আড্ডাপত্র

৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ২১ নভেম্বর, ২০২৪;বিকাল ৩:১১

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের এক কবিতার ভেতর থাকে একাধিক কবিতা |জাকির হোসেন

আড্ডাপত্র

মে ৩০, ২০২২ | জন্মদিন, প্রবন্ধ

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলালের সাথে প্রাবন্ধিক জাকির হোসেন
কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল দীর্ঘ এক যুগেরও বেশী সময় ধরে আছেন প্রবাসে। অথচ প্রবাস জীবন তাঁকে বৈদেশী বানাতে পারেনি। আপাদমস্তক তিনি রয়ে গিয়েছেন খাঁটি বাঙালি, বাংলাদেশি।

বসবাসের জন্য প্রবাসে শাখা-প্রশাখা ছড়ানো হলেও শেকড় থেকে কখনোই তিনি বিচ্ছিন্ন হননি। এখন বিশ্বায়নের কবিতা লিখলেও তাঁর শেকড় জন্মভূমির নাড়ির সাথেই প্রোথিত।

কবি দুলাল বরং প্রবাস জীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতাকে আরো সমৃদ্ধ করেছেনে। মাত্রা পেয়েছে আন্তর্জাতিকতায়। কখনো কখনো স্বদেশ ও বিদেশের নানা বিষয়আশয় দ্রবীভূত হয়েছে তাঁর কবিতায়। মানুষ যা চিন্তা করে অথচ প্রকাশ করতে পারে না, তাকে তিনি নিজের মধ্যে নিপুনতার সাথে ধারণ করেন। আর প্রকাশ করেন এমনভাবে যেনো হিব্রু বা মেন্ডারিন ভাষার বাংলা অনুবাদ আমরা পেলাম।

কবিতা নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। তাঁর নিকট সময়ে লেখা কবিতাগুলো এর সাক্ষী। খোয়াবনামা, নারীর মাংস, ভূমিকম্প, মাছমন্ত্রি, তুলসি, কুমির, বিবাহসমগ্র, নভেরা, Je t’aime, হিজড়া সাহিত্য, ইউনিয়ন, আলিফ, আওয়াজ এসব কবিতা পাঠ করতে করতে সমকালীন চিন্তার বাইরে চলে যাওয়া যায়। মনে হয় যেনো তিনি শতবর্ষ আগে থেকে শতবর্ষ পরের কবিতা লিখছেন একবিংশ শতাব্দীতে।

কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদের কবিতার চমৎকারিত্বের একটি উদাহরণ হলো এই যে, সবাই যখন মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞা প্রকাশ করে কবিতা লিখেন; তখন তিনি উল্টো ভাবে মাকে বলেন, আমি তোমার সন্তান বলেই তুমি ‘মা’ হতে পেরেছো।

সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জননী এবং সন্তানের পারষ্পারিক ঋণটা কবিতায় সমান্তরাল করে তুলেন তিনি। এভাবেই তাঁর কোনো কোনো কবিতার ধারা কিছুটা- এন্টি পয়েট, এন্টি সেক্স, এন্টি লাভ এবং গ্রন্থের নামকরণেও তা বৈপরীত্ব প্রতিফলিত হয়। এবং কাব্যগ্রন্থ থেকে আরেকটি কাব্যগ্রন্থ আলাদা। যেমন, তার সর্বশেষ তিনটি কাব্যগ্রন্থ ‘সঙ্গমের ভঙ্গীগুলো’, ‘তিন মিনিটের কবিতা’ এবং ‘আমার সাথে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ’ একটি থেকে আরেকটি দৈর্ঘ্য, দূরত্ব, পার্থক্য খুব সহজেই অনুমেয়।

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল একদিকে যেমন সহজ-সরল-সাবলীল ভাষায় লিখেন তেমনি তিনি জন্ম দেন প্রতীকী, রূপক রহস্যময় এবং জটিল কবিতা; এক কবিতার ভেতর যেনো একাধিক কবিতা! আবার একটি কবিতা থেকে আরেকটি কবিতার বিষয়বস্তু, ব্যঞ্জনা, উপস্থাপনার দূরত্বও পাঠকদের সুদৃষ্টি কাড়ে।

অন্তর্মুখি এই কবি অন্তরালে থেকেই প্রতিদিন বাংলা সাহিত্যকে, বিশেষত আধুনিক বাংলা কবিতাকে যেমন সমৃদ্ধ করছেন তেমনি সাহিত্য নিয়ে তাঁর গবেষণার কাজটিও চলে অহর্নিশি। কবিতার পাশাপাশি তাঁর গবেষণামূলক কাজও কম নেই। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করছেন তেমনি তিনি ৭১এর যুদ্ধশিশু নিয়ে কাজ করছেন।

বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কারিগর কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল তাঁর অধিকারের অংশ হিসেবেই নিশ্চয় তিনি একে একে স্পর্শ করবেন বাংলা একাডেমি, একুশে ও স্বাধীনতা পুরস্কার। মূল্যায়নের স্বীকৃতিতে তিনি যতটা না সম্মানিত হবেন, তারচেয়ে অধিক সম্মানিত হবে বাংলা সাহিত্য এবং বাংলাদেশ।

[কবি পরিচয়ের বাইরেও তিনি সাংবাদিক, নাট্যকার, গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিমান। জন্ম : ৩০ মে ১৯৫৮, শেরপুর। পিতা : আলহাজ্ব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক। মা : সারা শহীদুল্লাহ । স্ত্রী: অপি মাহমুদ। সন্তান: দুই কন্যা অনাদি নিমগ্ন, অর্জিতা মাধুর্য। ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইত্তেফাকের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতার জীবন শুরু। পরে দেশের বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৮০ সালে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। প্রবাসী বাঙালিদের জন্য নিউজ এজেন্সি ‘স্বরব্যঞ্জন’ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবাস থেকে প্রকাশিত (যুক্তরাষ্ট্র থেকে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক প্রবাসী, সাপ্তাহিক আমার পক্ষে, মাসিক পরিচয়, সাহিত্য পত্রিকা আকার-ইকার, মাসিক অভিমত; কানাডার থেকে সাপ্তাহিক প্রবাস বাংলা, সাপ্তাহিক ঢাকা পোস্ট, পাক্ষিক দেশ দিগন্ত, মাসিক বাংলাদেশ, সাহিত্য পত্রিকা বাংলা জর্নাল; জাপানের মাসিক মানচিত্র, মাসিক আড্ডা টোকিও, বিবেক বার্তা; অস্ট্রেলিয়ার সাপ্তাহিক স্বদেশ বার্তা প্রভৃতি) পত্রিকার সাথে যুক্ত। টরেন্টো থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বাংলা রিপোর্টারে প্রধান সম্পাদক ছিলেন। এখন সাপ্তাহিক বাংলার মেইল এবং সাপ্তাহিক সিবিএন২৪’এর উপদেষ্টা সম্পাদক।এছাড়াও বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের কানাডাস্থ বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সপরিবারে বসবাস করছেন কানাডায়। সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল কবিতা নিয়ে তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। কবিতাকে দেখেন উল্টোদিক থেকে। ভিন্ন আরেকটি চোখ দিয়ে।‌লেখা‌লে‌খি শুরু: মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। প্রথম লেখা প্রকা‌শিত হয় ১৯৭২ সালে, স্কুল ম্যগাজিনে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা প্রায় ৬০টি। কাব্যগ্রন্থ: তৃষ্ণার্ত জলপরী (১৯৮২); তবু কেউ কারো নই (নাসিমা সুলতানের সাথে যৌথ ১৯৮৫); অপেক্ষায় আছি প্রতীক্ষায় থেকো (১৯৮৭, ২য় সংস্কারণ ১৯৮৯); শহরের শেষ বাড়ি (, জানুয়ারি ১৯৯১); ঘাতকের হাতে সংবিধান ( ফেব্রুয়ারি ১৯৯০); একি কাণ্ড পাতা নেই( ১৯৯৫); দ্রবীভূত গদ্যপদ্য (১৯৯৯, ২য় সংস্করণ ২০০১); ঐক্যের বিপক্ষে একা (২০০০); মুক্তিযুদ্ধের পঙক্তিমালা ( ২০০১); এলোমেলো মেঘেরমন ( ফেব্রুয়ারি ২০০০); নির্জনে কেনো এতো কোলাহল ( ২০০০); পরের জায়গা পরের জমি ( ২০০৪); নিদ্রার ভেতর জেগে থাকা ( ২০০৪); ঘৃণিত গৌরব ( ২০০৫); কবিতাসমগ্র (২০০৬); অনন্যা প্রকাশন ( ২০০৮); সাতে নেই, পাঁচে আছি(২০১২); প্রেম বিরহের কবিতা, (শহীদ কাদরী, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে এক বক্সে ১৯৯৬); রবি ঠাকুরের প্রাইভেসি ( ২০১৫); পাখিদের গ্রামে আজ একটি গাছে সাথে সাক্ষাৎ করার কথা (২০১৭); ফেরোমনের গন্দে নেশাগ্রস্থ প্রজাপতি ( ২০১৭); তোমার বাড়ি কত দূর, অন্যপ্রকাশ (২০১৭); প্রেমের আগে বিরহে পড়েছি ( ২০১৮); সঙ্গমের ভঙ্গিগুলো ( ২০১৯); তিন মিনিটের কবিতা ( ২০২০); আমার সঙ্গে শেখ মুজিবের দেখা হবে আজ ( ২০২০)। সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা : অনুস্বর, ছোটকাগজ, প্রচ্ছদ, সূচিপত্র । পুরস্কার ও সম্মাননা : সূচিপত্র সাহিত্যপত্রের জন্য তিনবার মুক্তধারা একুশে পুরস্কার ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯২; শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব গ্রন্থের জন্য জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পুরস্কার ১৯৯৭, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পদক ১৯৯৬ ; জাপান থেকে বিবেক সাহিত্য পুরষ্কার ২০০৫; পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাব্যশ্রী খেতাব ১৯৭৭; মাইকেল মধুসূদন পদক ২০০৫; শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্মৃতি পদক ২০১৩; আবু হাসান শাহীন স্মৃতি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৮; আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা পুরস্কার ২০১৮ পূর্ব মেদনীপুর, পশ্চিম বঙ্গ; সাহিত্য দিগন্ত সন্মাননা ২০১৯, ঢাকা।]

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭৩০