আজ সত্তর দশকের খ্যাতিমান কবি মাহমুদ কামাল এর ৬৪তম জন্মদিন। জীবনের এই বর্ণাঢ্য উদযাপনকে স্মরণীয় করতে আজ তার ১০টি বাছাই করা কবিতা প্রকাশ করা হলো। সেই সাথে আড্ডাপত্র’র পক্ষ থেকে জানাই ফুলেল শুভেচ্ছা।
সঞ্চয় ভেঙে চলি
প্রকাশ্যে নয় কানে কানে কথা বলি
বয়স বেড়েছে সঞ্চয় ভেঙে চলি।
প্রিয় প্রতিভাসে আয়নায় সেই মুখ
প্রতিনিয়তই প্রতিরোধ সম্মুখ।
মুহূর্তমায় বিয়োগে বিয়োগে দিন
কখনো বিষাদ কখনোবা রঙ্গিন।
পাশ ফিরতেই কেটে যায় একবেলা
আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে রাখি অবহেলা।
যত মত তত পথ ভুল করে করে
অতিরেক প্রীতি চেঁচায় সমস্বরে।
জীবনের কাছে প্রশ্ন করেছি, তাই
বেড়াতে এসেছি এইবার ফিরে যাই।
প্রকাশ্যে নয় কানে কানে তাই বলি
বয়স বেড়েছে সঞ্চয় ভেঙে চলি।
প্রকাশে অক্ষত
গোপনে সারিয়ে ফেলি ক্ষত
আমি তাই প্রকাশে অক্ষত!
মুখোশের আড়ালেই লোকটির মুখ
সাবধান ভূষণের মাঝে পাড়ি দিচ্ছে পেছন-সম্মুখ
পরিস্ফুটনে ঐ লোকটিই আমি
প্রকাশিত আপোষকামী
দ্রুতবেগে ধরে ফেলি সুতো
যদি হয় প্রচল প্রসূত
এটা কোনও গল্প নয় সত্যিও নয়
মুখোশের ভেতরে নির্ভয়
খেলা করে আনন্দ শীৎকার
আসলে চিৎকার
শরীরে ময়লা জমে দাগ গোপনীয়
প্লাবিত জোছনার কথা তাদের শুনিয়ো
গোপনে সারিয়ে ফেলি যাবতীয় ক্ষত
আমি তাই প্রতিদিন প্রকাশে অক্ষত!
যাবো না তবু যাই
স্পষ্ট করে বলে দিতে পারি
যাবো না সেখানে!
তবু যাচ্ছি অবিরত প্রতিযোগী হয়ে
অস্পষ্ট ভাবেই দ্রুত এই যাওয়া আসা
লুকিয়ে লুকিয়ে খুব …
আমি এর নাম দিই শ্লেষ-বাস্তবতা
সবাইতো যাচ্ছে বেশ কেউ কেউ নিমপাতা হয়ে
অশত্থের পাতাও বদলে মুথাঘাস হয়ে
বিবর্ণ বিষণ্ন তবু দৃঢ় তার উড়ে চলা
স্পষ্ট করে বলে দিতে পারি
যাবো না, যাবো না!
পেছনে তাকাই আর খুব দ্রুত দৌড়ে যাই
সময়কে হারাতে হারাতে নতুন সময়
আমাদের এ ভাবেই পরাভূত করে।
ছন্দ
ছন্দ আমাকে দেখিয়েছে আলো-পথ
পথের মধ্যে ছিল না পাথরকুচি
খোলা দরোজায় ছিল না নিষেধ রেখা
একজীবনেই জেগে ওঠে স্বকীয়তা।
ছন্দ আমাকে নিয়মের মাঝে রেখে
জানিয়ে দিয়েছে এভাবেই শুচি রতি
ছোট এ জীবনে কেন যে হুলস্থুল!
অনতিক্রান্ত বৃত্তের মাঝে থেকে।
ছন্দ আমাকে ঢেউ হয়ে কাছে ডাকে
মিথুন মুদ্রায় চলমান ছবিগুলো
রক্তে রক্তে স্রোতনদী হয়ে ওঠে
তালশাঁস কাঁপে মাত্রাবৃত্তব্যাপে।
সামগ্রিকতা
চোখের চুম্বকে আটকে আছে নদী
সেই সাথে উদ্দীপিত ঢেউ
সব নিয়ে একটি শরীর
ততোধিক, ততোধিক…
উপমারহিত বলে
সৌন্দর্যের অনুষঙ্গ হোঁচট খেয়েছে।
লাবণ্য, সুষমা এই সমার্থক যতো
কোমলতা যতোই মাধুরী
ততোই উপরে ওঠে ওই চারুশীল
এই নদী বয়ে চলে চোখের চুম্বকে
এই নদী নিরন্তর সামগ্রিকতায়।
উপুড় হওয়া নদী
একটি শিশিরবিন্দু উপুড় হওয়া নদীটিকে প্রশ্ন করে
হে নদীমাতৃক দেশে জননী আমার
তুমি কি কাঁদছো?
এই প্রশ্নে নদীর কান্নার ধ্বনি
দ্রুত বেড়ে ওঠে
না– কোনও স্রোতধ্বনি নয়, প্রবহমানতা নয়
আনন্দ শীৎকার নয়
নদীটি কাঁদছে খুব পড়ন্ত বিকেলে
তার বুকে জল নেই কেন?
রূপকথা
শিশু ও কিশোরের পাঠ্যসূচিতে রূপকথা নেই
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী কিংবা ঈশপের গল্প
একুশ শতকের শিশুরা ছুঁয়েও দেখে না।
রূপকথা আজকাল বড়দের জন্য
এখন প্রতিনিয়ত রূপকথা তৈরি করছেন
রাজনীতিবিদগণ।
মুখোশের ভেতরে মুখোশ
বদলে যেতে যেতে স্বকীয়তা খুন হয় রাতে
দিনের আলোয় ফিরে আসে পুরনো আঙ্গিক
তুমি এরকমই, তিনিও, সেও, এবং
আমিও কি?
আমারও কি মুখোশের ভেতরে মুখোশ?
আমি সারাদিন আমি
আমি সারারাত আমি
তাহলে লখিন্দরকে সাপে কাটে কেন?
অনন্তের কবি
বিপাকে পড়েছে নদী ঋতুমতি নারীটিকে নিয়ে
যুবতী মধুর ঢেউ নদীটির সাথে মিশে গিয়ে
নদী-স্রোত হারিয়েছে দুর্নিবার তার দ্রুত গতি
জেগেছে লাবণ্যলতা অনুপম মধুময় রতি
ওই বুকে দেহ মেলে কথা বলে নদী কল্লোলিনী
দুলে ওঠে নদীর শয্যায় সাপ নয় তার দুই বেণী।
দেহের সান্নিধ্যে অনুপরমাণু শক্তি হয়ে ওঠে
শক্তির শকটে চড়ে যে ধ্বনি বিবৃত ঠোঁটে
প্রিয় ধ্বনি শিল্পময় অবসাদ অথবা খোয়ারি
ভেঙে নদী বলে ওঠে ওকে নিয়ে পথ দেব পাড়ি
নদীকে ধারণ করে নারী যেন অভিভূত ছবি
নারীর বিদ্যুল্লতায় নদী হলো অনন্তের কবি।
ঘামের মরশুমে উদ্ভাসিত তুমি
এলুমিনিয়ামের শরীরী অবয়বে উদ্ভাসিত তুমি
চোখের চুম্বকে ছন্দ সমীরণে চম্পূ জাগতিক
দরদি তরজমা তরঙ্গিনী হয় আনাজ তম্বুরা
চুড়ির ঘর্ষণে মন্দাকিনী ছোটে ঘামের মরশুমে
হৃদয় মন্থনে তখন ভূইচাঁপা উদ্ভাসিত হেমে
বিস্ফারিত চোখ বধূর মাঝে করে প্রেমিকা সন্ধান।