বাঘের পাড়ায়
বাঘের পাড়ায় আন্ধার রাতে গা ছমছম করে
শুকনো পাতাও পড়ে যদি, হরিণ ভেবে ধরে।
বাঘরা ঘুমায়, বাঘিনীরা এবং তাদের ছা;
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দ্যাখে হরিণচরা গাঁ-
সেই গাঁয়েতে হাজার হরিণ ঘুমায় গায়ে গায়ে
অন্ধকাররা আছড়ে পড়ে তাদের নরম পায়ে।
কি যে নরম মাংস তাদের, নোনতা নোনতা স্বাদ
কিন্তু তাদের ধরতে লাগে হাজার রকম ফাঁদ।
ফাঁদে তারা পা দেয় না, এমনই নচ্ছার!
ইচ্ছে করে সকাল বিকাল মটকায়ে দি ঘাড়।
‘হরিণ! হরিণ!’ বলে হঠাৎ চেঁচায় বাঘের ছা।
“হরিণ কোথায়? ঘুমো এখন।” শাসায় যে তার মা।
বাঘিনীর মা কোথায় ছিলো, বললো এসে, “হুম।
ঠিক বলেছে নাতি আমার। ভাঙলো তোদের ঘুম?
কী এনেছি দেখ্ না চেয়ে!” “দেখি, নানী, কী গোÑ”
দেখেই নাতি চেঁচিয়ে ওঠে, “ও-মা! এ যে মৃগ!”
মধ্য রাতে বাঘের পাড়ায় চলে ভোজোৎসব
হালুম হুলুম আওয়াজ ওঠে, খুশির কলরব।
বাঘের পাড়ায় জোছনারাতে বসে চাঁদের হাট
সুন্দরী সব বাঘের ঝি-রা, সে-কি তাদের ঠাট,
বাঘের বউয়ের লাঙ্গুল ধরে করে টানাটানি-
বাঘের বউ না, বাঘের বউ না, সে যে বাঘের রানী।
বাঘের খালা-ফুফু যত ছিলো আশেপাশে
জোছনারাতে তাদের সাথে হো হো করে হাসে
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে একে অন্যের গায়
জোছনাজলে তখন সারা বন যে ভেসে যায়!
কেওড়াপাতায় জোছনা নাচে, নাচে বাঘের মন
হালুম বলে হাঁক মারে সে, কাঁপে গোটা বন।
হরিণেরা বাতাসেতে পেতে রাখে কান
শোনে বাঘদের হাসাহাসি এবং তাদের গান।
বানরগুলো ভয়ে মরে, কামড়ে ধরে ডাল
গহিন বনে যায় পালিয়ে বন-শূকরের পাল।
বস্ত্রবাদ
খুলতে খুলতে কত আর খুলবে পোশাক, মেয়ে?
যায় যে উন্মুক্ত হয়ে পলি পড়া যমুনার চর!
ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো কি-রকম আছে চেয়ে চেয়ে-
হারিয়ে সোনালি হায়া আর কত হবে দিগম্বর?
তোমার আকাশ গেছে কুয়াশার মেঘে মেঘে ছেয়ে-
কোন্ ইবলিশ বলো করেছে তোমার ’পরে ভর,
ফেললে এভাবে তাই সমুদয় চক্ষুলজ্জা খেয়ে?
শকুনের মতো আজ মাংসাশী তোমার অন্তর।
আমরা নগ্নতা থেকে আসিনি কি ফিরে সভ্যতায়,
মহামূল্য মসলিনে দি’ নি ঢেকে তোমার শরীর?
খোসার মধ্যেই কলা শান্তি ও সৌন্দর্য খুঁজে পায়,
ডাবের ভিতরে পানি হয়ে যায় বেহেস্তের ক্ষীর।
ফিরে আসো বস্ত্রে, ঘন পল্লবের শীতল ছায়ায়,
ওঁৎ পেতে আছে বাঘ, তাক করা ঘাতকের তীর!
দাগ ও দুর্গন্ধ
কত বার হাত ধুলে মুছে যাবে হাত থেকে শোণিতের দাগ?
কত বার মুখ ধুলে মুছে যাবে মুখ থেকে মাংসের দুর্গন্ধ?
যতই হিসেব কষো, ক্যালকুলেটরে তুমি করো গুণ-ভাগ
মিলবে না এ গণিত, ফিরবে না জীবনের কাব্যে সেই ছন্দ!
অনেক কেঁদেছে নারী, অনেক কেঁদেছে শিশু, শিশুদের পিতা
মানুষের আর্তনাদে অনেক হয়েছে ভারী বিশ্বের বাতাস
নষ্ট ওই হাত দিয়ে টিপেছো বোতাম কিংবা টেনেছো কী ফিতা,
পড়েছে হুমড়ি খেয়ে নিযুত নিযুত, আহা, শতচ্ছিন্ন লাশ!
হায়েনারও হায়া আছে, চমকায় চোখে তারও ভয়ের বিদ্যুৎ,
পাথরেরও শক্ত প্রাণে তরমুজের মতো বুঝি আছে কোমলতা;
কিন্তু হে মানুষখেকো! স্বাধীনতাখেকো ওহে রক্তচোষা ভূত!
দয়া-মায়া-হায়া-ভয় তোমার জগতে জানি শুধু রূপকথা।
ধুয়ে যাও কোটি বার, তারপরও কোটি বার, কোটি বার ফের-
যতবারই ধোও না হে, যাবে না রক্তের দাগ, দুর্গন্ধ মাংসের।
নিস্তব্ধতার গান
স্তব্ধ করে রাখো বুক
আর বেঁধে রাখো ঠোঁট।
কিছুই বলে না যেন মুখ,
উলট পালট
যতই দ্যাখো না চারদিকে!
কথা বলবে না কোনো,
যা-ই যাক লিখে
আর যা-ই তুমি শোনো।
কেন যে হৃদয়ে রাখো আজও
কবিতার কথা, কুসুমের কথা!
পারলে ছুরির মতো বাজো;
তা না হলে, শুধু নিস্তব্ধতা!
এখানে গানের-সুরের-প্রেমের
দিন আর পাবে না কো;
বুঝা হয়ে গেছে ঢের,-
চুপ করে তুমি থাকো
যেন লাশ,
যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে
সভ্যতার কোনো লুপ্ত ইতিহাস
নারদ নদীর পাড়ে!
চালক
তারা ছাতা ধরে
চাইলো ঠেকিয়ে দিতে
বৃষ্টির পতন;
তবু সে পতিত হলো
পৃথিবীর ’পর,
ডুবালো পুকুর,
কর্দমাক্ত করলো জমিন।
সুউচ্চ দেয়াল তুলে
তারা ঠেকাতে চাইলো
ঝড়ের গতিকে;
তবু ঝড় এলো,
উড়ালো টিনের চাল
আর ঝাঁকা দিয়ে ফেলে দিলো
গাছের সমস্ত আম।
পৃথিবী ঢালাই করে তারা
ঠেকাতে চাইলো ভূমিকম্প;
তবু সে হঠাৎ এসে
দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেল
তাদের সাজানো সভ্যতাকে।
তারা আজ বলে- হায়,
আমাদের পৃথিবীটা
কারা যে চালায়!
বাটবিলে
কালের চাকা ঘুরতো যদি উল্টা
আবার ফিরে যেতাম বাটবিলে
শুধরে নিতাম পুরনো সেই ভুলটা
হতাম না আর আমড়া কাঠের ঢেঁকি
এবার তুমি দেখতে আজব দৃশ্য
বাঘের পিঠে চড়ে তোমার গাজী
অসি নাচায়, কাঁপে তাবৎ বিশ্ব
দেখে তোমার দুচোখ ছানাবড়া
কার কলিজা এত সাহস ধরে
তোমার দিকে হানে লোভের দৃষ্টি
যমেরাও আজ ভয়ে-ত্রাসে মরে
তোমার গাজী ক্ষেপেছে কী ক্ষ্যাপা!
বাটবিলে আজ যেন কুরুক্ষেত্র
ট্রয়নগরী আজ যেন বাটবিলে
জ্যোৎস্না রানী, মেলো তোমার নেত্র
দ্যাখো, প্রেমের শত্রুরা সব খতম
যখন গাজীর বাঘ সমরে অশ্ব
তোমার গাজী ক্ষিপ্ত ওডিসিউস
তখন তুমি শ্মশানঘাটের ভস্ম
হারিয়ে যাওয়া সোনার ইউরিডিসি
অশ্রু ঝরায় এখন আমার মসি-
ভীরুর জন্যে নয় তো প্রেমের খেলা
প্রেম শুধু চায় রক্তমাখা অসি;
কালের চাকা ঘুরতো যদি উল্টা!