প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
শত্রুর এক হাত
সৈয়দ হায়দার
ধৈর্যহীন শীতের মুক্তি প্রকৃতির অন্ধ ভাঁজে-ভাঁজে
বসন্তের শিমুল-রাঙা ছায়াপথে ঐ আসে
অন্তহীন অন্ধকারে গোপন গুহার মুখ খুলে যায়
পাতাঝরা হাওয়া বয়, প্রতিধ্বনি কিসের যেন বাজে
এখানে মানুষের দাম্ভিকতা, স্বার্থকেন্দ্রে গুঞ্জরণ
শোষণের সিংহদ্বার মজবুতের কলাকৌশল পুনর্জিত
তবু কোনো ডাক ব্যর্থ হয় না
বিদ্যুৎ, তরঙ্গমালা, অদৃস্টের বিপরীত কোনো যুদ্ধ
ব্যর্থ হয় না
এ জীর্ণ পাণ্ডুর অক্ষম স্বর্গের মঞ্চ
মুহূর্তে মুহূর্তে বাতাসের দমকায় কাঁপে
শীতের বৃক্ষগুলো কীভাবে হচ্ছে রুপান্তর
নির্ভয়ে কেমন গোলপাতা আনে সুন্দরবনের শিরা ছিঁড়ে
স্বগৃহ বানায় মানুষেরা
এখানে চৈত্রের রুদ্র তাপে মাটির চৌচিরে হাসে
কৃষকের সঙ্গে তার সখ্য, দিন-রাত কথা চলে—
শস্যপূর্ণ মাঠ, নদীর ইলিশ,
গজারি কাঠ, পুরো শালবন বাতাস আকাশ সবকিছু
চাই মানুষের করতলে
মানুষেরা কেবলই জট খুলে বিন্যস্ত ক’রে দিতে পারে নারীর চুলে
গিট খুলে দিলে
পাখি উড়ে যেতে পারে অসীমে, পরিসুমার নব্য সূচী রচিত হয়।
এখানে ডুবন্ত দ্বীপের ওপরে শুয়ে থাকা তিমি মাছ–
নিতান্তই ক্ষণস্থায়ী, নারীর ভালোবাসা খোঁজাঃ
নারী মানে ঘর, ময়ূরের আত্মীয়া, লীয়মান চাঁদের আলো
জ্যোৎস্না পর্বতের গায়ে ছড়িয়ে স্পন্দিত
কখনো ঘামের শরীরেই লুপ্ত
কি চাঁদ কি সূর্য কি তারকা কি গ্রহ
কি-বা দেবতা
কেউ গদিচ্যূত হতে চায় না
পারলে সে সিংহাসনে পা ঝুলিয়ে বসে
ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে দুঃখহীন খুশির প্রবাহ
গোরে প্রজ্বলিত আলোর মতন প্রতিবাদহীন
তবু কি পৃথিবীকে কিছু বলার নেই
স্বদেশের উদ্দেশ্যে কি কোনো কিছুই বলার নেই?
সমস্ত পৃথিবীর প্রগাঢ় অন্ধকার কী করে ধীরে-ধীরে
মানুষের মুখের ছায়ায় নেমে আসে
কী করে সবকিছু প্রতিবাদহীন মেনে নেয়
কৃতঘ্ন কে
রাজদরবারে ব’সে থাকা মুণ্ডহীন বেকুব না মানুষ
না ভাষা, না বিজ্ঞান, না কবিতা?
এখানে দলভুক্ত মানুশেরা কা’ধের ওপরে কা’ধ রাখে না
হাতের ওপর হাত রাখে না
ক্ষুধা-পেটে বিমুর্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শস্যের গোলার দিকে
মাখন-ঘরে সাজানো সমস্ত পাত্রের দিকে
অন্তরীক্ষ চোখে চেয়ে থাকে নারীর সমস্ত শরীরের দিকে
সে দৃষ্টির অলীক দর্শন আছে
ভিখিরি বালকের মধ্যে চাতকের প্রতীক্ষা আছে
এখানে গ্যাঁড়াকল আছে, মানুষের দেহ দু’ভাগ করার যন্ত্র আছে।
এখানে সবিস্তারে লম্ফ-ঝম্ফ আছে
ছাউনি সাজানোর হুলুস্থূল আছে,
প্রভাবশালী মহলের দশমিক গতিবিধি আছে
এখানে মানুষের রক্তস্রোত বয়
নারীর ঠোঁটে লিপস্টিকের বদলে জমাট রক্ত
ভুরুর বদলে চাবুকের দাগ, প্রসম্মতার বদলে মনে হয়
এখানে সব মানুষ পাশাপাশি বড় হয়ে ওঠে
তবু হাত কেন সমুদ্যত হতে পারে না
কেন দারুণ শপথ হ’য়ে ওঠে না নতুন পথে চলার
চোখে কেন ঝরে না আগুন?
এখানে ভয়ে কেঁদে-ওঠার কিছু নেই, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে
ক্রোধ আর মিছিল শুরু হবে
লক্ষীমন্ত মেয়েরা হাতে হাতে এনে দেবে ফুল–
শহীদের কবরে রোপিত হবে মাধবীলতার চারা
অন্ধকার শেষ হ’লে–নৈরাশ্য ও ক্ষয়ের নষ্ট পৃথিবীতে সূর্য
টগবগ লালে উঠে আসবে, তখন প্রভাত হবে
সে সবের সে প্রস্তুতি চলছে, তা মানুষের চোখে ঐ
জ্বলে-ওঠা আগুন, অগ্নিধারা থেকে বোঝা যায়।।
সৈয়দ হায়দার সত্তর দশকের অন্যতম কবি। তিনি ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে বাগেরহাট জেলার সাতসৈয়ামা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ আশরাফ আলী ও মায়ের নাম সৈয়দা জাহেদা আশরাফ। তিনি বাগেরহাটের পিরজঙ্গ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে মাধ্যমিক ও প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে উচ্চা মাধ্যমিক পাশ করেন। একই কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে স্নাতক (বাংলা) পাশ করেন। দীর্ঘকাল তিনি কাস্টমস কর্তকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কোনো সুখবর নেই (১৯৮৩); ভুলগুলো নাড়া দেয় (১৯৮৫); ধ্বংসের কাছে আছি(১৯৮৫), প্রতি পদে সীমান্ত (১৯৮৬), ভাঙলে মাটির মতো (১৯৮৭); কে বিতর্কিত কে তর্কাতিত (১৯৮৭);পরমার্থ অন্ধকার (১৯৮৮); , পাতা থেকে পাখি (১৯৯০); , কাছে থেকে প্রবাসিনী(১৯৯১), নেহাই(১৯৯২), উত্তরবঙ্গ(১৯৯২), বয়স যখন দিচ্ছে তাড়া (১৯৯২); গাছপালা (১৯৯৩); অরিষ্ট দু জন দু জনকে (১৯৯৪); আগদুয়ারী (১৯৯৯), আঁধারের শেষ ভালোবাসি (২০০৬) প্রভৃতি।
ছড়া : পুতুল রাজকন্যা, (১৯৯৬) ।
পুরস্কার : কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫); মহিউদ্দিন আহম্মেদ স্মৃতি গাঙচিল সাহিত্য পদক( ২০০৬)।