মানুষ মকর নয়, অন্যপ্রত্নজীব
মৌলিক হতে গিয়ে সেও তো নীরব হল অনুপুঙ্খ
মাকড়সার মত শুধু নিজ তন্তু নিজ শিল্পঘোরে
মুগ্ধ হয়ে টের পেল মানুষ মকর নয়, অন্যপ্রত্নজীব
বায়ু হতে প্রতিমুহূর্তে তারও অনিবার্য অম্লজান লাগে।
সর্বদাই অগোচরে তবু ঠিক পাতাদের আশ্চর্য রান্নাঘরে,
পাতাদের অপূর্ব রন্ধনশালায় শর্করার শতব্যঞ্জনা গাঁথে
বিশ্লেষিত করে নিলে মানুষও কার্বন, মানবীর হাড় হল হীরে
তখনি সে কেবল মৌলিক, কণাদের দিকে চোখ রেখে
কথা যে স্বয়ম্ভরস্বভাবে হাসায়, শব্দদের প্রতিভা সে জানে
মহাপ্রকৃতি যে নিয়মে স্নায়ুকে জাগায়, উদ্দীপ্ত করে রাখে
অন্বিষ্ট ব্যাখ্যান থেকে পরাজিত মানুষের বেদনা তুলে নিয়ে
সেও তো মৌলিক হল, ঐ গান শঙ্খসমুদ্রে যেভাবে বেজেছে
মানবীর তন্তুতারে তার সুর বুঝি পড়োকান্না কালরাতে
যৌগিক সমুদ্রে খুব ঝড় হল, প্রভাতে তার চিহ্ন মাত্র নেই।
প্রীতধামে অন্য এক আনন্দ
প্রীতধামে অন্য এক আনন্দ মুগ্ধ আর নির্ভার করে রাখে
ভাসি ও ভাসাই এক কার্পাসের নিবিড় চাদরে, চাদোয়ার চাঁদে
নিষ্কম্প শিখা নিয়ে পুড়ে যায় মহালোকের কোটি মোমবাতি
পোড়ে ও পোড়ায় তারা দূরবর্তী গ্রহের জমিন, রমণীয় কটি;
চামেলীর চোখে আমি অপরূপ শতকল্প মোমশিখা দেখি,
পৃথিবীর অনেক চামেলী তাদের কবিদের নম্রআলোয় মাখে
আর কাঁপে খুব সামান্য বাতাসে, থিরথির বুঝি দীপ্যমান
হতে গিয়ে এরাও পোড়ায় স্নিগ্ধফুল্লাঘ্রাণে অমানবীয় প্রাণে
আলো হয়ে তারাও তো মুহূর্তেই পাড়ি দেয় অসীম পরিধি
পারিজাতের মর্ম কিছু বুঝি, পরাজিত সেও তো সমাধি চায়
মর্মরের, বলে, ঊর্ধ্বমুখী ফলকের চূড়াটি দেখাও
যেখানে চড়–ইয়ের মত চঞ্চলতা একগুচ্ছ আলোকের তীরে
ভোর যে কতটা নির্মম, নরোমের কত যে মুখোশ
ছিন্নভিন্ন করে চলে যায় অজস্র পরমাণু, বেদনার রঙ বুঝি নীল!
নির্মিত হতে হতে
নির্মিত হতে হতে হাওয়া রাশি রাশি জুড়ে দেয় গান
পৃথিবীতে এত যে নির্মাণ চলে পুনর্বার ভেঙে যাবে বলে?
প্রথম দিনের সূর্য সঙ্গে করে এনেছিলো ঐ সান্ধ্যসঘন ব্যর্থতার
পড়ন্ত কৌণিক আলোয় কোটি বিশ্বে প্রস্তরের প্রস্তাবনা খসে
অত্যুজ্জ্বল তারকার লেক খসে যায় আলো হারাতে হারাতে
সেও তো বিলীন হয় অতিকায় মহাবাহু কৃষ্ণ গহ্বরে
আর সে ঊর্মিলা এসেছিল অগ্নিপ্রভ যৌবন পোড়াতে পোড়াতে
অতিদ্রুত নিভে যাবে বলে? সকল নির্মাণ শিরস্ত্রাণ খুলে রেখে
শেষবধি যেমন কবরে গিয়ে শুয়ে থাকে নিঃসঙ্গ মানুষ
এখন আগুনগোলা মানুষের দিকেই অচঞ্চল ক্রুর চোখ মেলে,
জলাশয় ভরে ফেলে মানুষ গড়েছে দ্বৈরথের ব্যর্থ জলাভূমি
স্থানুর সমস্ত ঘোরে চৈত্রের চিত্রময় দিনে বৈশাখের দুরন্ত পাখাটি
সে বুঝি কেশর ফোলানো সিংহ, উড়ন্ত কুক্কুট, স্থির ধেয়ে আসে
নির্মাণে বিস্ফারিত অতিপ্রিয় পৃথিবীর খাটে আমোদিত হতে গিয়ে
এত যে বিস্তারে ঢেকে ফেলে, বিস্ফোরিত হয়ে যাবে বলে?
বেদনার ব্যর্থ প্রস্তবনা
সহাস্য কিছু নয়, বেদনার ব্যর্থ প্রস্তাবনা ভূমিকে হাসায়
ভূমি তো সর্বংসহা অন্যমন্ত্র চায়, ঔদার্যে মেলে ধরে ভাঁজ
মুহূর্তে সুষুপ্ত বীজ বেড়ে ওঠে, দেখি কাণ্ড, বাহারী ফুলপাতা
প্রীতসম্ভাষণে বাতাসের ঝাপটি কাঁপায় ঐ কুমারী অধরে
নীলাকাশ মুখটি নামিয়ে রাখে ডগোমগো রৌদ্রতীর গাঁথে
ঐ মুখ মল্লিকার, ঐ ঠোঁট প্রাণপণ প্রতিবেশী হাস্নুহেনার
এখন দুরন্ত আর ঐকান্তিক সাহসী হতে গিয়ে সেও তো হারায়
মাটির প্রশ্রয়, ছুটে এসে যে বাতাস একান্ত প্রেমিকের মত
আলিঙ্গন করে সেও তো ব্যর্থ ঐ ভার তুলে নিতে
প্রমিত প্রেমের মাঝে যে মনোঐশ্বরিক ফটোগ্রাফ তোলা থাকে
বনভূমে সে কোন ফটোকপিয়ারে অগুনিত ছাপডা হতে থাকে
ভয়ের ভয়ার্ত মুখ, বুঝি তাই সোনারঙ রৌদ্র কিছু নয়
যদিও তা অপরিমেয় শর্করার মুদ্ধভোজ আনে, তবুও পতন
আজো প্রপিতামহের পা আমিষের সর্পিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে।
দূরত্বের কাছ থেকে ঘুরে
যখন দূরত্বের কাছ থেকে ঘুরে এসে দেখছি নিজের ঘর
পরম জ্যোতির মতো ইজ্জ্বল হলো যেন ফসফরাসজ্বলা মাছ
সবুজ সমুদ্রে, সৌরবলয়ের ভেতর গ্রহের মত উদ্ধারহীন
নির্মিত বাঁকানো রেখা ধরে প্রশ্নহীন চলেছি দুপুরে।
তাপর দ্রুত যে বিকেল হল সন্ধ্যা দূরত্বে থেকে
রাত্রির প্ররোচনাসহ বহুকাল দ্বৈতমুখ করে অনিকেত
বসে থেকে যে লাটিম উঠে গেল শেষাবধি ঘুরছে ঠিকই;
ভাবি সামান্য কাত হলে এই প্লানেটোরিয়াম থেকে নেমে যাব
কৃত্রিম আকাশে আর কত ভাল লাগে, এখন রুদ্ধশ্বাস
ছুটতে ছুটতে গিয়ে ঐ প্রেমজ্যোতিকেন্দ্র হতে দূরে
নিজের প্রজ্ঞা থেকে নয় আলোর কেশরে ঝুলে এত গর্ব হল
এত আলো দৃষ্টি ঝাপসা করে দেয়, তাই ভাবি
নিজঘরে ফিরে গিয়ে নিজস্ব আঁধার মুড়ে শ্রান্ত ঘুমাবো
আর ঐ বেদনার্ত গ্রহের বদনখানি ব্যথিত ঝুলাবো।
অবজ্ঞার জল ঠেলে
একান্ত দিনের বজরা অবজ্ঞার জল মেপে আঁধার ডিঙ্গায়
সে সব রাত্তিরের কথা ভেবে ভেবে এ রাত্রি শূন্য হয়ে এলে
যে সব নৌকা নেয়নি আমাকে কান্নার নদী ঠেলে ঠেলে
অবশেষে তারাতো এগোল, স্মৃতিব্যঞ্জনার ভেতর নিরূপায় যায়।
সহাস্য মুখ নিয়ে আলোকবর্তিকা ওরা, শিখা ওরা, চলে গেছে
অত্যন্ত নিকট থেকে বাস্তবিক দূরে চাঁদ, তবু সে ভূতুড়ে
জ্যোৎস্না থেকে অপার নির্যাস, কৌতুকাবহ, অকারণ ঝরে পড়ে।
প্রজ্ঞাহেতু বনভূমে অবিরল বসন্তনির্বাণ আজো নির্বাপণ
করে চলে অচঞ্চল হৃদয়ের তুষ, সে তপ্ত আগুনের আঁচে
অনেক দুঃখনিঙড়ানো মুখ বরফচরিত, দ্রুত চিহ্নহীন হলে
মানুষই কেবল পারে তীরবর্তী নদীদের চোখকে ভেজাতে
ভেতরে তাণ্ডবহীন, তন্দ্রাহীন জলে ঢেউয়ে শোকাতুর ঋণ
যে নৌকা একান্ত কাছে এসেছিল, সেও ছেড়ে গেছে ঘাট।
সন্ধ্যার কাফে, বকপূর্ণ ঝিল
প্রতিকাহিনী বিপুল, জলাধারে খেলে স্মৃতিমাছ
অল্প পেয়ে নাচে দুধে ভ্রান্তির সীমানা গাঁথে গাছ,
রাখালের দূতী মাঠে যে দিগন্ত আকাশে আঘ্রাণ
স্নায়ুকোষে চমকিত পল্লবিত গল্প পায় প্রাণ।
অপঙক্তির কাকে নিয়ে বসো অপ্রতিভ বিকেলের চুলে
তার দীপ্তি হিরণ্ময় সবচেয়ে তীব্রনীল, জ্বলে,
অসামান্য ভার নিয়ে মানুষের শিল্পসাধ্য চাল
চায়ের আড়ালে এসে লুপ্ত অশেষ আকাল।
বিভিন্ন ভঙ্গির মুখ নিরাসক্ত, উৎসুক, ব্যাকুল
কেউ লুকায় হত্যানখ, কারো হাতে বিপন্ন বকুল।
শস্য সন্ধ্যা গিলে পানীয়ের প্রগাঢ় প্রস্বর
অতিনিদ্রা গাঢ় হল মিথ্যাভুক ঠোঁটের উপর।
কোলাহলে একা এরা মুখরতা মুগ্ধকরা বক
ধ্যানমৌন, নিজমঞ্চে প্রত্যেকেই প্রবল নায়ক।
বসন্ত দিনের লিরিক
হাওয়ার ভেতর খোদিত হচ্ছে গান, গানের ভেতরে তুমি
মরুনিভৃতি টাঙ্গাচ্ছে আকাশ, নীলিমার সন্ত শামিয়ানা
ধূলির কোমর ধরে কেঁদে যাচ্ছে হু হু, বহুর নির্ণিমেষ টানা
চোখে কম্পিত, মুদ্ধ আর মণিবন্ধে আটকে থাকা ভূমি।
এ হাওয়া প্রতিভা বানায় আর বুনে দেয় দীপ্ত অশ্বগুলি
পুরনো সকল প্রাণ আয়ু পেয়ে ফিরে আসে বসন্ত প্রভাতে
অতন্দ্র প্রতিভা যত চায় মুগ্ধ জড়াজড়ি, আগুন জ্বালাতে
জড়ো করে ভ্রান্ত রাশি রাশি বন উজাড় সম্ভ্রান্ত বৃক্ষাবলি।
লোহার পরীকে খুব ঘুরিয়ে গেল সংক্ষিপ্ত ফুসলানো রাতে
প্রগলভ জ্যোৎস্না নিয়ে রাত তো ফুটেছে ধুন্ধুমার দিশি
জানি কাহার প্রভাব, হতশ্চল এ বসন্ত আয়ু অবিনাশী
স্বপ্নময় বন্ধনের দিকে নিয়ে গেল ছিন্ন দিনের প্রপাতে।
ভুলভাবে পাড়ি দিই, ধ্বনিময় পাখিদের ঘুমপর্দা ছিঁড়ে
পুরনো দিনের রীতি অবিকল বসন্ত বাগানে এল ফিরে।
যে সব অঞ্চলে রেলপথ গেছে
যে সব অঞ্চলে রেলপথ গেছে সেখানে চায়ের গাছ প্রতিশ্রুতিময়,
অজস্র কাপের প্রান্তে দ্যুতিময় ঠোঁটের সংরাগ, অমর্ত্যলোক ঘুরে আসা
বৃক্ষেরা কখনো জানলো না বেড়াবার মাঠ খোলা আছে, প্রকৃতিবিরুদ্ধ
হলে উহাদের ভালো হত; বেড়ানোর এত মুক্ত প্রান্তর পৃথিবীতে আছে।
মানুষ ঘুরছে রেলে, নিজের বাড়িতে যে কখনোই চেয়ারে বসে না
রেলের চেয়ার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, দৃশ্যের টিকটে গিয়ে বসে
সেও চায় চা বাগান ঢেলে দিক সবুজ নির্যাস, অতিতরল বনের চঞ্চল
ঘ্রাণ নেবে, যে নক্ষত্রের দিকে অজস্র শিশু চা-গাছ তাকিয়ে রয়েছে;
সেখানে আজ অবলুপ্ত চায়ের বৈঠক, মহাজাগতিক অতিথিরা ঠোঁট
নামিয়েছে, ভঙ্গুর ট্রেনে সেসব অঞ্চলে যারা আজো অন্ধ ঘূর্ণমান
নশ্বর পৃথিবীর নাভিকেন্দ্রে তাদের প্রকৃত মুখ বিগলিত ঘনশ্যাম,
স্বাদু লিকারের খোঁজে লুপ্ত ভ্রমণভঙ্গি রপ্ত করে নেমে গেছে পথে
শেকড় সংলগ্ন বৃক্ষদের চোখের উপরে এদের উদাসীন ভঙ্গি নাচে
অথন মানুষ জানলো না উড্ডয়নের অজস্র পৃথিবী মহাবিশ্বে আছে।
কবিতা কোথা থেকে আসে
কবিতা কোথা থেকে আসে? নক্ষত্রজগতের যে উল্কাপাত ঘটে
সেসব জ্যোতিষ্ককণা কিছু এসে মগজে সেঁধোয়,
কবিতা সেই আলো থেকে ফোটে? নীহারিকা পূর্ণদ্যুতিময়
ঈশ্বরীর দেহদ্যুতি নিয়ে কবিতার শরীর জেগেছে।
বহুবাঁক নিয়ে সুদূরে ধাবন্ত যে নদী দিগন্তের ইঙ্গিতবাহী
প্রেরণামূলক ঢেউ কিছু কবিতায় রাখে, বনাঞ্চলে যেভাবে সবুজ
মুদ্রিত পঙক্তির ভাঁজে গুঞ্জরিত জলসুর, নাকি পাতার মর্মর?
সুদূরবর্তী সব পাহাড়ের পিঠচ্ছবি কবিতাদেয়ালে।
দুধহীন শিশুদের দীর্ঘ মলিন সারি দীর্ঘতর হতে হতে
কবিতায় যত হাড়লিকলিকে অপুষ্ট অক্ষরের আকরে
গুটিশুটি শুয়ে থাকে, আহার চাইবারও শক্তি নেই
অধোমুখী স্তবকভারে কবিতা ঐ শিশুদের অনাথআশ্রম।
একদিন অন্ধকারে নির্জন স্টিমারঘাটে একা ফেলে গিয়েছিলে
সেসব বেদনা মনে করে কষ্ট পাই, কবিতা ঐ বেদনাসঞ্জাত।