এক চিলতে হাসি
একদিন এক রাঙামুখি বহুদূর পথ পাড়ি দিয়ে এক ঝিলের জলায় এসে নামলো। জলে ভাসতে ভাসতে দেখে ছোট্ট এক মেয়ে জানালার পাশে বসে কাঁদছে।
— ‘কী গো মিষ্টি মেয়ে, তুমি কাঁদছো কেন?’
— ‘আমার কোনও সই নেই, খেলার সাথীও নেই !’ ছোট্ট মেয়েটি জবাব দিল।
— ‘চিন্তা করো না, আমি তোমার সই হব।তুমি আমার সাথে পানিতে সাঁতার কাটবে আর আমরা জল ছিটিয়ে খেলবো।’ ছোট্ট মেয়েটাকে পাখিটা বললো।
ছোট্ট সেই মেয়েটি সাথে সাথে মনের আনন্দে হেসে ফেললো। সে বললো, ‘এখন তো শীত পড়ে এসেছে। ঠাণ্ডা পানিতে তো আমি নামতে পারবো না, সই?’
— ‘ঠিক আছে সই, তুমি জানালায় বসে থাকবে আর আমার সাঁতার কাটা দেখবে। আমি টুপ করে পানিতে ডুব দিয়ে তোমার জন্য শালুক তুলে আনবো। তুমি এসে নিয়ে যেও কিন্তু। ও হ্যাঁ, আমার নাম রাঙা, রাঙামুখি। তোমার নাম কী সই?’ পাখিট বললো।
— ‘আমার নাম পরি। বাবা রেখেছেন। জানো, আমি নাকি বাবার মা। মা তো আমার জন্মের সাতদিন পর অচল হয়ে গেছেন, তাই বাবাই আমাকে মায়ের মতো আদর করেন! আমিও বাবা-মা দুজনকেই সমান আদর করি।’
— ‘দুঃখ করো না পরি। দুজন যখন সই হয়েছি, তখন আর কোনও দুঃখ নেই। বলেই পাখিটা গাইতে লাগলো,
রাঙামুখির সই হয়েছে
ছোট্ট মেয়ে পরি,
তাথৈ তাথৈ নেচে-গেয়ে
আনন্দ ভাগ করি।
সইটা পরে আমি আগে
একটি সে নাম ধরি,
আমরা দুজন মিলে হলাম
বাবার রাঙাপরি।’
সেই থেকে ওরা পুরোটা শীত আর বসন্ত একসাথেই গল্প করে, গান গেয়ে কাটালো। তারপর একদিন রাঙামুখী বললো, ‘সই, ঐ যে দেখো, আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। সূর্য রেগে উঠেছে। বাতাস পালক ভেঙে দিতে ধেয়ে ছুটে আসছে। তাই আমাকে শিগগির চলে যেতে হবে।’
পরি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, ‘তুমি কোথায় যাবে, সই? কতদিন পরেই বা ফিরে আসবে, আর আমি একা-একা কীইবা করবো?’
— ‘আমাকে যে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে গল্পবুড়ো তলস্তয়ের বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। আবারও হেমন্তের শেষে আমি ফিরে আসবো। এতদিন নাহয় তোমাদের গল্পবুড়ো রবিঠাকুর, নয়তো কোনো নতুন গল্পবাজের গল্পের বই পড়ে আমার অভাব ভুলে থাকার চেষ্টা করো।’
ছোট্ট মেয়ে পরি সই পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিল। রাঙামুখীও অনেক খুশি হয়েছিল। তাই তো পরিকে পানিতে কতকৌশল করে সাঁতার কেটে দেখিয়েছে। একটু পরপর ওর রঙিন পালক ঝেড়ে টুপটুপ করে ডুব দিয়ে দেখিয়েছে। প্যাঁকপ্যাঁক করে গান গেয়ে শুনিয়েছে। পরিও তার বাবার লেখা ছড়া, ও নিজের লেখা ছড়াগান পড়ে শুনিয়েছে। আর তখন ফুলেরা হেসে দিয়েছে, ঘ্রাণ ছড়িয়েছে, দলে দলে প্রজাপতি হাওয়ায় নেচেছে, পাতার আড়ালে সুরের পাখিরা মধুর সুর ছড়িয়েছে, মৌমাছি মনের আনন্দে গড়েছে মৌচাক। কথাগুলো ভাবতেই পরির মুখ বিষাদের কালো মেঘে ছেয়ে গেল। তখন কেবল পরির মনেহল, ‘এই ঝিল যদি ভরে ফেলে, পাড়ের গাছ যদি কেটে ফেলে — সই কোথায় এসে বসবে? পাখিরাইবা কোথায় বসে গান গাইবে? মৌমাছি, প্রজাপতি — এদের কী হবে?’
ঋতু বদল হয়, সময়ও বদলে যায়। তবে ঋতুর এই বদল যেন ফিরে আসতে পারে সেটা মানুষকেই ভাবতে হবে। পরির মনে কীভাবে যেন আজ এসব ভাবনা ঢুকে গেছে। তাই সে মনে করে, ‘আমারও কিছু কাজ আছে। এই সুন্দর ঋতুবৈচিত্র্য আর প্রকৃতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য বড়দের সাথে কথা বলতে হবে। প্রথমে বিষয়টা বাবাকে বলতে হবে। তারপর আমার সহপাঠী আর টিচারদের বলবো।’
এমনি সুন্দর ভাবনার পর কখন জানি পরির সব দুঃখ ফুরিয়ে গেল! তখন ছোট্ট মেয়েটির মুখে ফুটে উঠলো এক চিলতে হাসি!