অলৌকিক পাখির ব্রিগেড
মুজতাহিদ ফারুকী
ওই তো পাখির ঝাঁক
অদৃশ্যের শঙ্কাহীন সিপাহী খেচর
পবিত্র আয়াত থেকে নিরন্তর স্রোত
নেমে আসে ক্ষমতার মদমত্ত হাতির ওপর
কিছু পাখি সহজেই চিনতে পারছি
ওই যে পাখিটি
দুদিকে ডানা ছড়িয়ে উদ্ধত রাইফেলের নলে
বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছে
ও হলো রংপুরের আবু সাঈদ
আমাদের বিজয় নিশানে নন্দিত এক বিষণ্ন শহীদ
যে পাখি যুদ্ধের মাঠে পানি লাগবে, পানি –
বলে হাসিমুখে শ্রান্ত যোদ্ধাদের পিপাসা মেটাচ্ছে
ওই পাখিটির নাম মুগ্ধ
আমি মুগ্ধ চোখে দেখি, অলৌকিক পাখির ব্রিগেড
উড়ে উড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে একেকটা ক্ষুদ্র কঙ্কর
আর তা মারাত্মক ক্ষেপণাস্ত্র হয়ে
মুহূর্তে
ধরিয়ে দিচ্ছে ফ্যাসিস্ট শাসকের তখ্তের নরম কুশন
ওই দেখ,
মুখে অন্ধকারের নেকাব জড়িয়ে
লেজ গুটানো নেড়ি কুত্তার মতো
কুঁই কুঁই করছে
ইবলিশের
দুরাচার গর্ভধারিনী।
প্রিয় স্বদেশের পিঠে পেকে ওঠা
বিষফোঁড়া গেলে খগোলের অবাক পাখিরা
বের করে দিয়েছে দূষিত রক্তসহ দুর্গন্ধ পুঁজ
দেখ, আজ দাঁড়িয়েছি শহীদের রক্তে ভেজা
সদ্যমুক্ত পিতৃভূমিতে
বুক ভরে টেনে নিই সতেজ বাতাস
বুকে হাত বেঁধে উচ্চারণ করি, ও মাবুদ, জগতের প্রভু,
কত সহজেই না তুমি ধ্বংস করো উন্মত্ত হস্তি বাহিনীর পরাক্রম
কী অবলীলায় ন্যূব্জ করে দাও লাহাবের
লম্বা কালো হাত
কী অদ্ভুত কৌশলে খুলে নাও জালিমের স্বর্ণ মুকুট
পরিয়ে দাও শীর্ণ এক ফকিরের রুক্ষ মাথায়
পীড়িত যে লোকটা মাত্র দুদিন আগেও
জীর্ণ পাঞ্জাবির নাজুক পকেটে জমা করতো
পথে পথে প্রবলের ঘৃণার ত-ুল।
পিতৃভূমি
মহিবুর রহিম
প্রতি ইঞ্চি জমিন আমাদের সত্তার আমানত
আমাদের প্রতিশ্রুতির কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন নেই
এমনিতেই তা আত্মোৎসর্গের রক্তে ভেজা থাকে
বৃহত্তর স্বার্থে, নির্ভয় তয়রান আবাবিল হয়ে উড়ে আসে
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে তার প্রামাণ্য রেওয়ায়েত আছে
শুধু ইতিহাস সৃষ্টি নয়, ইতিহাসের চালিকা শক্তি হয়ে
আমাদের বিশ্বস্ততা, দেশপ্রেম, মূল্যবোধ আর সাহসের অবিস্মরণীয় তকবির
বাধার পাহাড়গুলোকে সবসময় সমতল বানিয়ে চলে
কে আমাদের উল্টা সিধা ভয়ের গল্প বলে?
কে আমাদের সমতলের সীমাবদ্ধ সমষ্টি বিবেচনা করে?
জানার দৈন্যতা আছে যাদের, তারা নিশ্চয় করে জেনে নিক
আমরা সবসময় পরিবর্তন করতে পারি চাপিয়ে দেওয়া দিক
আমরা সবসময় পরিবর্তন করতে পারি আরোপিত ভাগ্যরেখা
কারণ আমরা মানবিক প্রয়োজনে রক্ত দিতে জানি
আর সতত নিরাপত্তা ও শুদ্ধতায় ঢেকে রাখি আমাদের পিতৃভূমি।
তবু আমি দাঁড়ালাম
জানে আলম
একটি প্রসন্ন প্রসূন প্রত্যুষের প্রত্যাশায় প্রজন্ম আজ প্রসব যন্ত্রণায় যেন কাটাচ্ছে কাল।
একটি প্রজন্ম আজ জালিমের মসনদ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাইরান আবাবিলের মতো কংকর নিক্ষেপ করে আবরাহা বাহিনীর সব সমূলে ধ্বংস করতে
একটি প্রজন্ম আজ সটান দাঁড়িয়ে গেছে।
আমি তাদের পাশে দাঁড়ালাম।
আমি দাঁড়ালাম
নারকেল বাড়িয়ার বাঁশেরকেল্লায় মহান তীতুমীর যেভাবে দাঁড়িয়েছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে।
আমাকে দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
আমার বিলে স্বাক্ষর করবে না বলে জানিয়েছে রাগান্বিত সভাপতি।
আমার চাকরি খাবে বলে হুমকি দিয়েছে কমিটি।
তবু আমি দাঁড়ালাম এই বিপন্ন ছাত্রদের পাশে।
আমি শিক্ষক
বিবেককে হত্যা করে আমি কোনো জালিমের দাসত্বে নিয়োজিত হতে পারি না।
নির্যাতিতের কান্না যে শোনে না সে-ই প্রকৃত বধির।
মজলুমের আর্ত চিৎকারকে উপেক্ষা করে যে নান্দনিক শিল্প নিয়ে মেতে আছে
প্রকৃত অর্থে সে ই গণিকাবৃত্তিতে নিয়োজিত।
যার কবিতা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে জানে না সে কবি নয় শব্দ জল্লাদ।
যার কবিতা অসত্যের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হয় না
সে কবি নয বন্য কাপালিক।
আমি দাঁড়ালাম এই বিপন্ন জনতার পাশে
আমি দাঁড়ালাম এই আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পাশে
আমি দাঁড়ালাম এই সংগ্রামী রক্তজবাদের পাশে।
আমি দাঁড়ালাম এই রক্তচূড়া রক্তলাল গুলমোহরের পাশে।
হযতো উপোষে কাটাবে রাত আমার শিশুপুত্র, শিশুকন্যা।
হয়তো আমার স্ত্রী বিমর্ষ হবে।
তবু আমি বিবেককে হত্যা করে কোনো জালিমের মসনদের খুঁটি হতে পারি না।
বসন্ত এসে গেছে
নুরুন্নাহার ডলি
এতো বসন্ত জেগেছে কল্পনার অতীত,
সবুজে সবুজে ছেয়ে গেছে রাজপথ।
সবুজ পাতা বুলেটের আঘাতে ছিন্নভিন্ন,
যত ঝড়ে,তত কচি পাতাদের মাথা হয় অভিন্ন।
তুমি কী ভাবছ?দলিত মতিথ করে বাঁচবে?
লূহের নহরে প্লাবিত জনপদে তারুণ্যই বাঁচবে।
যতই ঝড়ুক আকাশ থেকে গরম বৃষ্টি,
কিংবা বুলেট, মনে রেখো তারাই করবে নতুন সৃষ্টি।
একটা মারবে পাঁচটা দাঁড়াবে শেষতো হবেনা,
তারুণ্যের জোয়র কিছুতেই ঠেকানো যাবে না।
রক্তাক্ত পাখি
তাসনীম মাহমুদ
একটা শাদা পাখি, উড়ে যাচ্ছে— পালক রক্তাক্ত…
সেই কবে; রাশান বিপ্লবের যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়েছে!
গন্তব্যের পথে, একটা পাহাড়ী অরণ্য অপেক্ষায়—
জন্ম অবধি কুচো শামুক, পোকামাকড় যার খাদ্য
যে ছিনিয়ে নেয়নি মানুষের ব্রেকফাস্ট কিংবা লাঞ্চ।
একটা শাদা পাখি, যার পালক বেয়ে রক্ত ঝরছে—
যার ওমে ঘুমিয়ে পড়ে নতুন দম্পতি, আলুথালু
পৃথিবীর ডিনার— যার সুরের শত্রু আব্রাহার হস্তী;
তাঁর জন্যে; ভোরের আলোড়নে মিছিলের ঠোঁট
গেয়ে উঠবে কী সমন্বিত দাউদের (আ.) যবুর…!
আহা মানুষ— স্রষ্টার মানুষ! কেন রাঙাও হাত
ক্ষমতার খঞ্জরে? আস্তিন গুটায়ে চেয়ে দেখো
বিপ্লব ছিঁড়ে টুকরো টুকরো… মতবাদের ফাঙ্গাস
পাহাড়, অরণ্য, জলাশয়, লোকালয়— কোথাও নেই
অথচ নিশঙ্ক উড়ে যাচ্ছে; পালক রক্তাক্ত একটা শাদা পাখি।