আশিকুর রহমান একেবারে স্তব্ধ-মরাকাঠ। ভোর থেকে তার ওপর করাত চলেছে- রান্দা মারা-কুচি-তারকাটা গাঁথা সব হয়েছে- এই কফিন তাকে চিরেই তৈরি। আত্মজের লাশ যাচ্ছে তার হৃদয়-চেরা কফিনে¬। আজ ভোরের পত্র-পল্লবে স্নেহাচ্ছন্ন বৃক্ষ মাত্র একটা টেলিফোনে মরাকাঠ- সেই কাঠের কফিন আর সেই কফিনেই-
আশিকুর রহমান দোয়া-কালাম পাঠ করছেন- এরকম সময়ে এটাই করে সবাই। তিনি-ও করছেন স্বাভাবিকভাবেই- একটি প্রাণবন্ত জীবিত আত্মা যখন দেহ ছেড়ে নিরুদ্দিষ্ট তখন সেই আত্মার সদগতির জন্য প্রার্থনা ছাড়া আর কী করার আছে!
প্রাণবন্ত- হ্যা অসম্ভব প্রাণবন্ত ছিল। অথচ শিশুটির জন্মের পর শিশু হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার চিন্তিত ভঙ্গিতে বলেছিলেন- সিনড্রোম বেবী-
আইসিইউ’র ইনকুবেটর থেকে বিয়াল্লিশ দিন পর শিশুটি বের করা হল আর প্রফেসর ড. আজাদ বললেন- ডায়াগনোসিসে ভুল ছিল- সিনড্রোম বেবী নয় প্রোবলেম বেবী- এক বছরের মাথায় ফের শিশু হাসপাতাল-আইসিইউ।
প্রফেসর আজাদ এবার বললেন- ফ্যাল্টস টেট্রালজি- জন্মেই হৃদয়ছিদ্র বেবী।
প্যারিস প্রবাসী ড. রহমান বললেন, সারভ্যাইভ্যালে প্রোবলেম আছে-
প্রোবলেম বড় ধরণের। বছর পাঁচেক পর্যন্ত মাঝে-মধ্যেই হাত-পা-মুখমন্ডল ঘন নীল- কখনও কখনও মনে হয়েছে এই বুঝি সারা শরীর হয়ে পড়ে নীল কাদামাটি- অক্সিজেন-মেঘের মত অক্সিজেন বৃষ্টি শিশুটির নাকে-মুখে। এরপর মনেই থাকল না যে আদৌ কো প্রোবলেম ছিল-
বার বছরের সুঠাম প্রাণবন্ত বালক- দেখে চোখ ছানাবড়া ড. রহমানও বললেন, আই সি- ভুল- ভুল ছিল ডায়াগনোসিসে- ভুল হয়- হতে পারে অস্বাভাবিক নয়।
কৈশোর পার হবার সাথে সাথে একদা হৃদয়ছিদ্রকথিত অসম্ভব প্রাণবন্ত এ যুবকের হৃদয় হল অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। এই স্পর্শকাতরতার দরুণই কি- যত রকমের বিশেষণ আছে অভিধান ঘেঁটে সেসব টুকে টুকে বিশেষায়িত করা যায়- এক কথায় বলতে হয় নিটোল মেয়ে- এরকম একটি মেয়ের স্পর্শাকাক্সক্ষায় যুবকের হৃদয় আগ্রাসী হল- মেয়েটিকে কী ধারণ করেছিল মুক্তোর মত স্পর্শকাতর ঝিনুকে!
এখন সেই প্রাণবন্ত হৃদয়বান যুবকের লাশ যাচ্ছে- যদি আদৌ একে লাশ বলা যায়-
আশিকুর রহমান স্পষ্ট অনুভব করছেন হাত-পা ইত্যাদি তার ইন্দ্রিয়সমূহ টুকরো টুকরো বিচ্ছিন্ন- গরু জবাই করে হাড্ডি-মাংস কেটে যেভাবে আলাদা করে রাখা হয় সেরকম- একটার সাথে আরেকটার কোন সম্পর্ক নেই-
তার দোয়া-কালাম পাঠের ফাঁকে ফাঁকে এই সব তাজা দৃশ্যের বিদ্যুৎপাত তাকে থেকে থেকে বিচলিত করছে- এই প্রকার বিচলিত হওয়া কোন অজুহাতেই ঠিক নয়- মাঝখানে পার্থিব পীড়ন দোয়া-কালামের মহিমাকে বিঘ্নিত করে মাত্র-
বাবা মারা যাবার পর খবর পেয়ে তিনি যখন বাড়ি পৌঁছলেন তখন সূর্য ডুবে গেছে- বাড়ি ঘিরে প্রবহমান থরবাঁধা বেদনা। বোনেরা সব কোরআন তেলাওয়াতরত- অন্য রকম আবহ স্নিগ্ধতায় মোড়া- ভেতরে টপ টপ ঝরছে কষ্ট। দোয়া-কালাম পাঠ আর করুণ আর্তি মিলে নির্মিত সেই অপার্থিব আবহ এমনই যাতে অনুভূত হয় সামনেই আছেন আল্লাহ- আল্লাহ এবং মানুষের মাঝখানে দূরত্বটা নিতান্ত কম। সেদিন তার এই রকমই মনে হয়েছিল যা আগে কখনও ভাবেনওনি। দোয়া-কালামের আনুষ্ঠানিকতা বরাবর তার মনে হয়েছে লোক দেখান আড়ম্বর মাত্র!
সেটা ছিল পরিণত মৃত্যু। বাবার বয়স ছিল আশি বছর- দাদা মরেছিলেন নব্বই বছরে- পরদাদা বেঁচেছিলেন শত বছর- তারও আগের আট-দশ পুরুষের কথাও শুনেছেন ছোটবেলায় দাদার কাছে- এখন সেসব ধূসর-অস্পষ্ট এবং ক্রমশ বিলীয়মান। বাবার হয়েছিল স্ট্রোক- আরও বেঁচে থাকলে জীবন হত স্থবির- শয্যাগত। এমনিতেই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ- মা মারা গেছেন বিশ বছর আগে- বাবা যতদিন চলতে-ফিরতে পারতেন নিঃসঙ্গতাকে গাছ-বৃক্ষের সজীবতায় ঢেকে রেখেছিলেন- লাইন ধরে গাছ রোপনের ঘোর বিরোধিতা করতেন- কারণ প্রকৃতি এমনটা অনুমোদন করে না। বাবার কথা- বৃক্ষ-তরু প্রকৃতির প্রবহমান ঐশ্বর্য- জীবনে-মরণে মানুষের আশ্রয়- কিন্তু নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের এহেন স্থবির জীবন দুঃসহ- বাবা এ কথাটি কখনও বলেননি- প্রচলিত জীবনাচার হয়ত তাকে উৎসাহিত করেনি। প্রথমদিকে আবেগ আদর-যত্নে উৎসাহ যতটাই যোগাক তা নিতান্ত স্বল্পায়ূ। মানুষের জীবনে চলমানতার তাগিদ এমনই যে চলৎশক্তিহীন কোন জীবনের যত্নে-আত্তি প্রায় অসম্ভব। আশিকুর রহমান ভেবেছিলেন- বাবা সত্য সত্যই মরে বেঁচে গেছেন। বাবার মৃত্যু তাকে বিশেষ বিচলিত করেনি- কোন আফসোস হয়নি।
আজ আচমকাই বাবার লাশের কথা মনে পড়ল এবং বারবার তিনি দেখছেন- প্রশান্তির ঘুম- অনাবিল মুখমন্ডল- মেদবর্জিত সুঠাম দেহকান্ড- মনে হয় একেবারে তরতাজা যেমনটা শিশুকালে বাবাকে দেখতেন। কোরআন তেলাওয়াতরত বোনেদের সামনে দেখতে পাচ্ছেন- যে বোনটি কট্টর চাপাবাজ- কোন কথা মাটিতে পড়তে দেয় না কখনও- গায়ে পড়ে ঝগড়া করে- ছেলেঘেঁষা উড়নচন্ডি আলুথালু চলাফেরা যার ঠেকান যায়নি তাকেও দেখছেন একেবারে কাদার মত নরম শ্বেতশুভ্রতায় মোড়ান-পরিচ্ছন্ন। কোরআন তেলাওয়াত নিয়ে আশিকুর রহমানের কোন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ছিল না। বাবার লাশের পাশে বসে বোনেদের তেলাওয়াত শোনে মনে হল- একটি অনির্বচনীয় সুর আছে- যা মাটির উপরে মানব কণ্ঠে ধ্বনিত হলেও অলৌকিক মহিমার উদ্ভাস ঘটায়। মহিমাময় সেই দূর মুহূর্তটি আজ সামনে প্রসারিত হওয়ামাত্র আশিকুর রহমান দোয়া-কালাম পাঠ শুরু করেছেন- যা করবেন এমনটা কখনও ভাবেননি- পুত্রহীনতার নৈঃসঙ্গ কী তাকে অলৌকিক মহিমাময় উদ্ভাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে!
কফিনের ভেতর যা আছে তাকে লাশ বলা যায় কী- প্রাণবন্ত স্পর্শকাতর হৃদয়ের এক তরুণের লাশ যে কি না একটি অসম্ভব সুন্দর দেহলতা ও ঐশ্বর্য্যময় চেতনার মেয়েকে হৃদয়ের অনাবিল স্পর্শে বেধে ফেলে সেই মহার্ঘ সংবাদটি অবলীলায় জানিয়েছিল আশিকুর রহমানকে! দোয়া-কালামের মাঝখানে সুইয়ের বেঢপ ঘাঁইয়ের মত এই প্রশ্ন বারবার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে- আঘাত করছে- রক্তাক্ত করছে- বোধের ভেতর নিঃশব্দে-গোপনে প্রবাহিত হচ্ছে?
বাবার লাশ দেখে মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি- কোন শংকা দেখা দেয়নি। বাবার লাশ ছিল আশি বছরের বিচিত্রদশার সহজ স্বাভাবিক পরিণতি। এক অনাবিল প্রশান্তিতে থেমে যায় বাবার জীবন। লোকজন বলাবলি করেছে- আহ্ কী নূরানি চেহারা হয়েছে- আল্লাহর পছন্দের বান্দা-
আশিকুর রহমানের দোয়া-কালাম একেবারে সীমিত- কৈশোরে নামাজ পড়ার জন্য যতটুকু শেখা। এর বাইরে কোন দোয়া-কালাম- আশেকুল্লাহ মৌলভীর সুললিত কণ্ঠের রেশ শ্রুতিতে থাকলেও বহুকাল পর তার স্মৃতিতে আছে অতি সামান্যই এবং বিক্ষিপ্ত। এইটুকু তেলাওয়াতের বিষয় কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তদুপরি তার দোয়া-কালাম পাঠ মানে তো আপন মনে নিঃশব্দে আওড়ান- তবে কোন কৃত্রিমতা নেই। অস্তিত্ব নিংড়ান সবটুকু আকুতিতে তিনি সূরা ফাতিহা একবার এবং সূরা এখলাস তিনবার পাঠ করছেন। আশেকুল্লাহ মৌলভী স্যার বলতেন সূরা এখলাস তিনবার পাঠে এক কোরআন খতমের সওয়াব হয়। এই কথাটি স্মৃতিতে কি করে বেঁচেছিল তিনি জানেন না। বেঁচে যে ছিল বেশ আগেই নিশ্চিত হয়েছেন।
তার ছেলেটি জন্মে ছিল আন্ডারওয়েট এবং হয়ত অসুস্থও। কী সে অসুখ- এ নিয়ে কতটা দ্বিধায় দুলছিলেন ডাক্তাররা এটা শুরুতে বুঝতেই পারেননি আশিকুর রহমান। রাজধানীর একমাত্র শিশু হাসপাতাল যাত্রা শুরু করেছে মাত্র। জাপানি অনুদানে তৈরি আইসিইউ- জাপানি ডাক্তার-নার্স। অনুমতি নেই ভেতরে ঢোকার। এক ঘন্টা পর পর তার স্ত্রী যেতেন বাচ্চাকে বুকের দুধ দেয়ার জন্য। ডাক্তার ও নার্স কক্ষের মাঝখানে ছোট কক্ষে বসে বুকের দুধ নার্সদের দেয়া বোতলে গালিয়ে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। ছেলেকে এক নজর দেখার কাতর অনুরোধ ডিউটিরত সিস্টারকে বিচলিত করত- জানালার কাঁচের ভেতর সাদা পর্দা সরিয়ে দিতেন একটু- ছয় নম্বর বেড এক কোণে- ছেলেটার মাথার একটা অংশ আর মুখে লাগান অক্সিজেন মাস্কটাই দেখা যেত শুধু- আশিকুর রহমানের এটুকু দেখেই মনে হত ছেলেটাকে আদ্যোপান্ত দেখছেন।
তার স্ত্রী আফসোস করতেন, নিজের পেটের সন্তান এতদিনেও দেখতে পেলাম না- হাতে ছুঁতে পারলাম না- বুকে নিতে পারলাম না-
স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার বেদনাদগ্ধ কণ্ঠস্বর শুনতেন, আমার ছেলের লাশ আমাকে দেখতে দিলে না গো- আমি শেষবারের মত আমার কলিজার টুকরাকে একটু আদর করব না- শুধু একটুখানি আদর- তোমরা ওকে এ কোন আইসিইউতে ঢুকিয়ে দিলে-
আচমকা আকাশফাটা চিৎকারে সব কিছু তছনছ হয়ে যেত, একি- এসব কী- কোথায় আমার বাবার লাশ- আমার বাবা কোথায়- আমার সোনার পুতুল-
আশিকুর রহমান বারান্দার কোণে একটা বেডশীট বিছিয়ে রাত্রি জাগতেন- কাটিয়েছেন একচল্লিশটা নির্ঘুম-অক্লান্ত রাত। এতই একান্ত সেই সব রাত- গত বাইশ বছরে বহুবারই ওই রাতগুলো- চৈতন্যে আদোপান্ত যাপন করেছেন।
ডাক্তার-সিস্টাররা বলতেন, আপনি কেবিনে চলে যান- কোন প্রোবলেম নেই-
প্রোবলেম বেবীর কোন প্রোবলেম নেই! তার মনে হত ডাক্তার-সিস্টার হলেও এদের হৃদয় লোহা দিয়ে মোড়ান- সেই লোহার ভেতর স্বযত্নে রক্ষিত হৃদয় আদৌ কি অনুভূতিপ্রবণ?
রাতের বারান্দাটা সুনসান নীরবতায় ঘেরা। আশিকুর রহমান দুয়েকটা বই নিয়ে আসতেন। সার্বক্ষণিক টেনশন থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য পাতা উল্টাতেন-চোখ রাখতেন- চোখ পড়ত- মন পড়ত না- পাঠে মন দিতে পারতেন না- সাদা বিছানায় স্বচ্ছ অক্সিজেন মাস্কটা চোখের সামনে পেন্ডুলামের মত দুলত- দুলতে থাকত- পড়তে পারতেন না কিছুই। আইসিইউ’র দিকে তাকাতে পারতেন না- তাকিয়ে থাকতেন বাইরে- ছোট মসজিদের গেটটা দেখা যায়- গেটে জুতা পড়ে থাকতে দেখে বুঝতেন কেউ না কেউ ভেতরে নামাজ আদায় করছেন। নামাজের অনেক কিছুই ভুলে গেছেন- শুধু আল্লাহ আল্লাহ করতেন- আল্লাহর কাছে মাফ চাইতেন- ছেলেটির জীবন ভিক্ষা চাইতেন-
দূরে রাস্তায় একটা দু’টা গাড়ি চলে যাবার শব্দে মনে হত সব কিছু ঠিকঠাক আছে। খানিকটা সাহস যোগাত বারান্দার কোণঘেঁষে কী করে যেন প্রাণে বেঁচে যাওয়া তালগাছটা। এখানে খানা-খন্দকের ফাঁকে ফাঁকে এলোমেলো ভঙিতে একটা তাল বাগান ছিল- এ তাল গাছটির দিকে তাকালে ওই তাল বাগানটির কথা তাদের মনে পড়বে যারা এগ্রিকালচার ফার্মের পশ্চিম প্রান্তে ওই প্রাকৃতিক উচ্ছ্বাসটি অতীতে দেখেছেন।
ওই তালগাছ ঘেঁষে লাইটপোস্ট- তার হলুদ আলো- আসলে আলোটা কি সত্যই হলুদ ছিল- এই প্রশ্ন আজ এতদিন পর তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে- তখন হাসপাতালের বিছানা-দরজা-জানালা-পর্দা-সিস্টারের পোশাক-ডাক্তারের এপ্রোন- এই সমুদয় শ্বেতশুভ্রতাই তার কাছে হলুদ- চোখ জ্বালাকরা হলুদ। রাত বারটার পর ডিউটিতে আসতেন যে বাঙালি ডাক্তার নাম সম্ভবত তার মিজানুর রহমান।
এক রাতে বিকট হলুদ আলোতে আলবেয়র কাম্যুর দ্য আউটসাইডার বইয়ের পাতা উল্টে বললেন, বইটার অনেক নাম শুনেছি- পড়া হয়নি- আমি কি একটু দেখতে পারি?
আশিকুর রহমান বললেন, অবশ্যই দেখুন না-
পরের রাতে ডা. মিজান নিজে থেকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন- ভেতরে মানে ডক্টরস রুমে। কাম্যুর আউটসাইডার এর কথা কিছু বললেন না- আশিকুর রহমান ভেবেছিলেন বলবেন। তবে এরপর থেকে রাতে অধিকাংশ সময় সাহিত্য-সমাজ-ইতিহাস নিয়ে গল্প করতেন তারা। আশিকুর রহমান তার দীর্ঘ পঠন-পাঠন-অভিজ্ঞতা উজার করে শোনাতেন- ডা. মিজান এক সময় ভুলেই গেলেন এই ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী প্রোবলেম বেবী নিয়ে দীর্ঘ হাসপাতাল-বাস করছেন-
শুরুর দিকে এক রাতে ডা. মিজান তাকে জিঞ্জেস করলেন, আপনার ছেলের কি হয়েছে জানেন আপনি?
আশিকুর রহমান বললেন, না আমি ঠিক জানি না-
ডা. মিজান বললেন, উই সাসপেক্ট ইওর বেবী ইজ অ্যা সিনড্রোম বেবী-
সিনড্রোম বেবী কি- তার চেয়েও বড় প্রশ্ন আশিকুর রহমানের- ছেলেটি বাঁচবে তো- সুস্থভাবে বাঁচবে তো?
ডাক্তার বললেন, সিনড্রোম বেবী- বুঝেছেন তো?
আশিকুর রহমানকে নিশ্চুপ দেখে তার দিকে একটা এ্যাপ্রোন বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, চলেন- দেখবেন আপনার ছেলেকে-
একটু থামলেন, আশিকুর রহমানের চোখ-মুখ নিরীক্ষণ করলেন।
তারপর বললেন, আমরা আশাবাদী- আপনার ছেলে ভাল হয়ে যাবে-
ছেলেটি ভাল হয়ে গিয়েছিল- বেশ ভাল- সদ্য যৌবনেই সে ছিল স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ এবং অসম্ভব মেধাবী- যা তিনি নিজে কল্পনাও করেননি। এসএসসি ও এইচএসসিতে তারকা নম্বর পেয়ে বুয়েটে ভর্তি হওয়া পর্যন্ত ঘটনাগুলো অবলীলায় ঘটে গেল। কলিগরা ছেলেমেয়ের ভর্তি-সমস্যায় যখন নাজেহাল তখন তিনি দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে অফিস করেছেন আর দেশি-বিদেশি গল্প-উপন্যাস-স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়ে অবসর কাটিয়েছেন। ছেলে নিয়ে কোন টেনশনই ছিল না তার। এ সময়ের ছেলে হয়েও যে বখে যায়নি- এটা ভেবে অসম্ভব তৃপ্তি পেয়েছেন।
সমস্যাটা দেখা দিল ফার্ষ্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উঠবার পর। বাড়িতে মাঝেমধ্যে ওর ফোন আসত- কথা বলত অনেকক্ষণ ধরে। কার ফোন- কি কথা বলত খোঁজ নেননি। কোন তাগিদ অনুভব করেননি। এরপর দেরি করে বাড়ি ফিরতে লাগল আর ছুটির দিনেও বাইরে যেতে লাগল। মেধাবী ও দায়িত্বশীল ছাত্রদের ব্যাপারে বাবা-মা একটু বেশি উদাসীন থাকেন কি না কে জানে- তবে তিনি ছিলেন। এই উদাসীনকালেই একদিন ফোন ধরেছিলেন তিনি।
ওপাশ থেকে মেয়েটি বলল, চাচা আমি সোমা আমরা একসাথে পড়ি- সাম্য কি নেই-
মেয়েটির কণ্ঠ এবং কণ্ঠ ছাপিয়ে কথা ভাল লেগেছিল তার। আজকাল ছেলেমেয়েরা বলে আ্যাংকেল কিন্তু ও -চাচা বলল। মেয়েটি অন্যরকম এবং এ মেয়ে থেকে ভয়ের কিছু নেই- এ রকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন প্রথমদিনই। সোমা মাঝেমধ্যেই ফোন করত এবং তার সাথেও কথা বলত। এক সময় এটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। সোমা একদিন ফোন করে টিভিতে একটা নাটক দেখতে বলল- তিনি নাটকটি দেখলেন। সাম্যর নাটকের ব্যাপারে বিশেষ কোন আকর্ষণ ছিল না। আশিকুর রহমান আগোছালোভাবে দৃষ্টি রাখলেন। সাম্য পড়তে পড়তে ঘড়ি দেখে ঠিক সময়ে এসে টিভি অন করল। টেলপেই তিনি দেখলেন সোমাকে- চমকে দেবার মত মেয়ে। টিভিতে এ রকম চেহারার মেয়েরা ভাল অভিনয় করে না- কিন্তু সোমা একটি প্রাণোচ্ছ্বল মেয়ের চরিত্রে অপূর্ব অভিনয় করল।
নাটক শেষে সাম্য যখন উঠে যাচ্ছে তখন তিনি বললেন, মেয়েটি চমৎকার করেছে- ঠিক না?
সাম্য বলল, না-
তিনি বললেন, না মানে-
সাম্য বলল, দুঃখিত বাবা তোমাকে বলিনি- ওকে আমি চিনি-জানি। ও এরকম নয়- মোটেই এরকম নয় ও- ওকে এমনটা মানায় না মোটেই-
তিনি অনুমান করলেন সাম্য সোমার অভিনয় করা কিংবা এরকম চরিত্র করাটাকে খুব ভালভাবে নিতে পারছে না। তার মানে সাম্য তার ভালমন্দ চিন্তার সঙ্গে সোমাকে জড়িয়ে ফেলেছে। আশিকুর রহমানের আরও ভাল লাগল- সাম্য আজকালকার ছেলেদের মত ড্যাম কেয়ার নয়।
সোমা অনেক পরে একদিন ফোন করে বলল, চাচা সাম্য আজকাল দলের কাজে বেশি সময় দিচ্ছে আপনি জানেন কি?
তিনি ভাবলেন, এ কথার মধ্য দিয়ে সোমা কী বুঝাতে চাইছে যে- সাম্য তাকে আগের মত সময় দিচ্ছে না। ব্যাপারটা তিনি আমলে নিলেন না ভাবলেন- ওদের ব্যাপার ওরাই এক সময় ঠিক করে নেবে।
ছাত্র সংগঠনগুলো বেছে বেছে কিছু ভাল ছাত্রকে পিকআপ করতে চায়- তাদের মাথায়ই দেশ-জাতি-মানবকল্যাণ এই বিষয়গুলো যুতসই হয়ে গেঁথে বসে। সংগঠন টিকিয়ে রাখার জন্য এরকম কিছু নীতিবান-নিষ্ঠাবানের দরকার। আশিকুর রহমান এই বিষয়টি কখনও ভাবেননি- তার ধারণা ছিল যারা ভাল ছাত্র নয় তারাই কেবল সংগঠন করে বেড়ায়- ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়। তিনি শুধু একপিঠ দেখেছেন- আরেকপিঠে কখনও দৃষ্টিপাত করেননি।
তিনি ধরে নিয়েছিলেন সোমাই সাম্যর একমাত্র গন্তব্য। এরই মধ্যে সোমা মেয়েটা শো-বিজে অনেক দূর উঠে গেছে- এখন রীতিমত তারকা-খ্যাতিতে সমৃদ্ধ। প্রথমদিকে সোমা নিয়মিতই ফোন করত- নানা কথা বলত- ওর মুক্তিযোদ্ধা বাবার আকস্মিক মৃত্যুর কথা- ওদের মানসিক কষ্টের কথা। শুনতে শুনতে তার মনে হয়েছে দিনের আলোর মতই পরিস্কার এ মেয়ের মন। আরেক মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের বাবার শূন্যতা সহজেই মুক্তিযোদ্ধা আশিকুর রহমানের মনের কোমল জায়গাটা স্পর্শ করে। এক সময় অনেকদিন পর পর সোমার ফোন আসত- তিনি বিচলিত বোধ করতেন। গত কিছুদিন কোন ফোন এসেছে কি না তিনি জানেন না। এ সময়টাতে সাম্যও দেরি করে বাড়ি ফিরতে থাকে এবং হঠাৎ হঠাৎ রাতেও বেরিয়ে যায়। তিনিও টের পেতেন সাম্যর ভেতর অদৃশ্য এক জখম এবং তা থেকে নিঃশব্দ রক্তপাত হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের সময় তার কোলে প্রিয় এক বন্ধুর জখম-রক্তপাত-অসারতা-মৃত্যু- প্রতিটা পল তিনি দেখেছেন। তখন জানবাজ মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু- তারা- সহযোদ্ধারা সহজভাবে নিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন- শত্রুর মোকাবিলা করেছেন।
সাম্য কেন মারা গেছে- কারা মেরেছে- আশিকুর রহমান কিছুই জানেন না। পাশের বাসার রিশাদ ছোটবেলা থেকে সাম্যর বন্ধু- সে বলেছে, খালুজান ওই মেয়েটার জন্যই-
একসাথে ছাত্র সংগঠন করে সাম্যর খুব ভক্ত আদনান বলেছে, খালুজান আমি নিশ্চিত- সাম্য ভাই আদর্শ আর ব্যক্তিস্বার্থের চলমান সংঘাতের শিকার-
এ দু’টাই সহজ কথা- সাধারণভাবে এমনই ভাবা হয়। আশিকুর রহমান ভাবছেন অন্য কথা- তার প্রোবলেম চাইল্ড এই জগৎ-সংসারে এমন কী প্রোবলেম তৈরি করেছিল যে জন্য তাকে খুন করা হল?
তখনও তিনি দেখেননি তার ছেলের লাশ। নাক-মুখ-চোখ অক্ষত রয়েছে বলে লাশ শনাক্তকরণের কাজটি সহজ হল। সাম্যকে টুকরো টুকরো করে কেটে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হল কেন- একজন মুক্তিযোদ্ধার একমাত্র সন্তানকে বিনাযুদ্ধে সবুজ-শ্যামল এই দেশটির মুক্ত আলো-বাতাসে নিজের পায়ের তলার মাটি ছেড়ে দিতে হল- তিনি আর ভাবতে পারলেন না।
আশিকুর রহমান নামক হৃদয়-চেরা কফিনে যাচ্ছে সাম্যর লাশের সেই টুকরোগুলো- আর সাম্যর বাবা সেই কফিনের মাথার কাছে দোয়া-কালাম পাঠ করছেন। এ ছাড়া আর কী করার আছে জানেন না এই মুক্তিযোদ্ধা- অন্য কেউ জানেন কী না- এব্যাপারেও যথেষ্ট সন্দেহ তাকে ক্লান্ত-অবসন্ন করে তুলছে-