আড্ডাপত্র

১ মাঘ, ১৪৩১; ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫;দুপুর ২:৩২

গণঅভ্যুত্থানের কবিতা : পর্ব ১৬

আড্ডাপত্র

জানু ১৫, ২০২৫ | গুচ্ছ কবিতা

আয়নাঘর

সালেম সুলেরী

এক.

কী দারুণ নাম- নিদারুণ সাজঘর,
অধিবাসীদের কপাল-পোড়ানো ধী-জীবন বর্বর।

লাশ নয় তবে বোবা হয়ে থাকা
শাসনে বিরোধ, নিভৃতে রাখা-
একাকী যাপন, কথোপকথন- কারো সাথে কারো নেই,
কেটেছে বছর, দশক ও যুগ চোখবাঁধা শুন্যেই।
কারণ শাসক দেমাগী ত্রাসক, মানবিক গুণ নেই।

দু‘চোখে ছিলোনা ঘুম-
আয়নাঘরে‘র অভাগা আঙিনা শিরোপা দিয়েছে ‘গুম।’
আলোর ধরা‘তে কালো ও কালিমা, রেখোনা আঁধারে শ্বাস,
অত্যাচারের পাহাড়ে উঠলে হাতছাড়া নিজ বাস,
আয়নাতে দেখো বিধির বিধান
পরাজয়, পরবাস।

দুই.

যে ঘরে ঢুকলে মানুষেরা আর মানুষ থাকেনা…
যেমন গেস্টাপো তাঁবু, গুহাবাস,
হিটলার শাসিত জার্মান নাৎসী বাহিনী সন্ত্রাস।
তারাও পুলিশ ছিলো তাবে পোলাইট ছিলো না,
ধরণটা ছিলো প্রাণহরণের, উগ্রদূত মরণের।

`মর্তের নরক’, ছিলো আন্দামান নিকোবর দ্বীপ।
কালাপানি সেলুলার জেল
স্বাধীনতাকামী দেশদ্রোহী রাজনীতিকও
দাগী অপরাধী পাশাপাশি, ঠাসাঠাসি, গর্বনাশী।

সাতাশ বছর ভূতলে উতল নেলসন মান্দেলাও।
রুবেনদ্বীপ, পুলসমুর, ভিক্টর ভার্স্টার কারাগার।
কিংবা গুয়ানতানামো কিউবা‘য় মার্কিন বন্দিকারার…

শুধু কি তারাই পারে।
আমরাও পারি বলে- বঙ্গদেশ রচেছে ‘আয়নাঘর’,
অন্ধকারে বেচেঁ থাকা সবরÑ জিন্দাকবর।
সীমাবদ্ধ ঘুম, খাদ্য, চোখবাঁধা অসুস্থ সঙ্গীত
তারাই অতিথি যারা চিন্তাকর্মে শাসকের বিপরীত।

প্রিয়দেশ সবুজাভ তবে তামাটে আয়নাঘর-

মুক্তিলাভ তবু বেদনা পারদ কাদঁছে, যায় না জ্বর।

রোকেয়া ও হৃদয়রশ্মি

নাহিদা আশরাফী

অতঃপর
রোকেয়ার স্বপ্নকে তোমরা ভাগ করে নিলে।
মশাল হাতে মিছিলের অগ্রভাগে
আমরা দেখলাম,
অগণিত রোকেয়া রশ্মি।

কোন কোন রশ্মি এলো
মায়ের মমতা হয়ে।
যেন বা শীত সকালের মিঠে রোদ।
দুঃশাসন ভুলে গেলো,
মিঠে রোদকে তাতিয়ে মধ্য দুপুরে আনতে নেই ।
ভুলে গেলো,
বাঘের মুখ থেকে তবু খাবার কেড়ে নেয়া যায়
মায়ের বুক থেকে সন্তান !
এই দুঃসাহস কে কবে পেয়েছে, হায়!

কোন কোন রশ্মি এলো
বোনের বিশালতা নিয়ে।
যেন বা দিগন্ত ডানার নিশ্চিত নির্ভরতা।
দুর্বিনীত ভুলে গেলো
পাখি ও নীলিমার নিবিড় শক্তির কথা।
ভুলে গেলো,
বাজপাখির হিংস্র থাবা তবু বাঁচার সুযোগ দেয়
বোনের তীব্র করতল রাখে না কোন সংশয়।

কোন কোন রশ্মি এলো
প্রেমের পদাবলি হয়ে।
যেন বা কৃষাণীর সমৃদ্ধ সাজানো বাগান।
দুরাচার আবারো ভুলে গেলো,
কর্ষিত ভূমি ও ভ্রমরের কথা।
ভুলে গেলো,
বৃক্ষ থেকে ফুল তবু আলাদা করা যায়
অরণ্য থেকে সবুজ বলো কী করে হারায় ?

মেঘের মন্দিরা বাজাতে বাজাতে,
চঞ্চুতে যে গুঁজে রাখে স্বপ্নের আশালতা।
বুকের ভেতর ভৈরবী ক্ষোভ নাচে
তবু চোখ জুড়ে ভাসে কম্পিত ব্যাকুলতা।

এমন মা, বোন কিংবা প্রেমিকাকে
বলো তোমরা কোথায় রাখবে?
অবিনাশী শক্তি হয়ে যে আসে,
দ্রোহের দুর্বার পথে যে হাসে
সে তো অবিচার দেখলেই জাগবে।

তাই রাত্রি ভেঙে আলোর যাত্রী এলে,
ওদের জানিয়ে দিয়ো।
সমরে সংশয় রাখে না তারা।
আত্মা ও আঁচল পেতে তুলে রাখে,
শহীদের রক্তের ধারা।
প্রতি যুদ্ধে, গণ জোয়ারে
বারংবার ঢাল হয়ে ফিরে আসে
প্রজন্মের রোকেয়ারা।

আমার কবিতা

সৈয়দ রনো

আমার কবিতা সীমান্ত রক্ষী
বাংলাদেশের প্রতীক
আমার কবিতা ঝঞ্ঝা তুফানে
পথচলা এক পথিক।

আমার কবিতা ভুখা নাঙ্গাদের
মুখে তুলে দেয় ভাত
আমার কবিতা লাখো শহীদের
মুষ্ঠিবদ্ধ হাত।

আমার কবিতা বিশ্বায়নের
স্বপ্নে তুলা ঝড়
আমার কবিতা দেশাত্ববোধে
ভীষণ শক্তিধর।

আমার কবিতা মুক্তি সেনার
বুলেট বিদ্ধ খুলি
আমার কবিতা ভয় করেনি
এটম বোম আর গুলি।

আমার কবিতা গণতন্ত্রমনা
লাল সবুজের ছবি
আমার কবিতা অগ্নি মিছিল
রাজপথের এক কবি।

আমার কবিতা ফেলানীর লাশ
সাগর রুনির মা
আমার কবিতা বিশ্বজিতের
মায়ের বুকের ঘা।

আমার কবিতা হাইকোর্টে ঝুলে
গুমরে গুমরে কাঁদে
আমার কবিতা আগ্রাসনে
আটকে পড়েছে ফাঁদে।

আমার কবিতা ছাত্র জনতার
রক্তে ভেজা দিন
আমার কবিতা শোধরে দিবে
বীর শহীদের ঋণ।

আমার কবিতা আবু সাঈদের
রক্তমাখা বুক
আমার কবিতা ফ্যাসিববাদের
পতন হওয়ার সুখ।

আমার কবিতা বন্দী এখন
পড়শী দেশের হাতে
আমার কবিতা চেটেপুটে খায়
হায়েনারা সব রাতে।

গাজিরা মূলত শহিদের আলখেল্লা

পলিয়ার ওয়াহিদ

সে এক রাতের কবিতা। বাংলাদেশের রজনী। সে তো এখনো পোহায়নি!
স্মৃতির মিউজিয়াম ভরা লাশ। বুড়িগঙ্গার মতো লম্বা রাত। যেন রাতের ভেতর জেগে ওঠা তুরাগ। তাদের পানির মতো ঘোলা ইতিহাস। জাহাঙ্গীরনগর থেকে পলাশীর ত্রাস। এত এত দীর্ঘ রাত! রাতের গহীন গোঙানিপাত।

সে কত কত দিনের গল্প। তামার রোদের মতো অন্ধকারের গন্ধ। ভয়ে আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে উঠছিল শহর। সাভার থেকে যাত্রাবাড়ী লাশের বহর। কেউ কোথাও ছিল না নিরাপদ। শহরজুড়ে শত শত ছাত্রলীগ-পুলিশ শ্বাপদ।

বৃষ্টির মতো ঝরছিল গুলি—হেলিকপ্টারের খুলি, উঁচু ভবনের ছাদ। মুহূর্তে মরে গেছে শিশু, শুয়ে ছিল পিতার কাঁধ, ব্যালকনি ও বারান্দা, তাদের হাতে থাকত রামদা। কখন যে চলে যেত দিন। গা ঘিনঘিন। আকাশে চাঁদ; যেন মনে হত মৃত্যুর ফাঁদ!

জোছনার মতো গলে গলে পড়ছিল শহীদের মগজ! হাসপাতালে হাসপাতালে খোঁজ। এই ছিল যুবলীগের আবহাওয়া, আমরা প্রতিমুহূর্তে ছিলাম আজরাইলের খাওয়া। বেঁচে থেকেও আমরা ট্রমা শহিদ। তবুও গাইবো জীবনের গীত। আর যত জিদ ও জেল্লা, গাজিরা মূলত শহিদদের আলখেল্লা!

জনতার জাগরণ

নবীন সাদিক

বীরের রক্তে পাওয়া এই দেশে বার বার কেন জানি,
ক্ষমতার লোভে শাসকেরা আনে খুন আর রাহাজানি।
একাত্তরে যে স্বাধীনতা এলো, সাথে সাথে বাকশাল;
গণমানুষের নেতা মুজিবুর- দেখালো কি কুটচাল।

নব্বইয়ে এলো আবার আরেক স্বৈরাচারের রাত;
জনতার খুনে খুনী এরশাদও রাঙালো যে দুই হাত।
দুহাজার নয় থেকে দুই হাজার চব্বিশ সালে ফের,
স্বৈরাচারী সেই শাসন আনিল, মেয়ে খুনী মুজিবের;
জনতার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে যে নড়কের জ্বালা, হায়!
পিতার খুনের প্রতিশোধ যেন নিতোরে সে সর্বদায়।

জেগেছে হঠাৎ ছাত্র জনতার সমতার দাবী নিয়ে;
চেতনার নামে শত ব্যবধান রাখবে কে আগলিয়ে?
দাবীর জবাব দমন-পীড়নে দিয়ে যায় স্বৈরাচারী;
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া জুড়ে-ই কান্না ও আহাজারি।

পাখি মারা যেথা আইনে নিষেধ, মানুষ সেখানে মারে;
হাসিনা খবিশ নিষেধ মানে না, কে থামায় আর তারে?
ক্ষোভের পিদিম নিভুনিভু নয়, দাউ দাউ করে জ্বলে;
পানি না ঢেলে জনতার খুনে ক্ষোভ নিভায় কৌশলে।

জনতার বুকে আগুনের বীজ, লুকানো ক্ষোভের ধূপ;
জালিম রাজার জুলুমে জনতা ক’দিন রহিবে চুপ?
অনেক দিনের অবসাদ ঝেরে ক্ষোভাগুন জ্বেলে বুকে;
ষোলো বছরের দুঃশাসনের হিসাব লইবে চুকে।
সারা দুনিয়ার তাবত সাহস এক করে নিয়ে বুকে;
বুলেটের মুখে দাঁড়িয়ে দামাল, বারুদের ঘ্রাণ শুঁকে।

কেমন দামাল ছেলেরে আহাহা, বুকে ডর ভয় নাই;
তাজা প্রাণ দিয়ে— ❝স্বৈরাচারের জুলুমাবসান চাই!❞
নির্বিচারেই গুলি চালালো, যে মিছিলে মিছিলে রোজ;
শহিদে শহিদে ছেয়ে গেল দেশ, পিছু হটেনি; খোঁজ।

জনতার ঢেউ ছোট থেকে বেড়ে, মহা ঢেউ হয়ে বয়;
খুনী শাসকের বিলাসী গদিতে আনে যে মহাপ্রলয়।
জনতার ফুঁকে উড়ে গেলো, আহা দাপুটে স্বৈরাচার;
অহংকারে যে পাও দুইখানা, মাটিতে দিতো না তার।

নির্যাতনের-ই শেকলে বেঁধে, যে শাসন করেগো দেশ;
সুযোগ পেলে যে জনগণও, তারে বেঁধে নেয় অবশেষ।
অত্যাচারীগণ মানে না, ওসব নিয়তির লেখাজোখা;
ক্ষমতার-ই জোরে হয়ে ওঠে, আরও দাম্ভিক ও একরোখা।

গণজাগরণে কেটে গেল, আহা জনতার দুর্দিন;
বাংলাদেশের আকাশে পাখিরা স্বাধীন উড্ডীন।
ইতিহাসের ঐ পাতা ভরা, থাক বীরদের জয়গান;
যতদিন রবে স্বাধীন এ স্বদেশ, ততদিন-ই অম্লান।

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১