তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে শুকনো বাঁশপাতা ঝরে পড়ছে। উঠানের ওপর এতো বড় বাঁশঝাড় মোটেও ভালো লাগে না দৌলতন নেছার। পাড়া-পড়শির ধান শুকিয়ে যায় বেলা গড়ানোর আগেই, দুলুর ধান শুকায় না। দুলুর হাতে লম্বা একটি কঞ্চি, এটা উঁচু করে তিনি বলেন, হুঁস হুঁস। তখন শালিকের ঝাঁক ধানের ওপর থেকে উড়ে পালায়। দুলুর দুই মেয়ে উঠানের অন্য পাশে মাটিতে দাগ কেটে ছি কুত কুত খেলছে। ছোটো দুই ছেলে বানরের মতো পেয়ারা গাছে ঝুলে আছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে একটি তিলা ঘুঘু ‘অতিথি ফুররর…ফুর…’ করে ডাকছে। দুলু তখন নিজের স্ফীত উদরের দিকে তাকায়। ঘুঘুর ডাকে বাঁশঝাড়টা যেন মুহূর্তেই অন্যরকম হয়ে যায়, তখন এটাকে দুলুর আর খারাপ লাগে না।
ধান তোলা ক্ষেতের নাড়া পোড়াতে গিয়েছিল ফাজিল মিয়া। নাড়া পোড়ান শেষ। ঘেমে-নেয়ে দুই বাপ-বেটা ফিরে এসেছে। বাঁশঝাড়ের নিচে পাটি বিছানোই ছিল, সেখানে বসে পড়ে ফাজিল মিয়া আর তার বড় সন্তান তের বছরের পুত্র সালাম মিয়া। সাথে সাথে অন্য চার ছেলে-মেয়ে ছুটে আসে। বাঁশঝাড় কাঁপিয়ে এক পশলা হাওয়া এসে লাগে ওদের ঘর্মাক্ত শরীরে, একটু শীত শীত লাগলেও বেশ আরাম পায় বাপ-বেটা। ছোটো ছেলে জামাল দুই হাতে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে পিঠের ওপর ঝুলে আছে। দোচালা টিনের ঘরের পাশে একটু ফাঁকা জায়গা, যেখানে একটি পেয়ারা গাছ ছড়িয়ে আছে ছাতার মত, তার পাশেই আলগা একটি রান্নাঘর। রান্নাঘরের পাহাল থেকে সেদ্ধ মিষ্টি আলুর পাতিল তুলে আনে দুলু, মাত্র ঢাকনা খোলা মাটির পাতিল থেকে ধোঁয়া উঠে ওর মুখে লাগছে। ধোঁয়ার ঝাপটায় দুলু চোখ বন্ধ করে। পানিসহ আলুগুলো ঢেলে দেয় বাঁশের তৈরী খালুইয়ে। পানি ঝরে গেলে এক খালুই সেদ্ধ আলু, চ্যাপা শুটকির লাল ভর্তা এবং পিতলের এক জগ পানি এনে ওদের সামনে রাখে। ঢকঢক করে প্রথমে বাপ, পরে সালাম মিয়া পানি খায়। এই দৃশ্য দেখতে দুলুর খুব ভালো লাগে। ওরও ইচ্ছে করে বাপ-বেটার মুখ লাগানো জগে মুখ লাগিয়ে দু’ঢোক পানি খেতে। কিন্তু সে তা করে না, লজ্জা পায়। নিজের পোয়াতি পেট নিয়ে বেশ কষ্ট করে পাটির এক প্রান্তে ছোটো মেয়ের গাঁ ঘেঁষে বসে দুলু, পাটিতে জায়গা হয় না, ওর অর্ধেক পাছা পাটির বাইরে, মাটিতে।
— আন্নে কি আঁর হুতেরে আন্নের লাহান চাষা বানাইতেন্নি চান?
— গিরস্তের হুঁত গিরস্ত ঐবো।
— ঐতো না, আঁর হুঁতেরে আঁই দারোগা বানাইতাম চাই।
খিক খিক করে হাসে ফাজিল মিয়া। কাচা-পাকা দাড়িগুলো আঙুল দিয়ে খিলাল করে।
— আঁরে তুই আঁসাইলি বৌ।
— হঁ আঁন্নে তো আঁইসবেনৈ। আঁন্নের চাস্তো বাই, হান্নান বাইছাবের বাহে মুনি আছিল না, হেতে অবিছার ঐছে না?
— ঐছে।
— তঁই? আঁন্ডার সেলেম মিয়া দারোগা ঐতাত্ত না কিল্লাই? আঁই হেতেরে কৈ ইশকুলোত যা, আঁন্নে হেতেরে খেতো লৈ যান গৈঁ।
ফাজিল মিয়া সালামের দিকে তাকায়। সালাম তখন মিটমিট করে হাসে। বাপ-মায়ের তর্ক সে খুব উপভোগ করছে।
— কি-ও সেলেম মিয়া, ইশকুল বাঁলা নি?
ছোটো মেয়ে কুলসুম, যার বয়স চার বছর, বলে, ‘দিঁঅ বাঁদান, ইতকুল বাঁলা’। ছোটো বোনের কথা শুনে সালাম হাসে, বাবার দিকে ফিরে সেও ওপর-নিচ মাথা নাড়ে।
— দেখছত নি তর হুঁতের কাণ্ড। হেতে দারোগা ঐবো। ত বাজান কাইল্গোত্তন ইশকুলে যাইবা, খেতের কাম আঁই দেইক্কুম।
সালাম কোনো কথা বলে না। সে মন দিয়ে মিষ্টি আলুর খোসা ছড়ায় আর মুখে পোড়ে। দিলুর মুখে হাসি।
— লুতু মাস্টর আঁরে কৈছে, সেলেম মিয়ার মাঁতা বাঁলা। আর চাইর বছর বাদে মেট্টিক দিব। মেট্টিক পাশ দিলেঐ দারোগা।
কথাগুলো স্বগতোক্তির মত শোনায়।
বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে ‘পুত পুত পুত পুত’ করে ডাকতে ডাকতে একটি আইড়াকুপি পাখি বেরিয়ে আসে। দাঁড়কাকের চেয়ে বড় গোলগাল কালো রঙের একটি পাখি। পিঠের ওপর হালকা খয়েরি রঙের পোঁচ। উঠান পেরিয়ে পাখিটা দৌড়াতে দৌড়াতে অন্যপাশের জঙ্গলের ভেতর চলে যায়। তখন বাড়ির ঘাটে একটি সাদা টুপি দেখা যায়। কেউ একজন উঠে আসছেন। মানুষটির মেহেদি রাঙা দাড়ি, সাদা পাঞ্জাবি, গলায় ভাঁজ করে রাখা সাদা-কালো চেক গামছা স্পষ্ট হলে ফাজিল মিয়া লাফ দিয়ে উঠে এগিয়ে যায়।
— হান্নান বাইছাব নি, কুনসুম আইলেন ডাকাত্তন।
— আইছি গন্টা দুই অয়। তোরা আছত কেমন? তর তো মাশাল্লাহ গর বরা বাল-বাইচ্চা।
কথাটা বলেই নিঃসন্তান হান্নান মিয়া উদাস দৃষ্টিতে বাচ্চাদের দিকে তাকান।
— দুক্কু কৈরেন না বাইজান, আল্লায় মুক তুলি চাইলে দিতে কতক্কন।
— হ
দুলুর কথায় আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে হান্নান মিয়া।
— তুঁরে উজ্ঞা কতা কৈ ফাজিল। তোর বড় হুঁত-উজ্ঞারে আঁই লৈ যাই। হেতারে আঁই ডাকাত নিয়া পড়াইয়ুম, মানুষ করিয়ুম। তোরও জানের আছান অয়।
ফাজিল মিয়া আর দুলু দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
— চিন্তা করি ছা। আঁই দুইদিন আছি। যদি রাজি থাঅছ, আঁর লগে লই যাইয়ুম।
ফেনির দাগনভুঞা থানার মাতৃভূঞা ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম। ১৯৩৯ সালে তের বছর বয়সে আব্দুস সালাম তাঁর বাবা ফাজিল মিয়ার চাচাত ভাই আবদুল হান্নানের সাথে ঢাকায় চলে আসেন। আবদুল হান্নান পূর্ব বাংলার শিল্প মন্ত্রণালয়ে পিয়নের চাকরি করতেন। তিনি আব্দুস সালামকে ঢাকায় এনে পড়াবেন বললেও ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তাঁকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়নি। ১৯৪২ সালে আব্দুস সালামকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। তখন তাঁর বয়স ১৬ বছর। পরবর্তি তিন বছরে সালাম দুটি ক্লাস অতিক্রম করতে পারে। ১৯৪৫ সালে সালাম যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখনই তাঁর লেখাপড়া শেষ হয়ে যায়। এরই মধ্যে সালামের মা দৌলতন নেছা আরো দুটি সন্তানের জন্ম দেন। মোট তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে আব্দুস সালাম ছিলেন সবার বড়। অভাবের সংসারের দায়িত্ব নিতে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে তাঁকে চাকরিতে ঢুকতে হয়।
২১ জুলাই ১৯৪৭। প্রিন্সিপালের কক্ষ। আজিজুল হক কলেজ, বগুড়া। ছোটোখাটো এক মানুষ, মাথায় কালো ফেজ টুপি, চিবুকে লম্বা শুভ্র দাড়ি। তিনি জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। গভীর মনোযোগ দিয়ে এক সপ্তাহ আগের, কোলকাতা থেকে প্রকাশিত, দৈনিক আজাদ পত্রিকা পড়ছেন। এমন সময় পিয়ন রেজাউল এসে টেবিলের ওপর একটি টেলিগ্রাম রেখে যায়। কোলকাতা থেকে লিখেছেন কবি ফররুখ আহমদ।
17 JULY 1947
IN A CONVOCATION DR. ZIAUDDIN AHMAD STATED ‘ONLY URDU DESERVES TO BE THE STATE LANGUAGE OF A MUSLIM NATION’, WE MUST PROTEST.
FARRUKH, CALCUTTA
তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। জানালার কাছে এসে আকাশ দেখেন। তারপর ধীরে ধীরে পায়চারী করতে করতে বারান্দায় এবং পরে কলেজের উঠানে নেমে আসেন। পিয়ন রেজাউল পেছন পেছন আসে। কি এমন দুঃসংবাদ। মৃত্যুসংবাদ না তো, স্যারকে এতো উদ্বিগ্ন লাগছে কেন?
তিন বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন তিনি। কাজ পাগল মানুষ ড. শহীদুল্লাহ ঘরে বসে অবসর জীবন কাটাতে চাননি। তাই যোগ দেন আজিজুল হক কলেজে। তখন বিকেল। ভ্যাপসা গরম পড়েছে। আকাশ মেঘলা কিন্তু বাতাস না থাকায় গুমট হয়ে আছে। কয়েকটি কাক নারকেল গাছের পাতার ওপর বসে কা কা করে ডাকছে। হঠাৎ বাতাস ছোটে। কাকগুলো উড়ে চলে যায়। আকাশে ঘন কালো মেঘ জমে। কালো মেঘের বুকে এক ঝাঁক শুভ্র বলাকা মালার মত সারিবদ্ধভাবে উড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হয়। ঝুম বৃষ্টি। এমন অঝোর ধারার বৃষ্টি গত ৩/৪ বছরে হয়নি।
ফররুখের টেলিগ্রামে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন জ্ঞানী লোক। তাঁর স্টেটমেন্টের ভেল্যু আছে। এর মানে হল সম্ভাব্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকেরাও এটাই ভাবছেন। ওরা যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে শুধু উর্দূকে করে তাহলে অন্যায় হবে। উর্দূ এবং বাংলা দুটোই রাষ্ট্রভাষা হতে পারে।
২৯ জুলাই কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ ছাপা হয়। এই প্রবন্ধে তিনি একাধিক রাষ্ট্রভাষার পক্ষে যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘অনেকেই এরূপ ধারণার বশবর্তী যে একটি রাষ্ট্রে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা থাকিবে। সোভিয়েট রাশিয়ার কয়েকটি ভাষাই রাষ্ট্রভাষারূপে পরিগণিত হইয়াছে। সেইরূপ কানাডায় ইংরেজী ও ফরাসী ভাষা, বেলজিয়ামে ফরাসী ও ফ্লেমিশ ভাষা এবং সুইজারল্যান্ডে ফরাসী, ইটালীয় ও জার্মান ভাষা রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য’ তিনি আরো বলেন ‘কত অধিক সংখ্যক লোক একটি ভাষা বলে, এই অনুযায়ী বাংলা ভাষা বিশ্ব ভাষার মধ্যে সপ্তম স্থান অধিকার করিয়াছে। যদি বিদেশি ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তবে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করিবার পক্ষে কোনো যুক্তি নাই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তিনজন তরুণ শিক্ষার্থী কাজী দীন মুহাম্মদ, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আশরাফ হোসেন সিদ্দিকী এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের দু’জন শিক্ষার্থী কলিম উদ্দিন ও আনিসুর রহমান অধ্যাপক শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি হাতে নিয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেমের কাছে ছুটে যান। আবুল কাশেম ছাত্রদের বলেন, শহীদুল্লাহ স্যার লিখেছেন, অন্য বুদ্ধিজীবীরাও লিখছেন, কিন্তু শুধু লিখলেই চলবে না, আমাদের আন্দোলনে নামতে হবে। তোমরা তমুদ্দুন মজলিশে আসো।
২৯ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭। সোমবার।
ইউ সেইপ বিল্ডিঙয়ের উঠানে ফ্লাগ স্ট্যান্ড। পতপত করে উড়ছে চাঁদ তারা খচিত পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা। প্রতিদিন অফিসে ঢোকার সময় সাজ্জাদ হোসেন এখানে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ান, কপালে হাত তুলে জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানান, এরপর সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় নিজের অফিস কক্ষে ঢোকেন। সাজ্জাদ হোসেনের বাড়ি পেশাওয়ার, জাতে পাঠান, ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা, টিকালো নাক। যেমন লম্বা তেমন চওড়া। ভরাট কন্ঠ, যখন কথা বলেন মনে হয় কোনো সুরঙ পথ দিয়ে ভেসে আসছে অপার্থিব কন্ঠস্বর। এই কন্ঠকে সমীহ করে চলে অফিসের ছোটো-বড়ো, বাঙালি, পাঠান সকলেই। সাজ্জাদ হোসেন পূর্ব পাকিস্তান বাণিজ্য ও শিল্প অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। বিদেশিদের সাথে চোস্ত ইংরেজি বলেন তবে বাঙালিদের সাথে তিনি সব সময় উর্দূতে কথা বলেন। সাজ্জাদ হোসেন অফিসে আসেন ঠিক আটটায়, তিনি আসার ৩০ মিনিট আগে থেকে গাড়ি বারান্দায় দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, একজন তাঁর পিএ এহসান খান, অন্যজন পিয়ন আব্দুস সালাম।
আব্দুস সালাম মহাপরিচালকের চামড়ার এটাশে নিয়ে প্রশস্ত সিঁড়ি দিয়ে মহাপরিচালকের পেছন পেছন উঠছে।
— এহসান মুঝে এক বাত বাতাও
— সাব
— তমুদ্দুন মজলিসকা দেমাগ খারাব হো গায়া হ্যায় কেয়া?
— জ্বি সাব।
— জ্বি জ্বি কিয়া? সওয়াল কা কোঈ জওয়াব তো দো ভাই।
— জ্বি সাব।
— এক কাম কারো, মকসুদ সাব কো ভেজ দো।
— জ্বি সাব।
মাকসুদ উর্ধতন কেরানি। বাড়ি চট্টগ্রাম। বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশি হবে। মাথায় টুপি, পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ – এর সৈনিক। পাকিস্তানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত।
মহাপরিচালকের দরোজার কাছে একটি কাঠের টুলে বসে আছে সালাম। মাকসুদ সাহেব সালামকে ইশারা করে জানতে চান ভেতরে যাবেন কিনা। সালাম হাত ইশারা করলে তিনি দরোজায় ঝোলানো লাল ভেলভেটের পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢোকেন।
— আইয়ে, মকসুদ সাব, তশরিফ রাকখিয়ে, এক বাত বাতাইয়ে।
— জ্বি সাব
— আপ তো প্রফেসর কাসেম সাব কো জান্তে হি হোঙ্গে, ও তো পাকিস্তান কে লিয়ে বহুত খাস আদমি থা, ম্যায়নে সোনা, উনহুনে এক কিতাব নিকালা, উর্দূ নেহি কৌমি জবান হোগি বাংলা, ইয়ে বাত সাচ হ্যাঁয় কিয়া?
— ম্যায় তো এয়সে কুচ সুনা ভি নেহি।
— নেহি সোনা? কাল ম্যায় ক্লাব গায়া থা, অফিসার্স ক্লাব। উহা সব লোগ তো এ-হি জিকির কার রাহে থে। এক কাম কারো, ও কিতাব মুঝে জরুর চাহিয়ে। আপ ও কিতাব মুঝে তর্জামা কারকে সুনাওগে।
— জ্বি সাব, ঠিক হ্যায়।
— ঠিক হ্যায়, আপ আইয়ে, আপনা কাম কিজিয়ে…
মাকসুদ দরোজার বাইরে বের হতেই সালাম উঠে দাঁড়ায়। দুজনের চোখাচোখি হয়। মাকসুদ চোখ ফিরিয়ে হাঁটতে শুরু করে। লম্বা বারান্দা ধরে কিছু দূর হেঁটে গিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। সালাম তখনো মাকসুদের দিকে চেয়ে আছে।
কিতাবের কভারে বড় করে লেখা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এর নিচে ছোটো করে লেখা ‘বাংলা না উর্দূ’। লাল রঙ দিয়ে হাইলাইট করা। কভারের মাঝখানে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর সাদা অক্ষরে দুই লাইনে লেখা ‘তমদ্দুন মজলিস’। এর নিচে হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর তিনটি লাল বুলেট পয়েন্ট দিয়ে লাল অক্ষরে লেখাঃ
• আমাদের প্রস্তাব
(মজলিসের পক্ষ হইতে লিখিত)
• রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা
অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন
• বাংলাই আমাদের রাষ্ট্রভাষা হইবে
আবুল মনসুর আহমদ
কিতাবখানি উল্টে পাল্টে দেখছেন সাজ্জাদ হোসেন। কিছুক্ষণ পরে তা ফ্লোরের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলেন –
— কোই ভি কিতাব নাপাক নেহি হো সাক্তি। লেকিন ইয়ে কিতাব হারগিজ নাপাক হ্যায়। বাংলা? ইয়ে হিন্দু আদমি কো জবান হ্যায়, কৌম কি জবান আগার বাংলা হোগি তো সারে মুল্ক নাপাক হো জায়েগা। বাতাইয়ে মকসুদ সাব, ইয়ে গলদ বাত হ্যায় কি নেহি?
— আপনে বিলকুল সহি ফরমাইয়ে সাব।
— ইস নাপাক কিতাব মে জো কুচ লিখ্যা হ্যায় কাল আপনে মুঝে তর্জামা ক্যারকে সোনাও গে।
— রেহনে দো না সাব। ইয়ে নাপাক বাদ সুন্নে মে কিয়া ফায়দা।
— জরুর ফায়দা হ্যায় মকসুদ। দুশমন কা মোকাবেলা কার্নে কো উনকি হার কদম ওয়াকিফ হোনা ফরজ হ্যায়। ইয়ে এক হিন্দুস্তানি চাল হ্যায়।
মহাপরিচালকের কক্ষ থেকে ভেলভেটের পর্দা ঠেলে বের হয় মাকসুদ। টুল থেকে উঠে দাঁড়ায় সালাম। সালামের সাথে চোখাচোখি হয়। কেউ কোনো কথা বলে না। মাকসুদ লম্বা করিডোর ধরে দশ কদম এগিয়ে গিয়ে পেছনে তাকায়। সালাম তখনো তাকিয়ে আছে। ওদের আবার চোখাচোখি হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। আজ অর্ধদিবস অফিস হওয়ায় বারোটায় ছুটি হয়ে গেছে। চাচা আবদুল হান্নানের বাড়ি থেকে সালাম বেরিয়ে এসেছে মাস তিনেক হয়। পলাশীর একটি মেসে উঠেছে। ছাপড়া মেসের এক কামরায় দুটি ছয় ফুট বাই সাড়ে তিন ফুট তক্তপোষ, এরই একটি সালামের শয্যা, এখানে সে ঘুমায় বেহেশতের ঘুম। নিজেকে মনে হয় এই তক্তপোষের রাজা। এটাই সালামের নিজের পৃথিবী। এই একটি জায়গায় সে স্বাধীন আর সর্বত্রই পরাধীন, কেউ না কেউ তার নিয়ন্ত্রক।
অফিস থেকে বের হয়ে এক মিনিটও কোথাও দাঁড়ায় না সালাম। ওর লক্ষ সাড়ে তিন ফুটের তক্তপোষ। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সে ছুটতে থাকে। কার্জন হলের সামনে এসে কিছুটা আনমনা হয়ে যায়। এই জায়গাটিতে বড় বড় কিছু গাছ থাকায় দুপুর বেলায়ও একটা ছায়া ছায়াপরিবেশ থাকে। এই ছায়ার মধ্যে কিসের যেন মায়া। জায়গাটিকে কেমন আপন আপন লাগে। এখানে এলেই মনে হয় ওর নাম আব্দুস সালাম না, বাণিজ্য ও শিল্প অধিদপ্তরের পিয়ন আব্দুস সালাম একজন অচেনা মানুষ, ওর নাম সেলেম মিয়া। লক্ষণপুর গ্রামের বাঁশঝাড়, পুকুর পাড় চষে বেড়ানো কিশোর সেলেম মিয়া।
সেলেম মিয়া আরেকটু সামনে এগিয়ে একটি মৃদু গুঞ্জন শুনতে পায়। একদল ছাত্র বাঁশের মাথায় চাঁটাই বেঁধে তার মধ্যে রঙিন কাগজ লাগিয়ে মিছিল করছে। সেইসব কাগজে লেখা, ‘রাষ্ট্রভাষা, বাংলা চাই’। সালাম যত সামনে এগোয় গুঞ্জনটা তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ওদের বড় কর্তা সাজ্জাদ হোসেন যে বাংলা ভাষাকে অপছন্দ করেন লেখাপড়া কম হলেও এটা সালাম বেশ বুঝতে পারে। মিছিলের এই মানুষগুলি বুঝি ওদের বড়কর্তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে নেমেছে। বড় সাহেব বলেন, বাংলা হিন্দুর ভাষা, এই ভাষা নাপাক। কিন্তু আমার আব্বা তো পাঁচ অক্ত নামাজ পড়েন, লক্ষণপুর মসজিদের ইমাম সাহেব হাছন মোল্লা, গাঁওয়ের মুসুল্লিরা সকলেই তো বাংলায় কথা কয়। সালামের কাছে সবকিছু খটকা লাগে। হান্নান চাচা বলেন, পাকিস্তান অতি পবিত্র দেশ, উর্দূ পবিত্র ভাষা। বাংলা কি অপবিত্র? এই যে এতো মানুষ বাংলায় কথা কয়, তাঁরা কি সব দোযখে যাবে? সবকিছু কেমন গোলমেলে লাগে সালামের। মিছিলের স্লোগানগুলো তখন হাতুড়ির শব্দের মতো লাগে বুকে। ওদের অফিসের লাল দেয়ালে একদল মানুষ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।
ইতিহাস থেকেঃ
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার লক্ষকে সামনে রেখে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির শীর্ষব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি [১৯৪৮ সালের ৪ থেকে ৭ মার্চ ]। ষ্টুডেন্টস এ্যাকশন কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীক আন্দোলনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন করে। তাঁরা ১১ মার্চ ১৯৪৮ তারিখে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়।দুপুরে সমাবেশ করে এবং সমাবেশ শেষে একটি মিছিল বের করে। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী মিছিলে হামলা চালিয়ে শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, অলি আহাদসহ বেশ কয়েকজন ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করে।
৩২ টি ছাপড়া ঘরের মেসে ৬৪জন বর্ডার। ঘরগুলো দুই সারিতে বিভক্ত, রেললাইনের দুই সমান্তরাল রেখার মত। রেখার উত্তর প্রান্তে চারটি সারিবদ্ধ কাঁচা পায়খানা, পায়খানার পেছনে নিচু জমি এবং জঙ্গল। পায়খানার পাশে বড়সড় একটি কলতলা, একটিমাত্র টিউবওয়েল। চার বালতিতে পানি, একসাথে চারজন গোসল করছে। কলতলার আশে পাশে বেশ কয়েকজন লুঙ্গি পরা উদোম গায়ের লোক দাঁত দিয়ে কয়লার টুকরো ভেঙ্গে আঙুল দিয়ে দাঁত মাজছে। ওদের মুখ থেকে কালো রঙের লালা গড়াচ্ছে। লালা গড়াতে গড়াতে একজনের নাভির গর্ত ভরাট হয়ে লুঙ্গির খুঁটের দিকে কালো একটি ধারা নেমে যাচ্ছে। পায়খানার সামনে বর্ডারদের লাইন। সালামের সামনে তিনজন লোটা হাতে দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে দুইজন। এখন সকাল ছয়টা, হেঁটে অফিসে যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিট। সালামকে অফিসে পৌঁছাতে হয় সকাল সাড়ে সাতটায়।
যেখানে কলতলা এবং পায়খানা ঠিক এর উল্টোদিকে মেসে প্রবেশের একমাত্র তোরণ। তোরণটি কাঠের, জীর্ণ, অ্যাবড়ো-থেবড়ো। এর পাশেই, তর্জার বেড়া এবং ঢেউটিনের চাল দেওয়া একটি রান্নাঘর। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উঠছে। এখানেও লাইন। দুজন কালো, শীর্ণকায়, মধ্য-কুড়িতে বয়স, বুয়া বেশ দ্রত গতিতে খাবারের থালা তুলে দিচ্ছে বর্ডারদের হাতে হাতে। প্রতিটি থালায় একটি ডিম পোচ, আলু ভাজি এবং দুটো লাল আটার রুটি। নিত্যদিনের নাশতা রুটি-আলুভাজি, সপ্তাহে দুদিন থাকে ডিম পোচ, আজ সেই দুদিনের একদিন। বর্ডাররা নাশতার থালা নিয়ে যার যার ঘরের দিকে ছুটছে। বেশ কয়েকটি পাতি কাক রান্না ঘরের চালের ওপর থেকে সুযোগ পেলেই নেমে এসে বর্ডারদের হাতের থালার ওপর ছোঁ মারছে। রান্না ঘরের বাইরে একটি কাঠের টুলের ওপর বড় কেতলিতে চা এবং অনেকগুলো টিনের কাপ রাখা আছে। যাদের নাশতা খাওয়া হয়ে গেছে তারা টিনের কাপে চা ঢেলে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। এঁদের কেউ কেউ বাংলা ভাষা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এখানে-সেখানে গ্রেফতারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। মাওলানা ভাসানির প্রতি কারো কারো বেশ আগ্রহ। গতকাল মাওলানা সাহেব জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। দেখা যাক তিনি কি করেন। যে যুবকটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পিয়ন, বাড়ি যশোর, নাম ফারুক, তাঁকে বেশ জ্ঞানী মনে হচ্ছে এবং তার কাছে অনেক খবর আছে যা অন্য কারো কাছে নেই।
— মুসলিম লীগ থেকে দলে দলে বাঙালিরা বেরোয়ে আসচে, এবার খেলা জমবি। আকরাম খাঁ সাহেবকে ওঁরা ভেবেছে ওদের পা চাটবি, কিছুতেই তা হবি না নে।
সবাই হা করে ফারুকের কথা শুনছে। এদের অনেকেই মাথামুণ্ডু তেমন কিছু বুঝতে পারছে না। তবে বাংলা আর উর্দূর মধ্যে যে একটা ফাইট চলছে এটা বেশ বুঝতে পারছে। যিনি গ্লাস ফ্যাক্টরির ফোরম্যান, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই, মাত্র ছয় ক্লাস পড়লেও অভিজ্ঞতার কারণে যার জ্ঞান বেশ টনটনে, তিনি যোগ করেন।
— আরবি অক্ষরে বাংলা, কি আজগুবি ব্যাপার মিয়া। আকরাম খাঁ এই কমিটি থাইকা পদত্যাগ করে না কেন হেইডাই আমি বুঝি না।
দুই তিনজন চায়ের কাপ থেকে মুখ তুলে তাকায় হাতেম আলীর দিকে। এদের একজন আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে এগিয়ে আসে।
— হাতেম চাচা, আরবি অক্করে বাংলা, বিষয়ডা কি বুজলাম না দো।
— চোখ-কান খোলা রাইখো মিয়া। মুসলমানেরা পাকিস্তান পাইছে ঠিকই কিন্তু বাঙালিরা কোনো দেশ পায় নাই। হেরা, পশ্চিমারা, চাইতাছে উর্দূ যদি বাঙালিরা না মানে তাইলে আরবিতে বাংলা লেখতে অইব। এইডা আজগুবি না, কও।
সবাইকেই যার যার কাজে যেতে হবে। সকালের এই আড্ডার স্থায়িত্ব তাই ক্ষণস্থায়ী। ওরা চায়ের খালি কাপ কাঠের টুলে রেখে যার যার কর্মক্ষেত্রের দিকে ছুটতে থাকে।
১৯৫১ সালের মার্চ মাসে আব্দুস সালাম বাণিজ্য ও শিল্প অধিদপ্তরের রেকর্ড কিপার পদে পদোন্নতি পান এবং ঢাকার নীলক্ষেত ব্যারাকে সরকারী বাসা পেয়ে ৩৬বি কোয়ার্টারে ওঠেন। পলাশী মেসের বর্ডাররা সালামের মত একজন মিতভাষী এবং চরিত্রবান বর্ডারকে হারিয়ে মর্মাহত হয়।
১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাস। লক্ষণপুর থেকে চিঠি এসেছে। সালামের বাবা অসুস্থ, সালাম যেন বেশি করে টাকা নিয়ে শিগগিরই বাড়ি যায়। চিঠি লিখেছে সালামের ছোটো ভাই কালাম।
ফেনী স্টেশনে এসে ট্রেন থামে ভোর ছয়টায়। ট্রেন থেকে নেমে গরুর গাড়িতে চড়ে সালাম। উঁচু-নিচু কাঁচা রাস্তা। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে দিনের আলো নিভে গিয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। গাড়োয়ানের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সালাম ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢোকে। ফাজিল মিয়া ঘরের পেছনে, রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে, চাঁদের আলোতে হুক্কা টানছে। প্রতিটি টানের সাথে সাথে কল্কিতে টিক্কার লাল আগুন তীব্র হয়ে উঠছে এবং দম ছেড়ে দিতেই আগুনটা যখন স্তিমিত হচ্ছে তখন কল্কি থেকে নীল একটি ধোঁয়া উঠছে। অল্প বয়সী ফর্শা, গোলগাল মুখের এক মেয়ে সালামকে দেখে লম্বা ঘোমটা টানে। সালাম বাবা মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। যে মেয়েটি লম্বা ঘোমটা টেনেছিল সে কাছে এগিয়ে এসে সালামকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। ওর দেখাদেখি সালামের ছোট ভাই-বোনেরা সবাই লাইন করে দাঁড়িয়ে সালামকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে।
মায়ের দিকে তাকিয়ে সালাম বলে,
— কালামের বউ সুন্দর ঐছে।
— এরুম সুন্দর উজ্ঞা তুর লাই আঁই ঠিক কৈচ্চি।
কথাটা বলেই দৌলতন নেছা সালামকে জড়িয়ে ধরে নাকি সুরে কান্না শুরু করেন।
— তুর কিতা ঐছেরে বাজান। গত হাঁচ বছর আঁই তুরে দেয়ি নো। তুই দেশোত আইয়ছ না কা? কার লগে গুস্যা কইচ্চত? তুর বাহের লগে, না আঁর লগে?
— আঁই গুস্যা করি নো মা।
— তই?
ফ্যাল ফ্যাল করে দৌলতন নেছা ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
— আব্বার কি অসুক?
জামালের বয়স সতের। সে ফিক ফিক করে হাসে। কুলসুম ষোড়শী, ওর সারা গায়ে রূপের আগুন জ্বলে। সেও মুচকি মুচকি হাসে। সালাম বুঝতে পারে, ওর বাবা ফাজিল মিয়ার কোনো অসুখ করেনি, অসুখের কথা বলে ওকে বাড়িতে আনা হয়েছে এবং এ-ও আন্দাজ করতে পারে বাবা–মা ওর জন্য কোনো বিয়ের সম্মন্ধ ঠিক করেছে। ঘাটের কাছে একটি বিশাল বরুণ গাছ। বরুণ গাছ থেকে সুর পাল্টে নানান ভঙ্গিতে পেঁচা ডাকছে।
ঘরের মেঝেতে খড় ছড়িয়ে তার ওপর হোগলা বিছিয়ে বিছানা করা হয়েছে। একপাশে মেয়েরা অন্য পাশে ছেলেরা। দৌলতন নেছার ছোটো সন্তানের বয়স ১৩ বছর, খুব রুপবতী এক কন্যা, ফাতেমা। যেমন রূপ তেমন গুণ। এই মেয়েটি স্কুলে গিয়েছে। প্রাইমারি পাশ করেছে। পাঁচ মাইলের মধ্যে যেহেতু কোনো হাইস্কুল নেই তাই আর পড়া হয়নি। এজন্য ফাতেমার খুব মন খারাপ। সে আরো পড়তে চায়।
বড় ভাইকে পেয়ে ছোটো ভাই-বোনেরা সরব। সালামকে কোথায় বিয়ে করাবে, সালামের বউ দেখতে কেমন, এইসবই আলোচনার বিষয়। এক পর্যায়ে শুরু হয় ওদের সবচেয়ে মজার খেলা, ঘুমানোর আগে শুল্লুক বলা। ফাতেমা শুল্লুক দেয়।
— আঁই বড় বাইজানরে উজ্ঞা শুল্লুক দেই।
রাজবাড়ির গুড়ি/ এক বিয়ানে বুড়ি
সালাম বিপাকে পড়ে। সে এই শুল্লুক আগে কখনো শোনেনি।
— আঁই হাইত্তাম নো।
কুলসুম বলে, আঁই বাঙ্গাই?
ফাতেমা বলে, না ছুডু বু, তুঁই না।
তখন সবাই চুপ করে থাকে। টিনের চাল মটমট করে ওঠে। শব্দটা বিকট লাগে। ফাতেমা ভয় পায়। ভয়ে সে তার মায়ের দিকে ঘেঁষতে থাকে। নিজের ভয় দূর করতেই বলে –
— আইচ্চা ছুডু বু তুঁই শুল্লুক বাঙ্গা।
কুলসুম বলে, কলাগাছ।
এরপর আর কোনো সাড়া নেই। কিছুক্ষণ পরে নাক ডাকার একটা শব্দ ওঠে, আস্তে আস্তে শব্দটা তীব্র হতে থাকে।
ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে সালাম ঢাকায় ফিরে আসে। রাজাপুর ইউনিয়নের খলিলুর রহমানের অষ্টাদশি কন্যা বিলকিসের সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঢাকা থেকে বিয়ের বাজার করে একমাস পরে লক্ষণপুর ফিরে যাবে সালাম। ফাল্গুন মাসের ৩০ তারিখ, বৃহস্পতিবার, বিয়ে।
প্রতিদিন অফিসে আসা-যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উত্তেজনা দেখতে পায় সালাম। আজকাল সে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়, এক পা, দু’পা করে এগিয়ে যায়। কি বলছে ছাত্ররা? রোজই মিছিল বের হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বাংলা চাই।’ এই কথাগুলি খুব মধুর লাগে সালামের কাছে। আচ্ছা, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র না, আমাকে কি ওরা মিছিলে নেবে? সালামের ইচ্ছে হয় মিছিলে গিয়ে চিৎকার করে বলতে, সাজ্জাদ স্যার, বাংলা আমার মায়ের ভাষা, বাংলা অতি পবিত্র ভাষা, বাংলা নাপাক ভাষা না।
ঊনিশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে সালাম পলাশীর মেসে যায় ফারুকের খোঁজে। ফারুক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করে, ওর কাছে ভেতরের খবর থাকবে। দরকার হলে জীবন দেব তবু বাংলা ভাষা ছাড়ব না। বাংলা আমার প্রাণের ভাষা। এই কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে সালাম মেসের ভেতরে ঢোকে। ভেতরে জটলা। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে উত্তেজনাকর আলোচনা চলছে। মেসের ৬৪ জন বর্ডার মিলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন ছাত্রনেতা আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক যে কোনো মূল্যে বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বদ্ধপরিকর, এই কথা ফারুক সবাইকে জানায়। বাঙালিরা যে রাজনৈতিক দলই করুক বাংলা ভাষার প্রশ্নে সবাই এক হয়ে যাচ্ছে। এইসব উচ্চাকাঙ্খী কথা ওদের শোনায় ফারুক।
সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে। পাঁচজন এক সঙ্গে হতে পারবে না। বিশ তারিখ বিকেলে ঘরে ফেরার পথে সালাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ে। ফারুককে খুঁজে বের করে। ফারুক ওকে দুজন ছাত্রনেতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। একজন আনোয়ারুল হক খান, অন্যজন মঞ্জুর হোসেন। মঞ্জুর হোসেন সালামকে উৎসাহ দেয়, ‘বাংলা ভাষার আন্দোলন শুধু ছাত্রদের আন্দোলন না, এটা সব বাঙালির আন্দোলন, আপনে আসেন, আমাদের সাথে যোগ দেন।’
সালাম উত্তেজনায় সারা রাত ঘুমাতে পারে না। পরদিন অফিসে যায়নি। সকাল নয়টায় হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়। ওর গায়ে হাফ হাতা শাদা শার্ট, পরনে কালো ঢোলা প্যান্ট, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল।
রোদ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। নানান দিক থেকে ছাত্র জনতা ছুটে আসছে। এরই মধ্যে কয়েক’শ মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। তখন একটি টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে উপস্থিত ছাত্র জনতার উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছেন গাজীউল হক। তিনি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করার পক্ষে ছাত্র জনতাকে উদ্বুদ্ধ করছেন। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ছেন কাজী গোলাম মাহবুব। এর আগে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক তাঁর বক্তৃতায় বলেন, এটা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা যাবে না। কিন্তু উপস্থিত ছাত্র জনতা তেঁতে আছে, তাঁরা যে কোনো মূহূর্তে মিছিল বের করতে চায়। মিটিং শেষে ছাত্র জমায়েত ছুটে চলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে।
ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে আছে এই খবর পেয়ে ছুটে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেইন, তাঁর সঙ্গে আরো সাত/আটজন শিক্ষক। তিনি গাজীউল হকসহ অন্যান্য ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যেন কোনো মিছিল বের করা না হয়। উপাচার্য কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছাত্ররা স্বতঃস্ফুর্তভাবে মিছিল বের করে।
এক দৌড়ে সালাম মিছিলে ঢুকে যায়। পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। সালাম দেখে সবগুলো পুলিশের মুখ সাজ্জাদ হোসেন, ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা একেকটি অশুর। সালামের পেটে গুলি লাগে। গুলি লাগে আরো কয়েকজনের গায়ে। ছাত্ররা ধরাধরি করে সালামকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগে নিয়ে যায়।
দেড়মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল ভাষা সৈনিক আব্দুস সালাম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
দাগনভূঞার লক্ষণপুর গ্রামের নাম এখন সালামনগর। সালামনগরে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। শত শত মানুষ প্রতি বছর এই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে খোঁজে শহীদ আব্দুস সালামকে।
১৯৮২ সালের ৭ এপ্রিল। আজিমপুর গোরস্তানে এক বৃদ্ধা খুঁজছেন তাঁর পুত্রের কবর। কিন্তু কোথাও তাঁর চিহ্ন নেই। তাঁর হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা। পুত্রের কবর খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত বৃদ্ধার হাত থেকে খসে পড়ে পুষ্পগুচ্ছ। তিনি ঢলে পড়েন।
বৃদ্ধার নাম দৌলতন নেসা।