আর্টওয়ার্ক : সুলতান ইশতিয়াক
সাঁজোয়া থেকে গড়িয়ে পড়া
শহীদ ইয়ামিনের দেহ
কাজী জহিরুল ইসলাম
ঝাঁঝাঁলো দুপুরে পুলিশের নীল
সাঁজোয়া যানের ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়লো ইয়ামিন;
লাল জুলাইয়ের তরুণ বিপ্লবী
একটি প্রকাণ্ড হিমবাহের মতো ভেঙে পড়ে উষ্ণ সমতলে।
মুহূর্তেই ওর দেহ থেকে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়ে
রক্তাক্ত নতুন এক জুলাইয়ে,
যা ক্রমশ প্রলম্বিত হতে হতে গড়ায় ছত্রিশ তারিখ অবধি।
খয়েরি স্যুয়েটারের নিচে
ইয়ামিনের পরনেও ছিল নীল রঙের একটি জিন্স,
সেই নীল রচনা করেনি স্নিগ্ধ এক বর্ষার আকাশ
শিল্প-নগরীর দীর্ঘ রাজপথ জুড়ে;
ওর নীল জিন্স চোখের পলকে দ্রোহের ঝলকে
হয়ে ওঠে ক্ষেপা এক মহাসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ,
বেপথু খড়কুটোর মতো তুচ্ছ করে তোলে,
সহসা ভাসিয়ে নেয় ঘাতকের নীল এপিসিগুলো…
তখনও স্পন্দন ছিল,
আব্বার শুভ্র পাঞ্জাবীর মতো স্নিগ্ধ এক স্বদেশের স্বপ্ন
কেঁপে কেঁপে উঠছিল ওর গ্রীবার বাঁ দিকে;
ঘাতকেরা এই স্পন্দনতরঙ্গে এতোটাই ভীত হয়ে পড়ে যে
ইয়ামিনের দেহকে
সম্পূর্ণ নিথর করে দেবার উল্লাসে মেতে ওঠে পুনরায়,
বিপ্লবের আগুন দৃষ্টির আড়াল করার জন্যে
ওরা এক উদ্দীপ্ত তরুণ সৈনিকের মুমূর্ষু দেহকে সাভারের রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে
ছুঁড়ে ফেলে দেয় কংক্রিট-ডিভাইডারের অন্য পাশে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তপ্ত ছাত্রাবাসগুলো
বন্ধ করে দেয় স্বৈরাচারের দোসর নপুংসক কর্তৃপক্ষ;
নিরাপদে বাড়ি ফিরেও স্বস্তি নেই তরুণ ইয়ামিনের,
বন্ধুরা ফিরতে পেরেছে তো?
অস্থির ইয়ামিন,
বাবা ওকে ফেরাতে পারে না, বন্ধুদের বাঁচাতে হবে,
এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে,
ডাকতে হবে অন্য বন্ধুদেরও,
ভেঙে দিতে হবে স্বৈরাচারের তখতে-তাউস;
শত বিপ্লবীর দুঃসাহসী মায়েদের একজন ইয়ামিনের সামনে এসে দাঁড়ান,
কৈশোরোত্তীর্ণ পুত্রের বুকে দোয়া ইউনূস পড়ে নির্ভরতার ফুঁ দিয়ে বলেন,
যাও সোনা, বাংলাদেশ আজ তোমার প্রতীক্ষায়, তুমি যাও…
মমতার বুক থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে মধ্যবিত্তের স্বপ্ন
আন্দোলনের উত্তপ্ত রাজপথে,
দেশ মাতৃকার সুবৃহৎ কোল উজ্জ্বল করে জ্বলে ওঠে ওরা;
ঘাতকের গুলি বোঝে না স্বদেশ,
বোঝে না মায়ের মমতা, পিতার অশ্রুসিক্ত শব্দাবলী,
শুধু রক্ত বোঝে, বোঝে লাশ আর অবৈধ ক্ষমতা।
হাসিনার রক্তলোলুপ ঘাতক বুলেট ঝাঁঝরা করে দেয়
এক সম্ভাব্য প্রকৌশলীর দেহ;
ভেঙে পড়া,
নষ্ট হয়ে যাওয়া রাষ্ট্র মেরামতের প্রতিশ্রুতি বুকে নিয়ে
ভর্তি হয়েছিল যে তরুণ এমআইএসটির উজ্জ্বল ক্যাম্পাসে,
চকিতে লুটিয়ে পড়ে সে রক্তাক্ত জুলাইয়ের সমস্ত অবয়ব জুড়ে;
চতুর্দিক প্রকম্পিত করে তখন সহস্র কন্ঠে উচ্চারিত হয়
এক গগনবিদারী স্লোগান…
“বুকের ভেতর দারুণ ঝড়
বুক পেতেছি গুলি কর।”
ডেল্টা এয়ারলাইন্স। নিউইয়র্ক – ডালাস আকাশপথ। ১৯ আগস্ট ২০২৪
মিছিল চলবে
মামুন সুলতান
উত্তলিত পতাকার উড়ন্ত বাতাসে কে যায় মিছিলে
নয়াপল্টন শাপলাচত্বর মোকাররমের আহ্বানে
সাগরের উত্তাল ঢেউ তুলে কে যায় মিছিলে
গণতন্ত্রের মূক্তিমূর্ছায় লালফেস্টুনে জীবন বেঁধে
উত্তপ্ত বটতলায় কে যায় মিছিলে
বুলেটে দগ্ধ দুর্দিনে শ্লোগান তুলে কে যায় মিছিলে
স্বাধিকার হরণকালে মুক্তির লাল সূর্যোদয়ে
আপোষহীন আহবানে কে যায় মিছিলে
রাত্রির রন্ধনশালায় লুকায়িত ব্যালট উদ্ধারে
জনতার রুদ্ধশ্বাসে জিহ্বায় ফেনা তুলে কে যায় মিছিলে
ভাত কাপড়ের খোঁজে উলঙ্গ উল্লাসে কে যায় মিছিলে
নিরপেক্ষ বেকার ছাত্রের চাকরির তদবিরে কে যায় মিছিলে
মিছিল হবে মিটিং হবে বউ ঝি মায়েরা শুনো
গুমের ভয়ে লুকিয়ে রাখা সাহসী ছেলেদের ছেড়ে দাও
রশিছেঁড়া ষাঁড়ের মতোন হামলে পড়ুক শোষকের মহাগৃহে
ঝড়ের মত আচানক ভেঙ্গে ফেলো সীমারের তখত
ঝড় তুলো ঝড় তুলো হে কালবোশেখি ছাত্র-তরুণ
নার্গিস আইলায় ভেসে যাক ভোটচোর বেহায়ার কালোহাত।
মিছিল চলবে
এই মিছিল সব হারার, সব পাবার।
সব লিখে রাখা হবে
তাজ ইসলাম
যত গাঢ় আঁধার নিয়েই আসুক রাত
আঁধার তাড়াতে আমরা
হাতে হাতে আলো নিয়ে আসবই।
যতই ভয়ালই হোক দুঃসময়
আমরা বীরদর্পে অতিক্রম তা করবই।
নগরে এসেছে নতুন বর্গী
তার বুলেট থেকে অনিরাপদ
মাতৃকোলে দুগ্ধপোষ্য শিশু
দেয়ালে দেয়ালে লিখে রাখব
তার নাম।
কোন ভয়কেই গ্রাহ্য করি না আর
মৃত্যু এখন কাঙ্ক্ষিত সহচর।
পাতায় পাতায় লিখে রাখব তার নাম
যে উড়িয়ে,পুড়িয়ে ছারখার করেছে নিষ্পাপ আশা
যে খুন করেছে পবিত্র স্বপ্ন
এবং সম্ভাবনার বুকে ছুড়েছে
নাগরিকের ট্যাক্সের টাকার বুলেট
যত বিভৎসই হোক তার চোয়াল
বাংলাদেশের মাটিতে তার নাম
ঘৃণার কালিতে লিখে রাখা হবে।
যত তীব্রই হোক হুংকার
আমরা তার নাম লিখে রাখবই
মহাকাল যেন তার নামের উপর নিক্ষেপ করতে পারে ঘৃণা ও ক্ষোভের থুথু।
যত নিষ্ঠুরই হোক দুঃসময়
মানুষের মগজে মগজে লিখে রাখা হবে সবকিছু।
সব লিখে রাখা হবে, সব।
কিচ্ছু বাদ যাবে না।
আমরা প্রতি ফোঁটা রক্তের খুনির নাম বংশপরিচয়সহ লিখে রাখব।
যেন তার পরবর্তী প্রজন্মও লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখে
নতুন ভোরের উজ্জল রোদের সামনে।
সব লিখে রাখব, সব
ভয়ংকরের দোসরদের নামসহ।
একরাত্রি
সিকতা কাজল
রাত্রির নিস্তব্ধতা গ্রাস করে
খেয়ে ফেলে স্বপ্ন, সম্ভাব্য সংসার
শুক্রাণু ডিম্বাণু
থেকে ফুটে ওঠা
অনাহুত শিশুর জীবন।
বিষন্ন সাদা ভাত, এক গ্লাস নোনা জল আন্ধকারে জেগে থাকা
ক্লান্ত চোখের জল অনাকাঙ্ক্ষিত জলকেলিতে মেতে ওঠে।
আমরা জলের ফোটায় পৃথিবীর তাবৎ সম্পর্কের ক্যানভাস আঁকি।
তৈলচিত্রে ফুটে ওঠে প্রেমময় কথোপকথন।
মানুষ বোধহয় কথা দেয়, কথা না রাখার জন্যই।
প্রতিশ্রুতির ফুল খসে পড়ে বৃন্ত থেকে।
আহত বেদনার্ত কথারা
সমুদ্র মন্থন করে ফিরে যায়
সাহারা মরুতে।
আমরাতো সাহারা মরুভূমির বুকে জলেরপ্রবাহ খুঁজি
কিন্তু ঢেউয়ের পর ঢেউ উপচে পড়ে নিজস্ব নদীর কূলে, কূলে৷
কূল ভাঙার শব্দে জেগে ওঠা বালিহাঁস মন
কেবলি সাহারা দেখে ভিতরে বাহিরে।
একপসলা বৃষ্টির আশায় উর্ধ্বমুখী জনতা
কেবলই ফলজ বৃক্ষের কাছে নত হয় ফুল ও ফলহীন গাছেরা
পাতার মর্মরে
গোপন বাংকার তৈরি করে৷
আয়নাঘরে লাশের মত প্রাণহীন মানুষেরা
এখনও বাঁচার স্বপ্ন দেখে৷
সাততলার ব্যালকনি থেকে লাফিয়ে আত্মাহুতি দেয়া মানুষটি
শহীদ সাঈদ ও মুগ্ধে’র
মতো সাহসী হয়ে ওঠে৷
জীবন ও মৃত্যুর অমৃত পান করে
সে হয়ে ওঠে অবিসংবাদিত আত্মা।
আত্মারা মরে না; যুগে-যুগে, কালে-কালে ফিরে আসে বিশ্বাসী বিরান ভূমিতে।
মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় সগৌরবে।
মেট্রোরেলের ধ্বংসস্তুপের ভিতর
গর্জে ওঠে হাহাকার অথবা হাজার – হাজার লাশ সমাহিত হয় হৃদয়ের করস্থানে৷
মেঘের পালকি ও বাতাসের সাঁকো বেয়ে আমরা আসি ক্যাবিনেটে।
ক্যাবিনেট প্রধান বৃক্ষদেবী বা দেবতা
মিছিলে, রাজপথে হাঁটে
বাংলাদেশের
পতাকা হাতে ।
পতাকা লাল সবুজে মোড়ানো।
লাল রঙের বিছানায় তখন কত্থক নৃত্যের
তালে নাচে, একদল মানুষ,
সাদা শাবক,
খেঁকশিয়াল বা বালিহাঁস।
এখন কারফিউ নেই
আলাউদ্দিন আদর
থেমে গেছে হেলিকপ্টারের উম্মাদ ওড়াউড়ির শব্দ!
সাউন্ডগ্রেনেটের শব্দে আজ কোন শিশুকে আর চিৎকার দিয়ে;
মায়ের বুকে মুখ লুকোতে দেখিনি।
এখন কারফিউ নেই-
রাস্তার কোথাও দেখা গেছে কোথাও ট্রাফিক জ্যাম!
হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে-
বাড়ির ছাদ কিংবা বারান্দায় বাবা মায়ের কোলে;
আজ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েনি।
এখন কারফিউ নেই-
নেই পাঁচটা থেকে সাতটার সাময়িক শিথিলতার ঘোষণা!
পিঠের সাথে লেপ্টে থাকা পেটে হাত চেপে-
সত্তরোর্ধ কলিমুদ্দি দৌঁডাচ্ছে না বাজারের দিকে;
আজ গুলি খেয়ে মরেনি কোন সবজিওয়ালা।
এখন কারফিউ নেই-
নেট সংযোগ পেয়েছে অনেকই, স্বাভাবিক যোগাযোগ মাধ্যম
চারদিকে বিজয় উল্লাস, মিষ্টি বিতরণের ধুম!
শুধু অস্বাভাবিক আট শতাধিক পরিবার-
স্বজন’ হারানোর কান্না চৌত্রিশ কোটি চোখে…