আতাহার খান
[কবি কাজী জহিরুল ইসলাম এর জন্মদিন। তিনি কথাসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য, গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও অনুবাদে অনবদ্য। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খাগাতুয়া গ্রামে, ১৯৬৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। পিতা কাজী মঙ্গল মিয়া, মা সোফিয়া বেগম।তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। বর্তমানে জাতিসংঘের একজন ঊর্ধতন পেশাজীবী হিসেবে কর্মরত। স্ত্রী মুক্তি জহির, এক পুত্র ও দুই কন্যাসহ বর্তমানে বসবাস করছেন যুক্তরাষ্ট্রে।
কাজী জহিরুল ইসলাম লেখালেখি শুরু করেন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়বার সময়। দৈনিক আজাদের সাহিত্য পাতায় ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম লেখা।এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৬৫, যার মধ্যে কাব্যগ্রন্থ ২২টি । জার্মানি থেকে প্রকাশিত “পোয়েমস অব কাজী জহিরুল ইসলাম” নিউ ইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে ২০১৮ সালে। তিনি অর্ধশতাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন।
কাব্যগ্রন্থ: পুরুষ পৃথিবী (১৯৯৮), ভালোবাসার শব্দগুল্ম (১৯৯৯), পাঁচতলা বাড়ির সিঁড়িপথ (২০০১), দ্বিতীয়ঘাস ফড়িং (২০০১), আকাশের স্ট্রিটে হাঁটে ডিজিটাল নারদ (২০০৪), দ্বিতীয়বার অন্ধ হওয়ার আগে (২০০৬), উদ্বিগ্ন রাতের কথা (২০১৫), পুড়ে যাই দ্রোহে পুড়ে যাই প্রেমে (২০১৫), ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ (২০১৬), না জর্জেট না জামদানি (২০১৬), সূর্যাস্তের পরের ফিরিস্তি (২০১৬), রাস্তাটি ক্রমশ সরু হয়ে যাচ্ছে (২০১৭), দেহকাব্য (২০১৭), উটপাখিদের গ্রামে উড়ালসভা (২০১৭), বালিকাদের চাবিওয়ালা (২০১৮), যে বৃক্ষটি কাল হয়েছে গুম (২০১৮), ক্রিয়াপদহীন কবিতা (২০১৯), অন্ধকারে জিহ্বা নাড়ে পাপের গহ্ববর (২০১৯), বৃহত্তে যায় আদম হাওয়া (২০১৯), একালে কাকতলাতে বেল (২০১৯), প্রেমের পদাবলী, (২০২০), দেয়াল ঘড়িটা কী মিথ্যুক (২০২০), স্থবির আঁধারে স্বপ্নসম্ভবা বসন্ত (২০২০), কবিতাসমগ্র-১ (২০১৫), কবিতাসমগ্র-২ (২০১৮), কবিতাসমগ্র-৩ (২০২০)।
অনুবাদ কবিতা :জালালুদ্দিন রুমির কবিতা (২০১৭), এজরা পাউন্ডের কবিতা (২০১৯)।
গল্পগ্রন্থ: যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে (১৯৯২), উত্থানপর্বের গল্প (২০১৯)।
উপন্যাস: একাত্তুর এবং (১৯৯৮), একাকী নক্ষত্র (১৯৯৮), গ্রহান্তরের সুখ (২০০৮), থাবড়া হামিদ (২০১৮)।
ভ্রমণগদ্য: উড়ালগদ্য (২০০৬), পথকথন (২০০৫), কসোভোর পথে-প্রান্তরে (২০০৬), কাকাওয়ের দেশে (২০০৬), গজমোতির দেশ আইভরিকোস্ট (২০০৭), জানা-অজানা আফ্রিকা (২০০৮), ঘুলঘুলির আলো (২০০৯), উড়ালগল্প (২০১৮), ভ্রমণ সমগ্র-১ (২০১৭), ভ্রমণ সমগ্র-২ (২০১৭)।
প্রবন্ধ-গবেষণা: শেকড়ের খোঁজ (২০১৭), অসীম শূন্যতে তিষ্ঠ (২০১৭), বড় নারীদের কথা ও অন্যান্য গদ্য (২০১৮), দাগচিত্র (২০১৯), সৃষ্টিপুরাণ ও অন্যান্য লোককথা (২০০৭ এবং ২০১৮)
আত্মজীবনী :বিহঙ্গপ্রবণ (২০০৬ এবং ২০১৮)
স্মৃতিকথা: আড্ডার গল্প – হেমন্তের পত্রবৃষ্টি
শিশুতোষ গল্প: ছয় ঠ্যংঅলা নীল সাপ (২০০৮), জলের ঘড়ি (২০২০)
সম্পাদিত গ্রন্থ: জলের মিছিল (১৯৯৪), স্বপ্নশিকারিদের অরণ্যবিহার (২০১৭), চার ঊনবাঙালের কবিতা (২০১৮), আন্ডার দ্য ব্লু রুফ- ভলিউম-১ (Under The blue roof Vol. I) ২০১৮। Under The blue roof Vol. II (২০১৮), Under The blue roof Vol. III (২০১৯)
বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থ: After A Long Way ( ২০০২), The Smell of Dust (২০১৮), Poems of Quazi Johirul Islam ( ২০১৮), 100 English Haiku (২০২০)। উড়িয়া ভাষায় অনূদিত ক্রিয়াপদোহিনো কবিতা (২০১৯)।
কবির জন্মদিনকে বর্ণিল করবার জন্য আজ প্রকাশ করা হলো জাপান প্রবাসী কবি ও গবেষক প্রবীর বিকাশ সরকার এর একটি মূল্যায়ন গদ্য ও কবির দশটি বাছাই কবিতা। পাঠের আমন্ত্রণ।- সম্পাদক]
ফেসবুক-এর কল্যাণে এ-সময়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা চোখে পড়ে কাজী জহিরুল ইসলামের। কোনও কোনও দিন একাধিক কবিতা লিখে ফেলেন তিনি। পাশাপাশি লিখছেন সিনিয়র কবি ও সাংবাদিক ব্যক্তিত্বদের ওপর নিবন্ধ, নিচ্ছেন কারো-কারোর সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকার অথবা সঞ্চালক হিসাবে পরিচালনা করছেন ফেসবুক-এ লাইভ কবিতা পাঠের আসর, তার ওপর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরি। জহিরের এই সব বিষয়-আশয় আমার কৌতূহলই বাড়ায়নি, বিস্ময়েরও জন্ম দিয়েছে। একজন মানুষ কী করে এত নানামুখী কাজ সুচারুভাবে পালন করতে পারেন, কাজী জহিরুল ইসলামকে না-দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না। তিনি গা-গতরে কর্মপটু তো বটেই, উপরন্তু কোনও দায়িত্ব যদি তাঁর কাঁধে তুলে দেওয়া হয় তা শেষ না-হওয়া অবধি সেই কাজ যত্ন, নিষ্ঠা, শ্রম সব একাকার করে দিয়ে ঠিকই গন্তব্য-অভিমুখী এগিয়ে যেতে থাকেন।
এই উজ্জ্বল কর্মঠ মানুষকে আমি প্রথম দেখি পূর্ণিমা পত্রিকার অফিসে। সালটা সম্ভবত ১৯৯১ । পত্রিকাটির সার্বিক দায়িত্ব আমার হাতে। পূর্ণিমা তখন জনপ্রিয় জাতীয় সাপ্তাহিক ম্যগাজিন হিসাবে ভীষণ সমাদৃত। সারাক্ষণই কন্ট্রিবিউটার আর লেখকদের আনাগোনায় পুরো অফিসটাই থাকে সরব। ঠিক এরকম এক ব্যস্ত দিনে কালচারাল রিপোর্টার দুলাল খানের সঙ্গে এসেছিলেন কাজী জহিরুল ইসলাম। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দুলাল বলেছিলেন, আতাহার ভাই, এই কবির হাত কিন্তু খুব ভালো। আপনি ওকে কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন।
আমি তাকে বললাম, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের নিয়ে অফ-ট্রাকের রিপোর্ট চাই। আপনি কি পারবেন?
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে জহির এ-প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছিলেন তা এ-মুহূর্তে হুবহু মনে নেই, তবে তাঁর সপ্রতিভ চাহনির মধ্য দিয়ে আমি ইতিবাচক জবাবই খুঁজে পেয়েছিলাম। আজ খোলামনে বলতে চাই যে কাজী জহিরুল ইসলামের মাধ্যমে আমি পূর্ণিমার সঙ্গে বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-শিল্পীকে নিকটতম সম্পর্কে টেনে আনতে পেরেছিলাম। এক্ষেত্রে জহিরের ভূমিকা ছিল অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তবে তাঁর মূল চাকরি ছিল বিদেশি এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায়। দিনের বেলায় সেখানেই কাজ করতেন। অফিস শেষে রিপোর্টিংয়ের জন্য যাবতীয় তথ্য ও লেখক-শিল্পীদের খবরাখবর জোগাড় করে সোজা চলে আসতেন পূর্ণিমায়। নিবিষ্ট মনে কাজ করতেন। কাজ শেষে রিপোর্ট জমা দিয়ে চলে আসতেন আমার রুমে।
সেখানে যুক্তি-পাল্টা যুক্তিসহ জমে ওঠা তুখোড় আড্ডায় অংশ নিতেন এই নবীন সদস্য। সৈয়দ মনোয়ার হেসেন ও আবু করিমের মধ্যেই তর্কটা হত বেশি। আড্ডায় রবি আরমান, ইরাজ আহমেদ , মাহফুজুর রহমান, পঙ্কজ পাঠকও থাকতেন সরব। এখানে এই আড্ডা চলাকালীন কখনো আসতেন আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন, আবদুল মান্নান সৈয়দ। তবে নিয়মিত একবার করে অফিসে এসে কিছুটা সময় কাটিয়ে যেতেন আল মুজাহিদী, সানাউল হক খান, শিহাব সরকার, ফাহিম ফিরোজ , মাহমুদ কাশেমসহ আরও অনেকে। আাড্ডায় জহির থাকতেন উচ্ছ্বল। তাঁর আরও একটি গুণ হল কোনো কাজই তিনি ফেলে রাখতেন না, সময়ের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সব কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করতেন।
পূর্ণিমায় জহির ছিলেন একজন অত্যন্ত মেধাবী কন্ট্রিবিউটর। তারপরও মনে হত না তিনি খণ্ডকালীন প্রতিবেদক। ওর রিপোর্টিংয়ের স্টাইল ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। লিটারেরি ফ্লেবারের মিশেলে তাঁর চমৎকার গদ্যরীতির কৌশল ছিল সত্যই প্রশংসনীয়। আল মাহমুদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ তো প্রায়ই জহিরের রিপোর্টিং নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেতেন। তাঁরা উভয়ই বলতেন, ছেলেটার প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন আতাহার, অসাধারণ গদ্যের হাত ওর। কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয় জহিরের প্রতি। তারা চেয়েছিল তাঁকে নিয়মিত স্টাফ-রিপোর্টার করে নিতে কিন্তু আমার আপত্তির জন্য সে সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যায়। আসলে আমি চাইনি সাংবাদিক হিসাবে জহির তাঁর ক্যারিয়ার গড়ে তুলুক। এর কারণ হল সাংবাদিকতা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এক পেশা। যে-কোনো সময়ে চাকরি চলে যেতে পারে, এমনকি আর্থিক সংকটের জন্য পত্রিকার প্রকাশনাও অনিয়মিত হয়ে পড়তে পারে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, জহির বিদেশি যে-স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় চাকরি করছিলেন, সেখান থেকে আরো ভালো জায়গায় যাওয়ার তাঁর রয়েছে সুযোগ। আজ আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমার ওই সিদ্ধান্ত ছিল ঠিক। হ্যাঁ, কাজী জহিরুল ইসলাম জাতিসংঘের নিউ ইয়র্কের কেন্দ্রীয় অফিসে এখন গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করছেন।
পূর্ণিমার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে একটি লিটল ম্যাগও বের করেছিলেন জহির। ছোট কাগজটির নাম দিয়েছিলেন ‘কাজীর কাগজ’। পাশাপাশি করতেন জসীম উদ্দীন সাহিত্য পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব পালন। জহির আমাকে অনেকবার বলেছেন, আমি পূর্ণিমায় লিখি না, লিখি একজন মুক্তিযোদ্ধা আতাহার খানের কাগজে। পরবর্তিতে জহির আমার অনুরোধে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায়ও বেশ কিছু গদ্য লেখেন। তখনও, ওর একই কথা, আমি লিখি আতাহার ভাইয়ের কাগজে। জহির তার কলাম, প্রবন্ধ বা উপসম্পাদকীয়তে এমন বিষয় তুলে আনতেন যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক। যখন তিনি পূর্ণিমায় কন্ট্রিবিউট করতেন, একই সঙ্গে দৈনিক জনকণ্ঠে লিখতেন। যখন তিনি আমার দেশে কলাম লিখতেন, একই সঙ্গে প্রথম আলোতে নিয়মিত লিখতেন। এমনও দেখা গেছে একই দিনে আমার দেশ এবং প্রথম আলোতে তার লেখা উসম্পাদকীয় বিভাগে ছাপা হয়েছে। এটা এজন্য সম্ভব হয়েছিল, তিনি আমাদের অস্বাস্থ্যকর দলীয় রাজনীতি থেকে সব সময় দূরে থাকতেন এবং সব সময় সত্যিটা বলার চেষ্টা করতেন। জহিরই প্রথম ২০০৭ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিচয় পত্র তৈরির ধারণাটি দেন। কাজটি কিভাবে করা হবে এর বিস্তারিত পরিকল্পনা তার রচনায় ছিল। সেই লেখার পেপারকাটিং প্রকল্প বাস্তবায়নকারীদের টেবিলে টেবিলে ছিল।
নানামুখী কাজ গুছিয়ে সুন্দরভাবে শেষ করার আশ্চর্য গুণ ছিল তাঁর। ওই সময়ে আমি জহিরের বেশ কিছু কবিতাও পড়েছি। তখন ছিল তাঁর সূচনাপর্ব। আর এখন মানতেই হবে, কাজী জহিরুল ইসলাম বিশুদ্ধ মনীষাকে অবলম্বন করেই কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতার দুই অঙ্গ, একঃ উজ্জ্বল চিত্রকল্পের আয়োজন, দুইঃ উপস্থাপনার নিজস্ব ভঙ্গি। তাঁর কবিতার বিষয় ও বক্তব্যের ধরনও সমকালীন অন্য কবিদের থেকে পুরোপুরি আলাদা। নতুন আলোর ঝলকানিতে যেন হঠাৎ চমকে উঠতে হয়। এমন পঙক্তি কবিতার পাঠক হিসাবে জোর দিয়ে বলতে পারি, আগে কখনও দেখিনি। উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে উঠবেঃ
‘রোজ রাতে একটি কলম ঠোঁট ঘষে তোমার খাতায়।
চুমুর চিহ্নেরা আঁধারে সাঁতার কেটে কেটে ঘুম ভাঙায় শিল্পের।’
(কবিতাঃ শিল্প, গ্রন্থ: মশলারাজ্য)
আমার বলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, বাংলা কবিতায় এমন টাটকা সতেজ পঙক্তি খুব একটা চোখে পড়ে না। যিনি অনায়াসে এমন চমৎকার পঙক্তি রচনা করতে পারেন, তাঁর কবিত্বশক্তি নিয়ে সন্দেহ করার কোনও অবকাশ নেই। আরো একটি উদাহরণ দিলে আমার কথাটি পরিষ্কার হবে আশা করি,
‘রাত বারোটায় মিনিটের কাটা বড়
অস্থির, কামান্ধ,
উপগত হয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা
ঘণ্টার কাঁটার ওপর, আঁতুড়ঘর কাঁপিয়ে তখন
কাঁদে নতুন দিবস।
(কবিতাঃ সময়, গ্রন্থঃ জন্মান্ধ কৌরব)
.
কবিতায় এভাবে নতুন কথা, ছবি, দৃশ্য, কল্পনা তুলে ধরা সহজ কাজ নয়, নিঃসন্দেহে কোনো কোনো কবিতায় তাঁকে দেখা যায় আবিষ্কারকের ভূমিকায়। তা না হলে এমন স্মরণীয় পঙক্তি কী করে লেখা যায়? মেজাজে জহির অবশ্যই রোমান্টিক এবং বর্ণনায় রীতিমত দক্ষ। চিত্ররূপময় প্রতীকী কবিতাতেও তাঁর সমান মনোযোগ ও আগ্রহ।
কবিতা নিয়ে জহিরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ নেই। সেই পরীক্ষাই তিনি করেছেন ক্রিয়াপদ ব্যবহার না করে। একটি পুরো কবিতার বই “ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ”-এ কবি আসলেই কোনো ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেননি। একে কি পাগলামি বলবেন? না, এই কাজ করতে গিয়ে কাজী জহিরুল অত্যন্ত সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। এই ব্যতিক্রমী কবিতাগুলো ২০১৫ সনের ১৬ আগস্ট থেকে শুরু করে ২০১৬-এর এপ্রিলের মধ্যে লেখা। গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত পঁয়ত্রিশটি কবিতার কোথাও ক্রিয়াপদ ব্যবহৃত হয়নি। ক্রিয়াপদ এড়িয়ে পঙক্তির পর পঙক্তি সাজানো, কাব্যরসের স্বাদ বজায় রাখা, চিত্রকল্পের সফল প্রয়োগ, উপলব্ধির দুয়ার খুলে দিয়ে পাঠককে স্বাধীনভাবে ভাবতে সুযোগ করে দেওয়া, তার ওপর কবিতার প্রবহমানতা ধরে রেখে নানান রঙ আর ছবি আঁকা সত্যিই চাট্টিখানি কথা নয়। সেই জটিল ও অসম্ভব কাজ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে দেখিয়েছেন কাজী জহিরুল ইসলাম। “ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ”-এর ৩৫টি কবিতা পড়ে যে-কোনো বোদ্ধাপাঠকই বলতে বাধ্য হবেন, সবগুলোই পরিপূর্ণ কবিতা। একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে :
‘গুহামৃত্যুর কথাও তো বিস্মৃত নয়, কী নির্মম শৃঙ্গপতন
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নরম পলিতে পুরনো জিন, দানবীয় আস্ফালন
ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর
স্ফীত বক্ষ, নির্দয় বাহু
আরক্ত জ্বরেরও দেশান্তর আছে ইতিহাসে।
(ফ্রাঙ্কেস্টাইন/ ক্রিয়াপদহীন ক্রিয়াকলাপ)
পঙক্তিগুলো পড়ার পর কোথাও মনে হয়নি এখানে কাব্যিক গুণ ক্ষুণ্ন হয়েছে। বরঞ্চ পরোক্ষে রাজনীতির কথা বলা হয়েছে। ‘ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন’ শিরোনামের কবিতায় শুধু রাজনীতিই বা বলি কেন, একই সঙ্গে ইতিহাস চেতনার কথাও স্বীকার করতে হয় পাশাপাশি! ‘ক্যাথিড্রাল-সন্ধ্যা’, ‘বিপণন কন্যা’, ‘অধ্যবসায়’, ‘স্পাইরাল পতন’, ‘হাইফেন’ শিরোনামের কবিতায় ভাষাভঙ্গি আর জীবনদর্শনে কোথাও নেই পূর্ববর্তী কবিদের ছায়া, বরং অন্তর্চেতনার উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি চমক সৃষ্টি করে সত্য, এবং তার মধ্যেও আছে এক ধরনের সংশয় আর নৈঃসঙ্গের ছায়া।
মধ্যপঞ্চাশে উপনীত এই কবির এ পর্যন্ত ২৬টি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিটি কবিতার বইয়ে তিনি কল্পনাশক্তির নিখুঁত আয়োজনের মধ্য দিয়ে বস্তুর অন্তর্নিহিত রূপ প্রকাশে বেশ মনোযোগী হয়েছেন। বলা যায়, এটাই তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেখানে এই যে সাজানো আয়োজন তা শুধু অভিনবই নয়, নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়ও। ভাব এবং আবেগ এ-দুইই খুব ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আলোকিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নতুন নতুন উপলব্ধি, সূক্ষ্ম-চিন্তার সমাহার, বিষয় থেকে বিষয়ের উর্ধ্বে উঠে আসার ক্ষমতা, অনুভূতির রূপময় বিন্যাস, মূর্ত থেকে বিমূর্ত পথ-পরিক্রমাঃ এ-সবই হল তাঁর কবিতা নির্মাণের বিষয়-আশয়। সম্ভবত একারণেই তিনি তাঁর কবিতার ভিতর দিয়ে পাঠকের ভালো লাগার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছেন। এতে যে-কোনো পাঠকের পক্ষে সহজ হয়, তাঁর কবিতার অন্তর্গত সৌন্দর্যের গভীর থেকে আরও গভীরে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া। সেখানে পৌঁছানো মাত্রই এক ধরনের সাংকেতিক উপলব্ধির আশ্চর্য আনন্দ উপভোগ করা যায়। স্পষ্ট ভাষায় বলছি, একজন কাজী জহিরুল ইসলাম সত্যই বিরল গুণের অধিকারী,এবং এটা তিনি প্রকৃতিগতভাবেই রপ্ত করেছেন।