প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
অশোককানন
আবদুল মান্নান সৈয়দ
জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়,
আমার চারিদেক যতোগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার
পাতালের; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস একটি
নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্রঃ আর
সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।–একরকম দৃশ্যে আহত হ’য়ে
আমি শুয়ে আছি পথের উপর, আমার পাপের দুচোখ
চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হ’য়ে গেলো, আর যে-আমার
জন্ম হ’লো তোমাদের করতলে মনোজ সে অশোক সেঃ
জ্যোৎস্না তার কাছে ভূত কিন্তু একটি গানের উপর, দরোজা তার
কাছে পুলিশ কিন্তু একটি জন্মের উপর, মৃত্যু তার
কাছে দোজখ কিন্তু একটি ফুলের উপর।।
জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ
[রচনাকাল: ১৯৬২-১৯৬৬]
প্রকাশক : আসাদ চৌধুরী
ধ্রুপদ, ঢাকা-১
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ১৯৬৭
উৎসর্গ : আব্বা ও আম্মাকে
প্রচ্ছদ : রফিকুন্নবী
মূল্য : দু’ টাকা পঞ্চাশ পয়সা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৪০
কবিতার সংখ্যা : ১৭
আবদুল মান্নান সৈয়দ ষাট দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, সমালোচক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক।তিনি বহুমাত্রিক লেখক। প্রথম দিকে অশোক সৈয়দ নামে লিখলেও পরবর্তীতে আবদুল মান্নান সৈয়দ নামেই লিখেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ এর প্রকৃত নাম সৈয়দ আবদুল মান্নান। তিনি অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশের পশ্চিম বঙ্গের জালালপুর নামক গ্রামে ১৯৪৩ সালের ৩ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেন ।সেটা ছিল দুর্ভিক্ষের কাল। ১৯৫০ সালে ভয়াবহ দাঙ্গা হয় পশ্চিম বঙ্গে। তখন তার পিতা সপরিবারে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং গোপীবাগে বসবাস করতে শুরু করেন। তার পিতা সৈয়দ এ. এম. বদরুদ্দোজা ছিলেন সরকারি চাকুরে। মাতা কাজী আনোয়ারা মজিদ। তারা ছয় ভাই, চার বোন। তার স্ত্রীর নাম সায়রা সৈয়দ রানু। একমাত্র কন্যার নাম জিনান সৈয়দ শম্পা।
তিনি নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ১৯৬৩ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৬৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি ফরিদপুর শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজ, সিলেটের এম. সি. কলেজে এবং ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেছেন। তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট এর নির্বাহী পরিচালক (২০০২-২০০৪)ছিলেন।আলোচনা-সমালোচনা ও গবেষণায় তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্মের সাথে খুব কম লেখকেরই তুলনা চলে। তিনি কবিতা ও ছোটগল্পে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনান্দ দাশ, ফররুখ আহমদ গবেষণায় তিনি ছিলেন তিনি ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিষ্ণু দে, সমর সেন, বেগম রোকেয়া, আবদুল গনি হাজারী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, প্রবোধচন্দ্র সেন প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকের উপর গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন।
১৯৫৯ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে “সোনার হরিণ” শিরোনামে কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর আবির্ভাব। ১৯৬৭ সালে ‘ জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ কাব্যগ্রন্থের মধ্য দিয়ে বাংলা কবিতায় আবদুল মান্নান সৈয়দ বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র আসন তৈরি করতে সক্ষম হন। তার কাব্যশৈলীর বড় বৈশিষ্ট্য আধুনিকতা , নন্দনতত্ত্বের বহুমাত্রিক ব্যবহার ও পরাবাস্তবতার প্রয়োগ। জীবদ্দশায় কুড়িটির অধিক কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ (১৯৬৭); জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯); ও সংবেদন ও জলতরঙ্গ (১৯৭৪); নির্বাচিত কবিতা (১৯৭৫); কবিতা কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড (১৯৮২); পরাবাস্তব কবিতা (১৯৮২); পার্ক স্ট্রিটে এক রাত্রি (১৯৮৩); মাছ সিরিজ (১৯৮৪); পঞ্চশর (যৌথ, ১৯৮৭); শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৭); মার সনেট (১৯৯০); সকল প্রশংসা তার (১৯৯৩); নীরবতা গভীরতা দুই বোন বলে কথা (১৯৯৭)।
অনুবাদ কবিতা: মাতাল মানচিত্র (১৯৭০); বিদেশী প্রেমের কবিতা (১৯৮৪)।
উপন্যাস: পরিপ্রেক্ষিতের দাস-দাসী (১৯৭৪); কলকাতা (১৯৮০); অ-তে অজগর (১৯৮২); কলকাতা; পোড়ামাটির কাজ (১৯৮২); হে সংসার হে লতা (১৯৮২); গভীর গভীরতর অসুখ (১৯৮৩); প্রবেশ (১৯৯৪); ক্ষুধা প্রেম আগুন’ (১৯৯৪); শ্যামলী তোমার মুখ (১৯৯৭); শ্রাবস্তির দিনরাত্রি (১৯৯৮); প্রেম (১৯৯৯)।
ছোটগল্প: সত্যের মতো বদমাশ; চলো যাই পরোক্ষে; মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা; নেকড়ে হায়েনা; তিন পরী ইত্যাদি।
প্রবন্ধ-গবেষণা: নির্বাচিত প্রবন্ধ (প্রথম খণ্ড- ১৯৭৬, ২য় খণ্ড- ১৯৮৭); নজরুল ইসলাম কবিত ও কবিতা (১৯৭৭); নজরুল ইসলাম কালজ কালোত্তর (১৯৮৭); চেতনায় জল পড়ে শিল্পের পাতা নড়ে (১৯৮৯); কালান্তরের যাত্রী; পুনর্বিবেচনা (১৯৯০); বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা (১৯৯৪); বাংলা সাহিত্যে মুসলমান (১৯৯৮); আধুনিক সাম্প্রতিক (২০০১); দশ দিগণ্তের দ্রষ্টা; করতলে মহাদেশ; আমার বিশ্বাস; ছন্দ;
জীবনী: বেগম রোকেয়া; সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯৮৬); সৈয়দ মুর্তাজা আলী; ফররুখ আহমদ (১৯৮৮); শাহাদাৎ হোসেন (১৯৮৭); জীবনানন্দ দাশ (১৯৮৮); আবদুল গণি হাজারী(১৯৮৯); সৈয়দ মুর্তাজা আলী (১৯৯০); মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী (১৯৯৪); প্রবোধচন্দ্র সেন (১৯৯৪); রবীন্দ্রনাথ।
সম্পাদনা-গ্রন্থনা: ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭৫); ফররুখ রচনাবলী (প্রথম খণ্ড ১৯৭৯); ইসলামী কবিতা : শাহাদাত হোসেন (১৯৮৩);বাংলাদেশের কবিতা (১৯৮৮); বাংলাদেশের ছড়া (১৯৮৮); মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন স্মৃতি অ্যালবাম (১৯৮৮); সমরসেনের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯); মোহিতলাল মজুমদারের নির্বাচিত কবিতা (১৯৮৯); সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০); বুদ্ধদেব বসুর সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০); সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সুনির্বাচিত কবিতা (১৯৯০); আবদুস সাত্তার জীবন ও সাহিত্য (১৯৯০) ইত্যাদি।
জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্থাবলি: শুদ্ধতম কবি (১৯৭২); জীবনান্দ দাশের কবিতা (১৯৭৪); জীবনানন্দ দাশ (১৯৯৩); জীবনানন্দ (১৯৮৪); জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৮৬); জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী (১৯৮৭); জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ গল্প (১৯৮৯)।
নাটক-কাব্যনাটক: চাকা (১৯৮৫); নাট্যগুচ্ছ (১৯৯১); কবি ও অন্যেরা (১৯৯৬)।
স্মৃতিকথা: ভেসেছিলেম ভাঙা ভেলায়; প্রণীত জীবন; স্মৃতির নোটবুক (২০০০)।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি: একুশে পদক (২০০৩); বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮১); আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১); নজরুল পুরস্কার, পশ্চিম বঙ্গ, (১৯৯৮); কবি তালিম হোসেন পুরস্কার (২০০০); লেখিকা সংঘ পুরস্কার (২০০০); নজরুল পদক (২০০১); অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার (২০০২);
মৃত্যু: কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ ৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।