবৃত পাহাড় লেডির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে রইলাম। স্কটিশ ভাষায় পাহাড়কে বলা হয় বেন সে হিসেবে এর নাম বেন লেডি। বরফের মুকুট পরে সে আমাদের দৃষ্টিসীমায় বিশ্বসুন্দরীর মতো আটকে রইলো।
কিলমাহগ ছাড়াতেই সূর্য তার দেদীপ্যমান রূপ নিয়ে আমাদের মনের আকাশের সব মেঘ, কুজ্ঝটিকা সরিয়ে সারা রাজ্য ছড়ালো। আমাদের গাইড বললেন গত তিন সপ্তাহে এত সুন্দর আবহাওয়া তিনি দেখেননি। তাহলে গতকাল কোচের টিকেট না পেয়ে আমার ভালোই হয়েছে। বাস যখন দু’পাশে পাহাড়শ্রেণির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আর বুঝতে কষ্ট হয় না স্কটিশ হাইল্যান্ডে প্রবেশ করেছি। এর মাঝে একটি লেক চলে আসে দৃশ্যপটে, কিন্তু হায়, আমি যেপাশে বসেছি তার বিপরীতে, ছবি তোলার কোনো ফুরসৎই নেই আমার। কিছুটা ফবংঢ়বৎধঃব হয়ে কোচের সমুখে রাখা একটি খালি সিটে চলে যাই। এ দুটি সিট চালকদের জন্য সংরক্ষিত। আমাদের বাসে দু’জন চালক, দ্বিতীয়জন তারই একটিতে বসে আছেন। যিনি চালাচ্ছেন তার বিপরীতে ইনি সুঠাম দেহের, শ্রশ্রুমণ্ডিত এবং আশ্চর্য নির্লিপ্ত। প্রথমজন যেখানে ভীষন আমুদে, ইনি সেখানে রসকষহীন। দু’জনের মিলটি হলো দুজনেই ট্রাডিশনাল স্কটিশ পোষাক পরে আছেন, অর্থাৎ ওই তীব্র শীতেও মেয়েদের ফ্রকের মতো খাটো বস্ত্র। ভেবেছিলাম এরা দু’জন পালা করে গাড়ি চালাবেন, পরে দেখলাম না, ইনি এই কোম্পানিতে নতুন জয়েন করেছেন, আজ এসেছেন প্রশিক্ষিত হতে। নির্লিপ্ত হলেও অতিভদ্র মানুষটি, তার পাশের সিটটি নিতে তিনি আমাকে নিরস্ত করলেন না। হ্রদটির ওপাশে পাহাড়শ্রেণি, এপাশেও তাই, তীর ঘেঁষে পথ গেছে, অবিরত সৌন্দর্যময় সে পথের যেন শেষ নেই।
আমরা এসে পড়ি পাহাড়ে পাহাড়ে পূর্ণবেষ্টিত এক বিশাল প্রকৃতির মাঝে। অনেক পাহাড়ই বরফে ঢাকা, এ দৃশ্য আমার চোখে নতুন। দু’পাশের অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য দেখে নিসর্গপ্রেমী আমি উচ্ছসিত, সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো। ছবি তুলতে থাকি অবিরত, কখনো স্টিল, কখনো চলমান, মনে হয় সেলুলয়েড ফুরিয়ে যাবে, দৃশ্য ফুরাবে না। ওপাশের পাহাড়ে একটি রেলসেতু দেখলাম, রেললাইনটিও বোঝা যাচ্ছিল, রেলপথ বা সেতু এখন পরিত্যক্ত, অতীতের স্মৃতিমাত্র। বাস যাচ্ছিলো পাহাড়সমূহের কাছ দিয়ে, বাঁক ঘুরলেই অভিনব সব পাহাড় এসে দাঁড়ায় দৃষ্টির ফ্রেমে, অনেকক্ষণ ধরে তাদের রূপময় উপস্থিতি নিয়ে স্থির থাকে, চলমান পর্যটকের দল ঘাড়ব্যাথা নিয়ে তাদের দেখে।
একটি অসামান্য জায়গায় এসে পড়ি, এক বিশাল উপত্যকার ওপাশে একটি পর্বতমালা, পরে তার নাম জেনেছি, নেভাস রেঞ্জ, প্রতিটি পাহাড় বরফে আবৃত, কী যে মোহময় তাদের উপস্থিতি! আমার মন বলে উঠলো স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তবে তা রয়েছে এই উপত্যকায়। সেখানে, যেন ওয়াচ টাওয়ার, একটি ভাস্কর্য রয়েছে, আমাদের আগে পৌঁছানো কিছু পর্যটকবাহী কোচ ও গাড়ি পার্ক করা দেখে বিশ্বাস করলাম এখানে নিশ্চয়ই গাড়ি থামবে। স্টারলিংয়ের মতো এখানেও কোচটি না থামায় মনে মনে ক্ষুব্ধ হলাম। ‘এক্সপেরিয়েন্স’ কোম্পানি তো আর কবির কথায় চলবে না, তাদের রুটপ্ল্যান করাই আছে।
আমাদের চালক-কাম-গাইড তখন বলে চলেছেন রব রয় নামক স্কটিশ হাইল্যান্ড ডাকাতের ইতিহাস। শাসক ইংরেজের চোখে ডাকাত হলেও সে তো আসলে আরেক স্কটিশ নায়ক, স্কটিশ ‘রবিনহুড’।
প্রথম যৌবনে তিনি জ্যাকোবাইটদের পক্ষে ইংরেজ ও স্কটিশদের যৌথ বাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি একজন ধনী কৃষকে পরিণত হন। সে সময়ে স্কটল্যান্ডের প্রধান কৃষিকাজ ছিলো গবাদি পশুপালন। নিজের পশুপালকে বর্ধিত করার জন্য তিনি মন্টরুজের ডিউক জেমস গ্রাহামের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ (এটা অবশ্য সেসময়কার বিচারে, ঋণের পরিমান ছিলো ১০০০ পাউন্ড) ঋণ নেন। তার প্রধান পশুপালক কিনে আনা পশুদল নিয়ে গায়েব হয়ে গেলে রব রয় দেউলিয়া হয়ে যান। ঋণ ফেরৎ দিতে অক্ষম হওয়ায় তিনি অপরাধী সাব্যস্ত হন। জেমস গ্রাহাম রব রয়ের ভূসম্পদ ও খামার দখল করে নিলে তিনি দীর্ঘকাল ডিউকের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। অবশেষে আত্মসমর্পণে বাধ্য হলেও তার বীরত্বপূর্ণ লড়াই রূপকথার মর্যাদা পেয়েছে।
আমাদের যাত্রাপথটি ভরে থাকে পাহাড় আর হ্রদের মিলিত সৌন্দর্যে। অনিবার্য মনে পড়ে যায় পার্বত্য চট্টগ্রামের নিসর্গের কথা। যত্ন নিলে আমরাও পর্যটকদের জন্য গড়ে তুলতে পারি এমন অনিন্দ্যসুন্দর যাত্রা-অভিজ্ঞতা। একদিকে চালকের আবেগপূর্ণ বর্ণনা, অন্যদিকে তিনি ক্লান্ত হলে রেকর্ডপ্লেয়ার থেকে রেকর্ডেড ইতিহাস বর্ণন চলে। ভূগোল দেখব কী, ইতিহাসের ভারে নিমজ্জিত হয়ে থাকি। মনে মনে বলি, ইতিহাস আমি উইকিপিডিয়াতে পাবো, কিন্তু এই বিরল ভূগোল দৃশ্য জানালার পাট থেকে একবার চলে গেলে আর পাবো না। তাই ইতিহাসের দিকে সামান্য কান খোলা রেখে আমি প্রাণভরে দেখতে থাকি প্রান্তর, পাহাড়, হ্রদ। সে সৌন্দর্যের বুঝি কোনো শেষ নেই! চালক তখন বলতে শুরু করেছেন গ্লেনকো ট্রাজেডির মর্মান্তিক ইতিহাস!
যাত্রাপথে রয়েছে গ্লেনকো নামের এই ঐশ্বরিক সৌন্দর্যের স্থান। তার প্রকৃতিকে অপরূপ করে তুলেছে একটি জলাশয়, যার অন্যপ্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগর। প্রথমে ভেবেছিলাম হ্রদ, পরে জেনেছি ওটি একটি হাওড়, সারাবছর পানি থাকে না। হ্রদ হোক কিংবা হাওড়, রূপে সে অনন্য, গ্লেনকোর রাজকুমারী। এই স্বর্গসম ভূমিতে ১৬৯২ সালে ঘটে এক বর্বর হত্যাযজ্ঞ। দিনটি ছিলো ১৩ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির মতো স্কটিশরাও খুব অতিথিপরায়ণ জাতি। এই অতিথিপরায়ণ স্বভাব আর ঐতিহ্যের কারণেই সেনাধক্ষ্য রবার্ট ক্যাম্পবেলের সেনাবাহিনীকে আশ্রয় দিয়েছিলো গ্লেনকোর গ্রামবাসী। এর আগে ১৬৮৯ সালে জন গ্রাহামের নেতৃত্বে জ্যাকোবাইট বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। জ্যাকোবাইটরা ইংল্যান্ডের সিংহাসন থেকে বিতারিত রাজা দ্বিতীয় জেমসের পক্ষে লড়াই করছিলো, ডানকেল্ডের যুদ্ধে তারা ক্যামেরোনিয়ান বাহিনীর হাতে পুরোপুরিই পরাস্ত হয়। স্কটিশদের রাজা ছিলেন উইলিয়াম, যাকে ‘প্রিন্স অব অরেঞ্জ’ বলা হয়, তাদের সাথে গ্লেনকোর ম্যাকডোনাল্ড গোষ্ঠির বিরোধ তখন তুঙ্গে। সেই বাস্তবতার নিরিখে শত্রু সৈন্যদলকে আশ্রয়দান ছিল বোকামী। গ্লেনকোবাসীর সরল আতিথ্যের চূড়ান্ত অপমান আর বিশ্বাসঘাতকতা করলো ক্যাম্পবেল বাহিনী, তারা তাদেরই আশ্রয়দাতা স্কটিশদের রাতের অন্ধকারে নির্বচারে হত্যা করতে লাগলো। শান্তিময় গ্রামটিতে রক্তের নদী বইয়ে দেয় কৃতঘ্ন ক্যাম্পবেল বাহিনী, স্বর্গের উদ্যানে নারকীয় তা-ব নেমে আসে। নিহত হন গ্লেনকোর ম্যাকডোনাল্ড ক্লানের ৩৮ জন গ্রামবাসী, আগুনে পুড়ে মারা যান ৪০ জন নারী ও শিশু। অল্প কিছু মানুষ পালিয়ে পাহাড়ে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন। বর্বর ক্যাম্পবেল বাহিনী চলে যাওয়ার পরেও তারা আর প্রিয় জন্মস্থানে ফিরে আসেননি; বহুবছর গ্লেনকো রয়ে যায় পরিত্যক্ত। আজকের গ্লেনকো আসলে নবনির্মিত। খুব ইচ্ছা হচ্ছিলো গ্লেনকোতে যাত্রাবিরতি করি, আমাদের নির্দয়(?) চালক সেখানেও বাস থামালেন না। মনে হলো কী এক অদৃশ্য পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগুচ্ছেন।
দুই.
স্কটল্যান্ডের মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হবে দুটো নেকড়ে জাতীয় প্রাণীর সরু মুখ নর্থ সীর দিকে তাকিয়ে আছে। আশ্চর্য যে গোটা স্কটল্যান্ডে কোনো ভয়ঙ্কর প্রাণী নেই, সত্যিকারের অভয়ারণ্য যাকে বলে, হাইল্যান্ড আসলে তাই। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যে প্রাণী এই স্বর্গীয় প্রকৃতিকে রক্তাক্ত করে তুলেছে তার নাম মানুষ। প্রাগৈতিহাসিক যে বিপুল ভূগর্ভস্থ লাভার উদগীরণে এই পাথুরে ভূখণ্ডের সৃষ্টি, যেন সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এসেছে এই দ্বীপ, তাতে কত যে হ্রদ, কত যে নদী আর জলাশয়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। পাহাড়ের প্রহরা তো রয়েছেই। কালান্ডার শহরের পাশ দিয়ে গেছে টীথ (Teith) নদী, যার সেতুর উপর থেকে ডুন দুর্গের চূড়া দেখেছিলাম। আর যে দীর্ঘ জলাশয়ের পাশ দিয়ে বাস ছুটেছিল, যার ছবি তুলতে আমি সিট ও পার্শ্ব বদল করে ওপাশে চলে গিয়েছিলাম তার নাম Garbh Uisage। এখানে আরেকটি বিশাল হ্রদ ছিলো যার নাম লক আর্ন, আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকায় দেখা হয়নি। স্কটিশ ভাষায় লেককে লক বলা হয়, কাছের লক ভলি অবশ্য সরু নদীর মতো ক্ষীণকায়। আমরা এতক্ষণ এ৮৪ মোটরওয়ে ধরে ছুটেছি, ঢুকে পড়েছি বিস্ময়ের রাজ্য স্কটিশ হাইল্যান্ডে। লক আর্নের কাছে একই যাত্রাপথ এ৮৫ নাম ধারণ করলো। এখানে ওলগা বার্ন নামক আরেকটি সরু নদীর মতো লম্বা জলাশয় দেখলাম। পাহাড়, উপত্যকা, নদী আর হৃদের মিলিত কোলাজে স্বর্গের প্রতিরূপ নির্মিত, বিস্ময়ের পর বিস্ময়! শৈশবে পাঠ করেছি, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি’-দেশপ্রেমে টানটান। যে কোনো দেশপ্রেমিকের চোখেই তাই, নিজের দেশই সেরা, কিন্তু একথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলার কবি স্কটিশ হাইল্যান্ড দেখলে হয়তো দ্বিতীয় লাইনটির ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্থ হতেন।
আমরা যাচ্ছিলাম পাহাড়ে-হ্রদে পাল্টাপাল্টি বা সম্পুরক এক অনিন্দ্যসুন্দর ভূগোলের মধ্য দিয়ে। ঈশ্বর যদি আমাদের গ্রহে বসবাসের জন্য কোনো জায়গা বেছে নেন, আমার ধারণা তিনি স্কটিশ হাইল্যান্ড বেছে নেবেন। ক্রেইনলারিচ নামক স্থানের কাছে এ৮৫ ছেড়ে আমাদের গাড়ি এ৮২ অনুসরণ করে এগুলো। দুটো মোটরওয়ের সংযোগস্থলের কাছেই ফিলান নদী, যার কাছেই গ্লেনকো গ্রাম। গ্লেনকোর পাশে যে হ্রদ তার নাম লক লেভেন। অনিন্দ্যসুন্দর সে জলাশয়! এ৮২ অনেকগুলো বৃহৎ হৃদের পাশ দিয়ে চলা মোটরওয়ে। সবচেয়ে কাছে লক লিনহে, বেশ প্রশস্ত, আইল অফ মুলের পাশ দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে মিলেছে। এর সাথে একই সরলরেখায় রয়েছে আরও তিনটি বৃহৎ হৃদ- লক লচি, লক ৗইচ এবং লক।নেস পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ প্লেটগুলো যখন পরস্পরের কাছ থেকে সরে গিয়ে নতুন মহাদেশ তৈরি করছিলো, যখন আফ্রিকা থেকে সরে গিয়ে দক্ষিন আমেরিকা তৈরি হলো, সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে স্কটল্যান্ডের দু’টো প্লেট সরে গিয়ে তৈরি হয়েছে এই সুগভীর, চওড়া হ্রদগুলো। ব্রোঞ্জ যুগের পরে সংঘটিত ভূপৃষ্ঠের (Earth Crust) এই বিযুক্তিকে গ্রেট গ্লেন ফল্ট বলা হয়। একই সরলরেখায় সীমান্ত টেনে দেয়ার মতো এমন নয়নকাড়া সুগভীর চারটি হ্রদ পৃথিবীর কোনো ভূ-ভাগেই নেই।
বাস স্টারলিং থামেনি, গ্লেনকো থামেনি, এমনকি থামেনি স্পিয়ান ব্রিজ, আমাদের হতাশা অনুভব করেই কিনা, চালক একটি নৈসর্গিক স্থানে বাস থামালেন। এ৮২ মোটরওয়ের পাশেই এই পাহাড়বেষ্টিত নয়নাভিরাম স্থানটি। সেখানে যে পর্যটকবাহী গাড়িগুলো থামে তা বোঝা যায় মোটরওয়ে থেকে নেমে আসা পথ বেয়ে প্রশস্ত এক স্থান সুচিহ্নিত করে রাখার মধ্যে। মনে হলো মাটির পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন ভিনগ্রহের নিসর্গে নেমেছি। চারপাশে পাহাড়, পার্কিংলটের সাথেই একটি পাহাড়ি ঝর্ণা, তবে সে শায়িত, উর্ধ্ব থেকে পতিত নয়। তার উপর দিয়ে লোহার সেতু চলে গেছে ঝর্ণার ওপাড়ে, কাছের পাহাড় বরাবর চলে গেছে পথ, সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে একটি অনিন্দ্যসুন্দর বাড়ি। কে বানিয়েছে, কে জানে, তবে সমগ্র প্রকৃতির মাঝে তার একক অবস্থান তাকে এমনিতেই অনন্য করে তুলেছে, স্থাপত্যসৌন্দর্য করে তুলেছে তুলনারহিত। আমার পর্যটক সহযাত্রীদের অনেককে এই প্রথম ক্যামেরা বের করতে দেখলাম, তারা প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে নিজেদের চেহারা ও দেহ আবদ্ধ করে রাখলেন ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। একটি মেয়েকে দেখলাম ঐতিহ্যবাহী স্কটিশ পোষাক পরা আমাদের বাসের দুজন চালকের সাথে ছবি তুলছে, দেখাদেখি আমিও, তুলে দেয় সেই মেয়েটিই। সেতুর উপরে গিয়ে দাঁড়াই আর ঝর্ণাটির রূপ দেখতে থাকি। ইচ্ছে ছিল সেতু পেরিয়ে ওই নির্জন পর্বতদুহিতার কাছে যাবো, কিন্তু বাসে উঠে পড়ার ডাক এলো।
বাস ছাড়তেই সমুখের যে পাহাড়শ্রেণি দেখি, তাতে দু’টো অনুচ্চ পাহাড় মুখোমুখি, যেন একটি স্টেডিয়াম স্পষ্ট দেখা গেলো। চালক জানালেন এখানেই হ্যারি পটার সিরিজের একটি চলচ্চিত্র গবলেট অব ফায়ারের স্টেডিয়াম কেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার চিত্র ধারণ করা হয়েছিল ওই পাহাড়বেষ্টনীর প্রকৃতিতে একটি ভার্চুয়াল স্টেডিয়াম সুপারইম্পোজ করে। আমার মনে পড়ে গেল কলেজ জীবনে পাঠ্য সেই ইংরেজি টেক্সট ‘মেকিং এ ফিল্ম’এর কথা, যার শেষ বাক্য ছিল, ‘Nothing is real in the world of a film’। কেবল হ্যারি পটার নয়, এখানে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে জেমস বন্ডের সর্বশেষ ছবি স্কাইফল। বলে রাখা ভালো জেমস বন্ড চরিত্রে অভিনয় করা সবচেয়ে বিখ্যাত নায়ক সীন কনোরি এই স্কটল্যান্ডেরই সন্তান।
বাস ফোর্ট উইলিয়াম এসে পৌঁছালো। খড়পয লক লিনহের পাশে পাহাড়ঘেরা ফোর্ট উইলিয়াম তুলনাহীন সৌন্দর্যের এক স্থান। হ্রদে অনেক জলযান, ওপাশে পাহাড়ের প্রাচীর, ধূলিকণাহীন নির্মল বাতাস, শীতের সম্ভ্রান্ত আবরণ, মন নেচে উঠলো আনন্দে। এ এমন এক স্থান যা আমি কখনো দেখিনি, যার মতো তুলনীয়ও কিছু দেখিনি। এখানেই বেন নেভিস, কেবল স্কটল্যান্ডের নয়, সমগ্র ব্রিটেনের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় (উচ্চতা ১৩৪৪ মিটার)। আমাদের বাস বেন নেভিসের পাদদেশে এক রেস্তোরাঁর কম্পাউন্ডে পার্ক করলো, সময় দেওয়া হলো মাত্র ১২ মিনিট। নেমে কিছুক্ষণ বেন নেভিসের চূড়া দেখার চেষ্টা করলাম, পরে বাস থেকে অনেকক্ষণই তাকে দৃষ্টির সীমায় পাওয়া গেলো। রেস্তোরাঁটিতে ঢুকে মন প্রসন্ন হয়ে গেলো, এরা এদের প্রতিটি রেস্তোরাঁকে কী চমৎকার সাজিয়ে রেখেছে, কিন্তু কোনটির সাথে কোনটি মিলবে না। ক্ষুধা লেগেছিলো, অর্থসংকটে কত আর কষ্ট দেবো নিজেকে, একটা ডেনিস ফ্রুট পাই আর কফি নেই ২.৯৫ পাউন্ড দিয়ে। খাওয়ার অমন চমৎকার পরিবেশ আমি কোথায় পাবো? একমাত্র টেনশন নির্ধারিত ১২ মিনিটে খাবার শেষ করতে পারবো কি না। ভরসা ছিলো আমাকে ফেলে ওরা যাবে না, বিশেষ করে দু’জন চালকই আমায় ভালো করে চেনে। এখানে নয়নাভিরাম লেক লিনহে বাঁক নিয়ে লেক ইল নাম পরিগ্রহ করেছে, বা হতে পারে সেটি একটি আলাদা হ্রদ, টানা জলের মাঝে যদিও কোনো প্রাচীর বা সীমারেখা নেই, বাংলাদেশের অনেক নদীর নামের মতো।
ফোর্ট উইলিয়াম থেকে একটানা গাড়ি চালিয়ে আমরা এসে পড়লাম ফোর্ট অগাস্টাসে। যুদ্ধবাজ ইংরেজরা স্কটল্যান্ডের বিভিন্নস্থানে দুর্গ নির্মাণ করেছিল স্কটিশ বিদ্রোহ দমনের জন্য, সেসব দুর্গ ঘিরে গড়ে উঠেছে শহরগুলো, যাদের মূল প্রবাহ পর্যটকদল, নিসর্গের টানে যারা চলে আসে দূর-দূরান্তের এসব অঞ্চলে। ফোর্ট অগাস্টাস বিখ্যাত তার দুর্গটির জন্য নয়, তার পাদদেশে যে হ্রদটি রয়েছে সেটি স্কটল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত, সবচেয়ে সুন্দর হ্রদ, এর নাম লক নেস। ২৩ মাইল দীর্ঘ হ্রদখানি নর্থ সীর সাথে আরও কিছু হ্রদের মালা পড়ে আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। দুপ্রান্তে লোনাজল হলেও হ্রদগুলোর জল স্বাদু। বলা হয়ে থাকে এই হ্রদে যে পরিমান পানি রয়েছে, সমগ্র ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সবগুলো জলাশয়ে সে পরিমান পানি নেই। এর গভীরতা অবিশ্বাস্য, আইফেল টাওয়ার ডুবে যাওয়ার মতো গভীরতা। আশ্চর্য যে সারাবছরই, কী গ্রীস্ম, কী শীত, হ্রদের জলের তাপমাত্রা একই থাকে মাইনাস ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর কখনোই তার জল জমে বরফ হয়ে যায় না।
এই হ্রদ ঘিরে গড়ে উঠেছে খড়পশ লেক নেসের দৈত্যের কল্পকাহিনী। স্কটিশরা বিশ্বাস করে এই সুগভীর আর সুবিস্তৃত লেকের তলদেশে এক দৈত্য বাস করে। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে কেউ কেউ তাকে দেখেছে বলেও দাবী করেছে, যদিও সেসবের কোনো বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই, নেই অকাট্য প্রমাণ। লক নেস মনস্টারে যারা বিশ্বাস করে তাদের অন্যতম আমাদের বাসের চালক, যিনি ফোর্ট অগাস্টাস আসার পথে কল্পিত দৈত্যটির বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী শুনিয়ে আমাদের মাঝে শিশুতোষ ভীতি জাগিয়ে তুলতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেননি। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলতে থাকা পর্যটকদের মাঝে কতজন মনস্টারটির অস্তিত্ব বিশ্বাস করে তা জানতে চাইলে ৩০ জন যাত্রীর সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৮ জন হাত তুলে জানায় তারা বিশ্বাস করে হ্রদের অতলে অতিপ্রাকৃত শক্তি অবস্থান করে। আমরা বাকি ১২ জন সন্দেহবাদীকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখাতে লাগলেন আমাদের গাড়ির চালক, যাকে ওই মুহূর্তে মনে হলো পৌরাণিক ও ভূতুড়ে গল্পে আস্থাশীল এক বালক। কেবল আস্থাশীল নয়, গভীরভাবে বিশ্বাসী, অবিশ্বাসীদের পরিণতি ভেবে যিনি শঙ্কিত।
ফোর্ট অগাস্টাসে যেখানে আমরা নেমেছি সেখানে লেক নসের শুরু, উত্তর-পূর্বে ২৩ মাইল একটানা চলে যাওয়া হ্রদটি মিলেছে নর্থ সীর সাথে। আটলান্টিক মহাসাগর থেকে নর্থ সী যাবার একটানা বাঁধাহীন নৌপথ ছিলো না। থমাস টেলফোর্ড নামের একজন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রকৌশলী অষ্টাদশ শতাব্দীতে ক্যালেডোনিয়াণ ক্যানেল নামের জাহাজ চলাচলের উপযোগী জলপথটি খনন করেন। আমরা এসে দাঁড়াই মানব প্রযুক্তির এক অনুপম নিদর্শণ ক্যালাডোনিয়ান খালের উপরে নির্মিত সেতুরূপী বাঁধের উপর। খালটি হ্রদের চেয়ে অনেকটা উঁচুতে, তাই মেক্সিকো ক্যানেলের মতো এখানেও কয়েকটি ধাঁপে জাহাজকে জলের এক পিঠ থেকে অন্যপিঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। এই খাল ব্রিটিশ নৌযানগুলোকে নির্বিঘ্নে এক সমুদ্র থেকে অন্যসমুদ্রে পারাপার করে দিতো, কেননা প্রাকৃতিক হ্রদগুলো ছিল তাদের ডুবে থাকা পাহাড়চূড়া নিয়ে ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক। ক্যানেল তৈরির আগে এসব হ্রদে এত বেশি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে যে এদের বলা হতো ‘Graveyard of naval vessels’।
আমরা ফোর্ট অগাস্টাসে পৌঁছেছি দুপুর সাড়ে বারোটায়। চালক আমাদের জানালেন যারা লক নেসে নৌবিহারে যেতে চান তারা যেতে পারেন, পরবর্তী নৌযাত্রা বেলা একটায়। এক ঘণ্টার নৌবিহার শেষে আধা ঘণ্টার সময় পাওয়া যাবে, বাস রওয়ানা হবে দুপুর আড়াইটায়। যাত্রাপথেই নৌবিহারের টিকেট বিক্রি হয়েছিলো, বারো পাউন্ড দাম হওয়ায় আমি তখন কিনিনি, কেননা আমার পকেটে আছে সাকুল্যে ১৭ পাউন্ড। পরে লক নেসের সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে, আর নৌযানটির রাজহংসীসম ভাবভঙ্গী দেখে মনে মনে ভাবি টাকা আমি জীবনে অনেক পাবো, কিন্তু এই বিরল নৌবিহারের সুযোগ আর পাবো না। মনে মনে লাঞ্চ খাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিয়ে চোখ বন্ধ করে টিকেট কেটে নেই, বাসে না কাটার দ- দিতে হলো পঞ্চাশ পেন্স বেশি, অর্থাৎ ১২.৫ পাউন্ড।
লঞ্চে ওঠার আগে হ্রদের পাশে গিয়ে ক্ষণিক দাঁড়িয়ে ছিলাম। নীল আকাশের সবটুকু রঙ বুকে ধরে সে এক নীলসমুদ্র যেন, তার রূপ মুগ্ধ করে রাখে সকল পর্যটকের চোখ। বেলা একটার দলটি বেশ ভারি, লঞ্চটি টইটুম্বুর না হলেও ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ হলো। দোতালা লঞ্চটির নিচের খোলের ভেতরেই বেশির ভাগ মানুষ ঠাঁই নিলো, কেননা সেখানে বসার ব্যবস্থা আছে, সেখানে উষ্ণতা ঢের, কী মানবিক, কী জলবায়ুর। একটি বাংলাদেশী পরিবারেরর সাক্ষাৎ পাই, এরা এদেশেই থাকে, এসেছে বার্মিংহাম থেকে। তবু আমরা যারা নিসর্গলোভী তারা বাইরের কনকনে ঠাণ্ডা না হোক, শীতার্ত বাতাস উপেক্ষা করে বাইরের ডেকে, লঞ্চের সমুখে গিয়ে ঠাঁই নেই, প্রাণভরে দেখি লক নেস-এর অপার সৌন্দর্য। এমনিতে পদ্মাপারের মানুষ আমি, আমার রক্তস্রোতের ভেতর মিশে আছে জলভ্রমণ, লঞ্চযাত্রার সাথে আমি আশৈশব পরিচিত, কতবার যে গ্রামের বাড়ি থেকে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়ে ঢাকা এসেছি তা অগুণিত। লক নেস নৌ-ভ্রমণে আমার মনে পড়ে গেলো ২২ বছর আগে প্রথমবার বিলেতভ্রমণে এসে লেক ডিস্ট্রিক্টে উইন্ডারমায়ারে হ্রদে নৌবিহারের বিস্মরণঅযোগ্য স্মৃতি। দু’পাশে পাহাড়, মাঝে এই চওড়া জলপ্রবাহ চলে গেছে অনির্ণেয় সীমাহীনতার দিকে। একটি পাহাড়ের কাছে কিছু ভেঙে পড়া পাথরের গড়ানো খ- চোখে এলে গাইড বলেন হ্রদের দৈত্যটিকে মারার অভিপ্রায়ে এখানে তাবু গেড়েছিলেন এক স্কটিশ, বহু অপেক্ষার শেষে একদিন সত্যি জল ও কল্পনা ছিন্ন করে গল্পের দৈত্যটি নাকি উঠে এসেছিলো। তাকে বধ করবেন কি, তার উপস্থিতির বিহ্বলতা আর আতঙ্কে জমে গিয়েছিলেন বীর মানুষটি। জড়ো করা পাথর আর ছোঁড়া হয়নি।
আমরা যখন লক নেসে ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন সূর্য আকাশে প্রভাময়ীর প্রদীপ্ত ভূমিকায়। কী উজ্জ্বল দিন! কখনো ডেকের অভ্যন্তরে চোখ গেলে চোখে পড়ে সূর্যকিরণে উজ্জ্বলিত তিন শুভ্র কুমারীর প্রাণোচ্ছল উপস্থিতি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো এক স্প্যানিশ যুবক, অন্য পাশে এক চীনা জুটি, হতে পারে সদ্য বিবাহিত বা সদ্যপ্রেমে পড়া, লেক দেখবে কী নিজেদের দেখাই তাদের শেষ হয় না। আমার দায়িত্ব পড়ে যুগলের ছবি তুলে দেয়ার, কত যে ভঙ্গী আর উচ্ছাস যুগলের! আমাকে রোমান্টিক চলচ্চিত্রের ক্যামেরামানের ভূমিকাটি নিতে হয়। এ্যাঞ্জেলা নামের এক স্কটিশ রমণীর সাথে কথা হলো বোটে। সে আমায় জানলো, গতকাল সে আর তার সাথীরা চোখের সামনে দৃশ্যমান পাহাড়টির শিরদাঁড়া বেয়ে ১২ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিল। পাহাড়চূড়া থেকে লেক নেসকে কী অপূর্ব দেখায় তা সে আমায় জানালো। ফিরে আসার পথে ওপাড়ে একটি ছোট দুর্গ ঠিক নয়, পাথুরে প্রাসাদ, তার শীর্ষে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ছে, তার কাছে, যেন দানাপানির লোভে তীরে ভীড় করা হাঁস, জাহাজটি ধীরে চলে এলো। আমাদের রৌদ্রস্নাত নীলভবহ্রদে ভ্রমণ পুরোদিন হলে কী ক্ষতি হতো। না, টিকেট কেটে আরেকদল তখন তীরে অপেক্ষায়।
এরপরে আমাদের ইনভারনেস যাওয়ার কথা। স্কটিশ মানচিত্রে সেটিই সর্বউত্তরের বড় শহর। এরপরে মানচিত্রের যে অংশটি, বৃহৎ হ্রদসমূহের ওপাড়ে তা জনবিরল (সমগ্র স্কটল্যান্ডই জনবিরল), অসংখ্য দ্বীপ, সমুদ্র, জলাশয় আর পাহাড় নিয়ে গ্রহটির আরেক লীলাভূমি। জানা গেলো ইনভারনেসের পথে ভূমিধসের কারণে মোটরওয়ে বন্ধ, আমাদের সেপথে যাওয়া হবে না। যে পথে এসেছিলাম সে পথ ধরে কিছুটা দক্ষিণে নেমে আমরা এবার স্কটিশ হাইল্যান্ডের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্ব প্রান্তে পাড়ি দেবো। ইনভারনেস দেখা হলো না, হাইল্যান্ডের মধ্যভাগ দেখা হলো। ফোর্ট অগাস্টাসে গিয়ে বোট ধরার তাড়া নেই, আছে রাত আটটা পর্যন্ত কাটানোর অলস সময়। চড়াইয়ের পথে যেসব নয়নাভিরাম স্পট উপেক্ষা করে গিয়েছিলো আমাদের চালক, এক এক করে সেসব স্পটে বাস থামাতে লাগলো।
প্রথমে নামলাম লক লচির পাশে। অনুপম সুন্দর সে জায়গা। আরেক দফা ফটোসেশন হলো সেখানে। এরপরে চলে এলাম সেই বরফের পাহাড় বেষ্টিত অনুপম উপত্যকা স্পিন ব্রিজে। সমগ্র নেভাস রেঞ্জ পর্বতমালার সমুখে তার রূপদর্শনের প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁড়ানো এই প্রান্তরখোলা উঁচুস্থানে ব্রিটিশরা তাই বানিয়েছে যা দেখা যায় ব্রিটেনের সর্বত্র- যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিস্তম্ভ। এর নাম কমান্ডো মনুমেন্ট, পাথুরে শরীর নিয়ে নাম-না-জানা প্রতীকি সৈনারা পর্বতের প্রহরায় থেকে যাবে বহুকাল যতদিন পর্যন্ত পৃথিবী যুদ্ধকে ঘৃণা করতে শিখবে। ততদিন ভাস্কর্যের গাম্ভীর্য আর তার অলৌকিক চতুর্পার্শ্বের নান্দনিকতা ক্যামেরায় আর চোখে ভরে নিয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ পর্যটক।
স্পিনব্রিজের পাশে বয়ে গেছে একই নামের নদী। আমাদের বাস গ্লেনকোর দিকে না নেমে মোটরওয়ে এ৮৬ ধরে সুবিশাল কেয়ার্নগরমস জাতীয় উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্ত ঘেঁষে স্কটল্যান্ডের মধ্যভাগ চিরে এগিয়ে গেলো। তারও আগে এ৮৬ মোটরওয়ের প্রারম্ভেই আমরা একটি মনোমুগ্ধকর হ্রদের দেখা পাই। এর নাম লক লেগান। প্রাকৃতিক জলাশয়টিকে ভিন্নরূপ দিয়েছে একটি বাঁধ। এটি একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অংশ। আটকে রাখা হ্রদের পানি উঁচু থেকে তীব্র জোরে কয়েকটি নিয়ন্ত্রিত সুড়ঙের মধ্য দিয়ে নিচে ফেলা হচ্ছে। তীব্রবেগে মোটা জলকামানগুলো বহুনিচে একটি নদীতে পতিত হচ্ছে, সেখান থেকে সুনিয়ন্ত্রিত গতিতে জলধারা পৌঁছে যাবে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে, টারবাইন ঘুরিয়ে উৎপন্ন করবে বিদ্যুৎ। সেই অমিত সৌন্দর্যের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটির ছবি তুলতে পারলাম না, অমিতাচারী আমার ক্যামেরা ও মোবাইল দু’টোরই চার্জ শেষ। আমার মিতব্যয়ী ভ্রমণসঙ্গীরা তখন মহানন্দে ছবি তুলছে। লেক লগনের পাশে রয়েছে ডাটহিইনি ডিস্টিলারি, এখানে ভুবনবিখ্যাত স্কটিশ হুইস্কি প্রস্তুত হয়। এই লগন হ্রদের পাশেই রানী ভিক্টোরিয়ার একটি প্রাসাদ আছে। কোনো এক গ্রীস্মে তিনি এখানে বেড়াতে এসেছিলেন। সেই গ্রীস্মে একটানা ভারি বর্ষণে তিক্তবিরক্ত হয়ে রানী তার প্রাসাদটি সরিয়ে নেন ৭০ মাইল উত্তরে, এ প্রাসাদ আর ব্যবহার করেননি।
আমরা এসে পড়ি স্ট্রাথমাসিয়ে জঙ্গলে। একটি খামারে এসে নামি স্কটিশ হাইল্যান্ডের বিখ্যাত লোমঅলা গরু হেয়ারি কু দেখতে। গরুগুলো অন্য সকল গরুর মতো নিরীহ হলেও রূপে সত্যি আলাদা। বুদ্ধিমান মানুষের কেন তাদের নিয়ে এত আগ্রহ ভাবতে ভাবতে তারা জাবর কেটে চলে আর চলচ্চিত্রের চরিত্রের মতো উঁকিঝুঁকি মারা দর্শকদের উপেক্ষা করে নিজ নিজ ভূমিকায় অটল দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা অনতিদূরে উঁচু উঁচু স্কটিশ পাইনে ছাওয়া একখ- বনভূমে দাঁড়াই। সেখানে বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে এক ঝর্ণা বয়ে চলেছে। গাইড বল্লেন, হয় আপনারা বনের দিকে হাঁটতে উপরে চলে যান, কিংবা ঝর্ণা দেখতে নিচে নামুন। পরক্ষণেই কী ভেবে যোগ করলেন, ‘চাইলে দু’টোই করতে পারেন।’ আমি তাই করি, প্রথমে পাহাড় বেয়ে বনভূমে উঠে যাই, পরে নিচে নেমে পাহাড়ি ঝর্ণাটি দেখি। স্কটিশ পাইনের বনভূমে সূর্যের করুণাময়ী রশ্মি পড়েছে, সে করুণা পাতায় থরে থরে সাজিয়ে রাখছে বৃক্ষদল। ঝর্ণা দেখার জন্য একটি প্লাটফর্ম তৈরি করা আছে, গ্রানাইটের উপর দিয়ে নেমে আসা ঝর্ণাটি বেশ গতিশীল, পর্যটক মোহিত করতে উদগ্রীব।
সন্ধ্যের প্রাকলগ্নে, পৃথিবীতে মায়াবী বিকেল নেমেছে, আমরা পিটলোচেরি নামের এক শান্ত শহরে এসে থামি। যাত্রাবিরতি? এক ঘণ্টা। আমাদের অবসর দিতে চালক তখন উদার। এর আগে চড়াই-উৎরাই সম্পন্ন উপত্যকা আর পাহাড় ঘেরা অঞ্চল পেরুতে গিয়ে আমরা সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১৬০০ ফুট উপর দিয়ে এসেছি, সেটাই ছিল হাইল্যান্ড সফরে আমাদের সর্বোচ্চ উচ্চতা। সারাদিন তেমন দানাপানি পড়েনি পেটে, পিলটোচেরিতে এসে গ্রেগস নামের চেইন গ্রোসারি স্টোরে এসে ছয়টি ছোট ব্রেডরোলের একটি প্যাকেট ও এক বোতল দুধ নেই। যেখানে বসি (এখানে বসে খেলে দাম একটু বেশি; আমি অবশ্য টেক এ্যাওয়ের দাম দিয়ে বসে খাই)। অনতিদূরেই চারজন কিশোরি আলাপচারিতায় মেতে আছে। আমি তখন কেবল দুটো ব্রেড রোল খেয়েছি, চারটি রোল আমার টেবিলে, কিশোরীদের আমন্ত্রণ জানাই রোল খেতে। তারা অবাক ও আনন্দিত হয়, কিন্তু সুন্দর বিনয়ে আমার অনুরোধ প্রত্যাখান করে। অনুরোধ প্রত্যাখাত হলেও ওদের সাথে ভাব জমাতে আমার সমস্যা হয় না। ওরা সবাই স্কুলের ছাত্রী, আজ শনিবার, আজ ওদের বন্ধু নিয়ে বন্ধনহীন ঘুরে বেড়াবার দিন। তাদের রূপ দেখে রূপকথার বিভ্রম মনে হওয়া স্বাভাবিক। কেবল নিরুচ্চার্য সৌন্দর্য নয়, আমাকে মুগ্ধ করলো ওদের বিনয় ও সৌজন্যবোধ। গ্রেগস থেকে বেরিয়ে মহাসড়কের দু’পাশে বিন্যস্ত শহরটিকে ঘুরে ঘুরে দেখি। এদের সবকিছু এত সুন্দর কীভাবে? এই ভিক্টোরিয়ান শহরে অন্য অনেক শহরের মতোই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ রয়েছে। একটি গির্জার সান্ধ্যকালীন রূপ মিহি সৌন্দর্যে মোহিত করলো।
এরপরে কেবলি এডিনবরার দিকে পাড়ি। পথে পার্থ শহরটি দেখা হলো ভেতরে প্রবেশ করে নয়, বাইপাস দিয়ে যেতে যেতে। মোটরওয়ে এম৯০ ধরে ডানকলেড, ব্যাংকফুট প্রভৃতি শহর পেরিয়ে আসরা কিংক্রসে এসে পড়ি। এপাড়ে রসিত ওপাড়ে কুইনসফেরি, মাঝে ফার্থ অব ফোর্থের সেতু। আমাদের চালক কাম গাইডের ধারাবর্ণন তখনো ক্লান্তিহীন, বিশেষ করে লক নেস মনস্টার নিয়ে তিনি বেশ অবসেসড। যাত্রার শেষভাগে আমাদের কিছু স্কটিশ দেশপ্রেমের গান শোনালেন রেকর্ডপ্লেয়ারে, নিজেও একটি গান গাইলেন, এবং মনস্টারে অবিশ্বাসীদের নিয়ে একটি কোরাস গেয়ে সঙ্গীতপর্ব শেষ করলেন। বাস ততক্ষণে রয়েল মাইল চলে এসেছে। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে, সঙ্গী ভ্রমণকারীদের থেকে বিদায় নিয়ে মর্ত্যরে বাড়ি ফিরি।
স্বর্গ থেকে যেন পতন হলো আমার!