প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে..
আমার বাবা
আসাদ চৌধুরী
আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার ময়লা জামাকে,
শোনো বলি চুপি চুপি
আমার উলের রঙিন টুপি
দিতো মাথায় ফাঁক পেলেই,
হাসতো তখন দাঁত মেলেই।
আসতো চিঠি মুক্তো হাতের
আসতো হাসি জ্যোৎস্না রাতের
সব মেলেই।
আমার বাবা বাসতো ভালো দেশটাকে,
শ্যামল পরিবেশটাকে,
সবার চেয়ে প্রিয় ছিলো তাহার
টেবুল বোঝাই মুখরোচক আহার।
আমার বাবা আজব মানুষ,
তাঁহার কাছে প্রিয় মানুষ,
সাদা, কালো, হলুদ, লাল,
থ্যাবড়া নাক, গোল কপাল,
বাংলাভাষী, উর্দুভাষী,
বাসায় হতো ঠাসাঠাসি
দেশ-বিদেশের লোকের সাথে
আড্ডা দিতো দিনে-রাতে
আমার বাবা কেমনতর মানুষ?
আমার বাবা বাসতো ভালো মানুষ।
মুদির ছেলে হুমায়ূনে
বশ হলো তার আজব গুণে,
কাজীপাড়ার শান্তি ধোপা,
গোলাপীর মা’র দারুণ চোপা,
রিকশাচালক, সমীরুদ্দি,
মধ্যপাড়ার কানু বদ্যি,
ত্রস্তব্যস্ত কাগজঅলা
আলাপ জমায় বাড়িয়ে গলা
মিহিন সুরের গোয়ালিনী
বাজিয়ে চুড়ি রিনিঝিনি
আলাপ জমায় আছে কি হুঁশ?
আমার বাবা আজব মানুষ।
আমার বাবা বাসতো ভালো আমাকে
আমার মাকে, মামাকে,
পরী আপার উঠলে কথা
গুলিয়ে যেতো বুড়োর কথা;
আমার দু’বোন আজম ভাইতে
দ্বন্দ্ব হতো কে কার চাইতে
আদর পেলো বাবার কাছে
সেসব রিপোর্ট আমার কাছে
গণি ভাইকে ডাকতো বুড়ো ‘আব্দুল গণি’
সে ছিলো, তার শেষ বয়সের চোখের মণি।
এটুক বুঝি বাসতো ভালো আমাকে
এমন কি মোর জামাকে
এমন কি মোর বন্ধু-বান্ধব
ছাত্র-ছাত্রী, গোলাপের টব,
চেয়ার টেবুল, র্যাকের বই
জুতো, ছাতা, কতো কী কই
যাহা ছিলো আমার
চাকরি কিংবা খামার-
সবই অতি প্রিয় ছিলো বাবার
বুড়ো বাবার।
………………………………….
প্রথম কাব্যগ্রন্থ: তবক দেওয়া পান
প্রকাশকাল: ডিসেম্বর ১৯৭৫, (২য় প্রকাশ: ডিসেম্বর ১৯৮৩, জানুয়ারি ১৯৮৭)
প্রকাশক : ফরহাদ আলী, অনন্যা, ঢাকা-১
প্রচ্ছদ শিল্পী: আবুল বারক আলভী
মূল্য: সাত টাকা
(প্রথম সংস্করনের প্রচ্ছদ উদ্ধার করতে না পারার কারণে তৃতীয় সংস্করণের (জানুয়ারি ১৯৮৭) প্রচ্ছদটি তুলে দেয়া হলো। প্রচ্ছদ শিল্পী হাশেম খান, প্রকাশক মুক্তধারা, ঢাকা)
……………………………………………………………………………
[আসাদ চৌধুরী ষাট দশকের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন। শিশুসাহিত্য, অনুবাদ ও গবেষণায়ও তার যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। জন্ম ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উলানিয়ায়। পিতার মোহাম্মদ আরিফ চৌধুরী এবং মাতা সৈয়দা মাহমুদা বেগম। দাম্পত্যসঙ্গী সাহানা বেগম।
আসাদ চৌধুরী আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬০ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ থেকে। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যয়ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে আসাদ চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। তিনি জয় বাংলা (সাপ্তাহিক মুজিবনগর, ১৯৭১) এর সহকারী সম্পদক হিসেবেও কাজ করেন। পরবর্তীকালে ঢাকায় স্থিত হবার পর তিনি বিভিন্ন খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভয়েস অব জার্মানীর বাংলাদেশ সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা একাডেমিতে দীর্ঘকাল চাকুরীর পর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
কাব্যগ্রন্থ: তবক দেওয়া পান (১৯৭৫); বিত্ত নাই বেসাত নাই (১৯৭৬); প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৬); জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২); যে পারে পারুক (১৯৮৩); মধ্য মাঠ থেকে (১৯৮৪); মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫); আমার কবিতা (১৯৮৫); ভালোবাসার কবিতা (১৯৮৫); প্রেমের কবিতা (১৯৮৫); দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭); নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২); টান ভালোবাসার কবিতা (১৯৯৭); বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮); বৃন্তির সংবাদে আমি কেউ নই (১৯৯৮); কবিতা-সমগ্র (২০০২); কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩); ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬)।
প্রবন্ধ-গবেষণা: কোন অলকার ফুল (১৯৮২)
শিশুসাহিত্য: রাজার নতুন জামা (রূপান্তর, ১৯৭৯); রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০); গ্রাম বাংলার গল্প (১৯৮০); ছোট্ট রাজপুত্র (অনুবাদ : ১৯৮২); গর্ব আমার অনেক কিছুর (১৯৯৬); ভিন দেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯);
তিন রসরাজের আড্ডা (১৯৯৯); কেশবতী রাজকন্যা (২০০০); গ্রাম বাংলা আরো গল্প (২০০০); তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (জীবনী, ২০০০); জন হেনরি (আমেরিকার লোককাহিনী, ২০০১); মিকালেঞ্জেনো (জীবনী, ২০০১); ছোটদের মজার গল্প (২০০১); সোনার খড়ম (২০০৬); মুচি-ভূতের গল্প (২০০৬)।
জীবনী:সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩); রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯); স্মৃতিসত্তায় যুগলবন্দী (২০০১)।
ইতিহাস: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ (১৯৮৩)।
প্রবন্ধ-গবেষণা: কোন অলকার ফুল(১৯৮২)।
অনুবাদ: বাড়ির কাছে আরশিনগর : বাংলাদেশের উর্দু কবিতা (২০০০); প্যালেস্টাইন ও প্রতিবেশী দেশের প্রতিবাদী কবিতা (২০০৫)।
সম্পাদনা: যাদের রক্তে মুক্ত এদেশ (১৯৯১ যুগ্মভাবে); ছয়টি রূপকথা (১৯৭৯)।
পুরস্কার ও সম্মাননা: আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫); অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৮২); বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭); শম্ভুগঞ্জ এনায়েতপুরী স্বর্ণপদক (১৯৯৯); ত্রিভুজ সাহিত্য পুরস্কার; বরিশাল বিভাগীয় স্বর্ণপদক; অশ্বনী কুমার পদক (২০০১); জীবনানন্দ দাশ পদক; অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক; জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬); বঙ্গবন্ধু সম্মাননা ১৪১৮; একুশে পদক, (২০১৩); শব্দভূমি আজীবন সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮)
দেশভ্রমণ: জার্মাণী, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, গ্রেটবৃটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা।