আড্ডাপত্র

১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪;রাত ১১:১৮

জরিনা আখতার এর গুচ্ছকবিতা

আড্ডাপত্র ডেস্ক

অক্টো ১৯, ২০২০ | গুচ্ছ কবিতা

একটি চিল উড়ে যেতে দেখে

আকাশে একটি চিল উড়ে যেতে যেতে থমকে পড়েছিল যেখানে
সেখানে এক খণ্ড কালো মেঘ জমে ছিল বুকের জমাট অন্ধকারের মতো—
তবে কি চিলটি বেদনা-পীড়িত ছিল
আকাশ-ছোঁয়া নীল কণ্ঠে ধারণ করে যন্রণায় ছুটে বেড়াচ্ছিল দিগ্বিদিক!
তার ডানা থেকে ঝরে পড়ছিল গোধূলির গোলাপি আলো,
সন্ধ্যা নামলে চিলটি মিশে যাবে অন্ধকারে—
স্বপ্নদর্শী চিলগুলো এভাবেই হারিয়ে যায় একদিন;
মানুষেরা হারায় না—
তার আকাশ-স্পর্শী ভুলগুলো গেঁথে থাকে সমগ্র জীবনে তীরবিদ্ধ পাখির মতো,
তবু বেঁচে থাকার অদম্য বাসনা একটি নড়বড়ে সাঁকো পেরিয়ে
তাকে প্রতিদিন নিয়ে যায় এক চির হরিৎ বসতিতে —
যেখানে আকাশে এক খ্ণ্ড কালোর পাশে রয়েছে এক টুকরো আলো।

সোম ও বুধের মাঝে

সোম ও বুধের মাঝে আগে যে ফাঁক ও দূরত্ব ছিল
আজ তা ঘুচে গেছে—
মঙ্গলের জন্য আবেগ এখন নিরুদ্বেগে পরিণত হয়েছে;
আকাশ ও মাটির বিরহ-রেখা এখন নিশ্চিহ্ন হয়েছে,
মিলন-রেখার জন্যও নেই কোনো আকুলতা,
মঙ্গলের মঙ্গল-বার্তা এখন নিরামিষ—
রেঁস্তোরায় আমিষের কাটলেট আর কাঁটা চামচ
যে আনন্দ- যজ্ঞে মেত উঠতো
সে আনন্দ কোন পথে পলিয়ে গেল তার ঠিকানা নেই ;
মঙ্গল আছে, মঙ্গলের জন্য প্রতীক্ষা নেই—
সোম ও বুধের প্রতিবন্ধকতায় আজ আর ক্রোধ হয় না,
আজ আর মঙ্গলের জলতরঙ্গ বাজে না,
মঙ্গলের রিনিঝিনি আজ আর ঝড় তোলে না মনে,
নিরুত্তাপ মঙ্গল উপেক্ষিত নীরবতায় যায় আর আসে—
আজ আর তাতে কারো কিছু যায় আসে না।

অচিনপুর

হাজার দুঃখের চাষ করেছি মনের ভেতর— মুক্তো পেতে
হয়নি পাওয়া, হয়েছে তাই সরে যেতে,
আকাশ-নীলে ফাঁদ পেতেছি আকাশ-কুসুম করতে চয়ন
হাজার ফুলের পাপড়ি দিয়ে একটি মালা করতে বয়ন,
হয়নি, হয়নি তাও, কুসুম-বনে বৈরী হাওয়া
যা চেয়েছি যা দেখেছি, থাকলো সবই না-পাওয়া,
মনভুলো এক সুর বেঁধেছি, হয়নি গাওয়া
আসল সুরের খেয়ার কাছে হয়নি যাওয়া,
তোমরা দেখ বন্দরে সব যাত্রী করে ওঠা-নামা
আমার তো নেই যাওয়া-আসা, আছে কেবল থামা,
রিপু করা জীবন আমার, জোড়াতালির জীর্ণ ঘরে
একটি ভাঙা টেবিল আর একটি চেয়ার নড়বড়ে,
দেয়াল জুড়ে তিনটি ছবি— রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর শেখ মুজিবুর
এই ছবিতেই ধনী আমি, তোমরা থাকো যেখানে চাও — আমি আছি অচিনপুর ।

এক থালা সাদা ভাত

এই জন্মান্ধ জীবনেও আমি সবকিছু দেখতে পাই—
দেখি ভোরের টেবিলে এক থালা সাদা ভাত,
আনাজপাতি এখনও চুলোয়
রান্না হচ্ছে, অথবা হচ্ছে না, অথবা আদৌ রান্না হবে কিনা !
সাদা ভাত জুঁই বেলী শিউলি হয়ে সারা ঘরে সুরভি ছড়ায়—
এই জন্মান্ধ দুচোখেও আমি এইসব দেখতে পাই;
অন্ধকার গুহায় প্রথম যেদিন আলো জ্বলেছিল
সবাই কি সেদিন দেখতে পেয়েছিল!
কেউ কি ছিল না আমারই মতো জন্মান্ধ—
আলোহীন জীবনে হয়তো সে দেখেছিল অন্য কিছু
আমারই মতো নগণ্য কিছু আহার্য
বাকিদের মতো ভূরিভোজ নয়!
কী বিস্ময়করভাবে আমি তারই উত্তরসূরি হয়ে
আজও আছি এই লোকালয়ে—
এক থালা সাদা ভাতেএকটু ঝোলের প্রতীক্ষায়
প্রতিদিন ভোর হয় আমার,
এই জন্মান্ধ জীবনে আজীবন ভোর হতে থাকবে
এক থালা সাদা ভাতের প্রতীক্ষায়, আর কিছু নয়।

শব্দগুলো

তবে কি আর
আকাশ ফুঁড়ে বেরিয়ে এল
শব্দগুলো
মরচে পড়া এলোমেলো
শ্যাওলা কোথাও, কোথাও ধুলো ;
বয়সী এই শব্দগুলো কোথায় ছিল
জন্ম নিল কবে কোথায়
বাড়লো কবে, কিশোর থেকে তরুণ হলো
অর্ধশত এই জীবনে কবে কোথায় লুকিয়ে ছিল
বাহারি এই শব্দগুলো;
রঙের খেলায় গানের মেলায় রৌদ্রস্নাত শব্দগুলো
ধূসর বেলায় কেন এল
এলই যদি রাখবো কোথায়, থাকবে কোথায়—
বললে কি আর ফিরে যাবে— এতোই খেলো
অর্ধশত এই জীবনে এতকাল তো ভালোই ছিল
হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিল
শব্দগুলো!

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১