ছয়মাস!
আগে-পরে আরও অনেক বাক্য-বাহাস থাকলেও ‘ছয়মাস’ শব্দবন্ধটি তীরের ফলার মতো নাজিবের কানে এসে বিঁধলো।
রির্পোটের অপেক্ষায় ওয়েটিং-রুমে বসে আছে পুঁথি। সঙ্গে মা। চারপাশ উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠা। নাজিবও ওখানে থাকার কথা ছিলো। ডাক্তার বাবু জসীম ছাড়া বাকি সবাই চেম্বার থেকে বের হয়ে যাবার অনুরোধ করার পর তার কেমন খটকা লাগে—ব্যাপারটা স্বাভাবিক বলে উড়িয়ে দিতে পারেনি। ভেতরে সন্দেহ চাক বাঁধায়, ওয়াশরুমের ওজর দেখিয়ে সুকৌশলে দরজায় এসে আড়ি পাতে সে। পর্দাচ্ছান্ন থাইয়ের দরজাটা কিঞ্চিৎ আলগা থাকায় বিষয়টা কানের নাগালে আসতে সুবিধা হয়েছে বেশি। তারপরও ধোঁয়াশায় নিমজ্জিত থাকতো, যদি না জসীম কথাটা বারকয়েক না আওড়াতো।
নাজিব স্পষ্ট শুনেছে বাল্যবন্ধু জসীম আতঙ্কিতকণ্ঠে ডাক্তার বড়–য়াকে জিজ্ঞেস করে—‘এর কি কোনো সমাধান নেই ডাক্তার বাবু?’
‘না! অন্তত আমার জানার মধ্যে কোনো সমাধান দেখছি না।’ ডাক্তারের নিস্তেজ জবাব।
পুঁথি এবং নাজিবের বিয়ের বয়সও ছয়মাস পূর্ণ হয়েছে। পুঁথির গর্ভে নাজিবের চারমাসের বাচ্চা পৃথিবীতে আসার ইঙ্গিত-ইশারা দিচ্ছে। এরমধ্যে ভয়-জড়ানো আরেক ‘ছয়মাস’ শব্দমিলন তাকে হতবিহবল করে দিলো।
শারীরিক জটিলতার আদতে ভয়ঙ্কর-ব্যামো যে দীর্ঘদিন ধরে দেহের আনাচে-কানাচে ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে এ-রকম কিছু কখনোই টের পায়নি সে। সবকিছু যখন খোলাসা হলো তখন আর কিছুই করার থাকলো না তার!
ছয়মাস—কথাটা কানে ঢোকার পর নাজিবের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। ঘুরে পড়ার মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়। তবে সাহস হারায়নি। নিজেকে সামলিয়ে মৃদুলয়ে মায়ের পাশে এসে বসলো। পলকহীন তাকিয়ে থাকে গর্ভধারিণীর মুখের দিকে। মায়ের মুখটা কেমন অসহায় এক নারীর প্রতিকৃতি হয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চির মমতাময়ী মায়ের মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনায় পড়ে যায়—
এই তো সেই নারী! যে আমাকে গর্ভে নিয়ে তাবৎ যন্ত্রণা সহ্য করেছে। সামনে যে ভয়ংকর দৃশ্য অপেক্ষা করছে তা অতিক্রম করার শক্তি-সামর্থ্য তার আছে তো? পুঁথির মুখের দিকে চোখ পড়তেই বুকটা ধপ করে ওঠে। দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। পুঁথির সরল-সুন্দর মুখের দিকে তাকাতেই পারছে না। চোখের ভেতর থেকে পানির ফোয়ারা বাইরের দিকে ঠেলে আসছে। গোটা পৃথিবী জবাই করা পশুর মতো চোখের সামনে তড়পাতে থাকে।
তড়িঘড়ি করে আবারও ওয়াশ-রুমের দিকে ছুটে নাজিব।
শুভ্র-সতেজ আলোর ভেতর থেকে যেন বেরিয়ে আসে অন্ধকারের বুঁদবুদ। বেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেকে দমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে ওঠে তার মৃত্যুপরবর্তী পৃথিবীর দৃশ্য। মায়ের কান্না-ভেজা মুখ, স্ত্রীর বিধবা শাড়ি!—বহুদূর থেকে অচেনা একটা বিশ্রী সুর তার কান ঝালাপালা করে দিয়ে বলে—‘ছয়মাস, তোমার পৃথিবীর ভিসার আর মাত্র ছয়মাস বাকি আছে নাজিব! দ্রুত প্রস্তুত হও!’
পুঁথি। নামটা মনের আকাশে উদয় হতেই সর্বাঙ্গে কম্পন সৃষ্টি হয়। সাদামাটা, ভীতু হরিণীর মতো দেখতে মেয়েটিকে কতো স্বপ্ন নিয়ে যে ঘরে তুলেছে সে; অথচ সামনে তার পাহাড়ের বুনো অন্ধকারের মতো ভয়ঙ্কর অনিশ্চয়তা হাতছানি দিয়ে ডাকছে!
ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে ওঠে। নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করে। পুঁথির গর্ভস্থ অনাগত সন্তানের মুখ আরো বেশি দুশ্চিন্তার জন্ম দেয়। আসন্ন সন্তানের প্রতি সৃষ্টি হয় প্রবল মায়া। কে জানে, শিশুটি দেখার ভাগ্য কপালে জোটে কিনা। ভাবি-শিশু কি পিতৃস্নেহের অপূর্ণতা নিয়েই বেড়ে উঠবে? সন্তানের ভবিষ্যৎ-ভাবনা নাজিবের বুকের ভেতরে নতুন করে মোচড় দেয়, কই মাছের মতো খলবলিয়ে ওঠে খাপছাড়া কষ্ট। পুঁথি এতো তাড়াহুড়ো করে সন্তান নিতে চায়নি। নাজিবের দাবি মেটাতে গিয়ে তার জীবন-নৌকো মাঝ দরিয়ায় তলিয়ে যাবে এখন।
আসন্ন শিশুর মুখ একনজর দেখার তৃষ্ণা তাকে তপ্তবালুচর বানিয়ে দিলো। কেবলই মনের মধ্যে উত্তরহীন জটিল জটিল প্রশ্ন এসে উঁকিঝুকি মারে, কেমন হবে বাচ্চাটি, কেমন হবে চোখ-মুখ, হাত-পা ইত্যাদি! কার মতো হবে দেখতে? আমার মতো, নাকি পুঁথির মতো?
‘হায়! কী করলাম আমি! বিয়ে না করার সিদ্ধান্তে কেন যে অনড় রইলাম না চিরকাল? বন্ধুরা তিরস্কার করলেই বা কি আসতো যেতো?’
বাম-রাজনীতিতে থাকাকালে একদা ঠিক করেছিলো কোনোদিন বিয়ে করবে না নাজিব। তখন কোন যুক্তিতে এমন আনকোরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, তা স্পষ্ট নয়। কিন্তু পারিবারিক চাপ, বন্ধুদের অধিকতর ভর্ৎসনা, সবিশেষে পুরুষত্ব নিয়ে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের কারণে অনেকটা ইচ্ছের বাইরে বিয়ে করতে রাজি হয় সে। তাছাড়া পুঁথিকে দেখার পর পূর্বের সিদ্ধান্ত শ্রাবণের আকাশের মতো রূপ বদলাতে শুরু করে কোনো এক রোদ্দুরহীন বিকেলে।
‘অল্প-কটা দিন যদি বন্ধুদের কথা কানে না তুলে ধৈর্য ধরতাম! তাহলে দুটি নিষ্পাপ জীবনের দুঃখ-লরী কল্পনা করতে হতো না এখন। মায়ের আরো দুটি সন্তান আছে, কিন্তু পুঁথির আছে কে? অনাগত শিশুটি কার হাত ধরে ভূ-পৃষ্ঠের ওপর মাথা তুলে দাঁড়াবে?’
পুঁথি এবং মা যেন বুঝতে না পারে, বহুকষ্টে নিজেকে সামলে নেয় সে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। পেছন কৃত্রিম হাসি ছড়িয়ে এগিয়ে আসে জসীম।
‘তেমন একটা সমস্যা নেই। মাস ছয়েকের মধ্যে সবকিছু ঠিক-ঠাক হয়ে যাবে। ভালো ভালো যতো খাবার-দাবার আছে তাকে খাওয়াবেন। নাজিবকে মন মতো চলার সুযোগ দিবেন। ডাক্তার বলছেন, এটা কোনো রোগই না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
জসীমের শেষের কথাগুলো অত্যন্ত ভারি গলায় উচ্চরিত হলো। সেদিকে খেয়াল না করেই আনন্দচিত্তে সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাত তোলে পুঁথি এবং মা। ফাঁক বুঝে টয়লেটের নাম ভাঙ্গিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে জসীম। জসীমের সরে যাওয়ার কারণ কেউ না বুঝলেও নাজিব ঠিকই ঝুঝে গেছে। সে এটাও জানে যে জসীমের একটা কথাও সত্য নয়। সবই মিথ্যে আশ্বাস। নাজিবের স্পষ্ট মনে আছে, প্রয়াতবন্ধু মাঈনুদ্দিন মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় কাতরানোর কালে, বন্ধুমহলের সবাই মাঈনুদ্দিনের বাবা-মাকে ঠিক এভাবেই মিথ্যে আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো। নাজিব এটাও জানে, তার দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গী, পরম হিতৈষী জসীম এখন বাথরুমের বেসিনে চোখের পানি ঢালছে। যাওয়ার সময় পকেট থেকে রুমাল বের করার দৃশ্য নাজিবের চোখ এড়াতে পারেনি।
এককালের তুখোড় ছাত্রনেতা নাজিব মজুমদার নোংরা রাজনীতির মাঠ থেকে অনেকটা আশাহত হয়েই চলে এসেছে। জীবন গড়ার তাগিদে ল’ পড়েছে, বাংলাদেশ বারকাউন্সিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আইনপেশায়ও নিয়োজিত হয়েছে। বিয়ে-শাদীর পর্বও সেরেছে। কিন্তু সময় বড় নিষ্ঠুর!
ক্রমবর্ধমান শারীরিক অসুস্থতা জীবনের সবকিছুতেই ছন্দপতন ঘটাতে শুরু করলো। বিশেষত যেদিন জানতে পারলো মরণবিমারের ভয়ঙ্কর নাম, সেদিন থেকে তার জীবনধারা পাল্টে যায়। এতদিন মনে না হলেও এখন ঠিক ঠিক মনে হয়, যুগযুগ ধরে মারাত্মক এই ব্যামোটা কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেরিয়েছে সে। স¤প্রতি স্বাস্থ্যের ঘাটতি আরো বেশি নাজেহাল করে দিচ্ছে। শরীর, চেহারা, হাত-পা, এমনকি চুলেও আসে বিশাল পরিবর্তন।
দিনরাত দেয়ালে সাঁটানো ক্যালেন্ডারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। দিন গোনে। শরীর শিউরে ওঠে। মাঝেমধ্যে ক্যালেন্ডারটাকেই আজরাইলের মুখ মনে হয়। আগামী ছমাসের মধ্যে যে কোনো একদিন লুট হবে তার প্রাণ—ভাবতেই শিরদাঁড়া শীতল হয়ে আসে।
বিত্ত-সমৃদ্ধ ঘরের সন্তান হওয়ায় ঘরে বসেই দিন কাটে। কোর্টেও যাওয়া আসা হয় না। ইতোমধ্যে রোগের খবরটা লখিন্দরের সাপের মতো এ’কান ফুঁড়ে ও’কানে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। মোটামুটি অনেকেই জেনে ফেলেছে। গর্ভবতী পুঁথিকে জানানো হয়নি। তার সামনে কারো মুখ ফসকে বেরিয়ে এলেও ঠাট্টাচ্ছলে আবার তা ঢেকে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকে। পুঁথির নির্লীপ্ততা বাড়ে। পেটের দিকে তাকায়, কী ভেবে যেন তপ্তশ্বাস ফেলে।
আজকাল বেশিরভাগ সময় ফেসবুক-ইন্টানেট ঘাঁটাঘাঁটি করে সময় কাটিয়ে দেয় নাজিব। দেশ-বিদেশের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা দেয়, নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে। সারাক্ষণ মোবাইল, ল্যাপটপের সামনেই পড়ে থাকে সে। ইন্টানেটে থেকে নামকরা সব হাসপাতালের ঠিকানা, মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে, বেঁচে থাকার শেষ আশ্রয়টুকুন খুঁজে বেড়ায়। নাওয়া-খাওয়া, ইবাদত-বন্দেগী ছাড়া বাইরেও বের হয় না। অনলাইনে বড় বড় ডাক্তারে সাথে যোগাযোগ করে, হাসপাতালের ওয়েব পেইজে ক্লিক করে। প্রযুক্তির কল্যাণে দেশবিদেশের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায়, রোগের বর্ণনা দেয়; তাতে কেবল হতাশা বাড়ে। আশ্বস্ত করেনি কেউ। প্রায় সকলের একই মতামত—টাকা-পয়সা ঢালতে পারবেন, অনেকে অনেক আশা-ভরসা দেবে কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। দেরি করে ফেলেছেন অনেক। বাকিটা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিন।
খ্যাতিমান ডাক্তার-বদ্যিরাও যখন ভরসা দিতে পারে না তখন সামান্য ঔষধ-পথ্যের ওপর কীভাবে ভরসা রাখে সে? ফলে, ঔষধ সেবনে ক্রমশ অনিহা সৃষ্টি হয়, সবকিছু থেকে ভক্তি উঠে যায়।
এক-সন্ধ্যায় মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়ে নাজিব। বাড়ির পাশে প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করানো হয় তাকে। ঘরে পুঁথির অবস্থাও খারাপ। মা একা-একা আর কতটুকু সামলাতে পারে? রোগের কথা বাড়িতে জানাজানি হবার পর ভাই-ভাবিরা আগে থেকেই আলাদা বাড়িতে উঠেছে। পরিবারের আভিজাত্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে কিংবা চক্ষু-লজ্জায় অথবা কর্তব্যের খাতিরে নাজিবের যাবতীয় খরচপাতি তারাই বহন করে। মা থাকে নাজিবের সাথে। পুঁথি প্রসব-বেদনায় কাতর, নাজিব হাসপাতলে ভর্তি। দুর্দিনে আবার জসীমের কাঁধেই পড়ে নাজিবের দায়িত্ব।
রাতভর হাসপাতালে কাটিয়ে, খুব ভোরে ভারাক্রান্ত মনে একটি দুঃসংবাদ বগলদাবা করে জসীম যখন নাজিবের বাড়িতে পা রাখে, তখন বাড়িতে ছোট-খাটো একটা উৎসবের গন্ধ পাওয়া গেলো। যন্ত্রণাক্লিষ্ট পরিবারে অনেকদিন পর একটু হাসির ঝলকানি দেখা গেলো। কেউ একজন ছুটে এসে উৎফুল্লচিত্তে চিৎকার হাঁকতে শুরু করলো—
‘নাজিব ভাইয়ের বৌয়ে কী ঢহের পোলা বিয়াইছে গো!’
কথাটা শুনে জসীমের ঘোর কাটে। বাসার মোবাইল রিসিভ না হওয়ার কারণ উপলব্ধি করে।
ভয়-ডর, লাজ-লজ্জা উপেক্ষা করে আঁতুর ঘরে পা বাড়ায় বাকরুদ্ধ জসীম। দেখে, মমতাময়ী মায়ের কোলঘেঁষে পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে একটি ফুটফুটে শিশু। সদ্যোজাত বাচ্চাটি যেন নাজিবেরই অনুকপি! মা ও শিশু কী নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে সাতসকালে। তারা কি কেউ জানে, এমনই একটি ঘুম কালসাপ হয়ে একটু আগে খেয়ে ফেলেছে চিরদিনের একটি রক্তের বন্ধন!
বিমূঢ় হয়ে জসীম নিজের মাথার একমুষ্ঠি চুল খামচে ধরে, চেয়ারের উপর ধপাস করে পড়ে। শরীরে তার রাজ্যের ক্লান্তি। ভারী একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে এবং কণ্ঠে অদ্ভুত রকমের কাব্যিকতা মিশিয়ে আর্তনাদ করে বলে—‘তৃষ্ণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আমাকে এক গ্লাস পানি দিন। আমি একটা সমুদ্র সঙ্গে নিয়ে এসেছি, একটু পড়ে তার ঢেউগুলি আছড়ে পড়বে চোখের সৈকতে!’