প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
আমার দাহ আমার হাত
খালেদা এদিব চৌধুরী
কোনো একদিন উত্তপ্ত লোহার ঘর্ষণে প্রতিশ্রুতির শরীর ভেঙে
প্রার্থনার শেষ উচ্চারণ বিনষ্ট বাতাসের মতো
প্রবল বেগে ছুটেছিল—
আমি অন্ধকারে সর্বাঙ্গ লেলিহান শিখায় তপ্ত করে
অনন্ত প্রতিক্ষায় উন্মুখ হয়েছিলাম,
নিঃশব্দ রাত, আমার চারপাশের মানুষ, বিনিদ্র যন্ত্রণার মুহূর্ত
এর চেয়ে বড় বেশী মৃত্যু ও জন্মের সন্ধিক্ষণে কাঁপছিল-
আমার নির্ঘুম চোখে সে কি বিষের মরণ কামড়!
চাঁদ কোথায় লুকিয়ে মুখ আমার সমস্ত জীবনের পটভ‚মি
পালটে দিয়ে কবরের অন্ধকারে নিয়তির বয়স লেপে দিল,
আমাদের চারপাশের জ্যোৎস্না ডুবে গেল—
আমি মানুষের সঙ্গে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম
আপন আত্মাকে অস্বীকার করে নিথর ক্ষতের
মতো তৈলচিত্র হয়ে গেলাম যেন
আমার বিশ্বাস, পবিত্র সাহস কি নির্মম দাহের স্রোতে
জল-প্রপাতের মতো
পিপাসার আজন্ম বাসনাকে ঠেলে দিল।
সেইতো আমার দাহ—আমার জন্মের উচ্চারণ…
পাথর কি ধারণ করতে পারে সবটুকু জল— যন্ত্রণা।
আকাশ কি বনভ‚মি হয়ে যেতে পারে— এক মুহূর্তে!
আহা আমি কাকে বলব—
আমার সর্বাঙ্গে লেপন করো সভ্যতার কষ্ট
অঙ্কণ করো তৈলচিত্র—-!
অকস্মাৎ কি ভীষণ চিৎকার সভ্যতার রাজদূত নেমে এলো,
ভগ্ন ইচ্ছেরা বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো—-
যেন আমার সমস্ত স্বপ্নকে দাবানলে দাউদাউ জ্বালিয়ে দেবে
নরকের লেলিহান শিখায় সমস্ত মাঠ-ঘাট
জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে—
আমার শিশির-ভেজা ঘাস-ফসল,
আমার মাটি, ভালোবাসার জন্মভ‚মি—-
কি এলোমেলো মস্ত বাসাতে খুলে গেলো কপাট।
রাজদূতের চিৎকার– লকলকে আগুন
কোন দিনই জীবনের দাহ হয়ে থাকতে পারে না
আমি তখন রাশি রাশি মেঘের মতো ঘুমকে প্রার্থনা করলুম।
তবুও কি ঘুম আসে চোখে!
কি যেন চিৎকার, কি যেন কষ্ট, শরীরের জমিনে
কি যেন বিষাক্ত ফসল পোকারা কুরে কুরে নষ্ট করে দিচ্ছে।
সভ্যতা তুমি মারণাস্ত্রে রক্তপাত ঘটাও, যেন খুব শান্তিপ্রিয়
মানুষ তার ভীষণ অজ্ঞতায় নীরব—
বৃক্ষের স্বভাবে আমি বনভ‚মিকে ডেকে বললামঃ
দাহের সোনালী গুচ্ছ আমি কষ্টের ফসল রোপন করেছি
বস্ততঃ আমার হাতের বয়স এখন দুঃখের স্ফীত নদী।
খালেদা এদিব চৌধুরী কবি হিসেবে খ্যাতিমান। তিনি গল্পকার, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদ হিসেবেও সমধিক পরিচিত। জন্ম ১৯৩৯ সালের ৩ জুলাই, কুমিল্লায়। তবে তার পৈত্রিক নিবাস নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে। তার পিতার নাম আনোয়ারুল হক।
তিনি টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৭২ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
তার স্বামীর নাম আনোয়ারুল হক এবং তাদের তিন সন্তান; সঞ্জিতা, তানভীরুল হক প্রবাল ও সুমনা।তিনি চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর এর পরিচালক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশ এর অধিক।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: আমার দেহ আমার হাত (১৯৭৮); পান্থ তোমার ভালোবাষা (১৯৮৩); পাথরে আগুন (১৯৮৫); তোমার অনঙ্গ (১৯৮৬); দুহাতে আন্ধার কেটে (১৯৯৩); হে বাঁধন লতার কাঁদন (১৯৯৫); দু’ফোঁটা চোখের জল (১৯৯৭); প্রেমের কবিতা (১৯৯৮)।
গল্পগ্রন্থ: জনমনিষ্যির গল্প (১৯৮২); পোড়ামাটির গন্ধ (১৯৮৫); অন্য এক নির্বাসন (১৯৭৬)।
উপন্যাস: অনন্ত মধ্যাহ্ন রাত(১৯৮০); হে প্রেম হে সময়(১৯৯৭)।
শিশুকিশোর গল্প-উপন্যাস: অন্তর বন্ধু (১৯৮১); বুবুর জন্যে সারা দুপুর (১৯৮৩); অরণ্যের ক্যানভাস (১৯৮৬); শীতের দিন রাত্রি (১৯৮৭); তোমার পতাকা যারে দাও (১৯৮৮); মুক্তিযুদ্ধের কিশোর গল্প (১৯৯৩); সেই পাখি নেই(১৯৯৬)।
কিশোর অনুবাদ: মা (১৯৯১); জীম করবেট ও মানুষ খেকো চিতা (১৯৯২); স্পার্টাকাস (১৯৯৬)।
পুরস্কার ও সম্মাননা: বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৯৩); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৯); কবি জসিমউদদীন পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১); বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের পুরস্কার; অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার (১৪০২); এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন সাহিত্য পুরস্কার; ঢাকা মহিলা ক্লাব পদক; উশি সাহিত্য পুরস্কার (কুমিল্লা)।
খালেদা এদিব চৌধুরী ২০০৮ সালের ২৮ মে ইন্তেকাল করেন।