আড্ডাপত্র

১৪ মাঘ, ১৪৩১; ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫;সকাল ৯:৩৩

জন্মদিনে মুহাম্মদ ফরিদ হাসান এর দশ কবিতা

আড্ডাপত্র

আজ কবি মুহাম্মদ ফরিদ হাসান এর জন্মদিন। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে যারা অগ্রগণ্য ফরিদ তাদের অন্যতম। কী কবিতায় কী গল্পে কী গবেষণায় ফরিদ অগ্রগামী। সম্পাদনায়ও ইতোমধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। জন্ম১৯৯২ সালে, চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলায়। জাতীয় প্রায় সব দৈনিকে তিনি নিয়মিত কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ লিখে আসছেন। এ পর্যন্ত বিভিন্ন দৈনিক ও ম্যাগাজিনে তার দুশতাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত গ্রন্থ ১৭টি। লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনা করছেন গল্পের কাগজ ‘বাঁক’ এবং লিটলম্যাগ ‘মৃত্তিকা’। সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘দেশজ জাতীয় পা-ুলিপি পুরস্কার-২০১৭’ ও ‘চাঁদপুর সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার-২০১৪’ লাভ করেন।

তার জন্মদিনকে বর্ণাঢ্য করার জন্য আড্ডাপত্র প্রকাশ করেছে তার নির্বাচিত দশটি কবিতা। পাঠের আমন্ত্রণ।

মিথ্যুক আবশ্যক

বিধিমোতাবেক একজন মিথ্যুক নিয়োগ করা হবে
বেজন্মার মতো যার কথা হবে জন্মপরিচয়হীন
যে নিয়ম করে অসংখ্য মিথ্যা বলবে রোজ রোজ
ছাই দেবে বিনম্র লোকের মুখে মুখে
মিথ্যের ভেলকিতে পাড়া মাৎ হবে
কুপোকাৎ হবে ভদ্র-সুধিজন,
শুয়োরের বাচ্চাতুল্য এমন একজন
খাঁটি মিথ্যুক জরুরি ভিত্তিতে আবশ্যক।

আগ্রহী মিথ্যুকগণ আবেদন করুন কুৎসিত ছবিসহ
খুব দ্রুত করুন, সময় যে খুব কম
বেতন নিয়ে ভাববেন না একদম
বিশ-ত্রিশ-চল্লিশ, হীরে-মুক্তো-মানিক যা প্রয়োজন
বাড়ি-গাড়ি মদ-বেশ্যা যার যা প্রয়োজন অকাতরে দেবো
বিনিময়ে আমি কেবল একজন জাতমিথ্যুক চাই
বেজন্মার মতো যার কথা হবে জন্মপরিচয়হীন…

মুখ

মূলত আমি একা নই
অবিকল আমার মতো দেখতে
আমার কণ্ঠস্বর, হাসি-কান্নার রঙে
পৃথিবীর অসংখ্য প্রান্ত জুড়ে ঘুরে বেড়ায়
আরো অসংখ্য মানুষ।

আমি এখানে কবিতা লিখি
অ্যামাজনের গহীনে যে থাকে
আদিম জীবন আর শ্বাপদ স্পর্শে
তার সাথে আমার মুখ, চোখ-চুল
মিলে যায় হুবহু জমজের মতো।

অথবা একদিন পিরামিডের ভেতরে থাকা
জংধরা মমির মুখ আচমকা
আমাকে দেখে হেসে উঠে
জড়াতে চেয়েছে নিবিড় আলিঙ্গনে-
আমি নাকি তারই ভাই-তুতেনখামেন!

আমার মুখ নিয়ে চলে গেছে সহস্রজন
গতকালও ফিরেছি সৃষ্টির আদি-নক্ষত্রে
উদ্ভ্রান্ত আমি ঘুরেছি প্রান্তরে
জেনেছি খেয়ে গেছে গন্ধম আমারই মতো কেউ!

আমি আমার সবগুলো মুখ ফেরত চাই
অতিক্রান্ত দিন ও রাত ফেরত চাই
অথচ তখনো দেখি অসংখ্য মানুষ
হুবহু আমারই মুখের মতো, হেঁটে যাচ্ছে
আদি থেকে অনন্তে…হেঁটে যাচ্ছে…

কাছের বাঁশি

সমুদ্র কাছে এলে
আঁচল কেন দূরে রাখো মেয়ে
কী অত ভয়
কী বিস্ময়
ফেরি করে ফেরো অচেনা বন্দরে?

আমি তো প্রাচীন রাখাল
বাঁশি ফেলে দূরে
বেজে যাই তীব্র একা
প্রতিরাতে না-ফেরা ঘরে!

আমাকে কাছে রাখো চুড়ি, কপালের টিপ
অলসদুপুর রাখো, জলেভাসা দীপ
রাখো স্পর্শ-অনন্ত মদিরায়
রাখো আকণ্ঠ ডুবে যেতে যেতে
অতল গহীনে…

সমুদ্র কাছে এলে
ফিরে এসো মেয়ে, অনন্ত দহন রেখে…

বিলুপ্ত পুরুষ

একটি পাতার ওপর দাঁড়ালেই
ঘোর বৃষ্টি নামে সুঠাম শরীরে
ঝুম শব্দে কাঁপে নদী
দিগন্ত গিলে নেয় শ্বাস
জেগে ওঠে হন্তারক চোখ
হাঁটে লক্ষ্যহীন, উন্মত্ত ক্ষীপ্রতায়-
চারদিকে জমে আমারই মৃতদেহ!

যুগান্তর ডাক দিলে
একটি পাতার ওপর দাঁড়াতেই
প্রতিটি যুদ্ধ থামে
প্রতিটি নারী তখন ফলবতী
সংসারে-প্রতিটি সন্তান দুধে ও ভাতে!

আমি এক বিলুপ্ত পুরুষ
খুন করি নিজেরই শরীর
যুগান্তর-প্রতীক্ষায়…

এলোমেলো

মনে করো কেউ তোমাকে ডাকেনি,
অথচ তুমি শুনতে পাচ্ছো অতল গান, প্রিয় কথামালা
মনে করো একদিন কোথাও হারাওনি,
হারিয়েছে কেউ একজন, খুব গোপনে-একাকী।

মনে করো, তীব্র রোদ-শুয়ে আছো
আর ঝিরঝির বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে শরীর
ভরদুপুর জলে ভাসছে চাঁদ,
তুমি ডুবে আছো আকণ্ঠ, জ্যোৎস্নায়…

মনে করো, তুমি ঠিক তুমি নও-রবীন্দ্রনাথ,
কবিতা লিখছো পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা,
অথচ একদিন হয়ে উঠছো তররু পিকাসো,
কবিতা সব ছবি…ছবিরা সব পাখি, উড়ছে…

মনে করো তুমি সূচিত্রা সেন সাদাকালো,
উত্তমকুমার কেউ নেই …
আমি ক্রমশ নায়ক, পৃথিবী ভাসছে…
মনে করো… মনে করো।

পা ফেলে এসেছি রোদের উপর

নিজেকে রেখে প্রায়ই দাঁড়িয়ে থাকি দূরে
দেহসমেত পার হলাম কত পোড়া জমি, বসন্তহীন পৃথিবী
আমি তখনও বলেছি- শান্ত হও- মৃত্যুর মতো স্থির;

আমার আত্মা আর ঝড় আঁকেনি তরুণী ঠোঁটে
হাসিমুখ ছড়িয়ে দিয়েছি উঠানে, বধির বৃষ্টিতে
আমি ঈশ্বরে রেখেছি বাজি, জীবন দাও, জীবনের নহর যায় বয়ে!

পা ফেলে এসেছি রোদের উপর, সেই যৌবন মেখে তোমার
মন তো কবেই রাখা ইসরাফিলের ফুৎকারে, ফুঁ দাও-
এবং দেখ, ধ্বংস ও পতন জলে স্নান শেষে
আত্মার বাইরে দেহ আমার, দাঁড়িয়েছে দেখ!

আলোর নামতা

আমার আলো নেই, জোনাকির মতো
আলো নেই ধার করা কুপিতে
আগুন! আগুন! বলে চিৎকার করা হলো দ্বিগ্বিদিক
সাড়া নেই, নিথর পাড়া, এ যেন দঙ্গল পাথর এক!

গভীর রাত ঘুমাতে গেলো না আলোর প্রত্যাশায়
গাছেরা চাইলো কিছু আলো জ্বালি শবমিছিলে
ফুলেরা চাইলো জ্যোৎস্না নামুক চোখে-শস্যে
তবু আমি দাঁড়িয়ে রইলাম সূর্যহীন
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম জলের ভেতর
হাতে আগুন, পানিতে ভাসছে কুপি, তেল…
দেখতে পাচ্ছি ফেরেশতারা বিলিয়ে যাচ্ছে আলো দূরে…আরো দূরে
শব্দ শুনতে পাচ্ছি মেঘের, কান্নার…

ক্রমশ ঢেউ গিলে নিচ্ছে আমার দেহ
পুড়ে যাচ্ছে আগুনের নামতা বই
নিভে যাচ্ছে এক এক করে পিদিম, রাত্রি
অতঃপর-
শতাব্দির নিক্ষ অন্ধকারে জলোচ্ছ্বাসের মতন
নেমে এলো আলোর প্লাবন

আলোয় ভেসে যাচ্ছে দেহমন, রোদ্দুর, জল…

পদচিহ্নের মাটি

কিছু নিঃশ্বাস জমা থাকুক রাতের জন্য
বন্ধক থাকুক পদচিহ্নের মাটি
আর শব্দহীন কোলাহলের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে
উঠে আসুক ভবঘুরে মাঠ, বিস্মৃত বিকেল

তবু সকাল হলেই যেন ফিরে আসে ব্যস্ত সূর্য
আল্পনা আঁকা কচি কচি পা
বাতাসে আয়েশী ওড়নার সাজে
উড়ুক ধূলিময় পাতার স্ববান্ধব কবিতা…

ওরা বলুক, ইতিহাসের বিনিদ্র রাত বলুক
চোখ ভরা জল আর দুর্জেয় হাসি নিয়ে …

কম্পিত পঙক্তিমালা

যে দোলাচালে আজন্ম দোল খাচ্ছে তোমার পৃথিবী, কম্পিত
নিঃশ্বাসের প্রগাঢ় জোছনা নিয়ে লুকিয়ে ছিলো যে যৌবনা
নদী- তুমি তাকে হত্যা করলে। চিরকালীন বাক্হীন
ছুরির প্রতিটি স্পর্শ তাকে বিদ্রুপ করে নি, গেঁথে দেয় নি
আগুনের জলছাপ; তোমার নির্লিপ্ততায় পথ দেখাতে
আসেন নি গুরু নানক, চে গুয়েভারা, হয়তো পেরিয়ে গেছে
সময়ের মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। তোমার কৃত্রিমতার আবেগী
ভাষণে রুদ্ধ দেয়াল তুলেছিলো যে মহাজন; জানতে- তোমাকে
সে-ই এনে দিতো টাইটান মালা, বাসরের গুপ্তসজ্জা।
তুমি তাকেও হত্যা করলে…

আনন্দমাঠে প্রেম খুঁজে খুঁজে যারা ঘাতক পেয়েছিলো, বিবস্ত্র
ঘাতক! চেনাব নদীর জল…বোকা রোদ্র প্রতাপ- তাদের প্রথম
উপহার…

প্রেমী! তুমি হেলেন হয়েছিলে, দেবী হও নি…

বেদনা উৎসব

ঘুম নিয়ে চলে গেছে নদী।

শূন্য হাতে অন্ধকার
জলে পায়ের শব্দ
মিছেমিছি চাঁদ আনি ঘরে
অবিরাম ভাঙে কাচ
কত পতন, মিথ্যে শহরে…

আমাকে নিয়ে গেছে নদী।

দেহভরা পোকামাকড়
খেয়ে নেয় দৃষ্টি, চোখ
দূরে কোথাও বাজে বাউল
মানুষ
কত উৎসব নামে কত দিকে
সমূহ বেদনার…

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১