কাজী জহিরুল ইসলাম নব্বই দশকের অন্যতম কবি। তিনি কথাসাহিত্যেও অবদান রেখে যাচ্ছেন। তার ভ্রমণসাহিত্য সুখপাঠ্য। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাগাতুয়া গ্রামে, ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। পিতা কাজী মঙ্গল মিয়া, মা সোফিয়া বেগম।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে জাতিসংঘের একজন ঊর্ধতন পেশাজীবী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী মুক্তি জহির, এক পুত্র ও দুই কন্যাসহ বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে। কাজী জহিরুল ইসলাম লেখালেখি শুরু করেন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়বার সময়। দৈনিক আজাদের সাহিত্য পাতায় ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম লেখা।এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৬৫, যার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ২২টি । জার্মানি থেকে প্রকাশিত “পোয়েমস অব কাজী জহিরুল ইসলাম” নিউ ইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ২০১৮ সালে। তিনি অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। কাব্যগ্রন্থ: পুরুষ পৃথিবী (১৯৯৮), ভালোবাসার শব্দগুল্ম (১৯৯৯), পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়িপথ (২০০১), দ্বিতীয়ঘাস ফড়িং (২০০১), আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ (২০০৪), দ্বিতীয়বার অন্ধ হওয়ার আগে (২০০৬), উদ্বিগ্ন রাতের কথা (২০১৫), পুড়ে যাই দ্রোহে পুড়ে যাই প্রেমে (২০১৫), ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ (২০১৬), না জর্জেট না জামদানি (২০১৬), সূর্যাস্তের পরের ফিরিস্তি (২০১৬), রাস্তাটি ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে (২০১৭), দেহকাব্য (২০১৭), উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা (২০১৭), বালিকাদের চাবিওয়ালা (২০১৮), যে বৃক্ষটি কাল হয়েছে গুম (২০১৮), ক্রিয়াপদহীন কবিতা (২০১৯), অন্ধকারে জিহ্বা নাড়ে পাপের গহ্ববর (২০১৯), বৃহত্তে যায় আদম হাওয়া (২০১৯), একালে কাকতলাতে বেল (২০১৯), প্রেমের পদাবলী, (২০২০), দেয়াল ঘড়িটা কী মিথ্যুক (২০২০), স্থবির আঁধারে স্বপ্নসম্ভবা বসন্ত (২০২০), কবিতাসমগ্র-১ (২০১৫), কবিতাসমগ্র-২ (২০১৮), কবিতাসমগ্র-৩ (২০২০)। অনুবাদ কবিতা :জালালুদ্দিন রুমির কবিতা (২০১৭), এজরা পাউন্ডের কবিতা (২০১৯)। গল্পগ্রন্থ: যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে (১৯৯২), উত্থানপর্বের গল্প (২০১৯)। উপন্যাস: একাত্তুর এবং (১৯৯৮), একাকী নক্ষত্র (১৯৯৮), গ্রহান্তরের সুখ (২০০৮), থাবড়া হামিদ (২০১৮)। ভ্রমণগদ্য: উড়ালগদ্য (২০০৬), পথকথন (২০০৫), কসোভোর পথে-প্রান্তরে (২০০৬), কাকাওয়ের দেশে (২০০৬), গজমোতির দেশ আইভরিকোস্ট (২০০৭), জানা-অজানা আফ্রিকা (২০০৮), ঘুলঘুলির আলো (২০০৯), উড়ালগল্প (২০১৮), ভ্রমণ সমগ্র-১ (২০১৭), ভ্রমণ সমগ্র-২ (২০১৭)। প্রবন্ধ-গবেষণা: শেকড়ের খোঁজ (২০১৭), অসীম শূন্যতে তিষ্ঠ (২০১৭), বড় নারীদের কথা ও অন্যান্য গদ্য (২০১৮), দাগচিত্র (২০১৯), সৃষ্টিপুরাণ ও অন্যান্য লোককথা (২০০৭ এবং ২০১৮) আত্মজীবনী :বিহঙ্গপ্রবণ (২০০৬ এবং ২০১৮) স্মৃতিকথা: আড্ডার গল্প – হেমন্তের পত্রবৃষ্টি শিশুতোষ গল্প: ছয় ঠ্যংঅলা নীল সাপ (২০০৮), জলের ঘড়ি (২০২০) সম্পাদিত গ্রন্থ: জলের মিছিল (১৯৯৪), স্বপ্নশিকারিদের অরণ্যবিহার (২০১৭), চার ঊনবাঙালের কবিতা (২০১৮), আন্ডার দ্য ব্লু রুফ- ভলিউম-১ (Under The blue roof Vol. I) ২০১৮। Under The blue roof Vol. II (২০১৮), Under The blue roof Vol. III (২০১৯) বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ: After A Long Way ( ২০০২), The Smell of Dust (২০১৮), Poems of Quazi Johirul Islam ( ২০১৮), 100 English Haiku (২০২০)। উড়িয়া ভাষায় অনূদিত ক্রিয়াপদোহিনো কবিতা (২০১৯)
‘নাকের ওপর রোপণ করো নতুন দুটি চোখ
অন্ধকার এই পৃথিবীতে আলোর সভা হোক’
অন্ধকার এই পৃথিবীকে নতুন চোখে দেখবার এবং দেখাবার মতো দুঃসাহস দেখাতে পারেন একমাত্র তিনি, যিনি কবি এবং সত্যদ্রষ্টাও বটেন। কবিতার ধ্যানে-জ্ঞানে সদা জাগ্রত এই কবির নাম কাজী জহিরুল ইসলাম। তার ‘মশলারাজ্য’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার মিছিলে স্বরবৃত্তের এই মশাল যেন চিরন্তন। বহুপ্রজ এই কবির সঙ্গে প্রথম পরিচয় সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত নিউইয়র্ক মুক্তধারা বইমেলার আহবায়ক ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধা (যিনি কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের সহযোদ্ধা ছিলেন) লেখক, বিজ্ঞানী ড. নূরুন নবী। তার আমন্ত্রণে তিন দিনের জন্যে নিউইয়র্কে যাই। বইমেলার আয়োজনে কবি ও মুক্তিযোদ্ধা রফিক আজাদের কর্ম ও মর্মসহচরী হিসেবে তাঁর প্রয়াণ-কালীন বিষণ্ন স্মৃতি-সম্ভার নিয়ে হাজির হয়েছিলাম। একই অনুষঙ্গে আনোয়ারা সৈয়দ হকও ছিলেন আমন্ত্রিত অতিথি। সাহিত্য-সংযোগে খুব চমৎকার সময় কেটেছিলো আমাদের। সেই অনিন্দ্য মুহূর্তে বইমেলা চত্তরে কাজী জহিরুল ইসলামের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা কবি মাহবুব হাসান।
এই সংযোগসূত্রটি জহিরুলের জন্যেই দিনে দিনে ব্যাপ্তি পেয়েছে বহুলাংশে। ওখান থেকে টরন্টো ফিরে আসার ক’দিন বাদেই ‘UNDER THE BLUE ROOF’ নামের ইংরেজি কবিতার সংকলনটির সম্পাদক হিসেবে আমার কবিতা চেয়ে বসলেন কবি জহিরুল। বাংলা ভাষার কাব্য যাত্রাপথে আমাজন থেকে প্রকাশিত এই সংকলনটি জহিরুলের অন্যতম একটি কাজ হিসেবে গণ্য করি আমি।
বৈশ্বিক করোনাকালে আমি যখন পুনরায় বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী পুত্রদের কাছে এলাম তখন পুত্র অভিন্নের ওয়ার্ক ফ্রম হোম, প্রায় সর্বত্রই সকলের চাকুরিপনার কাজ ঘর থেকেই করতে হচ্ছে। বৈশ্বিক এই আত্মঘাতী মরণোন্মুখ সময়ে সারাদিন আমি চুপচাপ। কথা বলার কেউ নেই। জীবন বাঁচানোর জন্যেই যেন পাথর হয়ে নির্নিমেষ আকাশ পানে চেয়ে বসে থাকা। মানুষ থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও দূরত্ব বাড়ছে কেবল শুধুই জীবনটাকে বাঁচানোর দায়বোধ থেকে। তখন খুব মনে পড়তো রফিক আজাদের কবিতার একটি চরণ ‘মানুষেরা খুব ভয়াবহ প্রাণী’। কোভিড ভাইরাস এসে চরণটির মর্মার্থ যেন হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছেড়ে দিলো আমাদের।
জনবিচ্ছিন্ন, প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন এই অসহায় সময়ে হয়তো কিছু লিখি, নয়তো বই পড়ি। এভাবেই চলছি, পুনরায় অপরাপর নিকটস্বজন-বন্ধুদের সঙ্গে আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা, সেই অনিশ্চতা কাঁধে নিয়ে ঘুমুতে যাই বিছানায়। সকালটা জেগে ওঠে মৃত্যু-সওয়ার হয়ে। শতাব্দী প্রাচীন এমন বিষণ্ন সময়ের সঙ্গে মিতালি করে কাটছে প্রতিটি মুহূর্ত। সন্ধ্যা ছাড়া সন্তানের সঙ্গেও কথা বলতে পারি না। পৃথিবী-ব্যাপী মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিন বাড়ছে, সেইসব সংবাদে শ্বাসরুদ্ধকর বেদনা-বিহ্বল একটা অবস্থা যখন পার করছি, সেই সময়ে টরন্টো থেকে কবি মৌ মধুবন্তী একটা ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ডেকে নিলো আমাকে। একটু যেন শ্বাস ছেড়ে বাঁচলাম। সেখানে প্রথম দিনেই জহিরুলকে পেলাম পুনরায়। বুঝতে পারলাম ওরা দু’জনে মিলেই অনুষ্ঠানটি শুরু করেছে সবে। মাসখানেক এভাবে কবিতাকে অগ্রগণ্য করে জীবনের মানে খুঁজতে চেষ্টা করছিলাম। এরপরেই জহিরুল ‘কফি ও কবিতা’ নাম দিয়ে ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালকের হালটি ধরলো শক্ত হাতে।
শুরুতে কফি ও কবিতা নামক এই অনুষ্ঠানটি ঘণ্টাব্যাপী চললেও প্রবাস ও বাংলাদেশের কবিদের অংশগ্রহণে এর ব্যাপ্তি ও গভীরতা দিনে দিনে বেড়েই চলেছিলো। করোনা পরিস্থিতি মধ্যখানে কিছুটা প্রশমিত হলে অফিসের কাজ বেড়ে যায় প্রত্যেকের, ফলে এই অনুষ্ঠানটি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে প্রথম ৩/৪ মাস ছুটির দুদিন বাদ দিয়ে প্রায় নিয়ম করে বসেছি আমরা। বিভিন্ন সম-সাময়িক ঘটনা ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে প্রয়াত কবি রফিক আজাদ, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরী, আল মাহমুদকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দুটো অনুষ্ঠানে কবি আসাদ চৌধুরীও এসেছেন। যেহেতু তিনিও টরন্টোতে আছেন, তাকেও পেয়েছি সহজেই। এখানেই প্রথম দেখেছি কবি আমিরুল আরহামকে, প্যারিস থেকে যুক্ত হতেন তিনি। ডিসি থেকে মাহবুব হাসান সালেহ, নিউইয়র্ক থেকে মাহবুব হাসান, আবদুল্লাহ জাহিদ যুক্ত হতেন। শাকিল রিয়াজ সুইডেন থেকে, কলকাতা থেকে অয়ন ঘোষ, পার্থদা( যাকে করোনায় আমরা হারালাম)। বাংলাদেশ থেকে ফেরদৌস সালাম, রেজাউদ্দিন স্টালিন, রহিমা আক্তার কল্পনা, এনাম রাজু, পরে আরো যুক্ত হলেন সালিম হাসান, গাজী লতিফসহ অনেকেই। যাদের নাম উল্লেখ করেছি তারা ছাড়াও আরো অনেকেই ‘কফি ও কবিতা’ অনুষ্ঠানে কবিতা পড়েছেন। আবৃত্তিশিল্পের অনেকেই অংশ নিয়েছেন এই আয়োজনে। এর পুরোভাগে বলাই বাহুল্য কাজী জহিরুল ইসলাম ছিলেন এবং এখনো আছেন। লেখালেখির চাপে আমি অবশ্য অনিয়মিত হয়ে পড়েছি।
এই ভার্চুয়াল দেখা সাক্ষাৎটুকু আমাদের জন্যে অনেক বড় প্রাপ্তি ছিলো। নিজেদের বেঁচে থাকাকে যেন কবিতার গায়ে চিমটি কেটে অনুভব করতাম আমরা ক’জন কবিতাপ্রেমী মানুষ। সেই অনুষ্ঠানের সূত্রে প্রায় প্রতিদিনই দেখা, কবিতা পড়া এবং আলোচনা হতো পরস্পরের সঙ্গে—হোক না ভার্চুয়ালি, তবু অনেকের অনেক কবিতা শোনাবার/শুনবার সুযোগ হয়েছে করোনার এই আকাল-সময়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী বাংলা ভাষার আরো অনেক কবির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি নতুন করে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে—এটি আমার জন্যে বড় সঞ্চয় বলে আমি ভাবি। এই সময়-পর্বে আমি জহিরুলের অনেক কবিতা শুনেছি, বলতে দ্বিধা নেই ওর প্রত্যেকটি কবিতা আমার ভালো লেগেছে। এর পেছনে দুটো কথা বলতেই হয়, অসম্ভব নিরীক্ষা-প্রবণ কবি কাজী জহিরুল ইসলাম।
তার কাব্যগ্রন্থ ‘ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ’-এ যেমন এই নীরিক্ষার দেখা মেলে, তেমনি তার অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের ভাব-ভাষা-বিষয়বস্তু এবং ছন্দ অলংকারের প্রকরণ শৈলীতেও তার স্বাক্ষর বর্তমান। চমৎকার কিছু চিত্রকল্পের দেখা মেলে তার দেহকাব্যে, যেমন:
‘স্পর্শে তুমি ফেটে গেলে পেস্তাশিওর মত
দেখিনি তো মেপে দেহের তাপ উঠেছে কত
জ্বলছে দেখি সেই ফাটলে জ্যোৎস্না-গলা জল
জলের আলোয় পথ দেখা যায় আহা কী উজ্জ্বল’।
আমার এমনও মনে হয়েছে প্রতিটি মুহূর্ত যেনবা সে কবিতার সঙ্গেই কাটায়। কবিতা থেকে দূরে সরে যায় না মোটেই। দৈনন্দিন জীবনেও যা কিছুই সে করে সর্বত্রই কবিতা নাম্নী এক মায়াময় স্বপ্ন-অঞ্চল ঘিরেই তার কর্ম প্রবাহ উৎসারিত হতে থাকে বলে ধারণা আমার। বাংলা ক্রিয়াপদের বহুল ব্যবহার অনেক সময় কবিতার গাঁথুনিকে দুর্বল করে দেয় বলে জহিরুলের ধারণা। সকলেই আমরা তা মানি বা নাই মানি, ওর ধারণাটিও যে লক্ষণীয়—-একটি উদ্ধৃতি দিলে স্পষ্ট হবে বিষয়টি।
‘আমারও একটি সকাল আছে, হয়তো পার্থক্য অনেক
লুকাস, দিয়েগো, পেড্রো, কার্লোস আর হোসে’র সাথে
ওদের শিকারী চোখে একটি পুরোনো ওয়ার্কিং ভ্যান, জ্যাকসন হাইটসের মোড়ে
ঊনসত্তর স্ট্রিট আর রুজভেল্ট এভেনিউর সঙ্গমস্থলে
কাঁধের বিবর্ণ ব্যাগটিতে কিছু যন্ত্রপাতি, সাইডপকেটে স্বপ্ন,
তামাউলিপাসের সবুজ অরণ্য’
(কবিতার নাম: ইমিগ্র্যান্ট)
জহিরুলের কবিতার আর একটি বৈশিষ্ট্য হলো বিষয়বস্তু নির্বাচনে তার আন্তর্জাতিকতার বোধ ও বোধি। জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে নানাদেশ ভ্রমণ এবং পাঠসূত্রে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় তার রয়েছে, তার সঙ্গে আজন্ম লালিত স্বদেশভূমির কৃষ্টি-কালচারের একটি সমন্বিত রূপ খুঁজে পাওয়া যায় তার বেশ কিছু কবিতায়। বাংলাদেশের বিরল প্রজাতির তিলাঘুঘু, শৈশবের খাগাতুয়া গ্রাম, বকুলতলার উপস্থিতি যেমন তার কবিতায় বার বার এসেছে তেমনি ম্যানহাটনের আকাশ, হাডসনের তীর, পত্রগুচ্ছ দুলিয়ে ওকডাল কিংবা বার্চের ঝরাপাতাও ডেকে নেয় এই কবিকে।
দেশের বাইরে অনাবাসী কবিতার যে একটি নতুন ধারা তৈরী হচ্ছে দিনে দিনে, বাংলাদেশের কবিতার জন্যে তা নতুন সংযোজন। এই ধারার পথিকৃত হিসেবে কবি কাজী জহিরুল ইসলাম নিঃসন্দেহে অনেকের চেয়ে এগিয়ে আছেন। কবিকে জানতে হয় কবিতার ঘর-দোর সাজাবার শৈল্পিক রীতি, ভাষা, ছন্দ ও অলংকার ব্যবহারের নীতিও।
শেষাবধি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কবিকে দেখতে হয় দূরগামী স্বপ্ন। জলিরুল তার ‘হেঁটে যাই’ নামের কবিতায় অকাতরে সেই স্বপ্ন বুনে দেন যথেষ্ট মুন্সিয়ানায়।
‘কেমন আছেন, শরীর ভালো তো?
একথা বলেই একটি হলুদ পাতা হঠাৎ ঝরিয়ে দিল গাছ।
কোথায় ছিলেন এতোদিন, পুকুরের জলে
দেখিনি তো ছায়া, প্রশ্ন করে মাছ।
অনেকটা নিচে নেমে আসে ভবঘুরে মেঘেদের দল,
বৃষ্টিহীন রৌদ্রদিনে আচমকা
কে নামিয়ে দিল নুনমাখা এই জল?
রোদের রেখায় উড়ে উড়ে বলছে পথের ধুলো,
ভয় নেই, সহস্রাব্দের আঁধারে
আমরা জাগিয়ে রাখবো পায়ের চিহ্নগুলো।
আমি হেঁটে যাই দূরে, দু’পায়ের নিচে শুকনো পাতার গান,
হৈমন্তী বাতাস এসে দাঁড়ায় সটান,
আবার হবে তো দেখা?
আমি হাঁটি, দূর থেকে আরো দূরে, একা।’
(কবিতা: হেঁটে যাই)
শেষের আগে বলতেই হয় অনন্য এক মানবীর কথা। কবির জীবন সঙ্গী মুক্তি, ঘরে-বাইরে মুক্ত মনের এমন প্রিয়দর্শিনী নারী যদি সহায়ক শক্তি এবং অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কবি হৃদয়ে বাস করে, তবে তো কবির কাব্যযাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ হতেই পারে। আশা করছি, কবি কাজী জহিরুল ইসলাম আরো হাঁটবেন দূর থেকে বহুদূরের পথ….
জন্মদিনে আবারো অভিনন্দন প্রিয় কবি।
আইসবোট টেরেস, টরন্টো
৪/২/২০২১