নন্দনতত্ত্ব
আমাদের হাসনাত ভাই, বহুমাত্রিক লেখক হাসনাত আবদুল হাই,
যিনি নব্বইয়ের দশকে অভিমানী নভেরাকে প্যারিস থেকে
তুলে এনে আমাদের নাশতার টেবিলে বসিয়ে দেন,
নড়াইল থেকে সুলতান এবং
বরিশাল থেকে আরজ আলী মাতুব্বরকেও টেনে তুলে এনে
একই টেবিলে বসান;
এই ফেব্রুয়ারিতে তিনি, মানে সেই হাসনাত ভাই,
আমাকে বিশাল এক গ্রন্থ উপহার দেন,
গ্রন্থের নাম শিল্পকলার নন্দনতত্ত্ব,
কবি আমিনুল ইসলাম বইটির নাম দিয়েছেন
শিল্পকলার এনসাইক্লোপিডিয়া,
তিনি এর একটি রিভিউ লিখেছেন বলে আমাকে ঢাকার
বইমেলায় দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে জানান।
তো এই বইটি হাতে নিয়েই আমি “নন্দনতত্ত্ব” শব্দটি
নাড়াচাড়া করতে করতে এক গভীর ভাবনায় ডুব দিই।
অভিধানে পুত্র কিংবা বৈকুন্ঠের বাগান এসবই পাওয়া যায়,
পুত্র শব্দটিকে এক্ষেত্রে ড্রিল-ডাউন করে আরো গভীরে যাই,
স্থির হই সৃজনকর্মে এবং তখনই স্বর্গের বাগান তার সকল সৌন্দর্য নিয়ে দুলতে থাকে।
মেঘনার বুকে আর কিছুক্ষণ তাকাতেই
ভোরের কুয়াশা ফুঁড়ে উদ্ভাসিত হয় দূরাগত বরের নৌকা, এবং
ইউরেকা ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে ওঠে এক মেঘনা-বালক।
মেঘনায় সদ্য জেগে ওঠা চরের নরোম কাদায় বালক
অবিরাম দু’পায়ে আঁকতে থাকে সমৃদ্ধির লাঙল, সম্ভাবনার কৃষি,
সে আঁকে তার ইচ্ছের নৌকা
যা স্বপ্নের রোদে দুলতে দুলতে পৌঁছে যায় নতুন এক বন্দরে;
একটি সমর্থ নৌকা তার স্বপ্নের প্রধান অনুষঙ্গ এজন্য যে
সে জানতে চায় মেঘনার ওপারের গোপন রহস্য,
দু’বছর আগে তার বড়ো মামা ওপারে গিয়ে আর ফিরে আসেনি,
শুনেছে এ গাঁয়ের আরো কেউ কেউ মেঘনা পাড়ি দিয়ে নিখোঁজ হয়েছে,
এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুবকেরা এভাবে
ওপারে গিয়ে হারিয়ে যায়।
সেইসব হারানো-গল্প সে কাঁদায় আঁকে রোজ গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে,
এবং লক্ষ করে দেখে কাদা শুকিয়ে গেলেও
গল্পগুলো মুছে যায় না,
বরং কাদার দাগ থেকে গল্পের চরিত্রেরা উঠে আসে,
ওর সঙ্গে পা ফেলে হাঁটে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের উঁচু সড়কে।
এভাবেই দূর কৈশোরে নন্দনতত্ব আবিস্কার করেছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বালক;
যৌবনে সে বহুবার নারীকে এঁকেছে
হেমন্তের পাতার অরণ্যে,
নিস্তরঙ্গ জলাশয়ে ঢেউ তুলেছে অঙ্গুলি শিহরণে,
নারীদের ভেতরে ঘুমিয়ে পড়া নদীগুলো জাগিয়েছে
শুধু বাঁশি বাজিয়ে,
নদীরা বহুধারায় খুলে দিয়েছে তাদের নিজস্ব নন্দনশৈলী।
তখন তার মনে হয়েছে নারীর সৌন্দর্যে ডুব দেয়ার মানেই নন্দনতত্ত্ব,
অন্ধকারের ভীতি ছিল তার,
কালো বেড়ালের মধ্যে নন্দনশৈলী খুঁজতে যায়নি সে কোনো দিন
অথচ জীবনানন্দ দাশ কী অবলীলায় অন্ধকারের মুখোমুখি
অবাক বিস্ময়ে বসে থেকেছে দিনের পর দিন,
অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুলের নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়েছেন কবি,
‘পৃথিবীর সেই কন্যা কাছে এসে অন্ধকারে নারীদের কথা ক’য়ে গেছে’ তার কানে কানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুত্র তখন লিখে ফেলে “শেষ বিকেলের গান”
মৃত্যুর নির্জন অন্ধকারে ভীতি নয় বেজে ওঠে এক মুগ্ধ বীণার ঝংকার,
এবং এইসবে ডুব দিয়েই সে পেয়ে যায় মৃত্যুর নন্দনতত্ত্ব।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৫ জুলাই ২০২২।
ধর্ম
চুম্বকের ধর্ম শিখতে শিখতে
ছেলেবেলায় ধর্ম নিয়ে তৈরি হয় কৌতুহল।
চুম্বক যা করে তা যদি তার ধর্ম হয়,
মানুষ যা করে তা কেন তার ধর্ম হয় না?
মানুষের ধর্ম কেন হয় হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান?
তখন থেকেই, এক অদ্ভুত সন্ধ্যায়, পড়তে শুরু করি গীতা,
এরপর কোরআন, এরপর পাঠ করি বাইবেল।
হাতের কাছে তওরাত এবং যবুর ছিল না বলে
অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল,
বড়োবেলায় গভীর অভিনিবেশের সঙ্গে পাঠ করি এই দুটি গ্রন্থ।
কোথাও লেখা ছিল না মসজিদ ভাঙলে হিন্দু,
মন্দির ভাঙলে মুসলমান,
অথবা প্যালেস্টাইনের ভূমি দখল করলে
বা হলোকাস্টের শিকার হলে মানুষের ধর্ম হয় ইহুদি।
বরং আমি জেনেছি নিস্কাম কর্মের অসাধারণ দর্শন,
যা আমার কিশোর পুত্রকে শিখিয়েছি বুকের উত্তাপে জড়িয়ে,
সুরা আহজাব পড়ে জেনেছি,
মানুষকে তার প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলার আগে
বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিতে হয়,
তা কতটা মানুষ ও মখলুকাতের জন্য কল্যাণকর;
ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু বলেনি বাইবেল,
ঈশ্বরের অন্য নাম প্রেম,
তোমরা চূড়ান্তভাবে প্রেমে নতজানু হও, এসবই লেখা আছে বাইবেলের পাতায় পাতায়।
বুদ্ধের দশটি অমিয় বাণী কিংবা তওরাতে বর্ণিত
৬১৩টি নির্দেশনার নির্যাস যে টেন কমান্ডমেন্টস,
সেখানেও কেবল ভালোবাসার কথাই লেখা,
অথচ একুশ শতকের মানুষ
ঘৃণাকেই কেন ধর্মের অনুষঙ্গ করে তুলছে?
আমার প্রশ্ন অবশ্য সেখানেও না,
আমার প্রশ্ন হলো,
উত্তর-দক্ষিণে অবস্থান যদি চুম্বকের ধর্ম হয়
মানুষ যা করে তা কেন তার ধর্ম হবে না?
গ্রন্থ কেন ধর্মের জন্ম দেবে এবং মানুষ সেই পরিচয় ধারণ করবে,
বরং মানুষই ধর্মের জন্ম দেবে।
পাখিরা আকাশে ডানা মেলে দিয়ে উড়ে যায়,
এটি তার ধর্ম;
মাছেরা সাঁতার কাটে গভীর জলের নিচে,
এটি তার ধর্ম;
মাটিতে শেকড় ছেড়ে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে বৃক্ষরাজী সমস্ত জীবন,
এটিই তার ধর্ম…
তাদের সরলরৈখিক জীবনে বৈচিত্র নেই,
তাদের ধর্মও তাই সরল।
মানুষ পড়তে জানে, বলতে জানে, নির্মাণ করতে জানে,
যা খুশি তা করতে জানে,
এবং সকল মানুষ একই কাজ করে না,
তো যে মানুষ যা করে সেটিই কী তার ধর্ম নয়?
প্রন্থ নির্দেশিত ধর্মের বিরুদ্ধে আবার একদল লোক আছেন,
তারা বলেন ধর্ম বলে কিছু নেই,
ঈশ্বর-চিন্তা এক বিভ্রান্তি ছাড়া আর কিছু নয়,
চতুর পয়গম্বরেরাই গ্রন্থের রচয়িতা,
একজন ঈশ্বর কোন কারণে ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ পাঠাবেন?
তাদের জন্য উত্তর হচ্ছে, একজন লেখক কি কেবল একটি গ্রন্থই রচনা করেন?
না একজন পাঠক তার সমস্ত জীবনে একটি গ্রন্থ পাঠ করেন?
শিশুকালে আমরা এক ধরণের গ্রন্থ পাঠ করি,
কৈশোরে পড়ি ভিন্ন গ্রন্থ,
যৌবনে বইয়ের ধরণ কি বদলে যায় না?
বার্ধক্যে এসে আমরা স্থির হই, মনোযোগ দিই গভীর কোনো গ্রন্থে।
আজকের আলোচনার বিষয় আসলে এটিও না,
আলোচনা করতে চাই ধর্ম কী, তা নিয়ে।
গ্রন্থ নির্দেশিত পথ কেন মানুষের ধর্ম হবে?
মানুষ তার সাধ্য অনুযায়ী পাঠ করবে পৃথিবীর সকল গ্রন্থ,
শিখবে আলোকিত পথে হাঁটার কৌশল,
এবং নিজের কর্ম দিয়ে নির্দিষ্ট করবে তার নিজস্ব ধর্ম।
যে মানুষ সারাজীবন মানুষের সেবা করে কাটিয়ে দিল
তার ধর্ম কি সেবক ছাড়া আর অন্য কিছু?
আবার যে মানুষ অন্যের অনিষ্ট করে,
মানুষ খুন করে, অবৈধ অর্থ উপার্জন করে,
খাদ্যে ও অষুধে ভেজাল দেয়,
কোন কারণে তাকে মুসলিম বা হিন্দুর পোশাকে আবৃত করে রাখি,
তাকে নিরাপত্তা দিই?
পোশাকের ঐক্য দম্ভ তৈরি করে
এবং ঐক্য যত বড়ো হয় দম্ভ ততো বাড়ে,
শক্তির ধর্ম হচ্ছে প্রভাব বিস্তার করা,
আর তা জন্ম দেয় যুদ্ধ, অতঃপর ধ্বংস।
জন্ম এবং মৃত্যুর মাঝখানে যে সময়,
এই সময়কালে একজন মানুষ যে পদরেখা আঁকে,
সেখানেই লেখা থাকে তার ধর্ম,
প্রতিটি মানুষের ধর্ম তার একার, এটি কোনো দলগত বিষয় নয়।
হলিসউড, নিউইয়র্ক। ৩ জুলাই ২০২২।
শিল্পকর্ম
প্রকৃতি-সৃষ্ট একটা কিছু দেখে মানুষ প্রায়শ অভিভূত হয়,
মুগ্ধ হয়,
কেউ কেউ সেই মুগ্ধতার প্রতিকৃতি তৈরি করে,
কেউ ভাস্কর্য নির্মাণ করে,
কেউ রঙতুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ভাসিয়ে তোলে প্রিয় কোনো দৃশ্য,
কেউ নির্মাণ করে শ্রেষ্ঠতম শব্দের বিন্যাস,
মানে একটি কবিতা,
আবার কেউ নির্মাণ করে চলচ্চিত্র,
এইসবই শিল্পকর্ম,
শিল্প মানেই কৃত্রিম, অ-প্রাকৃতিক।
দেখা থেকে নির্মাণ অব্দি যে দূরত্ব, এটি শিল্পের গর্ভাবস্থা,
এই সময়ে শিল্পের হাত-পা গজায়,
হৃৎপিণ্ড তৈরি হয় এবং
জন্মের জন্য সে প্রস্তুত হতে থাকে।
দেখার মধ্যেও একটা বড়ো ব্যাপার ঘটে,
এই ব্যাপারটিই বলে দেয় কে শিল্পী
আর কে শিল্পী নয়।
দুজন মানুষ একটি বৃক্ষের দিকে তাকিয়ে কি একই বৃক্ষ দেখে?
দুজন মানুষ আসলে দেখে দুটি বৃক্ষ,
প্রত্যেকের বুকের ভেতর তার নিজস্ব একটি বৃক্ষ আছে,
নিজের একটি নদী আছে,
নিজের একটি পাহাড়, অরণ্য আছে,
আছে খুব নিজের একটি পাখি,
সব পুরুষের বুকের ভেতর তার নিজের একজন নারী থাকে,
নারীদেরও থাকে এক অনিন্দ্য পুরুষ।
সব মানুষের মধ্যে সে তার নিজের মানুষের প্রতিফলন দেখে,
এবং বাইরের দৃশ্যের সঙ্গে ভেতরের দৃষ্টি, যাকে আমরা অন্তর্দৃষ্টি বলি,
তা মিশিয়ে তৈরি করে নতুন এক গাছ,
নতুন এক পাখি,
নতুন নদী,
নতুন নারী কিংবা পুরুষ।
যিনি শিল্পী, নিজের মধ্যে অনুভব করেন
সেই দৃশ্যের রেপ্লিকা তৈরির তাড়না।
শিল্পকর্ম হচ্ছে শিল্পীর চোখে দেখা প্রকৃতি-সৃষ্ট দৃশ্য বা প্রাণের
এক অনিন্দ্য রেপ্লিকা, আর কিছু নয়।
ম্যানহাটন, নিউইয়র্ক। ৩০ জুন ২০২২।