আটকে পড়া নিঃশ্বাসগুলো
♦
একটা নিঃশ্বাস আটকে গেছে রঙধনুর বর্ণশৃঙ্খলে
নিঃশ্বাসটি মুক্তির প্রতীক্ষায় ক্ষণ গুণছে আবহমানকাল হতে।
একটা নিঃশ্বাস লাল-নীল সাদা-গোলাপির রাজনীতিতে আটকে আছে বাল্যশিক্ষার প্রথম পাঠ হতে। নিঃশ্বাসটি পাঠশালার বারান্দায় ঘুরেফিরে মরে।
একটা নিঃশ্বাস থমকে আছে রং ফর্সা করার টিভি বিজ্ঞাপনে। মডেলের শ্যামা মুখে সাদা ক্রিমের প্রলেপে নিঃশ্বাসটি আছাড় খেতে থাকে ক্রমশঃ।
একটা নিঃশ্বাস সংখ্যাগুরুর পকেটে পকেটে ঘোরে।যখন তখন গুরু-লঘু গণিতের দাপটে নিঃশ্বাসটি ইটচাপা ঘাসের মতো ধড়ফড় করে ওঠে।
একটা নিঃশ্বাস আটকেছিল পুকুরের ঘাটের পেছনে আশ্রিত পাল আমলের গেরুয়াধারী নির্বাণ-সাধকের বুকের ভেতর। নিঃশ্বাস ছাড়ার শোঁ শোঁ শব্দ হলেই মাৎস্যন্যায়ের খঞ্জর খুঁজে বের করতো কণ্ঠ নালীকে।
একটা নিঃশ্বাস আটকেছিল কিন্টে কুন্টের দু’পায়ের বেড়িতে। নিঃশ্বাসটি ক্রীতদাস হয়ে মনিবের যাতনা সয়েছে ; অ্যালেক্স হ্যালিও পারেনি তার মুক্তির ত্রাতা হতে।
বিরাট এক দীর্ঘনিঃশ্বাস আটকেছিল হিটলারের হাতের তালুতে, হ্যান্ডশেকের অস্বীকৃতিতে যার মুক্তি মেলেনি আজও সুবর্ণ করতল হতে।
একটা নি:শ্বাস আটকেছিল মুষ্ঠিযোদ্ধার অনিন্দ্য প্রজাপতি নাচে; মোহাম্মদ আলীর বুকে আজও তা খাঁচায় সমাহিত হয়ে আছে।
একটা নিঃশ্বাসকে মুক্তি দিতে লড়ে গেছে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, বিশপ ডেসমন্ড টুটু। তবু নিঃশ্বাসটা আটকে আছে দীর্ঘদিন অ্যাপার্টহাইটে। মাদিবার চেষ্টাতেও সে নিঃশ্বাস মুক্তি পায়নি শ্বেত ভালুকের থাবার কবল হতে।
একটা নিঃশ্বাসকে মুক্ত করতে হাজার হাজার জনতার সামনে চেঁচিয়ে বলা হয়েছিল, ‘উই নিড অ্যা চেইঞ্জ, উই নিড অ্যা চেইঞ্জ…।’ কিন্তু সেই পরিবর্তন আজও আসেনি।
একটা নিঃশ্বাসকে মুক্তি দিতে গিয়ে মাস্টারদা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল পাহাড়তলির ইউরোপিয়ান ক্লাব যেখানে কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ ছিল। সূর্যদা ফাঁসিতে ঝুলেছে তবু সে নিঃশ্বাসটি মুক্তি পায়নি আজও।
একটা নিঃশ্বাসকে সর্বশেষ মুক্তির জন্যে জর্জ ফ্লয়েড চিৎকার করেছিল। নিঃশ্বাসটি আটকেছিল শেষ মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাঁটুর চিপায়।
এতো কিছুর পরও নিয়তির কাছে নিঃশ্বাসের মুক্তির কোন আবেদনই গ্রাহ্য হোলো না। আরও শতাব্দী ধরে ইথারে ইথারে ক্ষুধিত পাষাণের মতো প্রতিধ্বনি শোনা যাবে, ‘আই কা’ন্ট ব্রিদ্, আই কা’ন্ট ব্রিদ্, আই কা’ন্ট ব্রিদ্…’
আটকে পড়া নিঃশ্বাসগুলোর মুক্তি নেই। মুক্তি নেই! মুক্তি নেই?
সাদা রঙে বাবার মুখ
♦
যেখানে যত সাদা রং আছে তাতে আঁকা আছে বাবার মুখ
সাদারঙগুলো প্রাণবন্ত হয়ে হেসে ওঠে বাবার মতো
আকাশভরা সাদা মেঘ হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশবে
বাবা যেমন নিয়ে যেতো মাঝে মাঝে স্কুলের গণ্ডীতে
আগে আগে বাবা আর পেছনে আমি ও অনুজ সহোদর
পথে যেতে যেতে বাবার কুশল নিতো পরিচিত মুখগুলো
কেউ মামা কেউ দাদু কিংবা কেউ বাবু ডেকে
বাবার সাদা জামাতে এঁকে দিতো মমতার ঘ্রাণ
মুখে বিস্তৃত হতো অপাপ হাসি আর আত্মজদের দিকে তাকিয়ে প্রসারিত হতো বাবার সে প্রসন্নতা-
সাদা মেঘে লুকিয়ে থাকে বাবা সাদা মেঘে লুকিয়ে থাকে শৈশব।
চাঁদের সাদা জোছনার জোয়ারে বার বার বাবার অবয়ব ফুটে ওঠে
রবিবার রাতের উঠোনে বাজার ফেরৎ বাবার মমতায় আমরা পেতাম উৎসবের ঘ্রাণ
ঘুমে চোখ ঢুলু ঢুলু হলেও রবিবার রাতের আহারে ছিলো বাবা-উৎসব।
স্কুলের সাদা ইউনিফর্মে চিরকাল সাঁটা আছে বাবা
স্কুলে আমি নই বাবাই যেতো কর্মস্থলে থেকেও বিপুল উৎসাহে
যেখানে যতো সাদা শার্ট সবখানে লেগে আছে বাবার ঘ্রাণ
জন্মের পর হতে আর কোন রঙে বাবাকে দেখিনি শরীর মুড়োতে
সাদা আর বাবা অভিন্ন যমজ জন্মোত্তর যাত্রাজুড়ে।
নিদ্রিত পৃথিবীকে পকেটে রেখে রাতজাগা দিনে
সাদাখাতাগুলোতে দেখি বাবার সহাস্য মুখ
সযতনে হাতের লিপিকে ঘষেমেজে রবীন্দ্রনাথকে অনুকরণের আরাধ্য প্রয়াসে জেগে থাকে বাবা উৎসাহের নির্ঘুম টনিক হয়ে।
শচীনের ব্যাট হাসলে বাবা হাসে, হাসি আমি, হেসে উঠতো পুরো পরিবার মাঠজুড়ে সাদা পোশাকের দেবদূতগুলোকে জীবন্ত দেখে
ক্রিকেটের সেই সাদা পোশাকের ভেতর আজও আমি দেখতে পাই বাবার চিন্তিত মুখ।
যেখানে যত সাদা আছে সবখানে মিশে আছে বাবার মুখ, বাবার হাসি
সূর্যের সাদা আলো হেরে যায় বাবার মুখের কাছে
হেরে যায় সাদা বক, খইরঙা মেঘ, কর্ণফুলির তীরে জাগা সাদা কাশ
বাবা ও সাদা দুই অভিন্ন যমজ। বাবা ভেতরে ও বাইরে সাদা, সাদা শুধু বাইরেই সাদা…
বাবা মানেই সাদারাঙা জীবন।
বৃষ্টিজলসা
♦
তারাচোয়া স্রোতে আলোর চূর্ণে অবারিত নেয়ে
নগরে নেমেছে নর্তকী-হিয়া। অদেখা ঘুঙুরে
মুগ্ধ শ্রবণে মাতাল হাওয়া মেখে নবনীতা
লীলায় মূর্ত হয়ে ওঠে হেসে। মুদ্রা-মগ্ন
তনুতে দুলিয়ে কোমড় কোমল হাড়হীন দেহ
দৃষ্টিকে নিয়ে যায় ইলোরায় অমৃত-গৃহে।
রাতের ঘোরকে কব্জায় পেয়ে নর্তকী-হিয়া
নেমেছে নগরে।পিপাসার দেহে নৃত্যের ছলে
জেগে ওঠে তাল। নব জলধারা ভেজায় রুক্ষ
মন। জনপদ জুড়ে মুড়ে আছে অনুরাগে রাত
মুদ্রা বিনয়ে। মোহনীয় ভাষে জাদুর মায়ায়
কেউ শুয়ে,কেউ ঘুমে আর কেউ জলতরঙ্গে
আরাধ্য আড় নিয়ে করে জলে মগ্নতা লীলা।
ঘরে ফিরে যেতে ব্যাকুলিত প্রাণ খোঁজে অবসর
পল ফুরসতে নাচের জলসা ছেড়ে অবশেষে
নিজগৃহে থিতু হয় পরিযায়ী পুলকিত মন।
আমার জন্মগ্রাম
♦
আমার জন্মগ্রাম আমি পকেটে নিয়ে ঘুরি
যেখানেই যাই প্রতিটা যাত্রায় সে সাথী হয়
মনে হয় সে আমার আজন্ম দেহরক্ষী
যে কোন বিপদে আমায় আগলায় মায়ের মমতায়।
আমার জন্মগ্রাম আমি স্মৃতিতে নিয়ে ঘুরি
দূর পরবাসে অজানা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে
আমি আমার জন্মগ্রামের কৈশোরের ছবি আঁকি
তখনও কর্ণফুলির রোষরাঙা চোখ তাকে ভষ্ম করেনি।
আমার জন্মগ্রাম আমি আমার প্রতিটা পংক্তির ভেতরে আঁকি
যেমনটা এঁকে চলি কবিতার গতিপথ নিশ্চল রাজপথে
যেখানে বায়ান্নের রক্তস্রোতে নদী ছুটেছিল সাগরে
আমার জন্মগ্রামের ছবি আমি আঁকি শহীদ মিনারে।
আমার জন্মগ্রাম আমি দেখি উড়ে যাওয়া পাখির ঠোঁটে
জলপাই ডালের মতো শান্তির বারতা নিয়ে
আমার জন্মগ্রাম আন্তঃমহাদেশীয় দূত হয়ে
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে অবলুপ্ত করে কালের জঠরে।
প্রতিটা দিনই বোধিদ্রুম
♦
গৃহবন্দি প্রতিটা দিন এক একটি স্বতন্ত্র বোধিদ্রুম
যার কোলে ধ্যানে বসে জাতিস্মর জ্ঞানের মতো
মনে পড়ে বন্দিপূর্ব জীবনের খুঁটিনাটি কথা
গৃহবন্দি প্রতিটা সময় বোধির ফলিত রূপ।
দেহকে শেকলে বেঁধে মনকেও বেঁধে রাখা দুরূহ
যেমন দুরূহ গৃহে নিদ্রা ও আহার ব্যতীত
নিশ্চল পড়ে থাকা- গ্রন্থাগারের গ্রন্থের মতো
তবু বাইরে যাওয়ার প্রলোভনে সসৈন্য মারকে
ধ্যানের প্রজ্ঞায় পরাস্ত করাই আজ আলোকন
গৃহবন্দি দিন তাই বোধিসত্বের পারমী-জীবন।
দুচোখের ছোট পটে আকাশের বনসাই এঁকে
ঘরে বসে পালাবদল হয় সৌরজগতের
তারপর কোভিড ঊনিশ এর গবেষণায়
পার হয় অলস দুপুর চঞ্চল সন্ধ্যে
এতেই আত্মস্থ হয় চার আর্যসত্য-
গৃহবন্দি প্রতিটা দিন বস্তুত অভিজ্ঞান
যার আশ্রয়ে মনের ধ্যানে আসে আলোকন
গৃহাবাসই উত্তম অনাগার সঙ্গনিরোধকালে
আজকের প্রতিটা দিন অনন্য বোধিদ্রুম আগামীর কাছে।
বোধোদয়
♦
পেটে নিদারুণ ক্ষুধা। তারচেয়েও মনের
ক্ষতের বোধ অধিক। হাতে গড়া কারাগারে
আত্মগ্লানিতে রাজা বিম্বিসার বন্দী।
চেয়ারের ক্ষমতায় সবার লোভ। পিতাকে
কয়েদ করে পুত্র নিজেই সিংহাসনে
আপনমনে কালের ডিঙি বেয়ে মহারাজ
ছোট্ট এক শিশুর মুখে খুশির ফোয়ারা
ছোটায়। রাতুল দু’পা,কোমল সে চাঁদমুখ
মহিষীর কোল ছেড়ে পেয়েছে রাজার বাহু
বিম্বিসার ঝাপসা চোখের জলে হারায়
অতীত সম্প্রচার,ফিরে আসে কারাগারে।
প্রতিদিন মহিষীর দেহমাখা মধু চেটে
বাঘ হতে বিড়ালের তারপর মুষিকের
দেহধারী মগধের নৃপতি বিম্বিসার
তবুও মনের পোড়া ক্ষতে পৌঁছেনি জীবাণু
এখনও রাঙামুখ, মায়ামাখা চাহনির
সে আত্মজকে মনে মনে সিক্ত করেন
পিতার অপার স্নেহে মনোমায়া সরোবরে।
সেদিনের পৃথিবীতে জ্বলেওনি কোন আলো
আঁধার কারায় বসে রাজন বিম্বিসার
শীর্ণমুখ তবুও প্রজ্ঞার আলোকের দীপ্তিতে
রাজার সুবাস। নিজ পৌত্রের জন্ম অভিষেকে
মনখানি টলোমল খুশিতে ও শঙ্কার দ্বৈরথে।
মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পুত্রের দূত আসে বন্দীর কারাগারে।
ক্ষীণ এক আর্তনাদ মাটির বুক চিরে
ছেড়ে যায় ইহলোক। মূর্ছিত মহীয়সী অনধীর
প্রতীক্ষায় থাকেন পরকালে মিলনের।
রাতের গভীর হয়, আঁধারে জোনাক ফোটে
প্রাসাদের দেউলের ছাঁচে জ্বলে ঘৃতদীপ
চারদিক আলোময় তবুও অন্তঃপুরে আলোহীন
নবজাতকের কান্নায় পুলকিত অজাতশত্রু
পদ্মের ঘ্রাণমাখা ধূপের সুরভি আর অমূল্য
অলঙ্কারের যত দীপ্তি মুহূর্তেই ম্লান তার
আনন্দের অতল আলোকনে। ছুটে যায় অনধীর
পায়ে অন্তঃকারায় যেখানে বিম্বিসার হতাশার
অন্ধকারে গুনছে চির মুক্তির দিন। উদয়ের
উদয়নে নবজাত পিতা অজাতশত্রু মনে মনে
করুণায় সমুদ্র হয়ে ওঠে। নিজের জন্মে তার
পিতার খুশির জোয়ারের ধারা অনূদিত হয় শিশু আত্মজ দর্শনে।
সময় থাকে না থেমে। নিয়তিও
করে না করুণা। পুত্রের জন্ম পিতার সকরুণ
বিয়োগে আশীর্বাদ এবং অভিশাপের আঁধারি ও আলোর খেলা।
নিথর পিতার পায়ে অজাতশত্রুর
প্রাণ গড়িয়ে লুটায় পরিতাপে।পুত্রের জন্মের
শুভ বারতায় জেলে সকল গারদ চেয়ে চেয়ে হাসে
উপহাসে। অসভ্য আঁধারের অশোভন অতিহাসি
অসহ্য হয়ে ওঠে।রাত কেটে আলো আসে অহনায়
দুঃখে হন্তারক বিলয় করে সকল কারাগার
জেলহীন মগধের দিকে দিকে সাড়া পড়ে। সন্তাপে
মগধের কারাহীন রাজা,পিতা নিহত বিম্বিসার।
ইলিশি এলিজি
♦
অতল সমুদ্রজলে নুনের নহর
রূপালি নধর দেহে লাবণ্য অতুল
আপন রূপের দোষে প্রজন্ম-প্রদোষ
জোছনা হারায় রূপ বিপদ সঙ্কুল
যৌবন অধীর তাই নদীর গভীর
ইলিশ বিরাজ করে মায়ের মায়ায়
নিষাদ জেলের জালে ঘাতকী উল্লাস
নিমেষে নিহত হয় রূপালি সোনায়।
লকলকে রসনায় রোজের যোগান
কিশোর ইলিশ আর মায়ের শরীর
ধীবর-নিষাদজালে জীবনের দীপ
নির্বাপিত নিশিদিন জনম স্থবির
হাজার বছরে হোক ঐতিহ্যের প্রাণ
মেঘনার জনপদ ইলিশ নিবিড়।
নদীগুলো পিতার কফিন
♦
এদেশের নদীগুলো আগে এতো রক্ত বহন করতো না বুকে
তাদের জলপ্রবাহ ছিলো স্বচ্ছ ঢেউয়ে ছিল স্বস্তি মাখা
তারা বাংলাদেশের মানচিত্রকে ধুয়েমুছে সাফ করে রাখতো প্রতিদিন
আগে তারা নদী ছিল পালতোলা নৌকা নিয়ে বয়ে যেত শোভাযাত্রায়
এদেশের নদীগুলো বঙ্গবন্ধুর মমতা নিয়ে সাগরে ছুটে যেত সম্মিলিত সংঘে।
আজকাল নদীগুলোতে কেবল রক্তের স্রোত, অশ্রুর ধারা
নদীগুলো আজ গতিহারা পথিকের মতো গন্তব্যহীন
নদীর ঊর্মিতে আজ কলনাদ নয় গুমরে ওঠে বিলাপের ধ্বনি
পিতাহারা দুহিতার বেদনার ভারে নদীগুলো হারিয়েছে নাব্যতা
নদীগুলো নদী নেই শোকের পাথর হয়ে কাতর হয়ে আছে ঠায়।
নদী ছিল জনকের মিতা নদী ছিল নেতার আশৈশব সখা
নদী ছিল পিতার যমজের মতো বেগবান সহোদর সৌহার্দ্যে
এ নদীর জলে ছিলো জনকের ঘাম, সাঁতার উদ্দাম, স্বপ্ন অতল
নদীছিলো জননীর জরায়ু যার ভেতর ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে
খোকার দুরন্ত শৈশব রুগ্ন কৈশোর আর কর্মমুখর যৌবন।
নদীগুলো আগে ছিলো জনকের ছায়া, মাঝরাতে নৌকায় ঘুমের বিছানা
নদী ছিলো খোকাটার নির্বাচনী বৈতরণীর অমোঘ প্রতীক
এদেশের নদীগুলোর আগে ছিলো সুরের ধারা প্রাণের প্রহর
কারণ তখন নদীগুলো মুজিবের স্নেহ পেতো, পেতো খুনসুঁটি
নদীগুলো শুনে যেত জনকের মুখে নৌকায় আব্বাসউদ্দীনের গানের তারিফ।
নদীগুলো আজ আর নদী নেই নদী নেই নদী নেই
নদী আজ বধ্যভূমি নদী আজ হায়েনার ক্রীতদাস
নদী আজ খেলে শুধু রক্তের হোলি পুরো বারো মাস
নদীগুলো আগে নদী ছিল নদী আজ রক্তের বান
পনর আগস্ট হতে এদেশের নদীগুলো পিতার কফিন।
মানচিত্রজুড়ে রক্ত
♦
এককালে পৃথিবীর কোলজুড়ে পুরুষ নামে বীর ছিলো
সংকট-সংক্ষোভে পথে নেমে তারা প্রতিবাদমুখর হতো
নিজেদের বুকের রক্তে তারা রক্ষা করতো মায়ের সম্ভ্রম
বোনের ঐশ্বর্য পবিত্র রাখতে পেতে দিতো চওড়া বুক
মেয়ের লাজ বাঁচাতেই হাতে নিতো সৎ সাহসের লাঠি।
এককালে বাঙালির পুরুষেরা আরাধ্য ছিলো ধরণীর
তাদের বীরত্বে মায়ের মুখে ফুটে উঠতো গর্বের শতদল
বধুদের মুখে নেমে আসতো পুর্ণিমার জোছনার প্লাবন
বোনেরা বরণডালা নিয়ে বীর ভাইদের বরণে ধন্য হতো
মেয়েরা বাবার বীরত্বে নিজেরা হয়ে উঠতো বিজয়িনী।
একদিন এ বঙ্গের পুরুষেরাও ছিল রিপুজয়ী সব্যসাচী
তাদের তলোয়ারের ধারে ঝিলিক দিয়ে উঠতো সত্য
মায়ের পদছোঁয়া অমৃত জলে বীরেরা মেটাতো পিপাসা
পুরুষের পাশে দিনের পর দিন বোনেরাও করেছে যুদ্ধ
বধুরা আঁচলে পরম মমতায় মুছে দিতো সংগ্রামী ঘাম।
আজকাল বাংলার পুরুষেরা মরে সব ভূত হয়ে গেছে
একদল বিবর্তিত পশুর ভিড়ে মরদের সিংহরা বিলুপ্ত
মায়ের জন্মগলিতে পশুদের লালায় জ্বলে ওঠে আগুন
বোনের ঐশ্বর্যে নবরূপী শ্বাপদের নখরে তাণ্ডবে-লাস
বঙ্গজননীর বিলাপের জল আর মোছে না বীরপুত্ররা।
চোখের জলে আজ জ্বলছে নোয়াখালি সুধারাম
জ্বলে তুষ হয়ে আছে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস
এমনি করেই আজ অভিশাপ নেমে এসেছে দীর্ঘতমার
পুরোদেশ ভরে গেছে অহল্যায় পুরো গ্রাম-শহরে শ্বাপদ
ধর্ষিতা বাংলাদেশ লাজে মাথা নুয়েছে পৃথিবীর সামনে
বীরের দেশের মানচিত্রজুড়ে আজ শুধু রক্ত আর রক্ত!
বিষাদেরা
♦
পরিযায়ী মেঘে ডাকে পাহাড়ের ফাঁকে
ওইখানে গোধূলিতে রাঙা ছবি আঁকে
জোয়ারের কলনাদে ডেকে চলে নদী
তার সাথে মোহনায় কেউ যেত যদি!
নীড়ে ফেরা পাখিদের পিছু নিয়ে হাওয়া
ক্রীড়ামোদে মেতে ওঠে মিছে করে ধাওয়া
আকাশের নীলে মাখা বড় দীঘিখানি
মাছেদের দলে মিলে করে কানাকানি।
ছায়া আঁকা গাছগুলো মোড়ামুড়ি করে
ফড়িঙের পাখা লাগে হলুদের খড়ে
সাঁঝে ফোটা ঘ্রাণে প্রাণ মাতায় মালতী
আঁধারের রূপে আসে যেন শ্যামা সতী।
মাঠে মাঠে ছিলো যারা জীবিকার দায়ে
সাঁঝবেলা আসে ফিরে নিজ নিজ গাঁয়ে
আকাশের কপালে সে ওঠে চাঁদা দীপ
ধূলি হতে লাগে তারে আলোকের দ্বীপ।
দিনশেষে চলে যায় পরিযায়ী মেঘে
বিকেলের ম্লানালোকে মনের আবেগে
মেঘেদের যাযাবরী জীবনের জের
মনে বাজে বিষাদেরা মৃদু মেজাজের।