আজ ২৫ নভেম্বর , দ্বিতীয় দশকের অন্যতম কবি আশিক বিন রহিম এর জন্মদিন। জীবনের এই বর্ণাঢ্য উদযাপনকে স্মরণীয় করে রাখতে আজ তার ১০টি বাছাই করা কবিতা প্রকাশ করা হলো। সেই সাথে আড্ডাপত্র’র পক্ষ থেকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা।
উড়ালপঙ্খি
মানুষ এক উড়ালপঙ্খি,
আমি তারে বাইন্দা রাখি না সুঁতার দড়ি দিয়া
লোহার শিয়লে আটকায়া মাগি না- সুখ
চাইরকোণা ঘরে।
আমি চাই মানুষের পাখনা থাহুক মেঘের লাহান
জমিন আর আসমান মিলায়া দেউক
পাখনা ঝাঁপটানি- কুয়ারায়।
উড়াল মানুষই বড় ভালো দেখি আমি
রঙে-ঢঙে, আহ্লাদে তার উড়ান-নাচন
বাতাসের লাহান- বহুক অবারিত।
উড়ালপঙ্খিরে বাইন্দা কী রাখা যায় কও-
পিরিতের সুতায়; তারে তুমি উড়তে দিও
গলায় দিও পরাণের তাবিজমালা
যতোদিন টান থাহে; বেশিদূর যাইবো না।
ফুল ও বন্দুক
পৃথিবী মূলত দু’পক্ষের
একাপাশে ফুল, তার বিপরীতে বন্দুক
আমি গান গাই ফুল হাতে- প্রণয়ে
ওরা, কামান আর মিশাইলে ঝংকার তোলে
সে ঝংকারে কাঁপে পৃথিবী, কাঁদে পাখি অরণ্য
আমি ফুলেল সুবাস ছিটিয়ে দিলে-
তারা হাসে- স্বপ্নে বাঁচে।
বন্দুকের শক্তি আর কতোটুকুই বলো
যতটা আছে ফুলে, যতটা প্রেমে
বুলেটবিহীন নষ্ট বন্দুক- কে রাখে কোমড়ে
চাও যদি নিঃশ্বাস পেতে দেখো ফুলে-
মরেও কেমন গন্ধ বিলায়।
বন্ধু এসো তবে-
যোদ্ধা নয়, চাষি হই
রাইফেল রেখে কাস্তে হাতে লই
ফুলে- সুবাসে ভরিয়ে দেই তাবৎ পৃথিবী।
সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন,
অনু-পরমাণু চুল্লি যতো- ভেঙে গুঁড়িয়ে দিই।
তারপর, সেইখানে যৌথ প্রণয়ে ফুলের বাগান গড়ি।
টান
তোমায় আমায় এক করেছে
এ কোন সুতোর বান
একটু দূরে চাইলে যেতে
লাগছে তাতে টান
সখি
তুমি আমার ভালোবাসার
আহ্লাদি আসমান।
তোমার চোখের উঠোন জুড়ে
এ কোন মায়ার চাষ
গোলাপ রঙের ঠোঁটের ভেতর
কোন সে নেশার বাস
সখি
তুমি আমায় কেমনে রাখো
মাতাল বারোমাস।
স্মৃতিবহা মেঘনা ও ইলিশের ঘ্রাণ
কেউ আমাকে একটা নদীর কথা বলুক
আমি এঁকে দেবো প্রমত্তা মেঘনা
আমাকে কেউ কোনো দুঃখের ছবি আঁকতে বলুক
লিখতে বলুক দীর্ঘ প্রতীক্ষান্তে খুঁজে পাওয়া সুখ-কথা
আমি মেঘনাকেই দেবো লিখে।
মেঘনা এক নদীর নাম
প্রমিলাসিঁথির মতো যে বয়ে গেছে আমাদের বাড়ির
পাশ দিয়ে। বুক চিরে যার ছুটে গেছে প্রাগৈতিহাসিক জাহাজ
পালতোলা ছইয়ের নাও; নাইওর খুঁজে নিয়েছে কাঙ্খিত তীর- গন্তব্য।
মেঘনা এক রাক্ষুসী নারী
যৌবনে বর্ষার জলে যে নেচে ওঠে ধ্বংসের খেলায়
তীর জুড়ে গড়ে ওঠা ঘর, ফসলি জমা মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন
করে দেয় ঢেউয়ের প্রহার, নিষ্ঠুর ছোবল।
মেঘনা মানে জীবন-জীবিকার অদৃশ্য বৈয়াম
যার পেটভর্তি মিঠাজল, বাহারি মাছ আর ফসলের হাতছানি।
মেঘনা মানে ইলিশের বাড়ি ‘ব্রিটিশ গেইটওয়ে টু ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’
স্টিমার জাহাজ; শেখ মুজিব, গান্ধী জি, রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের পদধূলি।
মেঘনা মানে মায়ের স্নান, ভেজা চুল, কাঁখের কলস, জলশস্য ইলিশ;
ডুলাভর্তি মাতাল ঘ্রাণ, বাজার-ফেরা বাবার স্মৃতি।
সুতো ছেঁড়া ঘুড়ি
কার আকাশে উড়ছ ঘুড়ি
ছিঁড়েছ সুতো কার
কার পরাণের নাটাইখানা
ভাঙছে বারংবার।
কোন বাগানের ফুল ছিলে গো
কোথায় বিলাও ঘ্রাণ
কার হৃদয়ে লিখছ এখন
আহ্লাদী আসমান।
কার নায়েতে গাও বিছিয়ে
চাঁদের জোছনা মাখো
কে ছিলো এক পরান মাঝি
তারে কী আজ আঁকো ।
কার বাঁশিতে আঙুল রেখে
কোথায় তোলো সুর
কার নয়নে স্বপ্ন ঢেলে
ছুটছ বহুদূর ।
ভুল ছুঁয়ো না ওগো মেয়ে
ফুল ছুঁয়ো না ভুলে
জীবন নামের ঘর এঁকো না
ভাঙন নদীর কূলে।
দুর্ভগা জননী
চোখ বুজলেই দেখি একদল কুকুর
কতোগুলো হায়না, শুয়রের বাচ্চা
একটা অসহায় রাষ্ট্রকে বিবস্ত্র করে
কাঁমড়ে-খাবলে, চেটেপুটে খাচ্ছে শরীর!
রাষ্ট্র চিৎকার করে
রাষ্ট্র পায়ে ধরে বাঁচতে চায়
রাষ্ট্র তার পতাকা জড়িয়ে
লজ্জাস্থান ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করে
রাষ্ট্র কেঁদে উঠে- যতটা সামর্থ আছে কণ্ঠে-
‘এরে আব্বা গো… তোগো আল্লাহর দোহাই’
বায়ান্ন, একাত্তর আর পঁচাত্তরের দোহাই
আমারে ছাড়ি দে…
কুকুরের দল থামে না
শুয়রের বাচ্চারা আরো উন্মাদ হয়
হায়নার মতো উন্মত্ত নখে খাবলে ধরে…
অথচ, এই অসহায়- উলঙ্গ বৈয়ামেই
জননী হৃষ্টপুষ্ট করেছিলো পৃথিবীর সন্তান
আহা, আজ মানুষমুখো শুয়োরের দল কতো নির্ভয়ে
তাতেই লেপ্টে দিচ্ছে কামাতুর জিহ্বার লালা!
তার পরেও, আমরা ঘৃণা ভুলতে শিখি
প্রতিবাদের জিকির- কীর্তন ভুলে যাই
অতঃপর নিজের, গালে নিজেই ঠাস্ ঠাস্
চপেটাঘাত করি সানন্দে!
আহা নির্লজ্জ বিবেক, আহা দুর্ভগা জননী।
মেঘনা গাঙের জল
মেঘনা গাঙের জল
আমার চোখে- শান্ত বুকে
কেমন করে- বসত গড়ে
খেলছে এমন বল।
আমি তো ছিলাম ফুল
নরম স্বরে- গাইছি ভোরে
দুলছি সকাল- হলদে বিকাল
কেমনে হলাম ভুল।
সুখ নামের ওই পাখি
দেয়নি ধরা- স্বপ্নে মোড়া
ছিলো সে-যে- পাইনি খুঁজে
কেমনে তারে ডাকি।
মেঘনা গাঙের জল
বারে বারে- চোখ দুয়ারে
এমন করে- নৃত্য ওরে
কেনো তার উছল।
নদীর জন্য আজ একটি মিছিল হবে
আজ পাখির কথা থাক—
ফুল পাহাড় প্রজাপতি আকাশ কিংবা জোনাকির কথাও নয়,
সূর্য ঘুমিয়ে থাক মাথা রেখে সফেদ মেঘের বালিশে।
আজ নদীর কথা হবে—
নৌকা-রঙিন পাল, ছইয়ের তলে নতুন বৌ, মিঠাজল, উছল ঢেউ
মুর্শিদী অথবা ভাটিয়ালি গানের গায়েনকে খুঁজব আজ।
আজ কথা হবে মেঘনা মেয়ের—
যার পলিমাটির আশীষ নিয়ে ধানের চারার মতো কিষান-কিষানি হাসে
মিঠাজলের লোভে জন্ম নেয় রুপালি ইলিশ।
আজ তার কথা হবে—
যে নদী বহুকাল ঢাকাবাসীর পাপ-বিষজল বয়ে আনে স্বেচ্ছায়
বিনিময়ে দুঃখিনী বুড়িগঙ্গাকে শুদ্ধ করে বাঁচিয়ে রাখে।
আজ সেই নদীর কথা হবে—
দস্যুজেলের ভয়ে এখন যেখানে ইলিশ কাঁদে
ফসলি জমি আর বালু সন্ত্রাসের ভয়ে
গোপনে মানুষ কাঁদে।
আজ একটি মিছিল হবে
নদী, ফসল, ইলিশ বাঁচাতে।
দাওয়াই
মাথার উপর ঝুলে থাকা চাঁদ, খুঁটিহীন নীল আসমান
মেঘ ভেঙে সূর্য হাসে। অথচ কী আশ্চর্য প্রেম—
যেখানে ক্ষত আঁকে সেখানেই লিখে দেয় দাওয়াই
মসৃণ মমতা।
ভালোবাসায় ক্ষত, রক্তাক্ত প্রাণে যতটুকু দহন-অসুখ
প্রেমেই তা চূর্ণ হয়, পূর্ণ হয় হৃদয়।
প্রেম—বড়ই আশ্চর্য দাওয়াই।
গোলাপ আমিও ফোটাতে জানি
নারী
আমাদের আদিপিতা একদিন ছুটে গেলেন ঈশ্বরের কাছে, আর্জি নিয়ে। ঈশ্বর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ইশারা দিলেন—‘বলো’। পিতা করজোড়ে ফরিয়াদ জানান—‘আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখতে চাই আরও মোহনীয়রূপে। সে যেন আরও সুশ্রী, আকর্ষণীয়া, দৃষ্টিনেশায় কামাতুর রমণী হয়ে ওঠে।’ ঈশ্বর মুচকি হাসেন স্বীয়সৃষ্ট নারী-পুরুষের মায়াটান প্রেম দেখে। বলেন—‘এ আর এমন কী চাওয়া! যাও তবে নেমে পড়ো মাঠে, ঘাম ঝরাও শরীরে।’ স্বপ্নপিয়াসু পিতা মাঠে নামেন, ঘাম ঝরান শরীরে; দিনশেষে ঘরণীর প্রেমে ও পরশে শুকিয়ে যায় নোনতা ঘামের নহর। এভাবেই আমাদের পিতার ঘামে সৃষ্টি হয় মায়ের পোশাক, প্রসাধন ভূষা ও বসন। আর সেই থেকে পুরুষ ভাঙলে বেরিয়ে আসে শ্রমমিশ্রিত ঘাম—নারী ভাঙলে বেরোয় প্রীতি ও প্রণয়, পোশাক-প্রসাধন, অলংকার ও সুবাস।