সোয়েব সাইফী
সোয়েব সাইফীর গল্পের মতো উপন্যাসও রহস্যময়। একটি ছায়াভাষার ভিতর দিয়ে তার কল্পনায় ভাষার সফর করতে হয়। দর্শন, ধর্ম, জীবন, জগৎ ও পরজগতের আলো-আঁধারির ভিতর অয়ংচির চরিত্ররা বিচরণ করে। সাইফীর ভাষা সরল তবে বিষয় গভীর। ছোট ছোট বাক্যের ভিতর গল্পের উত্তেজনা বিরাজমান।অয়ংচি ‘রিটার্ন টু এনাদার ওয়ার্ল্ড আফটার ডেথ।’ আড্ডাপত্রের প্রথম ধারাবাহিক উপন্যাস। একজন তরুণকে তুলে ধরতে পেরে আমরা আনন্দিত।
এক.
“তোমার পূর্বেও আমি জাত সৃষ্টি করেছি, জীন ও মানুষ। যাদের কেউ আমার পথে চলতো, কেউ বেপথে যেত। অতঃপর আমি কোরআন নাজিল করি। যেথায় ছিল পূর্ণ জীবন বিধান, সৎ পথের দিশারী। এরপরও কিছু মানুষ জান্নাতি হয়েছে, কেউ জাহান্নামের কালো আগুনে জ্বলছে। অতঃএব সাবধান, তুমি ‘গিগ’ পান করো না। এটি আমার তরফ হতে ভবিষ্যৎ বাণী আর আমি মহাজ্ঞাণী।”
অয়ংচি ‘পবিত্র লিলান বাণী’ বন্ধ করে ঝিম ধরে বসে রইলো। পাশ থেকে বন্ধু বললো, দয়াময় বারেবার কেন ‘জাত’ সৃষ্টি করে বলতে পারো?
অয়ংচি কথা বলে না।
‘আমি পথে থাকতে চাই, তবে গিগ (অপবিত্র জল) পান করে কেন বেপথে যাই, বলতে পারো?’
অয়ংচি কথা বলে না। ঝিম ধরে বসে থাকে।
বুমেরাং বিরক্ত হয়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অন্য ঘরে চলে যায়।
জানালার ওপাড়ে অন্ধকার সেঁজেছে, মেঘলা অন্ধকার। মেঘ চমকাচ্ছে। একবার আলোয় ভরে উঠে চারপাশ আবার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। ঝিরিঝিরি বর্ষণ ঝরছে। ভেজা বৃক্ষ দুলে যাচ্ছে গল্পময় ধুপছায়ায়। কী রূপ অপরূপ সেই দৃশ্যে। মেঘের আড়ালে মেঘ চমকায়, মেঘ ডাকে গুঢ় গুঢ়। আচ্ছা, মেঘেদের এমন ডাকে কেন শূণ্যতা অনুভব হয় একলা অন্ধকারে?
নৈসর্গিক নিরবতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। ছেয়ে যাওয়া নিরবতায় কেউ কথা বলে। ‘মেঘের না বলা কথা জানতে ইচ্ছে করে?’
চারপাশে ছায়া শূণ্য নিরবতা। তবে কথা কয় কে? ‘পবিত্র লিলান কি দরজার ওপারে?’
‘বড় অদ্ভুত গো তুমি। আমি বন্ধু আমি.. এখনো চিনতে পারো নি?’
অয়ংচি খেয়াল করে, ভাবনার গভীরে কেউ কথা বলছে, কথা বলছে অদৃশ্য এক অস্তিত্ব। ভাবনার ঘোরে বসে যে প্রশ্ন করে, কখনো বা সমাধান দান করে। কথা বলে আপন খেয়ালে। যদিও এ অদৃশ্য অস্তিত্বের নিজস্ব কন্ঠ নেই, প্রকৃতির খেয়ালে কন্ঠ পাল্টায়। অলস মধ্যহ্নে একরকম, ঘণ বরষায় ভিন্নরকম। খেয়াল করলে নিজের কন্ঠের মতোই মনে হয় কখনো। অয়ংচি অবাক হয়, নিজ অস্তিত্বের মাঝে কতো অদৃশ্য অস্তিত্বের বসবাস!
‘কি ভাবছো মেঘমালাময়, মেঘের কথা জানতে ইচ্ছে করে?’
‘ইচ্ছে করে তোমায় দেখার। আমার ঘরে বাস করে পরবাসী তুমি, কেন দূরে থাকো? তোমায় যে বড় দেখতে ইচ্ছে হয়!’
‘আমি যে অদৃশ্য, অদৃশ্যকে দেখবে কি করে?’
‘রাতের জোনাক আমি দেখেছি? হলদে আলো না জ্বাললে ওরাও রয় অদৃশ্যে। তেমনি তোমায় দেখতে চাই অদৃশ্য এক জোনাকির মতো।’
‘তবে অপেক্ষা করো রাতে, যতটা ক্ষণ রাত মাঝ নিশুতি হয়। আর যখন আকাশ ভেঙে নামে বাদলা। সেই বাদলায় নেমে পরো একলা, পবিত্র নয়নে। কথা দিচ্ছি, আমি দেখা দেবো।’
অয়ংচি বসে রয়, বসে রয় নির্লিপ্ত নয়নে। জানালার ওপারে দিন ফুরিয়ে রাত হয়। অয়ংচি দেখে দিন ও রাতের রূপের আবর্তন। ‘আচ্ছা, এ জাহানের সবই কি শুধু রূপের আবর্তন? কাঠ পোড়ালে যে করে তা ধোঁয়ায় আবর্তিত হয়! ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায় জীবণশক্তি, কয়লা হয়ে পড়ে থাকে উৎকৃষ্ট- প্রাণীও যে তাই।’ আবারো কেউ কথা বলছে ভাবনার গভীরে।
অয়ংচি অস্থির হয়। ‘কে এই অদৃশ্য শক্তি?’
‘দৃষ্টি অন্ধ কেন দরদী? দেখছো না, আকাশ ভেঙে কেমন বাদলা নেমেছে বাইরে! তাকিয়ে দেখো, মাঝ নিশুতির ঝুম বৃষ্টিতে তোমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে আছে।’
ঝাপসা আলোয় দৃষ্টি যায় মাঝ উঠোনে। ওখানে এক ছায়া মূর্তি বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে একলা ভিজছে। দু হাত উঁচু করে ঈশারায় ডাকছে। আলো হয়ে বিজলি চমকায় ফের, মেঘ করে গর্জন। কিন্তু একি, মেঘের গর্জন হয়ত বোবা হয়ে গিয়েছে। হয়ত মাতাল হাওয়া থেমে গিয়েছে। হয়ত প্রকৃতি তার শব্দ বিচ্ছুরণ থামিয়ে দিয়েছে। অয়ংচির জিভ গরম হতে হতে ভাপ বেরোয়।’
‘ভয় হচ্ছে দরদী? যাকে দেখার জন্য একজনম পার করেছ, যাকে দেখার জন্য কত আধ্যাতিক সাধুজনার সমাধি হয়েছে, সৌভাগ্যবান তুমি। কেন ভয় হচ্ছে? ঘর হতে বেরিয়ে এসো বন্ধু, এসো ভিজি অঝর বর্ষণে!’
এক পা দু পা… আচ্ছন্নের মতন এক’পা দু’পা করে মাঝ উঠোনে, ছায়ামূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো অয়ংচি। কিন্তু এ তো ছায়ামূর্তি নয়, ঠিক তার মতন দেখতে দ্বিতীয় অয়ংচি ঝুমবৃষ্টিতে একলা দাঁড়িয়ে হাসছে। কী অপরুপ তার চোখের কার্ণিশ। বৃষ্টির ছাট বারে বার ভিজিয়ে যাচ্ছে সেই চোখের কার্ণিশ।
‘এমন মাতাল বরষায় চুপ কেন দরদী? কথা বলো! তোমার মাঝে বসবাসকারী ছায়া ব্যতীত আমি ভিন্ন কিছু নই। জানতে চাও, যা আমি জানাতে ইচ্ছে করি।’
‘আজকের বর্ষাজল এতো শীতল কেন?’
‘এই শুধু জানতে চাও? – দ্বিতীয় অয়ংচি অট্ট হাসে।
ভীষণ শীতে গিরগিরিয়ে অয়ংচি বললো, ‘আমি ভবিষ্যৎ জানতে চাই।’
‘তবে শোনো, আগামী কাল কালি সন্ধ্যায় অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তোমার নিকট বন্ধু এ ঘটনার সাক্ষী হবে। তার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনো, অবজ্ঞা করো না। মনে রেখো, কালজয়ী এক রচনার সাক্ষ্য হতে চলেছো তুমি।’
হঠাৎ’ই বর্ষণ থেমে যায়। দ্বিতীয় অস্তিত্ব আকাশে তাকিয়ে বলে, ‘আজ বিদায় জানাও বন্ধু… পবিত্র লিলান এখনই উপস্থিত হবেন।’
‘হাজার কথা বলার আছে। কেন বিদায় চাইছো তাড়াহুড়োয়?’
‘মাঝ নিশুতির অঝর বর্ষণে ফের ডেকো কখনো, আমি আসবো। ওই শোনো, পবিত্র লিলান ডাকছেন?’
দুই.
অয়ংচি…
অয়ংচি…
দূর হতে বুমেরাঙ আসছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। বুক ধুক করে উঠলো। ছায়াশূণ্য তেপান্তরে কালীসন্ধে নেমে গিয়েছে।
বুমেরাঙ উবু হয়ে হাঁপাচ্ছে। দু’হাতে কী একটা ধরে আছে বুকের কাছে।
‘কি ওটা?’
‘শুয়ে ছিলাম ঝরনার কিনারায়, ঝরনা আমার সাথে কথা বলছিল। বলছিল তার সৃষ্টির ইতিকথা। সিদরাতুল মুনতাহার আদি কথা। শুনছিলাম মুদ্ধ হয়ে। কথা শেষে বললো, ‘লিলান সম্প্রদায়ের জন্য এক উপহার ধার্য হয়েছে। আমার বয়ে চলা পাদদেশে তাকাও।’
‘আমি তাকিয়ে রইলাম, তাকিয়েই রইলাম। হঠাৎ দেখি জলে ভেসে কী একটা ভেসে আসছে এদিকে।’
‘একে গ্রহণ করো। তোমার সম্প্রদায়ের জন্য এ এক অলৌকিক উপহার। কিন্তু সাবধান, বড় আবেগী হয়ে একে কখনো সেজদা করো না।’
ঝরণা কথা বলছিলো কি করে? গিগ পান করেছিলে?
বুমেরাঙ দমে যায়।
গ্রন্থখানা হাতে নেয় অয়ংচি। জল মাটিতে ভরা বিবর্ণ এক গ্রন্থ। অক্ষরগুলোর কিছুই বোঝা যায় না অবস্থা। কত কালের এটি কে জানে। অস্পষ্ট এবং দুর্বোদ্ধ কিছু লিখা তাতে। ‘তুমি কিছু বুঝতে পারছো বন্ধু?’
তিন.
‘পবিত্র লিলান, আপনি বলেন কী লেখা।’
পবিত্র লিলানের কপাল কুঁচকে আছে। নীচু কন্ঠে বললেন, “নিশ্চই তোমার প্রতিপালক আল্লাহ্। যিনি নভমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। যিনি পরিয়ে দেন রাতের উপর দিনকে, তা এমন যে দিন দৌঁড়ে রাতের পেছনে আসে। তিনিই বৃষ্টির পূর্বে সু-সংবাদবাহী বায়ু পাঠিয়ে দেন।”
‘এটা কি পবিত্র, লিলান?’
‘এটি আল কোরআন।’
বুমেরাং সপ্ন দেখছে কিনা বুঝতে পারছে না। অয়ংচির পা কাঁপছে। পবিত্র লিলান কিছু পাঠ করছেন। চোখ গোল হয়ে আছে তিনজনের। তারা পবিত্র কোরআন আবিষ্কার করেছে। বুঝতে পারছে না, পৃথিবী ধংশের পর এ কিতাব কী করে অক্ষত রইলো আর এলোই বা কী করে!
বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের অবসান ঘটিয়ে অয়ংচি পড়ে গেল। জ্ঞান আছে কী নেই ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। বুমেরাঙ বিদিক হয়ে পরলো। পবিত্র লিলান বললেন, ‘কেন ব্যস্ত হচ্ছো? ওকে ঘুমোতে দাও।’..
[চলবে]