প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
আশ্চর্য হবো না আর
জিয়া হায়দার
আশ্চর্য হবো না আর। সামান্য ইংগিতে, ইশারায়
যদি সে আদিম পাত্র নির্বকারে তুলে নিতে বলে,
যেহেতু জন্মের ভিতে, রক্তে সুতীব্র অতৃপ্তি জ্বলে
অবিরাম।
নিষ্প্রাণ ঘুঁটির মতো দাবার খেলায়
সুখের কৃত্রিম রাজ্যে বর্ণহীন নিষ্কম্প শিখায়
গর্বিত ছিলাম শুধু (সুগোপন ব্যথার অনলে
ধূপের গন্ধের মতো অজ্ঞাত দাহনে পলে পলে
হয়েছি নিষ্পাপ, খাঁটি); — প্রার্থনার সংগীত-সভায়
দুর্জ্ঞেয় নামের গান।
কোনো নারী (আশ্বিনের নদী)
নির্ভতির মন্ত্রে আর প্রেমে দেহের গভীরে ডাকে
সহাস্যে (বিস্মিত চাঁদঃ সেদিনের নিষিদ্ধ ফলেরা
কী বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী), রাত্রির ত্রিপদী
(আমি তার ক্রীতদাস) অকারণে বিহবলতা রাখে
যদি, আশ্চর্য হবো না; — সে আমার উৎসর্গের ডেরা।
একতারাতে কান্না
প্রকাশক : শফিক খান
সপ্তক প্রকাশনী, ঢাকা-২
প্রথম প্রকাশ : ১৩৭০ বঙ্গাব্দ (১৯৬৩)
উৎসর্গ : আমার লক্ষ্মীকে
প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী
মূল্য : দু’ টাকা পঞ্চাশ পয়সা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৭২
কবিতার সংখ্যা : ৩৫
জিয়া হায়দার অন্যতম কবি ও নাট্যকার। এছাড়াও তিনি সংগঠক, অনুবাদক ও অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর পুরো নাম শেখ ফয়সাল আব্দুর রউফ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন হায়দার।তিনি ১৯৩৬ সালের ১৮ নভেম্বর পাবনা জেলার দোহারপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হাকিমউদ্দিন শেখ ও মা মোছাম্মাৎ রহিমা খাতুন। বাবা মায়ের সাত ছেলে ও সাত মেয়ে। তিনি ছিলেন ছেলেদের মধ্যে বড়। তাঁর ছোট ভাই রশীদ হায়দার, মাকিদ হায়দার, দাউদ হায়দার, জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার – সবাই দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে খ্যাতিমান।
জিয়া হায়দার পড়াশুনা শুরু করেন তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত আরিফপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে ভর্তি হন পাবনা জেলা স্কুলে। পরে ১৯৫২ সালে গোপালচন্দ্র ইন্সটিটিউশন থেকে মাধ্যমিক ও ১৯৫৬ সালে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি ১৯৫৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৬৮ সালে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়-এ নাট্যকলায় ভর্তি হন এবং সেখান থেকে নাট্যকলায় এম.এফ.এ ডিগ্রী (১৯৬৮)অর্জন করেন। তিনি সানফ্রান্সিসকো স্টেট কলেজ ও নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েও নাট্যকলা বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এরপর বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সার্টিফিকেট ইন শেক্সপিয়ার থিয়েটার’ (১৯৮২) ডিগ্রি লাভ করেন।
জিয়া হায়দার এর কর্মজীবন শুরু সাংবাদিকতা দিয়ে। ১৯৬১ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘চিত্রালি’-তে যোগ দেন। পরে কিছুদিন সরকারী তোলারাম কলেজে শিক্ষকতা করেন।এরপর বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তান টেলিভিশনে সিনিয়র প্রোডিউসার হিসেবেও কাজ করেন। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের নাট্যকলা শাখায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন।
তিনি টেলিভিশনে থাকাকালীন সময়ে ‘নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি সিলেবাস প্রণয়ন, নাটকের ইতিহাস, তথ্য, প্রকার ও প্রকরণ অনুবাদ করেন বাংলায়। ১৯৯১ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা শাখায় অনার্স কোর্স শুরু হয়। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা) প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন করেন। ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকেঅবসর গ্রহণ করেন।
কবিতা, নাটক, নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ ও অনুবাদ মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ত্রিশের অধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে:
কাব্যগ্রন্থ: একতারাতে কান্না (১৯৬৩); কৌটার ইচ্ছেগুলো (১৯৬৪); দূর থেকে দেখা (১৯৭৩); আমার পলাতক ছায়া (১৯৮২); লোকটি ও তার পেছনের মানুষেরা (১৯৮৭); শেষ্ঠকবিতা (১৯৮৭); ভালবাসা ভলোবাসা ভালোবাসা (১৯৯০); নির্বাচিত কবিতা (২০০০); তোমার আমার পদ্য (২০০০); তোমার আমার পদ্য: দ্বিতীয় তরঙ্গ (২০০১);
নাটক: শুভ্রা সুন্দর কল্যাণী আনন্দ (১৯৭০); এলেবেলে (১৯৮১); সাদা গোলাপে আগুন; পঙ্কজ বিভাস (১৯৮২)।
রূপান্তরিত নাটক: প্রজাপতি নির্বন্ধ (১৯৭২); তাইরে নাইরে না (১৯৯২); উন্মাদ সাক্ষাৎকার; মুক্তি মুক্তি;
অনুদিত নাটক: দ্বার রুদ্ধ (১৯৭০); ডক্টর ফস্টাস (১৯৮১); এ্যান্টিগানে (২০০২);
নাট্য বিষয়ক গ্রন্থ: নাট্যবিষয়ক নিবন্ধ (১৯৮১); নাট্য ও নাটক (১৯৮৫); থিয়েটারের কথা (১ম খণ্ড- ১৯৮৫); থিয়েটারের কথা (২য় খণ্ড-১৯৯০); থিয়েটারের কথা (৩য় খণ্ড-১৯৯৪); থিয়েটারের কথা (৪র্থ খণ্ড-১৯৯৬); থিয়েটারের কথা (৫ম খণ্ড-২০০৭); বাংলাদেশের থিয়েটার ও অন্যান্য রচনা (১৯৯১); স্ট্যানিসলাভস্কি ও তার অভিনয় তত্ত্ব (১৯৯৫); নাট্যকলার বিভিন্ন ইজম ও এপিক থিয়েটার(১৯৯৫)।
পুরস্কার ও সম্মাননা: একুশে পদক (২০০১); বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৭); লোকনাট্যদলের স্বর্ণপদক (১৯৯৬)।
মৃত্যু: জিয়া হায়দার শেষ জীবনে ক্যান্সারে আক্রান্তে হন। ২০০৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পাবনা জেলায় তাঁর নিজ গ্রাম দোহারপাড়া সংলগ্ন পাবনা সদর গোরস্থানে দাফন করা হয়।