নায়ক না হওয়া কবিদ্বয়ের যৌথ জন্মদিন পালনের স্বর্ণস্মৃতি : সাদাকালো’য় প্রকাশিত প্রিয় কবিতার নেপথ্য গল্প
সতীর্থ দুই কবিবন্ধুর প্রিয়দিন জন্মদিন পাশাপাশি দিনেই। ২২ নভেম্বর কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের। পরদিন কবি মারুফ রায়হানের। আশি দশকের এই দুই বন্ধুই নায়ক হতে পারতো। চেহারা, প্রতিভা– বাংলা সিনেমার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। দু’জনেরই পৈতৃকবাস সংস্কৃতি ও মাইকেল-খ্যাত যশোরে। দু’জনই ‘অনিরুদ্ধ আশি’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা-সংগঠক। দু’জনের যৌথ-জন্মদিন আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা পালন করেছিলাম।
ঘটনাটি ২০০৩-এর নভেম্বরের। উদ্যোক্তা সংগঠন ‘অনিরুদ্ধ আশি’। আশি দশকের লেখকদের জাতীয় সংগঠন। সভাপতি কবি-মুক্তিযোদ্ধা খোন্দকার আশরাফ হোসেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান। ‘একবিংশ’ সাহিত্যপত্রের সম্পাদকও। ‘অনিরুদ্ধ আশি’র আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। আশির দশক-খ্যাত প্রায় সব লেখকই এতে সম্পৃক্ত হয়। উন্মোচন অনুষ্ঠানটিও ছিলো বেশ বর্ণাঢ্য। ভারতবাংলা’র প্রায় ২০ জন খ্যাতিমান অংশ নেন। শ্যামককান্তি দাশ, সুবোধ সরকার, তপন বন্দোপাধ্যায়, মৃদুল দাশগুপ্ত। ছিলেন অভিজিৎ ঘোষ, দীপক লাহিড়ী, চিত্রা লাহিড়ী, রফিকুল ইসলাম। অভিনয় ও আবৃত্তিরাজ সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ও।
বাংলাদেশের সত্তর দশকের কবিরাও অনুষ্ঠানে সরব ছিলেন। নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার, ড. মাসুদুজ্জামান। ছিলেন তুষার দাশ, সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, সৈয়দ আল ফারুক। আশি দশকের কবিদের হাট বসেছিলো যেন। আলোচনায় অংশ নেন সভাপতি খোন্দকার আশরাফ, সম্পাদক সালেম সুলেরী। এছাড়াও রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফরিদ কবির, সাজ্জাদ শরিফ। অনুষ্ঠান পরিচালনায় আসলাম সানী, ফেরদৌস নাহার। বক্তা কামরুল হাসান, ফেরদৌস সালাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপনে মারুফ রায়হান, এলিস, ওয়াহিদ রহমান প্রমুখ। অর্ধশতাধিক কবি নিবেদন করেন নিজস্ব পদাবলি।
ভারতবাংলা’র কলকাতা’য় ‘অনিরুদ্ধ আশি’র উন্মোচন পরের বছর। নেতৃত্বে কাজল চক্রবর্তী, চিত্রা লাহিড়ী, চৈতালী চট্টেপাধায়, নাসের হেসেন। সমন্বয়ে সৈয়দ হাসমত জালাল, জয়দেব বসু, সৌমিত বসু প্রমুখ। নন্দনের বাংলা একাদেমি মিলনায়তনে দু’দিনের আয়োজন। উদ্বোধক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমাপক কবি শঙ্খ ঘোষ। খোন্দকার আশরাফ, আমার নেতৃত্বে যোগ দেই ১২ জন। বাংলাদেশ দলটির সমন্বয়কারী ছিলেন কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু।
ঢাকায় স্টালিন-মারুফের জন্মদিনের যৌথ-উৎসবটিও স্মৃতিময়। এককভাবে স্টালিনের জন্মোৎসব আয়োজিত হয়েই থাকে। তবে মারুফ রায়হানের জন্মতিথি পালনের খবর জানতাম না। তাই আমরা যৌথ-উৎসবের সিদ্ধান্ত নেই। স্থান আমাদেরই নিজস্ব ‘সাদাকালো-নিউজব্যাংক’ হল। ঢাকার তোপখানা রোডস্থ বিখ্যাত মেহেরবা প্লাজায়। স্টালিন-মারুফের সৌজন্যে হলভাড়া মওকুফ করা হয়।
উল্লেখ্য, মারুফ তখন ‘সাদাকালো’ পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক। একই প্রতিষ্ঠানের সহকর্মী শাহিদা নাজকে বিয়েও করে। ফলে বন্ধুকবি মারুফ ‘জামাই আদর’ পেতেই পারেন।
রেজাউদ্দিন স্টালিন আশি দশকের কলজেছেঁড়া বন্ধু। মা রেবেকা সুলতানার হাতের রান্না অনেক খেয়েছি। ১৯৮৪-তে আমি দৈনিক জনতা’য় সহ-সম্পাদক। পাশাপাশি ‘ফিচার ইন-চার্জ’ও। আড্ডা পেটাতে স্টালিন অফিসে এলে ঘটনা ঘটতো। অনেকে ভাবতো বিটিভির তৎকালীন নায়ক ‘সাজ্জাদ খান’ এসেছে। চেহারায় অদ্ভূত রকমের মিলনশোভা। স্টালিন, মারুফ– দু’জনই সৌম্যদর্শন যুবক। টিভিনাটক বা সিনেমায় যেতে পারতো। কিন্তু ‘কবিতা রাশির জাতকে’রা কি তা পারে! স্টালিনের পেশা জীবন একনাগাড়ে ‘নজরুল ইনস্টিটিউটে’। মারুফ বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক বা ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াতে।
কবিদ্বয়ের জন্মদিনের প্রথম যৌথ-উৎসবটি হয় ২০০৩-এ। সম্মানিত অতিথি ছিলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত দুই কবিব্যক্তিত্ব। কবি আল মুজাহিদী ও কবি নির্মলেন্দু গুণ। বিশেষ অতিথি বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত পদ্যকার রফিকুল হক / দাদুভাই। এছাড়া জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পরিচালক কবি-সাংবাদিক মাহমুদ শফিক। উদ্বোধক ছিলেন কবি-ব্যাংকার আবু তাহের। সভাপতিত্বে ‘অনিরুদ্ধ আশি’ সভাপতি কবি খোন্দকার আশরাফ। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্বাগত বক্তব্য রাখি আমি। অনুষ্ঠান পরিচালনায় কবি আসলাম সানী, ফেরদৌস সালাম। সঙ্গে কবি-আবৃত্তিশিল্পী শামীমা চৌধুরী এলিস। অর্ধশতাধিক কবি-লেখক-শুভ্যানুধ্যয়ী শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো।
কবিতা ও সংস্কৃতিকর্মে উভয়ে সমধিক পরিচিত। মারুফ রায়হান-এর গ্রন্থসংখ্যা প্রায় ২৫। অন্যদিকে দ্বিগুণসংখ্যক বই কবি রেজাউদ্দিন স্টালিনের। কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছে কবি স্টালিন। অ্যামেরিকা থেকে ইংরেজি ভাষায় কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে।
সাদাকালো ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেতো– ‘কবিতা ও তার পটভূমি’। প্রিয় কবিতা ও তা রচনার নেপথ্য গল্প। বাংলাদেশ ও ভারতবাংলা’র ঋদ্ধ কবিরা তাতে লিখেছেন। স্টালিন, মারুফ-এর অজানা গল্পও সন্নিবেশিত হয়েছিলো। প্রিয়দিন-জন্মদিনে এবার অধিকাংশের না-পড়া সেই গল্পদ্বয়। সঙ্গে পরিমিত শব্দের প্রিয় কবিতাদ্বয়ও।
আটলান্টিকপারের সাগর শুভেচ্ছা কবিবন্ধুদ্বয়কে।
নিউইয়র্ক, নভেম্বর ২০২০
কবিতা ও তার পটভূমি
রেজাউদ্দিন স্টালিন
জন্ম : ২২ নভেম্বর, ১৯৬২
আমার সাম্প্রতিককালের প্রিয় কবিতার শিরোনাম– ‘নিরপেক্ষতার প্রশ্নে’। এই কবিতার কাব্যগুণ সম্পর্কে আমার উচ্চাশা নেই। তবে বক্তব্য প্রবাহের অভিঘাত রয়েছে। যা কবিতাটিকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ‘নিরপেক্ষ’ বলে অনেক ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান প্রচারণা চালায়। কিন্তু আদতে তা’ মূল্যহীন বা ফাঁপা। প্রত্যেককে কোনো না কোনো পক্ষাবলম্বন করতেই হয়। অন্তত যদি সে জীবিত হয়ে থাকে। কিংবা যদি তার হৃদয় থেকে থাকে। নিরপেক্ষ– অর্থাৎ কেউ কেউ শুধু একাই। ‘তার পরিপার্শ্ব বলে কিছু নেই’। তাপ-উত্তাপ বলে কিছু নেই। ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু বোঝার শক্তি নেই। তাহলে সে নিশ্চয়ই মৃতবৎ। মৃতবৎ এবং মৃত-এর মধ্যে শব্দগত পার্থক্য থাকতে পারে। থাকলেও চেতনাগত পার্থক্য তেমন নেই। এ জন্যে ‘নিরপেক্ষতা’র বিরুদ্ধে আমরা ভাবনাবলয় গড়ি। যা সত্য-সুন্দর স্বপ্ন ও প্রত্যাশার পক্ষে। সেভাবেই এই কবিতাটিকে দাঁড় করাতে চেয়েছি। সবসময় রাজনীতি করলেই পক্ষাবলম্বন হয় না। ন্যায়ের পক্ষে, সত্য ও সুন্দরের কল্যাণের পক্ষে অনেকেই। যিনি পক্ষে তিনিই প্রকৃত মানুষ, তাঁর জন্যে এই কবিতা।
নিরপেক্ষতার প্রশ্নে
যার আশা নেই সে কিছু হারায় না
যার স্বপ্ন নেই সে শুধু বর্তমানের
তার অতিত ও ভবিষ্যৎ নেই
যার মন আছে সে নিরপেক্ষ নয়
আকাশের আশা নিরপেক্ষ হবে
কিন্তু মেঘ তাকে আচ্ছন্ন রাখে
চাঁদ স্বপ্ন দ্যাখে নিরপেক্ষ আলোর
কিন্তু সূর্য তার আষ্টপৃষ্ঠে বাঁধা
নদী চায় নিরপেক্ষ প্রবাহের পথ
কিন্তু সমুদ্রের জলে তার বক্ষ বিবাহিত
পথ চায় নিরপপক্ষ নিয়মে গন্তব্যে গমন
কিন্তু পথিকের পদশব্দে
পথ ভেঙে ভিন্ন দু’টি গ্রহ
যার আশা আছে সে কিছু হারায়
যার স্বপ্ন আছে তার কিছু ভাঙে
যার আশা নেই স্বপ্ন নেই
তার মন নেই
সে নিরপেক্ষ অথবা মৃত ♠
মারুফ রায়হান
জন্ম : ২৩ নভেম্বর, ১৯৬২
২০০২-এ বেরোয় আমার সাতটি কবিতাগ্রন্থের নির্বাচিত কবিতার সংগ্রহ। শিরোনাম ‘শত কবিতা সতত কবিতা’। তাতে ফ্ল্যাপে কোনো প্রাজ্ঞজনকে দিয়ে লেখানোর চিন্তা ছিলো। আমার কবিতা সম্পর্কে লেখানোর বিষয়টি পরে স্থগিত করি। পরিবর্তে সিদ্ধান্ত নিই নিজেই কবিতামতো কিছু লেখার। ভেতরের ভূমিকা আগেই লিখে দিয়েছি। ফ্ল্যাপের অন্য পাশে সংযোজিত হয়েছে পরিচিতি। বাকি ছিলো শুধু প্রথম ফ্ল্যাপে কিছু শব্দসংযোজনের। পরিশেষে স্ব-উদ্যোগে সেটি-ও হলো। এবং লেখা ও ছাপানোর পর প্রিয়-ও হয়ে উঠলো ওই মুখবন্ধ-কবিতাটি।
‘প্রিয়’ বিষয়টি একই সঙ্গে বেশ কঠোর ও উদার। পিতার কাছে সকল সন্তানই প্রিয়। তেমনি কবির কাছেও তাঁর যাবতীয় রচনা। সংযোজিত সাতটি গ্রন্থ ঃ স্বপ্নভস্মের চারুকর্ম; উদ্বাস্তু গদ্যের গান; ভালোবাসার ভুলগুলো, ফুলগুলো; নৈঃশব্দের ধ্বনি; সন্ধ্যায় মেয়েটি যা যা বলেছিলো; গাছ ও নারী; নিষিদ্ধ নির্জন ডানা।
নির্বাচন করতে গিয়ে আমি কঠোরতা অবলম্বন করেছি। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ রচনাকেই দূরে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তার মানে কি শুধু গ্রন্থবদ্ধ রচনাগুলোই আমার প্রিয়? অন্যগুলো কি অপাংক্তেয় বা অপ্রিয়? তবুও ফ্ল্যাপের এই নতুন রচনা বিশেষ গুরুত্ববহ। যা দ্রুততম সময়ের ভেতর লিখিত ও মুদ্রিত। পাঠে, মূল্যায়নে যা আমার প্রিয় হয়ে ওঠে। এর ভেতর প্রকাশিত আছে জিজ্ঞাসার পর জিজ্ঞাসা। কবিতার উপযোগিতা এবং কেনো কবিতার পথে আছি। তা পুনর্বিবেচনার জন্যে আত্মদর্পণের মুখোমুখি দাঁড়ানো। পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ, বিনীতভাবে। আমার সময় ও স্বদেশ প্রথম দুই পঙ্ক্তিতেই জায়গা করে নেয়। কী-বোর্ডের ওপর আঙুল বাজাতে বাজাতে কি দেখছি! মনোশ্চক্ষে ভেসে উঠছে দুটো বিষয়। আমার নিজেরই একেকটা গ্রন্থের মৌল চরিত্র ও বক্তব্য। কবির কাজ, কবিতার আশ্চর্য ব্যবস্থাপত্র। গভীর গহন প্রয়োজন ধীরে ধীরে আত্মায় ধরা দিতে থাকে। উপসংহারে অনিবার্যভাবে এসে পড়েন জীবনানন্দ। কবি ও কবিতা নিয়ে তার ঋষিসুলভ চির-আধুনিক দুটি উচ্চারণ। ব্যস এভাবে লেখা হয়ে যায় নির্বাচিত সংগ্রহের ইশতেহার। অর্থাৎ : ফ্ল্যাপের কবিতা-বিজ্ঞাপন।
শত কবিতা সতত কবিতা
কবিতা কি সহিষ্ণু গণতন্ত্র এনে দেবে? অংশ নেবে
দেশে-দেশে যোদ্ধপরাধী নির্মূলে? সন্ত্রাসের গালে
থাপ্পড় মারবে? প্রিয়তমার অধরে রাখবে তপ্ত ঠোঁট?
ছোঁবে কোটি ছায়াপথ, মানবের ভেতরকার সৎ
নন্দনসত্তা? ভন্ড বুদ্ধিজীবীর মুখোশ খুলে ফেলবে
একটানে? শুষে নেবে সময়ের পাপ? কবিতা ভালো
না বেসে কেউ কি সন্তানের জন্ম দিতে পারে?
জলবন্দী নিঃস্ব মানুষের করতলে দু’টুকরো রুটি
আর ওরস্যালাইন হতে পারে কবিতা কখনো?
কবিতা তো ব্রহ্মান্ডের ডায়েরি, আত্মার গান।
তবুও কবিতা চিবিয়ে খায় দেবী ও দানব।
যদি কবিতাগ্রন্থ বন্ধ থাকে তাহলে বীজের ভেতর
বৃক্ষের সম্ভাবনা সুপ্ত থেকে যায়,
জীবনের কোনো অর্থ নেই , তবুও কবি ভাবেন
আত্মহননের চেয়ে ভালো শব্দ খনন;
বাতাসে খোদাই ক’রে যাও নীরবতার স্বর,
ধ্বনির উষ্ণতায় ফুসফুস সেঁকে যায় নষ্টভ্রষ্ট মানুষ।
জীবনানন্দ ঠিকই বলেন : সকলেই কবি নন, কেউ
কেউ কবি, আর কবিতা অনেক রকম।