মহাকালের অমিত্রাক্ষর
♦
আজ বৃষ্টি হবে
আকাশের অভিমান দেখে বুঝি
কবিতায় আমি খুঁজে ফিরি মেঘের পুরাণ
সে এক বিশাল মহাকাব্য
পাতায় পাতায় বৃষ্টির কলমে লেখা
মহাকালের অমিত্রাক্ষর
বৃষ্টির উপমা আর রোদ্দুরের মেটাফর
জলগন্ধ বাতাসের ওম
অভিমান বলে কবিতার কাছে কিছু নেই
অথচ আকাশ গম্ভীর হলে কবির মন কাঁদে
আকাশ মানেই তো স্বাধীনতা
দুঃখের শেকল ছিঁড়ে উড়ে চলা ঈগলের মত
বেদনার ব্যবচ্ছেদ
আজ বৃষ্টি হবে
বুকের বোয়েমে ভরে রেখো বৃষ্টিচূর্ণ
জীবনের চোখে মুখে ছড়িয়ে দিও ছিটিয়ে দিও
ধুয়ে দিও ধুলোয় জড়ানো পথিকের পথ
বৃষ্টিদিনে দেখা হবে
ভরা ভাদরে ভেজা হয় নি বহুদিন!
পাখিপুরাণ
♦
পাখিদেরও সংসার আছে
ওদের সবার মা আছে বাবা নেই
ঝড় বৃষ্টি আর শিকারীর তীর থেকে
পাখিকে বাঁচায় পাখির মা
আহার আধার তুলে দেয় মুখে
জন্মের পর একটি পাখি
যীশুর মতোই শুধু মাকে দেখে, চেনে
পাখির পিতাকে কখনো পাখিরা চেনে না
বহুগামী পিতা শুধু সঙ্গম বোঝে
পৃথিবীতে ঘরহীন কোনো পাখি নেই
বৃক্ষের কোঠরে অথবা পাতার আড়ালে
ছোট্ট বাসা ভালোবাসার বসত বাড়ি
পুরুষ পাখিটি সঙ্গে থাকে
আবার হারিয়ে যায় অন্য পাখির আড়ালে
পাখিদের রাজনীতি নেই
সীমান্ত, সম্পত্তি, অমরত্বের অহংকার নেই
তাই ওরা খুশিতে পাখনা তুলে নাচে,গান গায়
ওরা বিয়ে বোঝে না তাই ওরা সুখি
মুক্ত বাজার বোঝে না তাই উড়তে পারে
ওদের কোনো বুদ্ধিজীবী নেই
ওদের আরোপিত পাঠশালা নেই
তাইতো ওরা সুখি
প্রতিটি পাখিই কবি
কবিদের মতো ওরা আকাশকে বোঝে
মানুষের ভর্ৎসনা বোঝে না
আমি পাখিদের কাছে
পাখিপুরাণ শিখতে আসি।
কালো ও রঙিন কবিতা
♦
তোমরা দ্যাখো আমার রঙিন জীবন
অথচ রঙিন জীবন মানেই
কালো রঙের প্যাস্টেলে আঁকা মুখ
একটি কালো ক্যামেরা ছিল আমার বাবার
তার ছবি তোলার হাত ছিল চমৎকার
তিনি সাদাকালো ছবি তুলতেন
সারাদিন ডার্করুমে বসে নেগেটিভগুলো ডেভলপ করতেন
সারাজীবনে একটি রঙিন ছবিও তুলে যেতে পারেন নি
যাবার আগে আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন রঙিন ক্যামেরা
কিন্তু আমার তোলা সব ছবি আজ কালো হয়ে যায়
আমার মা সারাটিজীবন রান্নাঘরের কালো মেখেছেন
নদী তীরে বেঁধে রাখা কালো বাছুরটাকে আনতে গিয়ে
যেদিন বানের জলে তিনি ভেসে গেলেন সেদিন
তার পরনের শাড়িটিও ছিল কালো
আমার জন্মের দিনটিও ছিলো কালো আষাঢ়ের
শোক দিবসে জীবন জামায় ঝুলানো কালো ব্যাজ
কালো স্কুলব্যাগ, কালো ছাতা, কালো জুতা, কালো শ্লেট
ফাংশনে টাঙিয়ে রাখা নাটকের কালো পর্দা
পৌরপার্কে ফুটে থাকা একটি কালো গোলাপ
আজও আমাকে তাড়িয়ে ফেরে
আমার সামনে এখন কালো হাট, কালো নদী
কালো দুপুর, কালো রাত্রির ভোজ সভায়
শুনছি কালো কবিতা – কালো গান
চারপাশে শুধু কালো মানুষের কান্না
সত্যিকারের রঙিন হয়ে উঠতে চাই
আবার আমাকে একটি লালবই দাও, কমরেড!
জিরাফের ডানা
♦
তোমাদের সংবিধান থেকে উঠে আসে
দীঘল জিরাফ
ডানা মেলে উড়ে যায় আকাশের দিকে
দুঃসময়ের মানুষ জীবনে প্রথম দেখে
জিরাফের ডানা
নক্ষত্রের সাথে তার অনেক সখিত্ব
ডানায় ডানায় ঝুলে থাকে
আলোফুল – রূপকথা
অলৌকিক আলো মেখে ফিরে আসে
নিরপেক্ষ জনপদে
নীলস্বপ্ন হয়ে মিশে থাকে পথের ধুলোয়
নক্ষত্রের কুঁচি খুঁটে নেবে বলে
মূর্খ মানুষেরা খুব সকালেই ঘুম থেকে ওঠে
বুভুক্ষু থালায় ওরা তুলে নেয়
ছলনার ভোর
সংবিধানের জিরাফ আকাশে ওড়ে
দুঃখভোজী মানুষেরা
ইদের চাঁদ দেখার মত উৎসুক চোখে
খুঁজে ফেরে একফালি নিরাপদ স্বাধীনতা।
কালোস্কুল
♦
সারাটি জীবন কি শেখালেন মাস্টার মশাই!
শুধু ভালোবাসা আর ক্ষমা দিয়ে কি জীবন চলে?
ব্লাকবোর্ডে আপনি কি সব লিখতেন-
‘গরু খাস খায়, পাখি ওড়ে, মানুষও ওড়ে’
মানুষেরাও যে ঘাস খায়
মানুষের ওড়া আর পাখির ওড়ার মধ্যে অনেক পার্থক্য
পাখির একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে অথচ
মানুষেরা ওড়ে সীমাহীন
উড়তে উড়তে মরে
একথা আপনি কিন্তু বলেন নি!
আপনি যে সব অংক শেখাতেন তা এখন নিরর্থক
দুয়ে দুয়ে চার অথবা সরল অংকগুলো আর এখন মেলে না
আমাদের চারপাশে এখন দুর্ভেদ্য জ্যামিতি
আমি তো হারিয়ে ফেলেছি
সকল সমীকরণ – সূত্র আর সরলরেখা
আপনার শেখানো সে ত্রিভুজের মাপ
কোথায় আমার সেই কাঁটা কম্পাস কলম পেন্সিল!
মাস্টার মশাই! আমার জীবনে কোনো অংকই মেলে নি
আপনার জীবনও কি ছিল নির্ভুল অঙ্কের মত!
বলুন তো, ছিল কি? ছিল না।
কেননা আমি তো জানি
আপনার মুখে কলমের কালি ছুঁড়ে দিয়ে ইস্কুল পালানো সেই মূর্খ ছেলেটিই ছিল আপনার অন্নদাতা!