সায়মা ইসলাম
পুবদিকের ঝকঝকে নতুন পাঁচতলা ভবনটিকে ডিঙিয়ে এ পাশের সাদারঙা দোতলা বাড়ির ছাদে উঁকি দিচ্ছে সকালের সোনারঙা সূর্য। কাঠগোলাপ, জুঁই, বেলি, আ্যালামন্ডা, হরেক রঙের ঘাসফুলের মাঝে কাউকে খুঁজছে যেন। আজও ছাদে আসেনি সুমনা। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ঝাঁক ঝাঁক পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দে পুবাকাশে সূয্যিমামার জেগে ওঠা দেখা সুমনার ছেলেবেলার অভ্যেস। ভোরের নির্মল হাওয়ায় বুক ভরে শ্বাস না নিলে সারাটাদিন কেমন হাঁসফাঁস লাগে সুমনার। ফজরের নামাজের পর ছাদে গিয়ে মিনিট বিশেক সময় ভোরের মিষ্টি বাতাস গায়ে মেখে শান্ত, স্থিত মনে দিন শুরু করে সুমনা। ছাদ থেকে নেমে এসে রান্না ঘর থেকে শুরু হয় তার সারাদিনের দৌড়। সকালটা পার হয়ে যায় ঝড়ের গতিতে। ঠিকে কাজের মেয়েটা আসে সাড়ে ছয়টা, সাতটা নাগাদ । তাকে সাথে নিয়ে সকালের নাস্তা, দুপুরের রান্না সারতে হয় আটটার মধ্যে। তারপর সুমনাকে গোসল সেরে স্কুলের জন্য তৈরি হতে হয়।
ক’দিন হলো ভোরবেলা ছাদে যাওয়া হয় না। জমিলা তিনদিনের ছুটির কথা বলে বাড়ি গেছে। সপ্তাহ পার হয়ে যাচ্ছে, আজও তার পাত্তা নেই। কবে ফিরবে কে জানে? ঘুম থেকে উঠেই গ্যাসের তাপে দিন শুরু করতে ভালো লাগে না সুমনার। মনটা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।রান্নাঘরের কাজ একা হাতে সামলে ন’টার মধ্যে স্কুলে পৌঁছাতেও দেরি হয়ে যায়। তার উপর আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত হাতে তাওয়ায় ফুলে ওঠা রুটিটা উল্টে ভেতরে ভেতরে নিজেও ফুলতে থাকে সে।
দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যায়; ৮.২০। টেবিলে সকালের নাস্তা সাজানো, আবিদের লাঞ্চবক্স গুছানো, মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নাস্তা করানো, তারপর তাকে তৈরি হতে হবে। দুপুরের রান্নাটাও শেষ করা গেল না। স্কুল থেকে হন্তদন্ত হয়ে ফিরে আবার হাতাখুন্তি ধরো!
সাহেব তার ঘুম ঘুম চোখে বাথরুমে ফ্রেশ হচ্ছেন। মেয়েটাকে যদি ঘুম থেকে উঠিয়ে হাতমুখ ধুইয়ে নিজের সাথে বসিয়ে নাস্তাটা করে নেয় আবিদ, তাহলেও সুমনার অনেকটা সাহায্য হয়; অন্তত মানসিক স্বস্তি নিয়ে দিনটা শুরু করা যায়। কিন্তু তার তো সে দায় নেই। প্রতিদিন দেরি করে বিছানা ছাড়বে, তারপর বাথরুম থেকে বের হয়ে তাড়াহুড়ো করে নিজের জিনিসই ঠিকমতো খুঁজে পায় না, হাঁকডাক শুরু করে দেয়। একটু যদি আন্তরিকতা, সহযোগিতার মনোভাব থাকত স্ত্রীর প্রতি! মাঝে মাঝে মনে হয়, শুধু সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে দেয়ার জন্যই কাগজে কলমে রেজিস্ট্রি করে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘরে বউ এনেছে সে।
আবিদ বের হয়ে যাবার পর মেয়েকে নাশতা খাওয়ানোর ফাঁকে নিজে রুটির সাথে এককাপ চা কোনোমতে গলাধঃকরণ করে স্কুলের উদ্দেশ্যে ছুট দেয় সুমনা। বাসা থেকে স্কুল রিকশায় দশ মিনিটের পথ, হেঁটে গেলে আধঘন্টা। এখন অফিস টাইমে রিকশা পেলে হয়! বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশার জন্য না দাঁড়িয়ে গলিপথ ধরে হনহন করে হাঁটতে থাকে সুমনা।
বাড়ির কাছকাছি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটাতে সুমনার জয়েনিং এর সময় আবিদের আগ্রহের কোন কমতি ছিল না। কিন্তু সংসারের কাজে একটু সহযোগিতা করার কথা ভুলেও কি তার মাথায় আসে? সত্যিই কপাল বৈকি, এরকম আত্মম্ভরি একটা মানুষের সাথেই জুড়তে হলো তাকে!
অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে তখন অলস সময় কাটছিল সুমনার। সুমনার জন্য সুপাত্রের সন্ধান মিলল, যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! পাত্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রথম শ্রেণির চাকুরে। দেখতে শুনতে বেশ। শিক্ষিত ছোট পরিবার। কচুক্ষেতে নিজেদের বাড়ি, বাড়তি কোন বায়না নেই। এমন সোনায় সোহাগা পাত্র কেউ হাত ছাড়া করে? কালবিলম্ব না করে সুমনার বিয়ের সাঁনাই বেঁজে উঠে।
কিন্তু শোভনকে ছাড়া একটা জীবন স্বপ্নেও ভাবতে পারছিল না সুমনা। খুব আশা নিয়ে শোভনকে বলেছিল ‘কী করা যায়? শোভন কিছুদিন গুম হয়ে রইল; তারপর ম্লান মুখে বলল ‘আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছ। অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কি?’ শোভনেরই বা কী করার ছিল? বাড়ির বড়ো ছেলে। মাস্টার্সের রেজাল্ট তখনো হয়নি। কবে কী হবে তারও কোনো ঠাঁয় ঠিকানা নেই। সুমনাও পরিবারের অবাধ্য হতে পারেনি। সেই মনের জোর কী ছিল সুমনার, পারত কি অপেক্ষা করতে? অনিশ্চয়তার মাঝে নিজেকে ঠেলে দেয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে উঠতে পারেনি সুমনা।
মনের এক কোণে পড়ে রইল তার একসময়ের ভালবাসা। নিভৃতে হেলায় পড়ে থাকা সেই বছর দেড়েকের প্রেমই মাঝে মাঝে তার অস্তিত্ব জানান দেয় সুমনার নিরাপদ বলয়ে। দিনের পর দিন ছাইরঙা মেঘ পুঞ্জিভুত হতে হতে মনের আকাশটা ভারী হয়ে ওঠে যখন। সুমনার কী চাপা কষ্ট হয়? নাকি এই মাপাজোপা জীবনে ওই স্মৃতিটুকুই তার বাড়তি বিলাস! অনুভূতিটা ঠিক নিজেও বুঝতে পারে না সুমনা।
প্রথম দেখায়ই নাকি আবিদের খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল সুমনাকে। বিয়ের পর এ বাড়িতে এসে, প্রথম দিকে ছোটোখাটো নানা বাহানায় বাড়ির সামনে অযত্নে বেড়ে ওঠা বাগানের চাঁপা বা মাধবিলতা তুলে এনে খোঁপায় গুঁজে নিজেকে সাজাত সুমনা। চোখে কাজল পরে দাঁড়াত আবিদের সামনে, ওর চোখে তার ছায়া দেখবে বলে।
কিন্তু আবিদের চোখ এক মুহূর্তও থমকেছে সুমনার পরে? রাতের আবছা অন্ধকার বিছানার বাইরে গোধূলি সন্ধ্যায় বা অলস বিকেলে সুমনাকে আলতো জড়িয়ে ধরে কখনো জানতে চেয়েছে, সুমনা কেমন আছে তার নতুন পরিবারে?
পুরোনো ধাঁচের দোতলা বাড়িটির উপরতলায় শাশুড়ি, দেবর, স্বামী আর তিন বছরের নীলাঞ্জনাকে নিয়ে সুমনার সাড়ে পাঁচ বছরের সংসার। নীচতলাটা ভাড়া। একটা ফ্ল্যাটের বায়না হয়ে গেছে, সাড়ে পনের’শ স্কয়ার ফিটের; সুমনার ইচ্ছের জোরেই। ম্যারম্যারে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে ঝকঝকে ফ্ল্যাটে নিজের সংসারটা মনের মতো করে সাজাবে সুমনা। শাশুড়ি মা এ বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি না হলে কী হবে, সেটাই এখন মূখ্য চিন্তা।
সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা, আবিদের বাবা মারা গেছেন আবিদ যখন কলেজে পড়ে তখন। আঠারো বছর বয়স থেকে অসুস্থ মা আর ছোট ভাইকে নিয়ে এ সংসারের অভিভাবক আবিদ। অল্প বয়স থেকেই সংসারের চাপ মাথায় নিয়ে বড়ো হয়েছে সে। শুধুমাত্র এ কারণেই অভিভাবক সুলভ আবিদের মাঝে কোনো প্রেমিক পূরুষের ছায়ার লেশমাত্র দেখতে পাওয়া যায় না আসলে অতিমাত্রার অহমবোধে আপাদমস্তক নিজেকে মুড়ে রাখে সে।
বিয়ের পর পর ছুটি না মেলায় প্রায় এক বছর পর, সাত দিনের ট্যুরে দার্জিলিং গিয়েছিল তারা। হানিমুন কাম ম্যারেজ এ্যানিভার্সারি, বেশ কেটেছিল সপ্তাহটা। তখনই কয়েকটাদিন বেরসিক আবিদকে বেশ রোম্যান্টিক মনে হয়েছিল। তারপর আবিদ প্রয়োজন ছাড়া সুমনার হাত ধরেছে– এরকম হয়েছে আর? মনে পড়ে না!
হ্যা, নীলাঞ্জনা কোলজুড়ে আসার তিনদিন পর হঠাৎ সুমনার প্রেসার বেড়ে প্রায় মরমর অবস্থা। ঐ আধাচৈতন্যের মধ্যেই আবিদের মুখ দেখে তার ভিতরটা পড়ার চেষ্টা করেছিল সুমনা। সেদিন, আবিদের হত বিহ্বল চোখে তাকে ধরে রাখার প্রাণপন আকুতি দেখে প্রশান্তিতে চোখদুটো বুজে এসেছিল সুমনার। যেন বহুদুর থেকে তাকে ডাকছে আবিদ ‘সু..মনা…চোখ খোলো..এই যে দেখ আমি, তোমার নীলু…শুনতে শুনতেই যেন গাঢ় ঘুমের অতলে নিশ্চিন্তে তলিয়ে গিয়েছিল সুমনা। আধো চৈতন্যে দেখা শক্তপোক্ত আবিদের প্রীতিভরা সেই মুখটা নৈমিত্তিক সাদামাটা দাম্পত্যে অহর্নিশি খুঁজে ফেরে অবেক্ষমান সুমনা।
খ্যাতনামা স্কুলটাতে নিয়মশৃঙ্খলার খুব কড়াকড়ি। একান্ত দায়ে না পড়লে আবিদ বাসায় ফেরার পর কখনো স্কুলের খাতাপত্র নিয়ে বসে না সুমনা। আবিদ অফিস থেকে ফেরার পর আজও তিন তিনবার ফোন করেছে ঐ মহিলা। অফিসে পাশাপাশি কক্ষে বসে দু’জন, সারাদিন অফিসের পর জুনিয়র কলিগের সাথে এত কী কথা আবিদের? গত পিকনিকেও আবিদের সাথে মহিলার গায়ে পড়া ভাব চোখে লেগেছে সুমনার। সুমনার দৃষ্টিতে যে বিষয়টা মোটেও সুখকর নয়, বেশ কয়েকবার শান্তভাবে আবিদকে বলেছে সে। কিন্তু তার সুখ, অসুখ পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন কবেই বা বোধ করেছে আবিদ?
আবিদ ফোনে কথা শেষ করে বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতেই বিরক্তি ঝেড়ে বলে ফেলল সুমনা ‘সারাদিন পর বাড়ি ফিরে সংসার এর দিকে মনোযোগ না দিয়ে আমি যদি কোনো কলিগের ফোন নিয়ে পড়ে থাকি, সহ্য করতে তুমি?’ কথা শেষ হতে না হতেই পুরুষালি শক্ত হাতের চেটোটা চোখের পলকে গালের উপর এসে পড়তে সুমনা নির্বাক! খুব বাড়াবাড়ি কিছু বলে ফেলেছে সে?
বিস্ফারিত চোখে জল এল না একবিন্দুও, আবিদের নতুন রূপে হতবাক সুমনা বেডরুম লাগোয়া খোলা বারান্দায় গিয়ে বসে রইল নিশ্চল। তার গায়ে কেউ কখনো হাত তুলেছে মনে পড়ে না। আশ্বিনের আকাশ ভেঙে ঝমঝম বৃষ্টি নেমেছে, বৃষ্টির ছাটে ভিজে যাচ্ছিল সুমনা। ভিজুক, তাতেও যদি মনের তাত একটু কমে!
‘ভেতরে এসো, ঠান্ডা লেগে যাবে।’ কন্ঠের শীতলতা ভেজা বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে আবিদের পায়ের শব্দ ঘুরে ঘরের ভেতর মিলিয়ে গেল।
দীর্ঘ সময় পর, বুকের ভেতরের কালবৈশাখী দমকা বাতাস কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে নিঃশব্দ ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেটে জল আসে সুমনার। কী নিশ্চিন্তে মেয়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে লোকটা, একটুও অনুশোচনা নেই! ডিমলাইটের নীল আলোয় বিষিয়ে যায় সুমনার নিজ হাতে সাজানো ঘর। আবছা আলোয় টুকিটাকি জরুরি কিছু জিনিস ভরে নেয় ছোট একটা ব্যাগে, ভোরের আলো ফুটলেই আর নয় এই অনাহুত জীবন।
বারান্দায় ফিরে এসে চেয়ারে দু’পা তুলে গুটিশুটি মেরে বসে থাকে, উত্তুরে হাওয়া বইছে ক’দিন হলো। বৃষ্টি শেষের জলো বাতাসে কুঁকড়ে যায় সুমনা। এত তুচ্ছ মনে হয় নিজেকে! ঘন আঁধারের চাদরে ঢাকা বিশাল আকাশে একবিন্দু আলো খুঁজে বেড়ায় তার সদ্যস্নাত চোখ দুটি।
নীলক্ষেতে সেই বইয়ের দোকানটাতে, সেদিন অনেক বছর পর শোভনের সাথে হঠাৎ দেখা। মনের পর্দায় প্রায় ফিকে হয়ে আসা মুখটা পলকেই স্বচ্ছ হয়ে উঠল। শোভনের মুখটা কী বিমর্ষ দেখাচ্ছিল? সুমনাকে দেখে বিদ্যুত খেলে গেল যেন চোখ দুটোতে। গাঢ় চোখে দেখল সুমনাকে; মৃদু হেসে বলল,
‘তারপর, কেমন আছ? অনেকদিন পর দেখা, কোথাও বসে চা কফি খাওয়া যায়?’
এই চোখের দৃষ্টিতেই তো একসময় ভিজে কাদা হয়ে যেত সুমনা। সুমনার চোখে কাজল না থাকলে, ক্যাম্পাসের কোনো ফাংশনে শাড়ির সাথে কেশবন্ধন কাঁঠবেলির মালায় না জড়ালে, ঘরের জড়বৎ আরশিখানা কিছুই বলতো না সুমনাকে, বলতো শোভনের ঐ গভীর বিমোহিত চোখ। সুমনার কোনো কারণে অভিমান হলে হাজারবার মাফ চেয়ে কী সব কান্ড করত শোভন! কতটা পথ কারণে অকারণে, পাশাপাশি হাঁটত দু’জনে। সুমনা মনে মনে চাইত খুব, হাঁটতে হাঁটতে আনমনে শোভন তার হাতটা যদি ধরত একদিন! ধরেনি কোনোদিন। সেদিন যদি একটু জোর করত শোভন? না হয় হতো একটু হিসেব নিকেশের সংসার, শোভনের মনের ঘরে সম্রাজ্ঞী হয়ে তো থাকত সে!
নির্ঘুম দীর্ঘরাত শেষে আলো ফুটতে শুরু করলে শান্ত পায়ে বেশ ক’দিন পর ছাদে চলে এল সুমনা। আবছা অন্ধকার গায়ে জড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে ছাদের কার্ণিশ ধরে দাঁড়িয়ে রইল ভোরের অপেক্ষায়…
শনিবারের ফাঁকা বিকেলে আবিদ ফ্ল্যাটের কাজ দেখে আসার প্রস্তাব দিলে সুমনা এড়িয়ে যেতে চাইছিল ‘একদম বেরুতে ইচ্ছে করছে না আজ, ক’দিন আগেই তো দেখে এলাম।’
‘সময়মতো ঠিকঠাক বুঝিয়ে না দিলে পরে কিন্তু আর চেঞ্জ করা যাবে না, তখন বলবে, মনের মতো হলো না।’ আবিদের চাপাচাপিতে অবশেষে বেরুতেই হলো।
সুমনার বারবার বারণ সত্ত্বেও ফেরার পথে থাই রেস্তোরাঁটায় ঢুকল আবিদ। সুমনার মান ভাঙাতে এসবই পরোক্ষ উপঢৌকন। স্ত্রীর কাছে সরাসরি ক্ষমা চাইতে পৌরুষে বাধে আবিদের। অসুস্থ মা, ছোট ভাইয়ের সেমিস্টার ফি, ফ্ল্যাটের কিস্তি, সংসার খরচ সবকিছু সামাল দিতে সত্যি খুব চাপ পড়ে যায় তার ওপর। তবু সুমনার মাইনের কথা কখনো তোলে না আবিদ, দিতে চাইলেও নিতে চায় না। নিজের ছকের বাইরে সুমনাকে যদি একটু বুঝতে চাইত আবিদ, জোড়ে বাঁধা কুয়াশা ঢাকা এই সম্পর্কটা ফাগুনের দোলাচলে একটু মধুময় হয়ে উঠতেই পারত।
সবুজ স্বপ্নিল কৃত্রিম আলোয় মেনু কার্ড হাতে চারপাশে দৃষ্টি বুলাতে কোণার টেবিলের মেয়েটার উপর চোখ আটকে যায় সুমনার, শোভনের বউ না? হ্যাঁ, ইনডোর প্ল্যান্টের আড়ালে পিছন ফিরে বসে কালচে রঙের পাঞ্জাবি পরা শোভনই তো। একদিন মার্কেটে দেখা হতে মিলির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল শোভন। দেখতে আহামরি কিছু নয়, বিত্তবান পরিবারের মেয়ে বলে মুখে আলগা আহ্লাদি একটা ছাপ আছে। বয়সের কারণেও হতে পারে, কেবল অনার্স ফার্স্ট ইয়ার। শোভনতো এত সাজগোজ পছন্দ করত না আগে। এখন রংচঙে বউকে ছেড়ে কোনদিকে নজরই সরছে না তার, চপলা হরিণী সামলাতে ব্যস্ত শোভন। শোভনের একটা হাত কী মিলির হাতের ওপর? ঠিক বোঝা যায় না পেছন থেকে, চোখ সরিয়ে নেয় সুমনা।
‘সুমু, অর্ডারটা দাও।’ আবিদের গলায় নরম সুরে তিনদিন পর সরাসরি আবিদের মুখের দিকে তাকায় সুমনা, ঠোঁটের কোণে জোর করে হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে ‘আজ তোমার পালা।’
‘থাই স্যুপ, মিক্সড ভেজিটেবল, ক্যাসিওনাট স্যালাড, বীফ সিজলিং… নিজের পছন্দের মেনু আবিদের কন্ঠে শুনতে শুনতে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুমনা। ফেরার সময় দেবর আর শাশুড়ির জন্য পার্সেল নিতে ভুলে না সুমনা। চৌধুরী বাড়ির সুনিপুণা সুগৃহিণী সুমনা!
[চলবে]