কাসিদ
পাঠ মূল্যায়ন: মাইনুল ইসলাম মানিক
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উপন্যাস রচনা একটি দুরূহতম কাজ। ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহের সাথে ঔপন্যাসিকের নিজস¦ দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত হওয়ায় তাতে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠতা ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ‘কাসিদ’ উপন্যাসে লেখক জয়দীপ দে অদ্ভুত পারঙ্গমতার সাথে নিজস¦ কোন মতামতকে এড়িয়ে নির্মোহভাবে ইতিহাসের টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো একসূত্রে গেঁথেছেন। ফলে ‘কাসিদ’ হয়ে উঠেছে এদেশের আর্থ-রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রামাণ্য দলিল।
উপন্যাসের মূল প্লট পলাশী যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। এটি কেবল একটি যুদ্ধ নয়, ইতিহাসের বাঁক ফেরানোর একটি ঘটনা। যে ঘটনায় পাল্টে গেলো পুরো ভূ-ভারতের ভাগ্য। রাজা রাজাকে হারায়। রাজপাটে যায়। কিন্তু পলাশীতে হলো ভিন্ন ঘটনা। নবাবের অর্ধলক্ষ সৈনিকের মুখোমুখি হাজার মাইল দূর থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসা বণিকদের ভাড়াটে সৈন্যরা। সংখ্যায় মাত্র ৩ হাজার। কিন্তু ছোট্ট এই দলের সামনে ৮ ঘন্টা টিকে থাকতে পারল না নবাবের অর্ধলক্ষ সৈন্য। সব দায় কি চক্রান্তকারীদের? নাকি বিটুইন দ্য লাইনসে আরো কিছু আছে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর মিলাতে ইতিহাসের তোশাখানায় লেখকের প্রবেশ। দীর্ঘদিন ধরে অনাদরে পড়ে থাকা ধূলিমলিন সূত্রগুলো ধরে এগুবার চেষ্টা করেছেন তিনি। ছিলো অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর মেলানোর চেষ্টা।
উপন্যাসের এই অংশটুকুর পাঠ নিলেই বোদ্ধা পাঠক অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন, কেনো এই উপন্যাসটি অবশ্যপাঠ্য। ১৭৫৭ সালের ২ রা জুলাই রাত্রে সিরাজকে মুর্শিদাবাদে মীর জাফরের ঘরে আনা হয়। মীর জাফর তার পুত্রকে দায়িত্ব দেন সিরাজকে পাহারা দিয়ে রাখার জন্য। মীরণ তখন তার বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বাবার বিজয়-উদযাপনে ব্যস্ত। মীরণ তার বন্ধুদের ঠাট্টার সুরে বলল, এরকম একটা দামী মালকে সারাদিন পাহারা দিতে গেলে আমরা আনন্দ করব কখন। তার চেয়ে বরং ব্যাটাকে শেষ করে দেই। মীরণের প্রস্তাবে সবাই হই হই করে উঠল। উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কেউ সিরাজের গায়ে হাত তুলতে সাহস পাচ্ছে না। অগত্যা মোহম্মদী বেগ সানন্দে এই দায়িত্বটি নিল। একা ঘরে সিরাজ। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা। মোহম্মদী বেগ প্রবেশ করল। তাকে দেখে সিরাজ মনে বল ফিরে পেলেন। কারণ মোহম্মদী অনাথ ছিলো। তাদের প্রাসাদে বড়ো হয়েছে আলিবর্দীর অনুগ্রহে। সিরাজের মা আমিনা বেগমই তাকে ঘটা করে বিয়ে দিয়েছেন। সিরাজের আশা ছিলো এই মোহম্মদী বেগ বিপদের সময় তাঁর পাশে থাকবেন। আবার ভাবলেন, এ তো প্রকৃতিতে নিষ্ঠুর। তার দ্বারা সব সম্ভব। তাই তিনি জানতে চাইলেন, তুমি কি আমাকে হত্যা করতে এসেছো?
জি নবাব। ভীত নবাব মোহম্মদী বেগের পায়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন, আমাকে তুমি বাঁচাও মোহম্মদী। আমি আর নবাবী চাই না। শুধু বহুদূরে কোনো অজানা গ্রামে গিয়ে গোপনে এক সামান্য প্রজার মতো বাস করতে পারলেই আমি কৃতজ্ঞ থাকব। তুমি কষ্ট করে মীর জাফরকে বিষয়টা বুঝিয়ে আসো। আমার সাথে যা সম্পদ আছে আমি তোমাকে দিয়ে দেব। মোহম্মদী বেগের কোমরে তখন সিরাজকে হত্যা করার ছোড়া। তারপরও সে ভালোমানুষির ভান করে বেরিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে সে দেখল সিরাজ নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু মোহম্মদীর হাতে সময় নেই। খুব তাড়া। দ্রুত কোমর থেকে ছোড়াটা বের করে একটার পর একটা আঘাত করতে লাগল। সরফরাজ নামাজ পড়ার সময় পেয়েছিলেন, সিরাজ তাও পেলেন না। সিরাজ আর্তনাদ করে বললেন, আর না, যথেষ্ট হয়েছে, হোসেন কুলীর প্রতিশোধ হলো। কিন্তু মোহম্মদীর ছোড়া থামে না। পরদিন সিরাজের ক্ষতবিক্ষত দেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে নগর পরিভ্রমণে বের হয় মীরণের দল। হোসেন কুলীকে যেখানে সিরাজ হত্যা করেছিলো, সেখান দিয়েও সিরাজের মৃতদেহ গেল। লোকজন দেখল নবাবের শরীর থেকে পুরনো কালো রক্ত হোসেন কুলির খুনের জায়গায় পড়ছে। খাদেম হোসেন খানের বাসার পাশে একটা বাড়িতে সিরাজের মা, স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনদের বন্দি করে রাখা হয়েছে। তারা শুধু জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছে থমথমে শহর। নবাব গ্রেপ্তার। কি হয় তাঁর ভবিষ্যৎ, এ নিয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন। মীরণের সৈন্যরা এসে হাঁকডাক শুরু করল। হাতির পিঠে একটা ভেজা ববস্তা। বাড়ির জেনানারা ভাবলো মীর জাফরের প্রাসাদ থেকে হয়ত খাবার এসেছে। ফলমূল কিছু। হাজার হোক আত্মীয় মানুষ। এক জারিয়া দৌড়ে গেলো। তার সামনে হাতির পিঠ থেকে বস্তা নামানো হলো। বস্তার মুখ খুলতেই সে চিৎকার করে উঠল। জারিয়ার চিৎকার শুনে দৌড়ে এলেন সিরাজের মা আমিনা বেগম। তার মনে কু ডাকছিলো। বস্তার মধ্যে কর্তিত মস্তক আর দেহের খণ্ডাংশ। চোখ খোলা। যেন কাটা মুণ্ডুটা করুণ চোখে চেয়ে আছে মায়ের দিকে। মাগো, ঘরে তোলো। নিহত পুত্রের মাথা বুকে নিয়ে চুমু কাটতে আর উন্মাদিনীর মতো আর্তনাদ করতে লাগলেন আমিনা বেগম। চিৎকার শুনে খাদেম হোসেন খান বাড়ির ঝুলবারেন্দায় এসে দাঁড়ালো। তার কাছে অসহ্য লাগছে। সৈন্যদের ইশারা করলো আমিনা বেগমকে গৃহের ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সৈনিকরা আমিনা বেগমকে ধস্তাধস্তি করে গৃহের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। আবার হাতি চলতে শুরু করল। পিঠে সিরাজের লাশ।
ছেড়াখোঁড়া পোশাক পরা এক জীর্ণকায় মানুষ এসে পথ আগলে দাঁড়ালো। পরে তার নাম জানা যায়। জয়নুল আবেদীন। লাশবাহী হাতিটি থামল। মীরণের সৈন্যরা বিরক্ত, এ্যাই, কি হয়েছে? সরে দাঁড়াও।
–অনেক তো হলো, হাজার অত্যাচারী হলেও তিনি একজন মুসলিম, একজন মুসলিমের লাশ নিয়ে এ কি করছো তোমরা? তোমরা কি মরবে না! আল্লাহকে কী জবাব দেবে? তাঁকে তাঁর নানার পাশে শুইয়ে দাও। খোশবাগে। মরার পর অন্তত শান্তিটা পাক। সিরাজ চিরনিদ্রায় গেলেন।
উপন্যাসটির ফোকাসের জায়গা পলাশীর যুদ্ধ কিংবা সিরাজের পরাজয় হলেও ‘সন্ধ্যে বেলার প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকাল বেলার সলতে পাকানোর’ মত লেখক শুরু করেছেন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের চিত্র দিয়ে। এরপর বর্ণিত হয়েছে ঘরকুনো হিসেবে একদা পরিচিত ইংরেজ জাতির সমুদ্র ভীতি কাটানোর গল্প, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গঠন, ভারতবর্ষে তাদের বহির্বাণিজ্যের সূচনা পর্ব। শুধুমাত্র ইংরেজ নয় লেখক একই সূত্রে গেঁথেছেন পাশ্চাত্য নৌশক্তি তথা পর্তুগীজ ভাস্কো-দা-গামা কর্তৃক ভারতবর্ষের নৌপথ আবিষ্কার, ভারতবর্ষে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দের সংক্ষিপ্ত অথচ সামগ্রিক ইতিহাস।
ইতিহাস বারবার আবর্তিত হয়। বারবার ঘটে যায় একই ঘটনা। শুধু পাল্টে যায় সময়, পাল্টে যায় নাম। নবাব আলীবর্দী খাঁ একসময় সরফরাজ খানের কাছ থেকে শঠতার মাধ্যমে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন, হত্যা করেছিলেন সরফরাজ খাঁকে। একই পরিণতির শিকার হলেন সেই আলিবর্দীর উত্তরসূরি নবাব সিরাজউদ্দৌলা।‘কাসিদ’ শব্দের অর্থ বার্তাবাহক। ইতিহাসই কি সেই বার্তাবাহক!
গল্প বলার ক্ষেত্রে জয়দীপ দে শাপলুর একটি নিজস্ব বাচনশৈলী রয়েছে। ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস হওয়ায় ‘কাসিদ’ এর চরিত্রগুলোর বিকাশের পথ যতোটা সীমিত হওয়ার কথা লেখকের সযত্ন প্রয়াস সে সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চমকটা আছে উপন্যাসের শেষে। হয়তো এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারব নবাব সিরাজউদ্দৌলার বংশধরের শেষ পরিণতি!