আড্ডাপত্র

৬ কার্তিক, ১৪৩১; ২২ অক্টোবর, ২০২৪;সকাল ১১:৩০

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ৩

আড্ডাপত্র

অক্টো ৭, ২০২৪ | কবিতা, গুচ্ছ কবিতা

মাহবুব হাসান

পালাও পালাও

ধেয়ে আসছে সুনামী এক জনসমুদ্রের
পালাও পালাও তুমি
ভূমি ছেড়ে পরভূমে ,
নিখিলের ওপারে নয়, পার্শ্ববর্তী নিসর্গে,
তোমার আদিপুরুষের মনোভূমি, সেখানে সবুজ বৃক্ষ নেই,
তবু শ্বাস নিতে পারবে স্নেহমমতাহীন খরো দিগন্তে,
অবারিত ধুলিঝড়, অব্যাহত টিটকারির তীর
নগ্ন শ্লেষ
অশেষ কামনার বিষে জর্জরিত পরিবেশ ছেড়ে তোমাকে
পালাতে হবেই।

তুমি ঘোরতর ইরেনিজ নারী,
অবিশ্বাসীদের নিখিল-স্থপতি,
তুমি গণবিচ্ছিন্ন প্রতিশোধের অগ্নিশেকা হৃদয়বিক্রেতা
আইন, কায়দা-কানুন আর রীতির বেড়া ভেঙে
ক্ষেতের ফসল তছনছ করে
মত্ত হস্তিনী তুমি ছিলে আমাদের!

জনসমুদ্রের বিপরীতে তুলেছো দেয়াল তুমি পুলিশের,
লেলিয়ে দিয়েছো সন্ত্রাস হেলমেটে পুরে ছাত্রলীগের শির,
দিয়েছো হুংকার অপত্য স্নেহের রঙে গড়ে তোলা পিতৃভূমি,
এই গাছপালা সবুজ ধানচারা, রাখালের বাঁশি,
দক্ষিণের দৈত্য-দানোর রাঙানো চিৎকার
ফুৎকারে উড়ে যায় সুনামির তোড়ে—

পালাও পালাও তুমি
ক্ষমতার মগডাল থেকে অকস্মাৎ হড়কে পড়তে পড়তে
তুমি দেখলে তোমার সাধের মানুষ,গলায় মানুষ—-
তোমাকে আর বিশ্বাস করে না, তুমি হাসিনা শেখ
গিরগিটির মতো পাল্টে নিয়েছো রূপ—
তুমি আর কাউকেই বিশ্বাস করো না!

তুমি সুনামী দেখোনি কোনোদিন,
তার নিঃশব্দ গ্রহণকাল চলছে,
তুমি দেখলে নিজের
ঢেউয়ের শিরে জ্বলজ্বলে মানুষের রণহুংকার
খালি হাতে বুলেটের সামনে দাঁড়ানো আবু সাঈদের সাহস,
দেখোনি মুগ্ধর পানির প্রপাত, কেন না
তুমি কালা ও অন্ধ টানেলের ভেতরে রচিত সিংহাসনে
পেখম মেলে বসে স্বপ্নডানা মেলে বলেছো —
আমিই তো করেছি এই সমৃদ্ধির আতরমাখা মিথ,
কেন আমাকেই চলে যেতে হবে! কেন এই অন্যায়?

টানেলে জ্বলে উঠেছে আলোর প্রপাত, নতুন পৃথিবী,
উত্তরআধুনিক সকাল।

পালাও পালাও তুমি
লুটের বাক্সগুলো ফেলে সবুজ পৃথিবীর ঘাসে!
সেখান জনসমুদ্র মহানাগের ফণা তুলে ফুঁসছে!

শাহিদ উল ইসলাম

উত্তরসুরি

কোটার খোটা খেয়ে সেদিন কেঁপে
উঠে রাজার আসন
ইথারে ইথারেও সে সংবাদটি
পৌঁছে যায় সাত সাগর পাড়ে।
ছাত্র জনতার ঢল নামে বৃষ্টি হয়ে
অলিগলি ও রাজপথে।

মুগ্ধ একজন মানুষের সন্তান যুদ্ধের ময়দানে
শান্তির পতাকা নিয়ে দৌড়ে বেড়ায়— ‌পানি লাগবে,
পানি লাগবে, পানি পানি বলে—
খোদার কছম অনেক মিষ্টতা ছিলো সে পানিতে
চোখ ভিজে যায় বার বার।
আর আবু সাঈদ সে তো খুদেরাম নূরহোসেন এর
উত্তরসুরি যারা আমাদের স্বাধীনতা
ফিরিয়ে আনে বারবার।

পারভীন শাহনাজ

পরিভাষা

রাষ্ট্র তোমার পেটোয়াবাহিনী
কেড়ে নিল যত প্রাণ
সময় হয়েছে ফিরিয়ে দেবার
সবটুকু প্রতিদান
অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাওয়া
এই ছিল অপরাধ?
গুম করে দিলে, লাশ ফেলে দিলে
যে করেছে প্রতিবাদ!
তারুণ্যের তেজ বোঝোনি এখনো
পড়োনি কি তার ভাষা ?
রক্ত ঝরিয়ে রুখবে ওদের!
ভুলে যাও সেই আশা
পৃথিবীও জানে সেরা সম্পদ
এই তরুণের দল
প্রাণ কেড়ে নিয়ে যতই করো না
মায়াকান্নার ছল
ভুলবে না কেউ এই অন্যায়
মায়ের বুকটা খালি
বিশ্ব দেখেছে হতবাক হয়ে
মেখে দিলে চুনকালি!
লাল সবুজের এই বাংলায়
ওরাই আনবে ভোর
স্বেচ্ছাচারীর নেই তো সুযোগ
কাটুক তোমার ঘোর।

মামুন সুলতান

মিছিল চলবে

উত্তলিত পতাকার উড়ন্ত বাতাসে কে যায় মিছিলে
নয়াপল্টন শাপলাচত্বর মোকাররমের আহ্বানে
সাগরের উত্তাল ঢেউ তুলে কে যায় মিছিলে

গণতন্ত্রের মূক্তিমূর্ছায় লালফেস্টুনে জীবন বেঁধে
উত্তপ্ত বটতলায় কে যায় মিছিলে
বুলেটে দগ্ধ দুর্দিনে শ্লোগান তুলে কে যায় মিছিলে

স্বাধিকার হরণকালে মুক্তির লাল সূর্যোদয়ে
আপোষহীন আহবানে কে যায় মিছিলে
রাত্রির রন্ধনশালায় লুকায়িত ব্যালট উদ্ধারে
জনতার রুদ্ধশ্বাসে জিহ্বায় ফেনা তুলে কে যায় মিছিলে

ভাত কাপড়ের খোঁজে উলঙ্গ উল্লাসে কে যায় মিছিলে
নিরপেক্ষ বেকার ছাত্রের চাকরির তদবিরে কে যায় মিছিলে

মিছিল হবে মিটিং হবে বউ ঝি মায়েরা শুনো
গুমের ভয়ে লুকিয়ে রাখা সাহসী ছেলেদের ছেড়ে দাও
রশিছেঁড়া ষাঁড়ের মতোন হামলে পড়ুক শোষকের মহাগৃহে
ঝড়ের মত আচানক ভেঙ্গে ফেলো সীমারের তখত

ঝড় তুলো ঝড় তুলো হে কালবোশেখি ছাত্র-তরুণ
নার্গিস আইলায় ভেসে যাক ভোটচোর বেহায়ার কালোহাত।

মিছিল চলবে
এই মিছিল সব হারার সব পাবার।

হাসনাইন ইকবাল

নতুন ফেরিওয়ালা

শহরে এসেছে এক নতুন ফেরিওয়ালা
“এই পানি লাগবে, পানি?
কারো পানি লাগবে?”
বলতে বলতে চোখ মুছলেন মীর মুগ্ধ!
চব্বিশের ফেরিওয়ালা,
জুলাইয়ের বিপ্লব ফেরি করা তরুণ তিনি!
ঢাকায় তখন বৃষ্টির মতো ফুটছিলো টিয়ার সেল,
খইয়ের মতো গুলি,
উত্তপ্ত বালিতে যেভাবে সম্মিলিতভাবে ফোটে মুড়ি—
সেইভাবে ফুটছিলো সাউন্ড গ্রেনেড!
সমস্ত সামরিক অস্ত্রের গর্জনের শব্দ ম্লান করে বাতাসে ভাসছিলো,
মীর মুগ্ধের কণ্ঠস্বর!
—পানি লাগবে? পানি?
নতুন ফেরিওয়ালার হাঁক ডাক শুনে
সশস্ত্র যোদ্ধারা থমকে দাঁড়ালো,
রাইফেল তাক করা পুলিশ বিস্মিত চোখে দ্যাখে—
চেনা নগরের নতুন এই অচেনা ফেরিওয়ালাকে!
শহরের অলিতে গলিতে প্রতিদিন কতরকম হাঁকডাক বাজে,
কত ফেরিওয়ালা ঘোরে,
ভাঙারির ভ্যান চলে,
এ-ই ল্যাবুউউউউ— বলে ডেকে যায় কেউ,
কেউ কেউ ধমকের সুরে হাঁকে—মুরগীইইইই লইবেএএএন!
কাঁচা তরিকারি থেকে শুরু করে
জুয়েলারি পণ্য নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোড়িত হয় নগরের গলি ঘুপছি!
অথচ উত্তপ্ত তেলের কড়াইয়ে নেমে,
বন্দুকের নলের সামনে ঘুরে ঘুরে
বিষ্ফোরিত তারুণ্যের ফুলে-ফেঁপে ওঠা জোয়ারে
এ কোন মুগ্ধতা বিলি করছেন তিনি!
অজস্ত্র মারনাস্ত্রের সামনে এ কোন নির্ভিক ঘুরছেন—
এ কোন গোলাপ বিলিয়ে দিচ্ছেন সৌরভ!
ভয়ের যারা ফেরি করেন,
অন্ধকারের গোপন কুঠুরিতে বসবাস যেসব কীটের!
যারা বিলিয়ে বেড়ায় মনুষ্য সমাজে বৈষম্যের পচা ফল,
দুর্গন্ধ যাদের প্রিয় আতর—
তাদের কাছে এ দৃশ্য অসহ্য!
পানি লাগবে, পানি?
—এই শব্দবন্ধে তাদের গায়ে আগুন ধরে যায়!
যেন অজস্র ভিমরুলের হুলে বিদ্ধ হলো তাদের শরীর!
পানি লাগবে, পানি?
এই বাক্যে তারা ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে,
দিক্বিদিক ছুটতে থাকে উন্মত্ত ষাড়ের মতো,
ছুটতে ছুটতে প্রাণভয়ে ছুড়তে থাকে গুলি!
এলোপাতাড়ি গুলিতে ঢাকার রাস্তাঘাট রক্তে ধুয়ে যায়,
জোয়ারের পানির মতো বাড়তে থাকে হতাহত,
কুমিল্লা, রঙপুর, ঝিনাইদহ, রাজশাহী, চট্টগ্রামসহ
সারাদেশে স্তুপ হয়ে ওঠে মীর মুগ্ধের লাশ!
পুলিশের ভ্যান ভরে যায় মুগ্ধের নিষ্প্রাণ দেহে!
এপাচি কার থেকে গড়িয়ে পড়ে মীর মুগ্ধের শরীর!
নির্মাণাধীন ভবনের কার্নিশে ঝুলে থাকে প্রাণহীন মুগ্ধ আরেক,
ফিনিক্স পাখির মতো মুগ্ধরা আবার দাঁড়িয়ে যায়,
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো আচড়ে পড়ে রাজপথে!
ভয়ে কীটেরা বলে— “গুলি করি একটা, একটা মরে, একটাই যায়, বাকিডি যায় না।”
এদিকে মুগ্ধরা মৌমাছির ঝাকের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে
গাঁয়ের উঠোন থেকে রাজপথ কাঁপিয়ে শ্লোগান বাজে—
পানি লাগবে, পানি?
তখনই পৃথিবীর মঞ্চ কাঁপিয়ে বিষ্পোরিত হয় বিপ্লব— পানি লাগবে, পানি?
চব্বিশের বিপ্লব—পানি লাগবে, পানি?
কারো পানি লাগবে?

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১