প্রথম কাব্যগ্রন্থ, প্রথম কবিতা আড্ডাপত্র প্রকাশ করছে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের সাথে কবির আনন্দ, উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি পাঠকের কানে নতুন কবিতার গুঞ্জরণ ভেসে আসে। পাঠকের মনে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাটি তুলে ধরতে চায় আড্ডাপত্র। কবিতা পাঠের সাথে সাথে জানবো কবি সম্পর্কেও। এই আয়োজনটি পরবর্তীতে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হবে।
ভালোবাসা
আবু কায়সার
কয়েকজন মানুষের ভিতর এবং বাইরে কী কী ওই যে সমস্ত থাকে
আপাত নির্বোধ আমি ভাগ্যবলে—ভাগ্য নেই—কিছু কিছু জানি
কারো কারো সমগ্রই,—
বিশ্বাস বিশ্বাস বলে’ ঊনসত্তরের সেই শহরে একবার
যে শোক মিছিলে এক যুবকের আকষ্মিক মৃত্যু ঘটে যায়
তার নাম মোহাম্মদ, –কী কী ওই যে সমস্ত পদবিটদবি
আগে বা পশ্চাতে ছিলো মনে নেই, তবে সেই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত
নগ্নপদ, চোয়ালের ভয়ঙ্কর স্থিরভাব, চোখের ভিতরে
যা ছিলো যা থাকতে পারে আমি তার সমস্ত জানতাম।
রাস্তায় গড়েছে কতো ব্যারিকেড হাই হট্টগোল
এখানে ওখানে দেখি রক্ত জমে আছে। যেন কালো ক্যানভাসে
ম্যাজেন্টারেডের সুনিপুণ কারুকাজ,— সব শ্লোগানের থেকে ঢের দূরে
মিছিলবিচ্ছিন্ন আমি। যেন দূর শৈশবের মেলায় এসেছে
এক গ্রামীণ কিশোর।
কয়েকজন মহিলার ভিতর এবং বাইরে কী কী ওই যে সমস্ত থাকে
আপাত উদাস আমি কিছু তার বিস্তৃত বুঝেছি
কারো কারো সমান্যই
ঈশ্বর ঈশ্বর বলে’ এখন; তখনো যারা সহজ প্রেমিকা
শেখাতো অন্যকে নানা ছলাকলা চোখ ঠারাঠারি
প্রেমের নানান শিল্প
তাদের একজন ছিলো রাবেয়া,—এখনো আছে—দূরে
কী কী ওই যে সমস্ত পদবিটদবি
আগে বা পশ্চাতে ছিলো মনে নেই; তবে তার অর্থহীন স্তনের ভিতরে
অন্যান্য গোপন অঙ্গে; অতিশয় চুম্বন বিলাসে নাভিমূলে
যা ছিলো যা থাকতে পারে আমি তার সমস্ত জানতাম।
রাস্তায় এখন কিছু নগ্নমন দুর্দান্ত যুবতী
প্রেমের বিরুদ্ধে আছি এরকম অভিযোগে আমাকে তাড়ায়
রায়টকারের মতো,
কিছু কিছু যুবতীর বাক্য আর কর্মের ভিতরে আজকাল
ভালো সমন্নয় থাকে অতএব এক ধরন সহজ বিশ্বাসে
আবার গুহার বাইরে আমি নীলনবঘন আষাড়ের নীচে
দুবাহু বিস্তারে রাখি; সাক্ষী থাকে মোহাম্মদ এবং রাবেয়া; ভালোবাসা।
আবু কায়সার ষাট দশকের উল্লেখযোগ্য কবি। তিনি শিশুসহিত্যিক ও অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতিমান। প্রথম কাব্যগ্রন্থ আমি খুব লাল একটি গাড়িকে’ পাঠকনন্দিত হয় এবং তাকে কবিখ্যাতি এনে দেয়। ‘রায়হানের রাজহাঁস’ উপন্যাসটির জন্য তিনি শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি হেনরী মিলারের তিনটি উপন্যাস বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে অনুবাদক হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছিলেন।
তিনি ১৯৪৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে জন্ম গ্রহণ করেন।পরবর্তীতে তারা টাঙ্গাইলের নন্দিরবেতকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।তার পিতার নাম শফিউদ্দীন আহমদ যিনি বিন্দুবাসিনী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। কবি আবু কায়সার ওই বিদ্যালয় থেকে ১৯৬০ সালে মাধ্যমিক ও মাওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজ থেকে ১৯৬২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন।
বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন।তার মধ্যে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক গণকণ্ঠ, সংবাদ, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক যুগান্তর এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রা ও সিকদার আমিনুল হক সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিপ্লব’ অন্যতম।
মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কবি মোহাম্মদ আবদুল মাননান এবং কবি মাহমুদ কামালের যৌথ সম্পাদনায়
‘সব্যসাচী আবু কায়সার ’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চল্লিশ এর অধিক।
কাব্যগ্রন্থ: আমি খুব লাল একটি গাড়িকে (১৯৭২); যাদুঘরে প্রজাপতি (১৯৮৫); জোছনার মাতাল জেব্রাগুলো (১৯৮৫); লজ্জার দেরাজ (১৯৯৭); নিরুদ্দেশ অক্ষৌহিনী (২০০০); নির্বাচিত কবিতা (২০০৩)।
উপন্যাস: সব পাখি আসে; নিবারণপুরের বিবরণ (২০০০)।
শিশুসাহিত্য: পলি মাটির পুতুল (শিশুতোষ ছড়া); রায়হানের রাজহাঁস (কিশোর উপন্যাস); অন্যরকম ছেলে; একাত্তরের গল্প শোনো; পাখিপুরের ভুতুরে কাণ্ড; নিঝুমপুরের নির্জন বাড়ি; প্রেত পাহাড়ের যাত্রী; ইনকা রাজার গুপ্তধন; দুঃস্বপ্নের দ্বীপ; কাফ্রির কাটা হাত; পাঁচ পাহাড়ের বারো ভূত; খুশির খবর; ভয়ঙ্কর দ্বীফ; পাঁচ এ্যাডভেঞ্চার; কাকাতুয়া; পলিমাটির পুতুল; তোমার আমার ঠিকানা; বায়ু; ভয়ঙ্কর অভিযান (২য় সংস্করণ ২০০৬)।
স্মৃতিকথা: টুকরো টুকরো ছবি; অন্যরকম বঙ্গবন্ধু; রক্তঝরা একাত্তর (২০০০, ২য় সংস্করণ ২০১৪)।
জীবনী: যাদু সম্রাট পি.সি. সরকার; ইবনে সিনা (১৯৯২); মহাকবি গ্যেটে (১২তম সংস্করণ, ২০১৭); বজ্রনামের সেই ছেলেটি।
অনুবাদ: বুলগেরিয়ার গল্প ; কুমায়ুনের মানুষখেকো (মূল: জিমকরবেট)।
পুরস্কার ও সম্মাননা: অগ্রণীব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার; নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার; শিশুসাথী পুরস্কার; মুক্তিযোদ্ধা লেখক পুরস্কার; টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ প্রবর্তিত টাঙ্গাইল সাহিত্য সংসদ পুরস্কার।
মৃত্যু: ৩০ এপ্রিল ২০০৫।