আফরোজা পারভীন
জহির রায়হান (১৯ আগস্ট ১৯৩৫- ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশি চলচ্চিত্র পরিচালক, ঔপন্যাসিক এবং গল্পকার। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার অন্তর্গত মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক লাভ করেন)।
তাঁকে স্মরণ করে একটু পিছন ফিরে তাকাতেই হয় আমাদের।
চলচ্চিত্র শিল্পের জন্ম ইউরোপে। জন্মকাল ধরা হয় ১৮৯৫ সাল। ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয় পঞ্চাশের দশকে। ব্যাপকতা পায় ষাটের দশকে। বৃটিশ শাসন থেকে অব্যাহতি পেয়ে আনন্দিত ছিলাম আমরা। সে আনন্দ ধূলিস্মাৎ হয়ে যায় রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে। আবার রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করেই এ দেশের মানুষ রুখে দাঁড়ায় শোষণের বিরুদ্ধে। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয় গণতন্ত্রের জন্য স্বতঃস্ফূর্ত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পূর্ব পাকিস্তানের শোষণের চিত্রটি বাঙালি জাতির সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর এদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে অঙ্গিকারাবদ্ধ এক নতুন প্রজন্ম আবির্ভুত হয়। এরাই ১৯৬২ সালের সামরিক শাসন জারির পর দেশব্যাপী সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। দিনে দিনে তা এগিয়ে যায় দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
ঢাকায় ‘মুখ ও মুখোশ’ নামে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সবাক ছবি নির্মাণ করেন আব্দুল জব্বার খান। এর আগে ‘দ্য লাস্ট কিস’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মিত হয়। পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় ছবি হিসেবে ‘আকাশ আর মাটি’ মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এদেশে বাণিজ্য নির্ভর উর্দু চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ঘটালেন এহতেশাম তার ‘চান্দা’ ছবির মাধ্যমে। ‘চান্দার ব্যবসায়িক সাফল্যের কারণে পরের বছর নির্মিত হলো ‘তালাশ।’ শুরু হলো উর্দু ছবির জোয়ার। পাশাপাশি আবির্ভাব ঘটলো লোক আর ঐতিহাসিক কাহিনি নির্ভর চলচ্চিত্রের।
ষাটের দশক এদেশে এক অস্থির ভাঙা-গড়ার সময়। ১৯৬৪-এর দাঙ্গা, ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু পরিবারের দেশান্তরি হওয়া, পাশাপাশি এদেশে গড়ে ওঠা মুসলমান নব্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব প্রত্যেকটিই উল্লেখযোগ্য ঘটনা। রাজনীতিতেও ছিলো অস্থিরতা। আইয়ুবের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলন, ১৯৬৪-এর দাঙ্গা আর দাঙ্গা বিরোধি উদ্যোগ। ১৯৬৬-এর ৬ দফা, এবং অবশেষে ৬৯-এ জনগণের ধুমায়িত ক্ষোভের তীব্র বিস্ফোরণ এসব কিছুর সমন্বয়ে ষাটের দশক বাঙালির জাতীয় জীবনের ইতিহাসে এক বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। এসময় চলচ্চিত্রে যাঁরা ছিলেন তাঁরাও ছিলেন সুরুচির ধারক। নাজির আহমেদ, ফতেহ লোহানী, সাদেক খান, জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সুভাষ দত্ত এরাই তখন ছিলেন চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু এসব কিংবদন্তিতুল্য মানুষের চলচ্চিত্রে উপস্থিতি সত্ত্বেও ১৯৫৬ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত নির্মিত ছবির মধ্যে অল্প কিছু ছবি ছাড়া সার্থক চলচ্চিত্র পাওয়া যায় না বললেই চলে। অন্যদিকে, ১৯৭১-এর পর যেসব ছবি নির্মিত হয়েছে সেখানেও দেখি নানা ধরনের সংস্কার, কুসংস্কার, খুন, জখম, রাহাজানি, নারী ধর্ষণ, গোয়েন্দা এডভেঞ্চার আর যৌনতা।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মতো একটা বিরাট ঘটনা এদেশে ঘটেছিলো। সংস্কৃতির স্বাধিকার আর রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে সূচিত হয়েছিলো মুক্তিযুদ্ধ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব উজ্জ্বল বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কোনো প্রচেষ্টাই তখন ছিলো না।
এই পুরোটা সময়ের মাঝে উল্লেখ করার মতো যে কয়েকটি ছবি নির্মিত হয়েছে তাঁর অনেকগুলোরই পরিচালক ছিরেন জহির রায়হান।
জহির রায়হানের যে সময়কাল সেটা বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসেরও উল্লেখযোগ্য সময়। তাঁর জন্ম ১৯৩৫ সালে। ১৯৭২-এর ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত তাঁকে আমরা পাই। আমেরিকার বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার রবার্ট অল্টম্যান এর জীবনকাল ১৯২৫-২০০৬। আর স্টানলি কুবরিক ১৯৫৫ সালে ‘কিলার কিস’, ১৯৫৬ সালে ‘দি কিলিং’ ও ১৯৫৭ সালে ‘পাথস অব গেন্ডারি’ নামের ছবি পরিচালনার মাধ্যমে হলিউডের দৃষ্টি কাড়েন। ১৯৬০ সালে ‘স্পার্টাকাস’ ছবির জন্য একাডেমি এওয়ার্ড পান। উডি এলেনের জন্ম ১৯৩৫ সালে। অর্থাৎ জহির রায়হানের জন্মের বছর। ‘এনি হল’ ও ‘ম্যানহাটনের’ মতো ছবির জন্য তিনি অমর হয়ে আছেন। তিনি ২৪ বার অস্কারের জন্য মনোনিত হয়ে ৪ বার অস্কার জিতে নেন। অন্যদিকে, এই উপমহাদেশে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ আলোড়ন তোলে ১৯৫৫ সালে। এই ছবির মাধ্যমে ভারতীয় চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র অঙ্গনে স্থান লাভ করে।
১৯৫৬ সালে জহির রায়হানের গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’ ও তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘প্রবাহ’ প্রকাশ পায়। ১৯৫৯ সালে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ ও ‘এদেশ তোমার আমার’ চলচ্চিত্র দুটির সহকারী পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে জহির রায়হানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পড়তেই তিনি চলচ্চিত্রের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই সময় ছোটগল্প লেখক হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পরে তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। কয়েক বছর সহকারী পরিচালক থাকার পর ১৯৬১ সালে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ মাত্র ১২ বছরের মধ্যে তিনি নিজেকে যুক্ত করেন ৩০টি চলচ্চিত্রের সঙ্গে। চলচ্চিত্রে স্থান করে নেন পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনিকার, সংলাপকার, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে।
তিনি নির্মাণ করেছেন বহুমাত্রিক চলচ্চিত্র। যেমন : এদেশ তোমার আমার (১৯৫৯), আধা-পরাবাস্তববাদী কখনো আসেনি (১৯৬১), মধ্যবিত্তের স্বপ্নভিত্তিক সোনার কাজল (১৯৬২), মধ্যবিত্ত বাঙালির স্বপ্ন ভাঙার বেদনা নির্ভর কাচের দেয়াল (১৯৬৩), প্রথম রঙিন ছবি সঙ্গম (১৯৬৪), প্রথম সিনেমাস্কোপ বাহানা (১৯৬৫), বেহুলা (১৯৬৬), রোমান্টিক জুলেখা (প্রযোজনা ১৯৬৬), লোককাহিনি সুয়োরাণী ও দুয়োরাণী এবং কুঁচবরণ কন্যা (প্রযোজনা ও গান রচনা ১৯৬৭), মনের মতো বউ (১৯৬৯)। অন্যদিকে, পাকিস্তানিদের শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন আর এসবের প্রতিবাদে সৃষ্ট দ্রোহ, লড়াই, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বিধৃত হয়েছে জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০), স্টপ জেনোসাইড (১৯৭১), এ স্টেট ইজ বর্ন (১৯৭১) নামীয় চলচ্চিত্রে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতির উদ্যোগে, বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম পরিষদের সহায়তায় জহির রায়হান নির্মিত ‘স্টপ জেনোসাইড’ মুক্তি পায় ১৯৭১ সালে । ঢাকায় স্টপ জেনোসাইড প্রদর্শিত হয় ১৯৭২ সালে শত্রুমুক্ত পরিবেশে।
ছবির প্রথমেই রয়েছে লেনিনের বাণী ও একটি স্থিরচিত্র। এরপরই ঢেঁকিতে ধানভানারত কিশোরী, হঠাৎ কুকুরের ঘেউ ঘেউ, গুলির শব্দ, প্রাণভয়ে উড়ন্ত কাকের চিৎকার, অসংখ্য লাশ, ভেঙে পড়ছে বার্লিনের প্রাচীর। টাইটেল, স্টপ জেনোসাইড । গণহত্যা বন্ধ কর। টেলিপ্রিন্টারে ঠকঠক : ডেট লাইন ২০ জুলাই, নিউইয়র্ক। মহিলা কণ্ঠে উচ্চারিত জাতিসংঘের মানবাধিকারের ধারা। আবার ডেটলাইন ২০ জুলাই সায়গন। ভিয়েতনামে মার্কিনি বর্বরতার সাফাই গাওয়ার নির্লজ্জ দৃশ্য। কসাই সেনাপতি কেলির ছবি। কাট টু বাংলাদেশ। আবার ২০ জুলাই, স্থান বনগাঁ সীমান্ত। ইংরেজিতে আলমগীর কবিরের ধারাবিবরণী। সেই সাথে হাজারো শরণার্থীর মিছিল। ছেলে বুড়ো নারী শিশু প্রাণভয়ে পালাচ্ছে ভিটেমাটি ছেড়ে। হত্যার দৃশ্য। শরণার্থী শিবিরে ক্লোজআপে একজন বৃদ্ধর মুখে পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত নির্যাতনের বর্ণনা। ফরিদপুরের বিনোদ-বিহারির কথা, একজন ধর্ষিতার নিঃশব্দ চাহনি, কসাই ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠে নিন্দা। এরপরই ক্যামেরার ফ্রেম জুড়ে একটি উলঙ্গ শিশুর মূত্রত্যাগের দৃশ্য-যেন পাকিস্তান রাষ্ট্র তলিয়ে যাচ্ছে এই অপবিত্র প্রবাহ ধারায়। কিন্তু পরক্ষণে জন্ম নিয়েছে নতুন দৃশ্য। গাঁয়ের পথে গাছ গাছালির আড়াল আর পাখির ডাকের মধ্য দিয়ে মালকোচা দেয়া, হাতে বন্দুক দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে একদল মুক্তিযোদ্ধা।
ছোটছবি স্টপ জেনোসাইউডকে নির্মোহভাবে বিচার করেও এর যে বৈশিষ্ট্য অগ্রাহ্য করা যায় না তা হলো, সময় এবং স্থানকে অতিক্রম করার ক্ষমতা। স্টপ জেনোসাইডের দৃশ্যাবলি এবং মানুষের নির্মম অত্যাচারের দলিল চিত্রগুলি হয়ে উঠতে পারে যে কোনো কালের এবং যে কোনো দেশের। এই বৈশিষ্ট্যটি যে কোনো শিল্পকে মহত্বের মর্যাদা দিয়ে দেয়। স্টপ জেনোসাইড সেই সাথে এক অনন্য চলচ্চিত্র তার ভাষায় এবং আঙ্গিকে।
আগেই বলেছি, ছবিটি শুরু হয়েছে লেনিনের বাণী দিয়ে। এরপর গ্রামের একটি কালো মেয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিচ্ছে, মুখে নিরুদ্বেগ সরল একটুকরো হাসি। হাসিটুকুর রেশ পুরো মিলিয়ে যায় না, সাউন্ড ট্রাকে ঢেঁকির শব্দ তখনও বেজে চলেছে। এরই মাঝে কুকুরের অমঙ্গল ডাক আর ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেটের শব্দ। কালো, অন্ধকার ফ্রেমে আর কিছুই দেখা যায় না। কুকুরের সাথে যোগ দেয় কাক। আর্তনাদের মতো ডাকে তারা, একটানা। যখন কিছু দেখা যায় তখন মনে হয়, না দেখলেই ভাল ছিলো! গণহত্যার স্টিলগুলো ভেসে ওঠে একের পর এক। রাস্তায় পড়ে থাকা একাকী লাশ, কখনও লাশের স্তুপ, পানিতে ভেসে যাওয়া গলিত মৃতদেহ, বুলেটবিদ্ধ শরীর, মাথার খুলি ফেটে বেরিয়ে যাওয়া মগজ, চোখ উপড়ানো মানুষ-সাউন্ড ট্রাকে কুকুর, কাক আর নরঘাতকের ব্রাশফায়ার। স্থিরচিত্র থেকে চলমান দৃশ্যে যাই। এক ঝলক দেখি ধসে পড়ছে বার্লিনের একটি প্রাচীন গৃহ। আবারও আবহমানতার ভেতরে স্থাপিত হয় এই ছবির মেজাজ।
স্টপ জেনোসাউড লেখাটি ভেসে ওঠে এবং ক্রমশ ছোট থেকে বড় হয়।
২০ জুলাইয়ের ডেটলাইনে টেলিপ্রিন্টারে আসা তিনটি খবরকে পর পর উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথম খবর নিউইয়র্ক জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে আসা। সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানবাধিকার বিষয়ে চমৎকার সব কথা বলা হয়েছে। পরের খবরটি ভিয়েতনামের। সায়গনের ডেটলাইন প্রচারিত স্টিল ছবির রেপোটার্জে দেখানো হচ্ছে বি-৫২ বোমারু বিমানের ধ্বংসযজ্ঞ, মার্কিনি ও তার তাঁবেদার বাহিনির অত্যাচার, শিশুর লাশ। ২০ জুলাইয়ের তৃতীয় সংবাদ বাংলাদেশের শরণার্থী মিছিল।
ফ্রেম থেকে ফ্রেমে মৃত্যু আর জীবনের সংঘাত, গণহত্যা আর মানতার দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। চলচ্চিত্রের ইমেজ গ্রন্থণে শব্দের ভূমিকা যে কতোখানি শক্তিমান হতে পারে স্টপ জেনোসাইড তার একটি বড় উদাহরণ। আমরা হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার বর্ণনা শুনি সাউন্ড ট্রাকে, ছবিতে দেখি গণহত্যার স্টিল। ইয়াহিয়া আর তার বাহিনী বার বার তৈমুর, চেঙ্গিস, হিটলার আর মুসোলিনির সমান্তরালে স্থাপিত হয়।
২২ জুলাইয়ের ডেটলাইনে ফিরে আসে টেলিপ্রিন্টার। ভিয়েতনামে যুদ্ধাপরাধে বিচারাধীন এক মার্কিন লেফটন্যান্টের পক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ওকালতির খবর আসে। এই লেফটন্যান্ট ভিয়েতনামের একটি গ্রামে অসহায় নারী পুরুষকে হত্যা করেছিলো। ভিয়েতনামের গণহত্যার স্টিল থেকে কাট করে আমরা চলে আসি বাংলাদেশে। দেখি বুড়িগঙ্গার তীর, অজানা গ্রাম, পুড়ে যাওয়া জনপদ, লাশের মিছিল, ফিরে আসে কাকের আর্তনাদ। ছবিটি প্রশ্ন করে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের চেতনাকে প্রশ্ন করে, এই বাংলাদেশে, এই ভিয়েতনামে, এই মানবাধিকার লংঘনের বিচার করে হবে? জাতিসংঘের ঘোষণা তবে কি কেবলই পরিহাস?
সভ্যতা কি তবে এগিয়ে যাচ্ছে না পিছিয়ে আসছে! মানুষের উপর মানুষের এ নির্মম অত্যাচার কি প্রমাণ করে যে মধ্যযুগের সেই অন্ধকার সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি?
পর্দায় ফিরে আসে শরণার্থী মিছিল। কষ্টের দীর্ঘ দীর্ঘ পদযাত্রা। যে বৃদ্ধটি চার হাত পায়ের উপর ভর দিয়ে হেঁটে আসছিলেন তার আদলে কিসের ছবি! মৃত্যুর নাকি জীবনের?
জাতিসংঘের মানবাধিকারের মহিমাময় বাণী আবারও শুনি আমরা। আর সাথে সাথেই ফ্রেমে প্রবেশ করে সারি সারি বন্দুকের নল, গুলির একটানা শব্দ। এর মাঝে একটা দৃশ্যে একটি শিশু জলত্যাগ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। প্রতীকটি স্পষ্ট।
কিন্তু বিনা প্রতিবাদে মার খেতে বাঙালি জানে না, জানে না বিশ্বব্যাপী শোষিত মানুষেরা। ছবিটি তাই অনিবার্যভাবেই এগিয়ে গেছে প্রতিরোধের দিকে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুতি আর যুদ্ধের দিকে। ছবির এই অংশটি চমৎকার শিল্পিত। বিশেষ করে ক্যাম্পের দিকে ক্যামেরার ধীর গতিতে, প্রায় মাটির সমান উচ্চতায় এগিয়ে যাওয়া। গাছের আড়ালে আড়ালে লংশটে মুক্তিযোদ্ধাদের মিছিল। ক্যামেরা রণাঙ্গন থেকে ফিরে আসে শরণার্থী শিবিরে। সেখানে কিশোরটিকে পাই আমরা। যার সব কথা ফুড়িয়ে গেছে। ক্যামেরার দিকে অসহায় চোখ তুলে সে তাকায়। পেছনে প্রায় আউট অব ফোকাসে কখনো শরণার্থী শিবির, কখনও অসহায় নর-নারীর মুখ। এই কিশোরী সম্পর্কে বিস্তারিত জানি না আমরা। জানি না কি ট্রাজেডির সে শিকার। কিন্তু জানি এ কিশোরীর গল্প বাংলাদেশের, ভিয়েতনামের, হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের কিংবা পৃথিবীর যে কোনো দেশের, যে কোনো কালের নিপীড়িত মানুষেরই গল্প। স্টিলে ফিরে আসে ইতিহাস। ফরাসি বিপ্লবের স্কেচ থেকে হিটলারের জার্মানি কিংবা আলজিয়ার্সের রাজপথ। গণহত্যা বন্ধ করার উদাত্ত আহ্বানের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড।
স্টপ জেনোসাইড সম্পর্কে সাপ্তাহিক চিত্রালীর ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ তারিখের সম্পাদকীয়তে লেখা হয় :
মোড়কে এ ছবির পরিচিতি একটি দলিলচিত্র হিসেবে, কিন্তু ডকুমেন্টারি বা দলিলচিত্র বলতে আমরা যা বুঝি স্টপ জেনোসাইডকে তা বললে ছবির সবটুকু পরিচয় ধরা যায় না। কেনোনা প্রায়শঃ দলিল ছবি তাৎক্ষণিক বা সাময়িক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার্য । কিন্তু স্টপ জেনোসাইড এই ধারাকে ছাপিয়ে উঠেছে। এতে রয়েছে ইয়াহিয়া খানের বর্বরতার ক্রুর স্বাক্ষর । দেখানো হয়েছে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষের এক অশেষ অনির্দিষ্ট পথে যাত্রার মর্মভেদী দৃশ্য। আর এসব ছেড়ে যদি বোধের জায়গাটিতে নেমে আসি তবে মনে হবে সমগ্র মানব ইতিহাসে কালে কালে সংঘটিত নৃশংসতার এক অবয়ব যা আপনি প্রত্যক্ষ করছেন। মনে হবে, এই শতকের শেষভাগে বাংলাদেশে সংঘটিত মানব ইতিহাসের এক বিরাট ট্রাজেডির পথ ধরে আপনি ফিরে গেলেন হাজার হাজার বছর দূরে। ছবির একটি পর্যায়ে জহির বলেছেন, স্টপ ! যেন বলছেন, দাঁড়াও পথিকবর, তিষ্ট ক্ষণকাল । শিল্পী জহিরের এই আকুল আবেদন যেন মানব ইতিহাসে বিভিন্ন সময় সংঘটিত অন্যায় অত্যাচার আর নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য সেই সব বিবেকবান মানুষের প্রতিধ্বনি যারা বার বার নৃশংসতা, ক্রুরতা, হত্যা আর বর্বরতার বিরুদ্ধে মানুষকে বলে গেছেন, বাঁচাও, থামো আর ক্রুরতা নয়, বাচাও, মানুষকে বাঁচাও।
২০ মিনিটের এ ছবি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল। মানকিতায় সমৃদ্ধ এই ছবিটি বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। ছবিটি ‘সিডালক’ এবং ‘তাসখন্দ’ চলচ্চিত্র উৎসব কমিটির পুরস্কার পায় ।