প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
সাহসী মানুষ চাই
মোহন রায়হান
তোমাদের লোভাতুর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব আমি
অলীক উচ্চারণে যারা নিজেদের ভেবে থাকো কবি
ভূমিতে শিকড়হীন; যে বৃক্ষ বাড়েনি তার মূলের মাটিতে
সেই শিল্পতরু আজ আমাদের প্রয়োজন নেই।
আমাদের জীবনের জন্যে আজ শিল্প চাই, ফিরে চাই মাটির আঘ্রাণ
তপ্ত অঙ্গীকার বুকে নিয়ে আমি সেই শোভন আগুন আজ
ছড়াব সময়ে।
তোমাদের মাথা থেকে দৃঢ় হাতে খুলে নেব কবির শিরোপা
তোমাদের মুখে আমি থুথু দিই, থুথু দিই, থুথু দিই
এতটুকু সম্মান দিতে আজ রাজি নই, মুখচোরা ভীরুটে শিক্ষক,
বেজন্মা-দালাল বুদ্ধিজীবী তোমার মাথার খুলি আমি
আঘাতে উড়িয়ে দেব।
এই আমার বিংশতি যুবক বুকের অগ্নিময় উত্তুঙ্গ বিক্ষোভ থেকে
নতুন অস্ত্রের মতো ঝলোমলো এই যৌবনের বহ্নিতেজ থেকে
আমি হ্যান্ডগ্রেনেডের মতো আমার প্রচণ্ড রুদ্ররোষ ছুড়ে দিই
এইসব বুদ্ধিজীবী লেখক শিক্ষক কবি ঘুণে-ধরা রাজনীতিকের প্রতি।
বুর্জোয়া অর্থনীতিকের ডাটা আমি দু’পায়ে মাড়াই
কারা বলে ব্যর্থ মাটি, এই জল, ব্যর্থ এই মানুষ-লাঙল?
এই শস্যের বৈভবে খাদ্যঘাটতির কথা
আমি মানি না, মানি না।
সাম্রাজ্যবাদ আর তার পরিকল্পনার বুকে লাথি মারি
আজ আমাদের শুধু সাহসী মানুষ চাই, শুধু সাহসী মানুষ চাই।
একজন ক্রুশবিদ্ধ কোমল যিশুর মতো দৃঢ় মহান শিক্ষক
গনগনে আগুনের ফুলকির মতন দৃপ্ত লেলিহান বুদ্ধিজীবী
ফুলের সুষমা আর বারুদের বিস্ফোরণ বুকে নেয়া কবি চাই
আজ আমাদের।
আমাদের পাঁজরের হাড়ে হাড়ে জেগে থাকে ব্যর্থতার গ্লানি
আমাদের অপমান বেদনা হতাশা আর ব্যথার বিক্ষোভ
একদিন গোপন ট্রিগারে তার খুঁজে নেবে রক্তাক্ত প্রতিশোধ।
ভালোবাসি নদী, জল, ফুল, পাখি, কাকলি সুবাস
অথচ জীবনে আজো ফিরে তো এল না সেই সবুজ সুস্থতা
সেই হাত স্নেহমাখা, মায়ের দরদী চোখ তারা আজ হারাল কোথায়?
আমার স্বপ্নের জন্যে পাথরে পাথরে জানি চূড়ান্ত সংঘর্ষ হবে
সংঘর্ষের ভাষা তাই হবে জানি পাথুরে কঠিন আর নিটোল নির্মোহ।
বড়বেশি বাজে, এই বুকে বড়বেশি লাগে
অতন্দ্র প্রহর কাটে, কাটে রাত, বিনিদ্র জীবন,
কত ঘাম রক্ত অশ্রু ঝরে যায় হায় বিনাশী খরায়
তবু কিছু কিছু মানুষের প্রাসাদের স্বপ্ন ভাসে চোখে
অলীক স্বপ্নের রথে চড়ে তারা পেতে চায় রঙিন জীবন।
এ-জাতির অধ্যাপক, কৃষিবিদ, শল্যবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী,
প্রযুক্তিবিদ, বিজ্ঞানী
সুহাসিনী বিমানবালার অধরের হাসি দেখতে দেখতে
ভিনদেশে পৌঁছে যায়- ইউরোপ, আমেরিকা, আজকাল
বড়বেশি মধ্যপ্রাচ্যে।
আমাদের এককালীন বামপন্থীরা বর্ষার শুরুতে দ্যাখো
ইলিশ ঝাঁকের মতো উঠে যায় লঙ্কা-দ্বীপে, কেমন উজান ঠেলে ঠেলে
গণতন্ত্র পরিহিত শয়তান সাম্রাজ্যের অস্ত্র নেচে ওঠে বারবার
সুযোগ পেলেই দ্যাখো জনতার কণ্ঠে সেই অক্টোপাস চেপে ধরে টুঁটি।
না, বোঝে না সংস্কৃতি আমাদের অশিক্ষিত নেতা
বরং নির্বাচন ভালো বোঝে,
প্রেমের স্বভাব ভুলে অর্থের প্রাচুর্য চায় নষ্টা প্রেমিকারা
তীর্থের কাকের মতো মাতাপিতা বড় বড় সুযোগের প্রত্যাশা করেন,
অধ্যাপক নোট লিখে বাজার গরম ক’রে লুফে নেয় কাঁচা কাঁচা টাকা
টোপ গিলে বুদ্ধিজীবী সহজে বিবৃতি দেয় জনতার বিপক্ষ কাতারে।
কোনো ছাত্র আজ আর আর্তের সেবার জন্যে ডাক্তারি পড়ে না
আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের আর বুঝি কোনো মহৎ উদ্দেশ্যই নেই!
সবাই শোষক কিংবা শাসকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দালাল
গ্রামে গ্রামে স্বনির্ভরতার বক্তৃতা করে শহরে এসেই শান্তিবাহিনীর
সাদা ঠোঁটে চুমু খায়, চাটে পুঁজ স্বজনের হাড়।
আমাদের মৃত্যুর জন্যে আজ কোনো পরিতাপ নেই
আমাদের জন্মের জন্যে আজ কোনো ভালোবাসা নেই
আমাদের ধ্বংসের জন্যে আজ কোনো প্রতিকার নেই
আমাদের সবকিছু আজ শুধু ছলনার, শুধু আজ ব্যর্থতার
ক্লেদ নিয়ে আসে।
আজকে এখানে একজন শিক্ষক জন্মাক
আজকে এখানে একজন বুদ্ধিজীবী থাক
আজ নবজন্ম হোক এদেশের লেখক কবির
আর তারা অন্ধকারে ঝলসিত আগ্নেয়াস্ত্রের মতন
হোক স্পর্ধিত, স্পর্ধিত হোক
আজ তারা স্পর্ধিত হোক।
…………
১.৯.৭৮
সিরাজগঞ্জ
মোহন রায়হান সত্তর দশকের তুখোড় প্রতিবাদী কবি। দ্রোহ, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, মুক্তিযুদ্ধ লড়াইয়ের-চেতনা, মানবমুক্তি তার কবিতার বিষয়। বাগবাটির ঘোড়চড়া গ্রামে মাতুলালয়ে ১ আগস্ট ১৯৫৬ সালে তার জন্ম। তার পিতার নাম মো: পিতা ফরহাদ হোসেন, ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিক। মাতা মাহমুদা খাতুন ও স্ত্রী রোকসানা লেইস। সিরাজগঞ্জের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের দিয়ারপাচিল গ্রাম তার পিতৃভূমি।
তিনি ১৯৭২ সালে জ্ঞানদায়িনী হাই স্কুল, সিরাজগঞ্জ থেকে মাধ্যমিক ও সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে ১৯৭৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন।এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৮০ সালে স্নাতক (সম্মান) ও ১৯৮১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি স্বউদ্যোগী পেশাজীবী। বিকল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিনা অপারেশনে হৃদরোগ চিকিৎসা দিতে গড়ে তুলেছেন সাওল হার্ট সেন্টার (বিডি) লি.। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
কবি মোহন রায়হান যখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, ছিলেন মফস্বলে। ওই সময় স্কুল পালিয়ে যোগ দেন ছয় দফা আন্দোলনের মিছিলে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে কিশোর ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত। পরিণামে ভোগ করতে হয় পাক-পুলিশের রক্তাক্ত প্রহার। মাত্র ১৫ বছর বয়সে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতার পর যুক্ত হন জাসদ রাজনীতির সঙ্গে। ১৯৭৩ সালে আইএ পরীক্ষা দিতে হয়েছে জেলখানা থেকে। গুম ও অসংখ্যবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন- পুলিশ, আর্মি আর দলবাজ সন্ত্রাসীদের হাতে। জেল খেটেছেন ১৩ বার। ৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ে শামিল ছিলেন সামনের সারিতে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদ সামরিক শাসন জারি করা মাত্র মধুর ক্যান্টিন থেকে প্রথম প্রতিবাদী মিছিল বের হয় মোহন রায়হানের নেতৃত্বে। ১৯৮৩-এর ১১ জানুয়ারি সামরিক স্বৈরশাহীর বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্রবিদ্রোহের নেতৃত্বও দেন তিনি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদের ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা ।
রাজনৈতিক ভূমিকার পাশাপাশি সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠনে তার ব্যাপক অংশগ্রহণ ও প্রশংসনীয় নেতৃত্ব ছিলো। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব, লেখক শিবির, অরণি সাংস্কৃতিক সংসদ এর প্রতিষ্ঠা ও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। কিশোর বয়স থেকেই কবিতায় হাতেখড়ি। ছাত্রাবস্থায় বের হয় প্রথম কাব্যগ্রন্থ। তার প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ:
কাব্যগ্রন্থ: জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ (১৯৭৯); আমাদের ঐক্য আমাদের জয় (১৯৮০); সামরিক আদালতে অভিভাষণ (১৯৮৪); আর হল না বাড়ি ফেরা (১৯৮৫); ফিরে দাও সেই স্টেনগান (১৯৮৬); শকুন সময় (১৯৮৭); গোলাপ জানের পকেট পঞ্জিকা (১৯৮৮); মোহন রায়হানের সংগ্রামী কবিতা (১৯৮৯); মোহন রায়হানের প্রেমের কবিতা(১৯৮৯);নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৩); Selected Poems (১৯৯৩); ঘাতক না প্রেমিক (১৯৮৫); সবুজ চাদরে ঢাকা রক্তাক্ত ছুরি (১৯৮৮); কবিতা সমগ্র (২০০১); নিরস্ত্রীকরণ কবিতা (২০০২); রক্তসিক্ত অশ্রুজবা (২০০৬); কবি কাপুরুষ হলে পৃথিবীতে নামে অন্ধকার (২০১০);মেঘের শরীরে যাব; শাহবাগ ডেকেছে আমায় (২০১৪); ।
সম্পাদনা : সম্পাদিত পত্রপত্রিকাগুলোর মধ্যে স্ফুলিঙ্গ, সমকণ্ঠ, মায়াবিনী গোল্লায় যাক, জনান্তিক, অরণি, সাহস, প্রাক্সিস জার্নাল, উপদ্রুত এই মাটি জ্বলে প্রতিরোধে, ইশতেহার, বিদ্রোহের পঙক্তিমালা, সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন ও কবিতাপত্র দিকচিহ্ন।
দেশভ্রমণ: ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান।