আড্ডাপত্র

১৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০; ২ ডিসেম্বর, ২০২৩;রাত ১:১৩

হারানো কুড়নো আখ্যান | পর্ব- চার

আড্ডাপত্র

নভে ৭, ২০২০ | স্মৃতিগদ্য

সরকার আবদুল মান্নান


কত স্মৃতির ভিতর ধুলোর আস্তর জমে। একটু ফুঁ দিলে ভেসে ওঠে স্মৃতির পর্দায়। শার্সি টেনে  দেখা যায় ঝলমলে রোদের ভিতর হাসছে আনন্দ-বেদনার রোদবৃষ্টি। দুঃখ-কষ্টের জমানো ব্যথা। বেড়ে উঠবার টানটান ঘটনা। আবার মিষ্টি ফুলের সুবাসও আসে জানালার ফাঁক গলে। ড. সরকার আবদুল মান্নান নিজের জীবনের সেইসব গল্পই ধুলোর চাদর সরিয়ে পাঠকের সামনে হাজির করছেন। নিজের জীবনের সাথেও তো মিলে যায় কত কিছু!

পাল তোলা নৌকা

বর্ষা কাল। গ্রামের মানুষ নৌকা ছাড়া অচল। বাড়ি থেকে বের হতে গেলেই উঠতে হয় নৌকায়। গোরু-ছাগলের ঘাস কাটতে নৌকা লাগে। হাট-বাজারে যেতে নৌকা লাগে। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রতিবেশীদের বাড়িতে যেতে নৌকা লাগে। স্কুল-মাদরাসায় যেতে নৌকা লাগে। এমন কি প্রাকৃতি কাজে সাড়া দেওয়ার জন্যও নৌকা নিয়ে চলে যেতে হয় আড়ালে- ধান ক্ষেত, পাট খেত বা ঝোপ-ঝাড়ের ভেতরে।
প্রয়োজনের মানুষ যারা তাদের নৌকা খুব প্রয়োজন। তারা নৌকায় চড়ে অনেক কাজ করে। কিন্তু আমরা যারা শিশু, যাদের কোনো কাজের মানুষই মনে করা হয় না, নৌকায় তাদের সব চেয়ে বেশি কাজ থাকে। অতীব জরুরি কাজ। আর সেই কাজের কোনো সময়ও থাকে না। যখন-তখন আমাদের কাজ পড়ে যায় এবং আমরা নৌকা নিয়ে চম্পট দিই।

সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। চিন্তাহীন বৃষ্টি। কোনো বেগ নেই, আবেগ নেই, তাড়া নেই- এমন বৃষ্টি। আকাশ থেকে আপন মনে ঝড়ে যাচ্ছিল অভিন্ন তালে লয়ে ঝঙ্কারে। গ্রামীণ জামাইদের মতো। বর্ষায় যখন তারা শ্বশুরালয়ে এসে ওঠে তারপর আর যাওয়ার নামটি লয় না। কিন্তু এক সময় শ্যালিকা বা দাদি শাশুড়ি নামক নির্লজ্জ প্রাণীরা তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়,‘অ কুলসুমের জামাই, আমনেগ বাড়ি-ঘর কি গাঙ্গে ভাইঙ্গা নিছে?’ জামাইর তখন হুশ হয়, মনে হয় বাড়ি যাওয়ার কথা। কিন্তু এই নিরাবেগ বৃষ্টিকে মনে করিয়ে দেবে কে? সূর্য দেব তো আর তার শ্যালক না। সুতরাং বৃষ্টি ঝড়ছে নীরবচ্ছিন্নভাবে।
সেই বৃষ্টির মধ্যে আমরা তিনটি বালক ছোট কাকুর ডিঙ্গিতে উঠলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, নৌকায় মাস্তুল ছিল, বাদাম ছিল, বৈঠা ছিল, হাল ছিল। এমন কি লগিটিও কাকু বাড়ি নিয়ে যায়নি।

এমন পরিপূর্ণ সুযোগ আমাদের জীবনে আর কখনই আসেনি। সুতরাং আমরা আনন্দে অস্থির হয়ে উঠলাম। আর কে কোন দায়িত্ব পালন করব তাই নিয়ে মহা জামেলা লাগিয়ে দিলাম। লগি মারলে বৈঠা বাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। হান্নান বলল, ‘এই পোড়া মইচ তুই লগি মার আর আমি বইডা বাই।’
আমাকে পোড়া মরিচ বলাতে মেজাজটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বিশেষ করে হান্নান বললে আমি আর মাথা ঠিক রাখতে পারি না।
বৈঠা দিয়ে ওর পশ্চাৎদেশে আঘাত করে বললাম, ‘পোড়া মইচ কছ কে, হ্যা? আমার নামে তোরে কামড়ায়!’
গফুর আমাদের এসব ঝগড়াকে পাত্তা দিল না। মহা মাতব্বরের ভাব নিয়ে বলল, “ওই কালকুইট্টা, লগি বাঅনের কাম কী? বাহের গোত্তে লগি বাস নাই। এহন বাদাম উড়া।’

গফুর সব সময়ই আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। কখনো বলে, ‘পোড়া মইচ’, কখনো ‘কালকুইট্টা’। আমার কাছেও একটা জবাব আছে। কিন্তু সচরাচর আমি বলতে সাহস পাই না। ওর মুখের সামনে উপরের পাটির দাঁতগুলো খুব বড় আর উঁচু। সব সময়ই সেগুলো বের হয়ে থাকে। সে জন্য বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বিগণ ছাড়া চেঙ্গর প্রকৃতির নারি-পুরুষরা ওরে বলে দাত্তা।
আমি দু-এক বার দাত্তা বলে ওর হাতে ভালো মার খেয়েছি। মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে গিয়ে যখন উপস্থিত হয়েছি, মা তখন অগ্নিমূর্তি। ‘কি রে কানতেছস কিলিগা। কী অইছে?

আমি তখন সেই কান্না জড়িত কণ্ঠে নাকের পানি আর মুখের পানিতে একাকার করে বলতাম, ‘দাত্তায় আমারে মারছে।”
মা আরও অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলতেন, ‘দাত্তায় তোরে মারছে আর তুই কী করছস- বলে আমার পিঠে কয়েক ঘা থাপ্পর লাগিয়ে দিতেন। আর আমি অধিক চিৎকার করতে করতে দক্ষিণের বিলের দিকে দৌড়াতাম। সুতরাং খুব অল্পতেই আমার এই বোধোদয় ঘটে যে, সহানুভূতিহীন এই পৃথিবীতে এমন কি মায়ের কাছেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লাভ নেই। অধিকন্তু ডবল মার খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। তাই পারতপক্ষে গফুরকে আমি দাত্তা বলি না। তবে অন্যে যদি বলে- বিশেষ করে, বলে যারা মার খাওয়া ছাড়াই পাড় পেয়ে যায়, তখন আমি খুশি হই, আর গফুরের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিই।
আজ আর আমি গফুরকে ছেড়ে কথা বলতে চাইলাম না। বললাম, ‘ওই দাত্তা! লগি না বাইলে নাও খালে নিবি তোর মাথায় কইরা?’
হান্নানও আমার কথায় সায় দিল। বলল, ‘তোর মাথায় গু। নাও খালে না-নিলে বাদাম দিলে চলব?’
দুই দিকে আক্রমণ পেয়ে গফুর আর কথা বাড়াল না। বলল, ‘তয় নে। নাও খালে নে।’

লগি মেরে, বৈঠা বেয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা নৌকা নিয়ে বর্ষার খরস্রোতা খালে চলে গেলাম। এই খাল অল্প পশ্চিমে মেঘনায় গিয়ে মিলেছে। নৌকা খালে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের আর তেমন কিছুই করতে হলো না। নৌকার মাঝে পাল তোলার গর্তে লগি কুপে পাল তোলার সময়ও আমরা পেলাম না। ভাটার তীব্র টানে কয়েক মিনিটের মধ্যে নৌকা পড়ল বিপুল জলরাশির দিগন্তহীন মেঘনায়। খালে-বিলে যে নৌকাটিকে মনে হলো বিশাল জবরদস্ত, সেই নৌকাটিকেই বিপুল মেঘনার সীমাহীন বুকে অতি অসহায় একটি ঠোঙ্গার মতো মনে হচ্ছিল। আর সেই ছোট ঠোঙ্গাটি আপ্রাণ চেষ্টা করছিল তিনটি বালককে রক্ষা করার। কিন্তু কিছুতেই যেন পারছিল না। স্রোতে আর ঢেউয়ের তোড়ে ডিঙ্গিটি অসহায়ের মতো পাক খাচ্ছিল। ভয়াবহভাবে দুলছিল। কিন্তু তখনও আমাদের বোধোদয় হয়নি যে, আমরা একটি ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি।
সেই চরম বিপদের মধ্যে গফুর বিশাল দাঁতগুলো মারিসমেত বের করে বোকার মতো হেসে বলল, ‘বাঁচতে অইলে বাদাম দিতে অইব, বুঝলি। গঙ্গিমা বেজায় চইট্টা গেছে। শিগগির পলাইতে অইব।’
এই আহম্মকটার অনেক কথাই আমরা বুঝি না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সমীহ করি। সুতরাং তিনটি বালক আপ্রাণ চেষ্টা করে পাল তুলে দিতে সক্ষম হলাম।
পালে যখন বাতাস লাগল তখন নৌকাটি এমন দ্রুত পাক খেল যে, আমাদের তিন জনেরই স্রোতে আর ঢেউয়ের তাণ্ডবের মধ্যে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কোনো রকমে টাল সামলিয়ে হান্নান হাল ধরল। কিন্তু নৌকা চলল রকেটের গতিতে দক্ষিণ দিকে। অর্থাৎ আমাদের প্রত্যাশার উলটো দিকে। আমি উষ্ঠাগত প্রাণ নিয়ে বললাম, ‘ও গফুর, নাও যায় কই? আমাগ কি সাগরে লইয়া যাইব!’
পালে বাতাস লাগর সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ছুটল পশ্চিম দিকে। পশ্চিম দিকে বিশাল জলরাশি ছাড়া আর কিছু নেই। ও পাড়ে পাড় কোথায় আমরা তার কিছুই জানি না। পাড় থাকলে সেই পাড়ে দৈত্য-দানোদের পৃথিবী কি না তাও জানি না। হান্নান হাল ধরে আর আমি পালের লগি ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলাম, ‘ও গফুর, নাও যায় কই!’

পুবদিক থেকে বাতাস বইছে। সেই বাতাস পালে লেগে নৌকা যাচ্ছিল পশ্চিম দিকে। গফুর পালের রশিটা টেনে একটু কৌণিক করার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার গতি পরিবর্তন হয়ে নৌকা ছুটছে দক্ষিণ দিকে। এখন আমাদের আত্মায় পানি এসেছে। তীরের অনুকূলে নৌকা যাচ্ছে- এই হলো ভরসা। হান্নান হাল ধরে মহা আনন্দে আছে। আর চিৎকার করে বলছে, ‘পঙ্খি। পঙ্খির মতো যাইতেছে।’
পঙ্খির মতো নৌকা কোথায় যাচ্ছে তা বোঝার সময় তখনও হয়নি। অসাধারণ একটি গতির বেগ আমাদের পাগল করে তুলেছিল। গতির ভেতরে এমন বিস্ময়কর আনন্দ থাকতে পারে তা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। হান্নান তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাল সামলাচ্ছিল। গফুর পালের রশি ধরে রাখছিল প্রাণপনে। আর আমি পালের লগি সোজা রাখতে চেষ্টা করছিলাম সর্বশক্তি দিয়ে। ডিঙ্গিটি তখন সত্যি স্পিড বোটের মতো উত্তাল তরঙ্গায়িত ঢেউ অগ্রহ্য করে ছুটে চলছিল আর সামনের গলুইর সঙ্গে সেই ঢেউ ধাক্কা খেয়ে আনেক উপরে উঠে যাচ্ছিল জলরাশি। আমরা অধিক উন্মাদনা ও শক্তি নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছিলাম পাল তোলা নৌকাটিকে। এ যেন অনেকটা উন্মত্ত ষাড়কে নিয়ন্ত্রণ করা।

এর মধ্যে আমরা বাড়ি থেকে তিন-চার মাইল দূরে চলে এসেছিল। এখলাসপুর, জহিরাবাদ, জয়পুর, নাওভাঙ্গা ইত্যাদি গ্রাম অতিক্রম করে আমরা চলে এসেছি আমিরাবাজারের কাছে যার পাশ দিয়ে ডাকাতিয়া নদী এসে মিলেছে মেঘনার সঙ্গে। কিন্তু সেই সময় দশ-বার বছরের বালক আমরা, কিছুই চিনতাম না। আনন্দ, উন্মাদনা, এডভ্যাঞ্চার- এই সব ছিল আমাদের একমাত্র পরিচয়। সুতরাং যে গতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে তার চেয়ে সত্য আর কিছুই ছিল না। সুতরাং মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, হাট-বাজার অতিক্রম করে আমরা মহা আনন্দে চিৎকার- চেচামেচি করতে করতে চাঁদপুরের দিকে এগুয়ে যেতে লাগলাম।
কিন্তু যখন দিনের আলো কমে আসতে লাগল তখন গফুর বলল, ‘হাঞ্জা অইয়া যাইতেছে। থো, আর যাই না।” বলেই সে পালের রশি ছেড়ে দিল। তখন এলায়িত পালে উদ্ভ্রান্ত বাতাস ঝাপ্টা দিয়ে পালের কাপড় ছিড়ে ফেলার অবস্থা তৈরি করে। আর নৌকার গতিও থেমে যায় অকস্মাৎ।
হান্নান হাল ছাড়ল না। কিন্তু পালের মাস্তল এখন আর ধরে রাখার কোনো মানে হয় না। তাই আমি মাস্তল ছেড়ে দিলাম। কিন্তু পাটাতন উলটিয়ে আমি যা দেখলাম তা ভয়াবহ। নৌকার প্রায় অর্ধেক ডুবে গেছে পানিতে। চিৎকার করে গফুরকে বললাম, ‘হায়, হায়। নাওয়ে পানি উঠছে। শিগগির পানি ইচন লাগব। নাইলে নাও ডুব্যা যাইব।’

পাটাতন উলটি উলটিয়ে সেউতি খুঁজতে লাগল গফুর। আর চিৎকার করতে লাগল, ‘ও হান্নান, হেউত পাইতেছিনা তো। পানি অনে কী দিয়া ইচুম!’
অনেক খোঁজা খোঁজির পর সেউত পাওয়া গেল। কাঠের সেউত। পানি সেঁচ করতে সুবিধা। হান্নান হাল ধরে বসে আচে। নৌকা ধীরে এগুয়ে যাচ্ছে উজানের দিকে। আমি আর গফুর পালা করে নৌকার পানি সেঁচে নদীতে ফেলতে লাগলাম।
এর মধ্যে আমাদের বোধোদয় হলো যে, বাড়ি থেকে অনেক দক্ষিণে চলে এসেছি। কিন্তু কতটা পথ এসেছি তার কোনো ধারণা আমাদের নেই। এখন সেই পথ পিছিয়ে যাবো কীভাবে।
হান্নান বলল, ‘নদীর পাড়ে নাও রাইখ্যা কারো বাইত গিয়া হুইয়া থাকমু।’
হান্নানের কথা শুনে গফুরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। উঁচা দাঁতগুলো বের করে ভেঙচি দিয়ে বলল, ‘তোর মাতায় গু। কুত্তার গু। মাইনসে আমাগ থাকতে দিব কিলিগা? আমরা কি হেগ কুটুম?
আত্মীয়কে আমরা কুটুম বলি না। গফুর বলে। গফুরের দাদি অনেকদিন সিলেটে ছিলেন। সিলেটের কিছু কিছু শব্দ তিনি হরহামেশাই বলেন। এর মধ্যে কুটুম একটি। গফুরও দাদির মতো আত্মীয়কে বলে কুটুম।
গফুরের যুক্তি আমার কাছে খুবই জুৎসই মনে হলো। ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললাম, ‘হান্নান, তুই একটা বুদ্দু। নদীর পাড়ে নাও রাইখ্যা যাই, আর চোরেরা মজা করে নাওডা লইয়া যাওক। তাই না, বোদাই?’

দুই জনের কথায় হান্নান খুবই অপমানিত বোধ করে। হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘তয় কী করবি কর। আমি আর কিছু করতে পারতাম না।’
হাল ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৌকাটি পাক খেতে খেতে তীরের দিকে এগুতে লাগল। এর সঙ্গে বইঠা ফেলে ফেলে গফুর নৌকাটিকে তীরের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। নৌকা তীরে পৌঁছলে একটি প্রায় ডুবন্ত হিজল গাছের ডালে নৌকাটি বেঁধে আমরা বাড়ি ফিরে আসার পথ বের করতে চেষ্টা করলাম।
হান্নান বলল, ‘আইচ্ছা গফুর, তুই দেখছস, বাতাস যেদিক থিকা আইয়ে ছোট কাকু বাদাম দিয়া হেই দিকে নাও নিতে পারে?’
গফুর খুব অবাক হলো। হান্নানকে গালি দিয়ে বলল, ‘তুই একটা গাধা। বাতাসের উলটা দিকে নাও যায় কেমনে? নাওয়েরে কী ভূতে ধরে?”
আমি একটু খটকার মধ্যে পড়ে গেলাম। বাতাস যেদিক থেকে বয় ঠিক সেদিকে না-হলেও তার খুব কাছাকাছি দিকে পাল তোলা নৌকা যেতে আমিও দেখেছি।
কিন্তু গফুরের তিরস্কারের ভয়ে আমি মুখ খুলতে পারছি না। তবুও এক সময় গফুরকে বললাম, ‘আইচছা, বাদামের রশিটা এদিক-ওদিক টাইন্যা দেখতে পারি না নাও উত্তর দিকে যায় কি না? এহন তো বাতাস একটু ঘুরছে’
শেষ পর্যন্ত অনেক তর্ক-বিতর্ক করে সিদ্ধান্ত হয় যে, চেষ্টা করতে দোষ কী?
নৌকা আবার নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। হান্নান হাল ধরল। আমি আর গফুর পাল আর মাস্তুল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এমন একটা কৌণিক অবস্থান তৈরি করতে চাইলাম যাতে পুবের বাতাস পালে লেগে নৌকা উত্তর দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই সেই কৌণিক অবস্থান তৈরি করতে পারছিলাম না। নৌকা কেবল পশ্চিম দিকে দিগন্তহীন অনন্ত জলরাশির দিকেই চলে যাচ্ছিল। কখনো কখনো প্রবল স্রাতে আর ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা ভয়ঙ্কর রকম পাক খাচ্ছিল। আর ক্ষণে ক্ষণে নৌকা থেকে আমাদের ছিটকে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল।

শক্ত করে হাল ধরে হান্নান চিৎকার করে বলছিল, ‘তোরা নাও ডুবায়লাবি? এই দাত্তা। আয় আইল ধর। আমি দেহি।’
গফুরের হাতে হাল ধরিয়ে দিয়ে হান্নান পালের রশি ধরল। মুহূর্তেই সে পালটিকে এমনভাবে ঘুরিয়ে দিল যে পালে বাতাস লাগার সঙ্গে সঙ্গে নৌকা অনেকটা উত্তর দিকে চলতে শুরু করল। গফুর শক্ত করে হাল নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল আর আমি মাস্তল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
স্রোতের উলটো দিকে এবং বাতাসেরও প্রায় উলটো দিকে নৌকা চলতে লাগল স্পিড বোটের মতো দ্রুত গতিতে। এই অসাধারণ ঘটনাটি উপভোগ করছিল ইলিশ মাছ ধরার নৌকাগুলোর মাঝিরা। ‘মারহাবা, মারহাবা। বাঘের বাচ্চা’ এই সব শব্দ আমাদের কানে আসছিল। আর আমরা নিখুঁতভাবে নৌকার হাল নিয়ন্ত্রণ করছিলাম।

কিছু দূর যাওয়ার পরই দেখা গেল বকর ভাই, ছোট কাকু এবং আরও কয়েকজনে একটি পাল তোলা নৌকা নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। আর চিৎকার করে গালাগাল দিচ্ছে। কিন্তু যখন তারা দেখল আমরা পুবের বাতাস পালে লাগিয়ে উত্তর দিকে যাচ্ছি তখন আমাদের দক্ষতায় অভিভূত হয়ে গালাগাল থামিয়ে দিল। ছোট কাবু বলল, ‘বাঘের বাচ্চা। ওগ লইয়া চিন্তা করণের কাম নাই।’
আমাদের কাছাকাছি এসে তাদের নৌকার পালও ঘুরিয়ে দিল। সূর্যাস্তের পরপরই বর্ষার এক রক্তিম সন্ধ্যায় দুটি পাল তোলা নৌকা সরকার বাড়ির মাসজিদের ঘাটে এসে ভিড়ল। মা-বাবার হম্ভিতম্ভি ছাপিয়ে রহিমা, প্রভাতি, সুরুজ আর শেপালির চিৎকার শোনা গেল। কেন আমরা ওদেরকে নৌকায় নিই নাই ইত্যাদি।

[চলবে]

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১