আড্ডাপত্র

১৮ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১; ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪;রাত ১১:১৩

পোড়ালেই পোড়ে

আবু সাঈদ জুবেরী

আগ ২৭, ২০২০ | গল্প

‘খতম হো গিয়া?’
‘ইয়েস, ইয়োর অনার।’ সে কুর্নিশ করলো আরেক দফা।
নতুন নবারের চোখে-মুখে খুশির ছটা, বহুতখুব মেরে লাল। ‘আভি ক্যায়া চাহিয়ে তুমকো?’
সে মাথা চুলকালো। মনে মনে বললো, ‘ড্যাড, ইউ নো এভরিথিং। আপনি নিজে কথা দিয়েছিলেন। এখন দিয়ে দিলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়।’
তাকে চুপ দেখে নবাব বলে উঠলেন, ‘অনেক কিছু দিতে ইচ্ছে করে রে ব্যাটা। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি অপারগ। নগদ টাকার খুব টানাটানি। হিসাব করে দেখেছি, সাহেবদেরই দিয়ে দিতে হবে বারো লাখ পাউন্ড। কোষাগার একেবারে খালি হয়ে যাবে।’

 

দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিড়ে। শাদা মুক্তোর দীর্ঘ মালাটা গলা থেকে খুলতে লাগলেন তিনি।
পুত্রের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। বিরস গলায় সে বললো, ‘দিস ইজ নট প্রোপার জামমেন্ট, ড্যাড। আই নিড মানি।’
‘আপাতত কত টাকা হলে তোমার চলে?’
‘নট সো বিগ এমাউন্ট। ফিফটি থাউজেন্ড অনলি। ইউ আর কমিটেড টু গিভ।’ সে স্মরণ করিয়ে দিলো।
নবাবের কপালে ভাঁজ পড়লো, ‘আমি কি টাকার অংকটা বলেছিলাম?’
‘অফকোর্স।’ নবাব পুত্রের ভারি গলা, ‘ইউ সেইড মোর দ্যান ফিফটি থাউজেন্ড পাউন্ড উইল গিভ মি। দ্যান, আই ওয়ান্ট অনলি ফিফটি থাউজেন্ড।’
তাহলে হয়ে যাবে। মুক্তোর মালার শেষ প্যাঁচটা গলা থেকে খুলে ফেললেন নবাব, তারপর ছুঁড়ে দিলেন পুত্রের দিকে, ‘এই নাও। এটা বিক্রি করে তারচে’ অনেক বেশি পেয়ে যাবে।’
‘সো স্যাড ড্যাড! আই নিড ক্যাশ এমাউন্ট।’
নবাব বললেন, ‘ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এটা নিয়ে জগৎ শেঠের কাছে চলে যাও। সে-ই সব ব্যবস্থা করে দেবে।’

তার আর ইচ্ছে করলো না নতুন নবাব জং বাহাদুর মীর জাফরকে ধন্যবাদ জানাতে, কুর্নিশও না। মেজাজ খাট্টা হয়ে গেছে। শাদা মুক্তোর দীর্ঘ মালাটা আচকানের পকেটে রাখলো অনেক কষ্টে, তারপরও বেরিয়ে রইলো খানিকটা। হনহনিয়ে দরবার ত্যাগ করলো নবাবপুত্র।
বাইরে ততক্ষণে বিকেল ফুরিয়ে গেছে। লুৎফাবাগ, স্যরি। মনিবাগ থেকে ভেসে আসছিলো হাজারো ফুলের মিঠে গন্ধ। ২৯ জুন নবাব সিংহাসনে বসার দিন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নামফলক বদলে গেছে বাগানটার। এখন তার মায়ের নামেই সব।
মনিবাগ অনেক দীর্ঘ বাগিচা। মাটির মহীর এমন কোনো ফুল নেই, যা এই বাগানে দু®প্রাপ্য। প্রতিদিন বিকেলে ফুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে অনেকক্ষণ এই বাগিচায় হাঁটাহাঁটি করে সে। আজ আর সম্ভব নয়, তাড়া আছে।
সে হাতে তালি বাজালো। পর পর দুবার বাজালে কোচোয়ান ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে আসবে। অনেকখানি পথ যেতে তাকে। আল্লাহ মালুম, কাকা আবার এ সময় ঘরে থাকে কি-না।
বাড়িতেই ছিলেন মহাতপ কাকা ওরফে জগৎ শেঠ। ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শুনে তার পুরনো উমেদ, উদয় চাঁদ বাংলোঘরের বাইরে উঁকি দিলো। মীরনকে এক পলক দেখামাত্র হাঁকডাক শুরু হয়ে গেলো উদয় চাঁদের, আজ্ঞে কী সৌভাগ্য, দুয়ারে রাজপুত্র দেখছি যে!
গম্ভীর গলায় সে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার কর্তা কই?’
হাত কচলে উদয় বললো, ‘আজ্ঞে, তিনি তো বাটিতেই আছেন।’
‘কল হিম।’
হকচকিয়ে গেলো মহাতপের পুরনো উমেদ, ‘আজ্ঞে…।’
ধমকে উঠলো সে, ‘হারি আপ। কল হিম এটওয়ান্স। আই হ্যাভ লট অব ওয়ার্ক।’
উঁচু গলার কথাবার্তা শুনে মহাতপ চাঁদ রায় নিজেই বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে বন্ধু উমি চাঁদ। মীরনকে দেখে দুজনের মুখ-ভরা হাসি। মহাতপ বললেন, ‘আরে এসো, এসো। কী মনে করে বাবা…?’
‘থ্যাংক ইউ কাকা। জরুরি একটা কাজে নবাব বাহাদুর আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। তাই এলাম।’
‘কী সৌভাগ্য আমার। নবাব বাহাদুর এত্তেলা পাঠালেই পারতেন, দরবারে গিয়ে দেখা করে আসতাম। …তা কষ্ট করে তুমি যখন এসেছো বাবা, বসো। একটু জলপান যোগ হোক।’
মীরন মাথা ঝাঁকালো, ‘আজ আর বসবো না কাকা। সময় কম। … টাকা-পয়সার মামলা তো, আমি তাই নিজেই চলে এলাম।’
মহাতপ রায় চাঁদের চোখ দুটো কপালে, ‘টাকা-পয়সা? আমার কাছে তো নবাব বাহাদুরের কোনো পাওনা নাই!’
উমি চাঁদ সুযোগ পেয়ে মুখ খুললেন, ‘বরং আমরাই নবাব বাহাদুরের কাছে অনেক কিছু পাই। আজ যে এতো আনন্দ করছেন তোমার বাবা, কোত্থেকে হলো মীরন? আমি আর মহাতপ তার পেছনে ছিলাম বলেই।’
মীরন হাত ওঠালো, ‘আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিসন এনি মোর ওয়ার্ড। আই নো এভরিথিং। আমাকে এসব শোনাচ্ছেন কেনো কাকা? নবাব বাহাদুর আমাকে পাঠিয়েছেন এই মুক্তোর মালা দিয়ে। আচকানের পকেট থেকে দীর্ঘ মালাটা খুলতে খুলতে সে বললো, দেখুন তো মহাতপ কাকা, আপনার সিন্দুকে এটা রেখে কতো টাকা দিতে পারবেন।’
মহাতপ যেন আঁতকে উঠলেন, ‘সে কী! এই মালা কেনো বিক্রি করবেন নবাব বাহাদুর? এত মহামূল্যবান!’
উমি চাঁদের চোখ দুটো ছানাবড়া। ‘নতুন মাসের মাত্র দুই তারিখ আজ। ঊনত্রিশ জুলাইয়ে মসনদে বসলেন তোমার বাবা, তিন দিনও তো হয়নি। এর মধ্যে কী এমন হলো যে গলার মালা বিক্রি করে দিতে হবে?’
মহাতপ বললেন, ‘আরে উমি, মুক্তোর মালাটা তো আলিবর্দি খাঁর। লিসবন থেকে আনিয়েছিলেন নাতির জন্যে। সিরাজের গলা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া।’
উমি চাঁদ স্পষ্টভাষী মানুষ। বললেন, ‘এসব কী আর অজানা কিছু? কা- তো সব মীরনই করিয়েছে।’
এবার কথা বলার সুযোগ নিল মীরন, ‘মহাতপ কাকা, অত আলোচনার কিছু নাই। মালাটা নবাব বাহাদুরের ছিলো, এখন আমার। তিনি ইনাম হিসেবে দিয়েছেন আমাকে। আর আমি চাইছি, মালাটা বিক্রি করে ক্যাশ টাকা নিতে। …এখন বলুন, কতো টাকা দিতে পারবেন?’
মহাতপ চাঁদ রায় আমতা আমতা করতে লাগলেন, ‘এই মুক্তোর মালার দাম দেওয়ার মতো টাকা…। না, সিন্দুকে আছে বলে মনে হয় না। দেখি উদয় চাঁদ কী বলে। রাজপুত্রের আবদার তো রাখতে হবে।’
এসময় উমি চাঁদ তার কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় কিছু বুঝি বললেন। মহাতপের চেহারায় আলোর ঝাপটা লাগলো। তিনি হাঁকডাক শুরু করলেন, ‘উদয়… উদয়…।’
দরোজার আড়ালেই ছিলো উদয় চাঁদ। জোড় হাতে বললো, ‘আজ্ঞে শেঠজি, বলুন।’
মহাতপ রায় চাঁদের বংশীয় পদবী জগৎ শেঠ, বেশিরভাগ মানুষ তাকে ওই নামে চেনে। এমনকি নবাব বাহাদুরও ‘জগৎ শেঠ’ বলে ডাকেন। কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ থেকে নিয়ে গোটা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধনী পরিবারের সদস্য মহাতপ এই মুহূর্তে নবাবপুত্রকে খুশি করতে ব্যস্ত; বললেন, ‘উদয়, জলদি করো। সিন্দুক খুলো। মীরন নিজে এসেছে। মালাটা রাখতেই হবে।’
উদয় চাঁদ শেঠজির পুরনো উমেদ ও হিসাবরক্ষক। ব্যবসাপাতি থেকে নিয়ে জমিজমা-খাজনাসহ সব হিসাবই তার মুখস্ত। গম্ভীর গলায় বললো, ‘আজ্ঞে, সিন্দুকে দশ হাজারের বেশি ক্যাশ নেই। কিন্তু মালাটা তো লক্ষ টাকার।’
ধমকে উঠলেন মহাতপ, ‘বেশি কথা বলো না উদয়। দশ হাজারই নিয়ে এসো।’
গলার স^র আচমকা নরম হয়ে গেলো তার, ‘বাবা মীরন, নিজের কানেই তো শুনলে? সিন্দুকে আর ক্যাশ নেই। নবাব বাহাদুরের বখশিস পাওয়ার আশায় সিন্দুক খালি করে দিয়েছি। হা হা হা।’
মীরন কড়কড়ে গলায় জিজ্ঞেস করলো, বাকিটা কবে দিবেন?
মহাতপকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলেন না উমি চাঁদ। বললেন, ‘মাসে মাসে দশ হাজার করে নিও। তাতে মহাতপ বাঁচবে, তোমারও ক্ষতি হবে না বাবা।’
মীরন বললো, ‘দ্যাটস অ্যা গুড আইডিয়া। কিন্তু একটা চুক্তি হওয়ার দরকার কাকা। পরের মাসে যদি আপনি আর টাকা না দেন…।’
‘রাম রাম!’ কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলেন মহাতপ, ‘নবাব বাহাদুর মীর জাফর আাল খাঁর পুত্রের সঙ্গে ধোঁকাবাজি! কার ঘাড়ে কয়টা ধড় আছে?’
উমি চাঁদ বললেন, ‘তোমার মনে যদি কোনো খটকা থাকে, তাহলে তোমরা যখন বলছো, হোক। উদয়কে বলি স্ট্যাম্প আনতে।’
মহাতপ তাড়া দিলেন, ‘কই উদয়…?’
নগদ টাকার তোড়া ততক্ষণে পোঁটলায় বেঁধে এনেছে পুরনো উমেদ। সঙ্গে একখানা স্ট্যাম্প। মৃদু কণ্ঠে বললো, ‘আজ্ঞে সব তৈরি করে এনেছি। দু’পক্ষ শুধু স^াক্ষর আর টিপসই দিবেন।’
মীরনের অবাক চাউনিকে স্থায়ী হতে না দিয়ে মহাতপ বলে উঠলেন, ‘আমার দেওয়ান কাজের মানুষ। কখন কী লাগবে, এসব ওর মুখস্থ। …দেখো তো বাপু, ঠিকঠাক সব লেখা হয়েছে কি-না।’
মীরন দলিলটি পড়লো। ফারসি ভাষায় লেখা। দাপ্তরিক এ ভাষাটি তার অপছন্দ, কারণ সে কোনোমতে পড়তে পারে মাত্র। জটিল বাক্য লিখলে বুঝতে পারে না। মীরনের পছন্দ ইংরেজি। ওয়াটস-ক্যানিংহামের মতো অনর্গল ইংলিশ বলার কৌশল সে রপ্ত করতে চায়। নবাব বাহাদুরের মতো শুধু উর্দু জানলে এখন চলবে না। দুনিয়া পাল্টে যাচ্ছে।
‘ঠিকই আছে মনে হচ্ছে।’ উমি চাঁদের দিকে দলিলটি বাড়িয়ে দিয়ে মীরন বলল, ‘কাকা আপনি পড়ে শোনান। একই সঙ্গে ইংরেজি ও উর্দুতে বলবেন।’
উমি চাঁদ পুরোটা পড়ে শোনালেন। প্রতি মাসের দশ তারিখে দশ হাজার টাকা করে শোধ করবেন শেঠজি। নয় মাসে পরিশোধ সমাপ্ত হবে।
মীরন বললো, কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখে টাকা দিতে না পারলে মাশুল কী হবে, তা তো লেখা হলো না।
উমি চাঁদ বললেন, ‘ন্যায্য কথা। মহাতপ তোমার উমেদকে বলো, দলিলে দুই হাজার টাকা জরিমানার কথাটা লিখে দিতে।’
মহাতপ কপাল কুঁচকে ফেললেন। মুখে বললেন, ‘উদয় লিখে দাও।’
নগদ দশ হাজার টাকা ও স^াক্ষর-টিপসই দেওয়া দলিলটা নিয়ে চলে গেল মীরন। তার ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই উমি চাঁদ বললেন, ‘আমার ভাগটা দিয়ে দাও মহাতপ।’
শেঠজির ঠা-া গলা, ‘তা না-হয় দিলাম উমি। কিন্তু জরিমানার কথাটা তুমি আগ বাড়িয়ে বলতে গেলে কেনো?’
‘বিশ্বাস করাতে…। এক দানে তোমার পঞ্চাশ হাজার লাভ করিয়ে দিলাম। আমাকে এখন চল্লিশ হাজার দিলেই চলবে।’
‘বিক্রির আগে লাভের ভাগাভাগি?’ মহাতপ হাসতে হাসতে বললেন, ‘মুক্তোর মালাটার আগে হিল্লে করো।’
উমি চাঁদ বললেন, ‘ঘণ্টাখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে। চিঠি লিখে দিচ্ছি কিলপ্যাস্টিকের বোনের কাছে। তিনি অলংকার সামগ্রী জমাতে পছন্দ করেন। টাকার কুমীর।’
‘কোন কিলপ্যাস্টিক?’
‘উমি চাঁদ হাসলেন, তুমি দেখি দুনিয়ার কোনো খবর রাখো না। ইনি মেজর। তার জন্যেই তো হেরে গেলেন সিরাজ। ভয়ংকর সাহসী মানুষ। কিন্তু ডরোথির কাছে কাদার মতো নরম। … তুমি শোনোনি, নবাব বাহাদুর তাকে প্রায় একষট্টি হাজার পাউন্ড ইনাম দিচ্ছেন? অথচ দেখো, আমাদের কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। এই তিন দিনে একবারও দরবারে ডাকেননি। এখন নাকি ফিরিঙ্গিদের জন্যে তার দরোজা খোলা।’
মহাতপ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ভগবান এসব সহ্য করবেন না।’
উমি চাঁদ তুড়ি মারলেন, ‘আরে ছোড়ো ইয়ার। তার আগেই বিচার হয়ে যাবে। …দাও কাগজ-কলম, আর টাকাটা আনতে বলো।’
এক পায়ে খাড়া উদয় চাঁদ। কাগজ- কলম এগিয়ে দিলো, সঙ্গে একটা পোঁটলা, যেখানে আছে চল্লিশ হাজার। তিনি লিখতে লাগলেন, ‘ডিয়ার সিস্টার ডরোথি…।’

পাটনা অভিযানের ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় মীরন জানতে পারলো, এ পর্যন্ত যত টাকা সে পেয়েছে, তার একটিও মহাতপ কাকা দেননি। দিয়েছেন নবাব বাহাদুর।
এসবের মানেটা কী? মালা নিয়ে জালিয়াতি করার পরও কেনো বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা! বাপের ওপর চোখ লাল করতে পারলো না সে। তিনি তো ঠিকই বলেন, ‘যে দেয় তার মনে থাকে, যে নেয় সে ভুলে যায়।’ কিন্তু দায়টা তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিলেন কেন? মীরনের হাত থেকে বন্ধুর ইজ্জত বাঁচাতে?
বাঁচতে দেবে না সে।
তখনই হাতে তালি বাজাল, পর পর দু’বার। শব্দ শোনামাত্র কোচোয়ান ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে হাজির। মীরন গম্ভীর গলায় বললো, ‘চলিয়ে, শেঠজি কা মোকাম…।’

বহুদিন পর নবাবপুত্রকে দেখে বেজায় খুশি মহাতপ চাঁদ রায়। হাত কচলে বললেন, ‘আমি নিজেই যাচ্ছিলাম তোমাকে আশীর্বাদ করতে। কাল নাকি পাটনা যাচ্ছো?’
মীরন বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি অন্য একটা ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি কাকা। স্ট্রেইট আনসার দেবেন।’
‘বলো বাবা। তোমার যে কোনো কাজে আমি সহায়তা করতে পারলে খুশি হবো।’
মীরনের কপালে ভাঁজ পড়লো, আপনি কি জানেন, কতো নিষ্ঠুর মানুষ আমি?’
থতমত খেয়ে মহাতপ বললেন, ‘মানে…!’
চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে এলো তার, ‘যাকে চেয়েছি, তাকেই খতম করে দিয়েছি আমি। কেউ বাঁচাতে পারেনি, বাঁচতেও পারেনি। আমার হুকুমে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে আমেনা ও ঘষেটিকে। সিরাজের ছোট ভাই মির্জা মেহেদি আমার পায়ে পড়ে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলো, পায়নি। এক কোপে ওর ধড় আলগা করে দিয়েছি। আর সিরাজের পরিণতি তো জানেনই, গরুর গাড়িতে চড়িয়ে তাকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়েছিলো। মুহম্মদী বেগ বাঘ-বকরী খেলেছে সিরাজকে নিয়ে, কুড়িটি কোপ তো সে একাই মেরেছে। হ্যাঁ, সবই আমার হুকুমে।’
মহাতপ আমতা আমতা করতে লাগলেন, ‘তো বাবা, এসব আমাক শোনাচ্ছো কেন?’
চোখ ছোট করে মীরন বললো, ‘তার কারণও আপনি জানেন।’
‘আমি!’ শেঠজীর চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম।
মীরন বললো, ‘কারণ আপনি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেননি। কথার বরখেলাপ করেছেন। ইউ আর অ্যা বিট্রেয়ার।’
মহাতপ বললেন, ‘কথাটা যদি মুক্তোর মালা প্রসঙ্গে হয়, তাহলে বলবো, এজন্য আমি দায়ী নই। উমি চাঁদ আমার হয়ে নবাব বাহাদুরের দয়া চেয়েছিলো, তিনি দয়া করেছেন। আমার আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করেই হয়তো নবাব বাহাদুর সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন।’
মীরন ধমকে উঠলো, ‘কিন্তু তা আমাকে জানাননি কেনো?’
চুপসে গেলেন মহাতপ, ক্ষীণ গলায় বললেন, ‘আমাকে নিষেধ করেছিলেন উমি। …তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, ওকে ডাকিয়ে আনি, নিজের কানে শোনো।’
শেঠজির উমেদ উদয় হাত কচলে বললো, ‘তাকে আনতে লোক পাঠানো হয়েছে, এই এলেন বলে।’
বাইরে এসময় ঘোড়ার গাড়ির শব্দ শোনা গেলো। মীরন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো, জমকালো পোশাক পরা উমি চাঁদ গাড়ি থেকে নামছেন। তার দু’গালে হাসি। পেছনে দুই লাঠিয়াল।

শেঠজির প্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ির সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উমি চাঁদ বললেন, ‘ঠিক সময়ে এসে পড়েছো মীরন। আর সুযোগ হবে কি-না, বলা মুশকিল। যুদ্ধে যাচ্ছো, জীবন-মরণের কথা ভগবান জানেন। …তোমার পাওনা টাকাটা নবাব বাহাদুর প্রতি মাসেই দিচ্ছেন। বন্ধুদের প্রতি তার এই বদান্যতার কথা তো সেধে গিয়ে তোমাকে বলতে পারি না মীরন, কি বলো? নবাবের নিষেধ ছিলো।’
মীরন কঠিন গলায় বললো, ‘আমার সঙ্গে চুক্তিপত্রটা কিন্তু আপনার বন্ধুর। তিনি শর্ত ভঙ্গ করেছেন।’
আমতা আমতা করে উমি চাঁদ বললেন, ‘তা ঠিক। কিন্তু স^য়ং নবাব বাহাদুর যখন আদেশ করেন, কথাটা তোমাকে না জানাতে, তখন আর কিছু করার থাকে না বাবা।’
‘আমি শর্ত ভঙ্গকারীদের ক্ষমা করি না।’ মীরন দাঁত কিড়মিড় করলো ।
মহাতপ নিজেকে সামলাতে পারলেন না, চিৎকার করে উঠলেন, ‘তো কী করবে তুমি?’
কোষ থেকে তরবারিটা এক টানে বের করে ফেলল মীরন, ধড় আলগা করে ফেলে দেব মাটিতে।
মহাতপের গলার শিরাগুলো মোটা হয়ে গেলো, ‘তোমার বাবাও যা জীবনে উচ্চারণ করতে পারেননি, তা করলে তুমি! ঠিক আছে এর ফল পাবে। পেতেই হবে তোমাকে।’
মীরন গর্জে উঠলো, ‘আমাকে ভয় দেখাবেন না। জীবনের জন্য কোনো মায়া নেই আমার। চাইলে এখনই খতম করে দিতে পারি যে কাউকে।’
উমি চাঁদ দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার চোখ দুটো লাল, নবাব পুত্রের মুখে হত্যার কথা শোভা পায় না। তুমি তো আর জল্লাদ মুহম্মদী বেগ নও। শান্ত হও বাবা।’

শরীর কাঁপছে মীরনের, লোহু টগবগিয়ে যেন ফুটছে, বাগে আনতে পারছে না নিজেকে। তলোয়ার উঁচিয়েই রাখলো সে।
শান্ত হও বাবা। উমি চাঁদ আবার বলে উঠলেন, ‘কোষে তলোয়ার ঢুকিয়ে ফেলো। এখানে কিছুই করতে পারবে না তুমি। বেইজ্জত হবে। আর সেটা হবে তোমার জন্য কলঙ্কের।
মীরনের অবাক হওয়া চোখ দুটো দেখতে পেলো দশ-বারো জন তীরন্দাজ অনতিদূরে দাঁড়ানো। এদের অন্তত দুজনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। সন্ধ্যার আলোয় ঠিক ঠাহর করা গেলো না। ফিরিঙ্গিদের আনা অস্ত্র কি-না ওগুলো। বুড়ো শেঠজির উমেদ উদয় চাঁদের মুখে তখন রহস্যময় হাসি।
তলোয়ারটা খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললো মীরন। তার হাত-পায়ের কাঁপুনি সামান্য কমেছে। কিন্তু বুকের ভেতরকার উষ্ণতা কিছুতেই কমছে না। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভারি ও গম্ভীর গলায় সে বললো, ‘উমি কাকা, ব্যাপারটা শেষ হবার নয়। পাটনা থেকে ফিরে আসার পর খবর দেবো আপনাকে। বিহিত একটা আলবৎ হবে।’

ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই মহাতপ চাঁদ বলে উঠলেন, ‘গর্দভটা এখন কার কাছে যাবে জানো?’
উমি চাঁদ মাথা ঝাঁকালেন, না। তিনি জানেন না।
যাবে রাজবল্লভের কাছে। এখন তো রাজেই ভরসা নবাবের। পুত্রকেও ওর কাছে ঠেলে দিয়েছেন। দু’দিন পর বুঝবে মজা।
উমি চাঁদ ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘কিসের কথা বলছো তুমি? খোলাসা করো।’
মহাতপের কপালে বিরক্তির ভাঁজ, ‘দিন-দুনিয়ার কোনো খবর না রাখলে সব কথাই উদ্ভট লাগে উমি।
ফিসফিসে শব্দ হলো তার দু’ঠোঁটে, ‘নতুন খেলা শুরু হয়েছে দরবারে। প্রতিদিন অন্তত একবার বৈঠক হয় চার জনে। নবাবপুত্র মীরন, জামাই মীর কাশিম আর বন্ধু রাজবল্লভ মিলে সারাক্ষণ গুজগুজ করে কিভাবে ফিরিঙ্গিদের তাড়াবে। আকাশকুসুম আর কী!’
উমি চাঁদের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম, ‘বলো কী! আবার ষড়যন্ত্র? না, আর কোনো ষড়যন্ত্রে নাই আমি। সিরাজকে সরিয়েই বুঝছি, ভালো কাজ করিনি। এদেশ থেকে জন্মেও আর ফিরিঙ্গিদের হটানো যাবে না।’
মহাতপের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি, ‘গর্দভটা ভাবছে এসব খুব সহজ কাজ। তলোয়ার আর বন্দুক চালাতে পারলেই হলো। কিন্তু ওর মতিগতির সব খবর যে বড়লাট পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, তা ওর মাথায় নেই। গর্দভ কাহিকা।’
উমি চাঁদ চোখ ছোট করে বললেন, ‘তুমি আবার কোনো কলকাঠি নাড়োনি তো?’
‘একেবারে যে নাড়িনি, তা বলা যাবে না। তবে ওর আজকের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে, কাঠিতে আরো বেশি নাড়া দেওয়া উচিত ছিলো। আমি শুধু মেজর ওয়ালসকে জানিয়ে রেখেছি।’
তুড়ি মেরে যেন কথাগুলো উড়িয়ে দিলেন উমি চাঁদ, ‘আরে ওইসব খাকিদের জানিয়ে লাভ কী? ওদের কাজ কর্তাদের হুকুমে যুদ্ধ করা। পলিসি আর প্রশাসন যাদের হাতে, তারাই তো আসল।’
মহাতপ শান্ত গলায় বললেন, ‘কথার ধর্মই হচ্ছে এক কান থেকে দশ কানে ছড়ানো। মেজর ওয়ালস কি পেটের মধ্যে কথাগুলো ধরে রাখবে মনে করো? ও নিজেই একজন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’
উমি মাথা ঝাঁকিয়ে মিটিমিটি হাসলেন, ‘আমি আরো শক্ত কাজ করতে গিয়েছিলাম। পরে ভেবে দেখলাম, লাভ নাই। যার জন্য করব চুরি, সেই বলবে চোর। এখন নবাব আর নবাবপুত্র যা করছেন।’
‘কী করতে চেয়েছিলে বলো তো?’
‘কী আর!’ উমি চাঁদ ঠোঁট ওল্টালেন, ‘বড়লাটকে একটা চিঠি লিখবো ভেবেছিলাম। ওদিকে ডরোথির কাছে তাগাদা দিতাম। সিস্টারের সঙ্গে তো বড়লাটের এখন দহরম-মহরম।’
মহাতপ হাত চেপে ধরলেন, ‘মেরে জানে দোস্ত…। এই কাজটাই করো না তুমি। গর্দভটার আচরণ ভুলতে পারছি না ইয়ার। ওর কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।’
উমি চাঁদ হাত সরিয়ে নিলেন, ‘একটা গর্দভের জন্য সবাই কষ্ট ভোগ করবে। তাতে আমার কী লাভ?’
‘লাভ হবে, লাভ হবে।’ মহাতপ ফের হাত টেনে ধরলেন, ‘তুমি বরং সিস্টার ডরোথিকেই চিঠি লিখে দাও। বড়লাটের কাছে লিখলে এ্যাকশন নিতে দেরি হবে।’
‘আমার লাভের কথাটা আগে বলো।’
মহাতপ অনেকক্ষণ পর যেন হাসার সুযোগ পেলো, ‘আমি কি তোমাকে কখনো ঠকিয়েছি উমি? সুখ-দুঃখে অনেক বছর এক সঙ্গে আছি আমরা। বল্লভ দা ঘষেটি বেগমের কাছে না ভিড়লে আমাদের তিন-চারজনে মিলে শক্ত একটা সিন্ডিকেট হতো। বাণিজ্য করতাম মহানন্দে।’
‘আরে ছোড়ো ইয়ার। গতস্য শোচনা নাস্তিঃ। লাভের কথাটা আগে বলো।’
মহাতপ বিন্দুমাত্র চিন্তা না করেই বললেন, ‘নগদ কুড়ি হাজার…।’
কথা কেড়ে উমি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কখন দেবে?’
‘চাইলে এখনই।’
উমি চাঁদ হাত বাড়ালেন, ‘দাও। টাকাগুলো নগদ হাতে পেলে আমার চিঠি লেখার হাত খুলবে।’
আড়াল থেকে সব কথাই বুঝি শোনে উদয় চাঁদ, না হলে উমির কথা শেষ হতে না হতে কোত্থেকে হাজির হলো সে? এক তোড়া নোট মহাতপের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘শেঠজি, হিয়াপার সব ঠিক হ্যায়। কুড়ি হাজার।’
উমি চাঁদ আচকানের দুই পকেটে তোড়া দুটি চালান করে দিয়ে লিখতে বসলেন, ডিয়ার সিস্টার ডরোথি, এ্যান আর্জেন্ট ম্যাসেজ ফর ইউ…।

২ জুলাই যখন মুর্শিদাবাদ থেকে আজিমাবাদে সবাই পৌঁছলো, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে তখন।
ফৈজুল খাঁ বললো, ‘হুজুর, আজ রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেওয়া ভালো। সামনে দুর্গম পথ। আকাশের অবস্থাও ভালো না।’
বুড়ো এ লোকটার মতামত বরাবরই রাখার চেষ্টা করে মীরন। তবে সময় নেয় কোনো কথা না বলে। আজও তা-ই করলো ।
নীরবতার সুযোগ নিলো ফৈজুল খাঁ, ‘সেনাদলকে তাহলে থামতে বলি জাঁহাপনা?’
মীরন বললো, ‘তাই করুন। ভেরি ব্যাড ওয়েদার। কীরকম গরম পড়েছে দেখেছেন? ইউ নো ফৈজুল চাচা, বিলাতে গরম কখনোই পড়ে না। হাউ নাইস ওয়েদার।’
ফৈজুল খাঁ শুধু মাথা ঝাঁকাল।
তারপর লাগামে হেঁচকা টান দিয়ে দ্রুত চলে গেলো সেনাদলের অগ্রভাগে। তার চীৎকার শুনতে পেলো মীরন। হল্ট হল্ট, ঠেরিয়ে ঠেরিয়ে…।
আপন মনে হেসে উঠলো সে, ‘হল্ট’ শব্দটি ফৈজুল খাঁ ফিরিঙ্গিদের কাছ থেকে সম্প্রতি শিখেছে। খুব সম্ভব আমবাগানের যুদ্ধের সময়। ২৩ জুনের সে যুদ্ধে ফৈজুল গোপন সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছিলো। তার প্রতিটি খবরই ছিলো বস্তুনিষ্ঠ। সেই পুরস্কার মীরন দিয়ে যাচ্ছে তিন বছর ধরে। ফৈজুল খাঁকে বানিয়েছে প্রধান সহকারী। বাড়িও একটা দিয়েছে মুর্শিদাবাদে, বিশাল মহল। ওখানে আগে সিরাজের খালা ঘষেটি বেগম থাকতেন।
ফৈজুল খাঁ ফিরে এলো মিনিট দশেকের মধ্যেই। হাত কচলে বললো, ‘গোস্তাখি মাফ করবেন হুজুর, দেরি হয়ে গেলো। সে কী! আপনি এখনো সওয়ার?
মীরন হাসলো, ‘ইউ নো চাচা, ঘোড়ার পিঠে আমি ঘুমাতেও পারি।’
ফৈজুল খাঁ’র আকর্ণ হাসি, ‘সেকথা আর বলতে হুজুর। নিজের চোখেই কতোবার দেখলাম। এখন বিশ্রাম নিতে আপনার তাঁবুতে চলুন। আমি সব ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছি। তাড়াতাড়ি চলুন হুজুর, বৃষ্টি নামবে।’
বলতে না বলতে গুড়গুড় শব্দ উঠল আকাশে। কালো মেঘে ছেয়ে গেল চারপাশ, শোঁ শোঁ হাওয়ার ঝাপটায় গাছপালা মুহূর্তে সব ঝাঁকড়া মাথার দরবেশ, যেন জিকির পড়ছে। সঙ্গে ঘন ঘন বজ্রপাত।

পরদিন মুর্শিদাবাদে পৌঁছলো ভয়াবহ দুঃসংবাদ। নবাবমহল স্তব্ধতায় ডুব দিলো। পিনপতন নীরবতা রাজধানীতে।
আজিমাবাদে দুর্যোগের ওই রাতে বজ্রপাত ছিলো স^াভাবিক ঘটনা। অনেক তাঁবু পুড়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে চল্লিশটি ঘোড়া দড়িদড়া ছিঁড়ে নিখোঁজ। তিনটি ঘোড়াকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে আজিমাবাদের অরণ্যে। এর মধ্যে দুটি কালো আর একটি শাদা। তবে লোকবলের তেমন ক্ষতি হয়নি। সেনাবাহিনীর সবাই অক্ষত। ফৈজুল খাঁ ফিরে এসেছে মুর্শিদাবাদে। পাটনা অভিযান ব্যর্থ।
ফৈজুল খাঁ লিখিত বক্তব্যে জানালো, বজ্রপাতে নিহত হয়েছেন নবাবপুত্র।

শোকে-দুঃখে নবাব বাহাদুর বোবা হয়ে গেলেন। সবচেয়ে হতবাক তিনি ফৈজুলের আচরণে। ঘোড়ার কোচোয়ান থেকে পদোন্নতি দিয়ে কোথায় বসিয়েছিলো তাকে মীরন। বাড়িও দিয়েছিলো আর মুঠো ভর্তি টাকা। সেই লোকটার মুখে মিথ্যা কথা একটুও আটকালো না!
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন অসহায় নবাব। সজোরে কাঁদতেও এখন ভয় পাচ্ছেন তিনি। আর নীরবে কাঁদার কোনো সুযোগ নেই। চারপাশে সারাক্ষণই মানুষ। রাতের স্তব্ধতায় পাশে থাকবে মণি বেগম, অঝোর ধারা নামবে আজ তারও চোখ ফেটে। অথচ তিনি সত্য কথা বলতে পারবেন না।
কোনোদিন বলা সম্ভব নয়, খবরটা সকালেই জেনে গিয়েছিলেন তিনি লরিস্টনের দূতের মাধ্যমে। ফরাসি সেনাপতির চিঠিটা ছিলো ফারসিতে লেখা।
হ্যাঁ, গতরাতে ঘন ঘন বজ্রপাত হচ্ছিল আজিমাবাদে, সত্যি কথা। আর সে সুযোগটাই নেয় মেজর ওয়ালস। আগুন ধরিয়ে দেয় মীরনের তাঁবুতে!
ঘটনাকে বিশ্বাস্য করতে আরো কয়েকটি তাঁবু আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়, যেগুলোতে কোনো মানুষ ছিলো না। দড়ি কেটে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় চল্লিশটি ঘোড়াকে। আর তিনটি ঘোড়াকে হত্যা করা হয় বিষ লাগানো ছুরি মেরে। যার মধ্যে দুটি কালো, একটি শাদা।
মেজর ওয়ালস কি বুঝিয়ে দিলো, আমাদের একজন গেলে তোমাদের দুজন যাবে?
পরের টার্গেট কি তবে নবাব বাহাদুর? বুঝতে পারলেন না পুত্রহারা বৃদ্ধ মীর জাফর।

 

 

 

Facebook Comments

আড্ডাপত্রে লাইক দিন

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১