নলজাত বা টেস্টটিউব নদীদের কথা
কলস কাঁখের দিন ক্রমশ বিলীন!
নদীর নিকট যেতে যতি-ক্লান্ত নারী ও পুরুষ,
স্রোতের জলের কাছে কতো আর খুলে দেবে
উদোম আঙিনা, দেহের গোপন।
নদীও ক্লান্তির রাণী–
কোথায় বর্ষাতী, বিমূঢ় যুবতী!
কী অদ্ভুত সমঝোতা–
নদীতে যৌবন নেই নিয়ম মাফিক–
না নিজের, না রমণী পুরুষের।
আরো আছে অদ্ভুত উল্টাগমন।
নদী আর দর্শনের দেবী নেই…
এখন সুড়ঙ্গ সেবী!
চাপকলের গভীরে নদী তার ফেরী করে দুগ্ধজল।
শহরের ঘরে ঘরে, অফিসে অ্যাপার্টমেন্টে
সাপের আদলে, বাঁশরূপী দীঘল পাইপে
স্নানঘরে, ভোগায়তনে, বাগানে
সীমাবদ্ধ সাঁতারের শুচিবাই চৌবাচ্চায়
বেসিনে টেস্টটিউব নদী, যান্ত্রিকতাময় আঁচ চায়!
অসংখ্য নলের গতি। বিভাজিত জলেরই জাতক, হায়।
নলজাত বা টেস্টটিউব নদীদের কথা–
সেও এক বাস্তবতা।
জলেরা মানবমুখী, নদীরা নদীতে নেই–
জল গেলো কল অভিমুখে, রে সমাজ, তোমার জন্যেই!
মেঘের পুরুষ চোখ
মেঘেরা পুরুষ বটে
সূর্যের সাহসে জন্মে, ভাঙে,
কালবোশেখীর রুদ্রতায় মূর্তিমান যমদূত
আকাশ ভাঙার দ্রোহে ফুঁসে ওঠে–
যেনো দূরন্ত ক্ষত্রিয় উড়ো হাঁস।
পুরুষও মানুষ বটে, ভাঙে-গড়ে।
হৃদয়ে অতিথি পেলে প্রেমে আলুথালু।
পুরুষ চামড়াগুলো ভেতরের রঙে নিজেকে রাঙায়।
কালো হাঁস পালকে পালকে সাদা হয়।
রুদ্র মেঘ সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে।
আর প্রেমের মাধবীলতা খুঁজে ফেরে।
মেঘের নায়িকা কারা– আমি তা জেনেছি।
শহরের শান্ত লেক, মুক্ত জলাশয়
মনুষ্য আড়ালে রোজ আঁচলে কোঁচড়ে গুঁজে নেয়
মেঘফুলমালা।
মেঘের নারীরা– মানবসেবার জলাধার,
মেঘের প্রেমিকা মানুষেরই প্রতিবেশী,
আহা মানুষেই সমাদর, মানুষেই ক্ষতি বেশি!
উড়াল রাজার মেঘ, ইটের জঙ্গল দেখে বিরাগভাজন,
শহরের গলদেশে চেয়েছে মানবী-লেক, হ্রদের সাজন।
মেঘ-নদীর দাম্পত্য সনেট
বৃষ্টি না হলে গাঁয়ের মানুষ ব্যাঙের বিয়েতে মজে,
তবুও আকাশ উদার নাহলে মানুষতো নিরূপায়–
ফসলের মাঠ শকুনি মেজাজে তৃষ্ণায় গজগজে
সাঁতারু মানুষ এইবার গেলো নদীতীরে ভীরূপায়…
নদীও অনেক বাসীমুখে আছে, হয়নি গোসল-চান
দূষণ শরীরে জলা-জীর্ণতা, একাকীত্বের দায়,
দাম্পত্যের সোহাগ খোঁজে কি, কে করে কন্যা দান
অপয়া হৃদয়ে সাথীহীনতায় শরীর শুকিয়ে যায়!
গ্রামীণ ঋষিরা নদী বোঝে বেশি, যতোই পুরনো হোক–
লৌকিকতার আয়োজনে তারা নদীকে গোসল দিয়ে
মেঘ-পুরুষের সঙ্গে অলীক সাজায় স্রোতের বিয়ে,
জোড়া-মিলনের উৎসবে সেকি ষোলো আনা উদ্যোগ,
মেঘ ও নদীর বাসর ঘটিয়ে জল খোঁজে সাধারণে,
জলবন্ধার সভ্য সমাজ গোপনে প্রহর গোণে…
মাত্রাবৃত্ত (ইটালিয়ান আদি সনেট-এর পের্ত্রাক ধারা)
ভাড়ানদী
নদীদের আসলে নিজস্ব কোন জল নেই।
মানুষেরা যেমন মায়ের গর্ভ থেকে
মাটির গভীরে যেতে যেতে
পৃথিবীর ট্রানজিটে গায় জীবনের গান,
সেভাবেই ঝর্ণা-পাহাড়ের গর্ভজল
সমুদ্রের রাজবাড়ি যেতে যেতে
নদীকে বানায় জলপরিবহন পালকি।
ধার নেওয়া শোধ করা আর
জলকেলীর দেহজ সুড়সুড়ি ছাড়া
নদীদের আর কোন ব্যাংক-ব্যালেন্স দেখি না।
সমুদ্র আসলে এক জলের মোকাম।
নদী কি তাহলে জলবণিতার নিষিদ্ধ দালাল?
রাতের রিকশায় ছোটা ঘোরের নারীরা
খদ্দেরের ঠিকানা পেলেই
মুঠ ভরে মজুরী বিলায় চালকের জ্যোৎস্না হাতে।
অথচ জলেরা পেলে সমুদ্র যৌবন দিন
নদীদের জন্যে কি আর পারানি দেয়!
কোটি কোটি কিউসেক পারাপার দুঃখ নিয়ে
ভাঙাগড়া নিয়ে নদী এক গাধা মার্কা
প্রাগৈতিহাসিক কুরিয়ার সার্ভিস, যে
জন্মেছে বহনকাজে,
তার সাথে কবিদের; চিত্রশিল্পীদের
উৎসারিত সৃষ্টির কাহাতক তুমুল তুলনা সাজে !
বৃষ্টিভেজা রোদের বসত
[শুদ্ধতার কবি জীবনানন্দ দাশ স্মরণীয়বরেষু]
বর্ষণে কে বেশি কাঁদে–
আকাশ না মানুষের বুক ভরা মেঘ?
আকাশের ভয়-রং নীল চোখে
বাঁদুরের রং নেমে আসে,
মানুষের চোখে আসে দু’রঙা রেইন-গ্লাস।
মানুষ বলতে আজ তৃতীয় বিশ্বের কলাগাছ,
কলাপাতার ছাতায় চলা উদার আকাশমুখো
এই আমাদের কথাই বলছি।
উঠোনকে ফুটো করে কুয়া মেলে, পানি তো মেলে না।
ডালভাত, অথবা একটি বাড়ি একটি খামার
কাঁথাঢাকা চোখে-মুখে স্বপ্নের সওদা কতো,
খরাকে তাড়াতে, ফসলের মাঠে গিয়ে বাম্পার বাম্পার বলে
উল্লাসের আকাঙ্খায় কতোকাল বৃষ্টিকে ডেকেছি,
সেঁচের শ্যালোর প্রাণে বিদ্যুৎ প্রবাহ খুঁজে মাথা ঠুকি,
বুঝেছি খুঁটির জোর কম হলে–
আকাশ-নদী বা সেঁচ না দিলেও পানির বিপদ।
তৃতীয় বিশ্বের চোখে চোখে সাজায় বিষন্নতার সংসার।
বৃষ্টির দখল দেয়া চোখে যার সকল মৌসুমী সুখ একাকার,
তার কাছে বৃষ্টির বিলাস হয়তো আরেক কৌতুহল–
তাহলে কি আকাশেরও দুঃখ আছে?
নাকি উদার আকাশ জাল ফেলে টেনে নেয়
মানুষের মন-পুকুরের মেঘ-মাছগুলো।
হৃদয় হালকা হয়,
বৃষ্টি এলে রোদগুলো মুখগুলো কোথায় লুকায়?
জানেন কোথায়–
ছন্দমুখর টিনের চালে বৃষ্টি বৃষ্টিকে নাচায়,
রোদ ঢোকে মানুষের বুকে বুকে…
মানুষ প্রফুল্ল হয়ে যায়
এইবার সকলেই কবি হয়, কেউ বাদ নয়
কাদাময় কষ্টের বাগানগুলো নিপাট কবিতাময়।
বুড়ো নদীদের দেশে
নদীরা বুড়ো হয়ে বাংলদেশে কেনো? বিদায়ী আশ্রয়ে?
স্রোতেরা দক্ষিণে, খরাতো উত্তরে, ব্যথারা পশ্চাতে–
সমুখে প্রত্যাশা, সাগর সংকটে জলোচ্ছ্বাসে কাঁদে,
পূর্বে সংগ্রামী সাতটি প্রতিবেশী গোপন সম্পদে
আপন মাটি খোঁজে।
কি বলে পশ্চিম? কেনো যে বোবা পাখি?
বোবা বা ডোবা নয়, স্বাধীন চরাচর, দুঃখ বরাবর
বাগান ফুলভরা, মালীরা অভাগত, শহীদ মহিমায়
খবরে শিরোনাম। জননী জেগে থাকে, ক্ষমতা ঘরে তোলে
ফুলকে ফোটাবার, রোদকে নামাবার, শীতকে তাড়াবার
তাড়িত হয় সুখ! দু’হাত ভিক্ষুক, সবইতো সিঁদ কাটা
বাড়ির তিনপাশে ডাকাত ভূগোলের, খেলছে জমিদার
নদীতে দাবাখেলা, জালেও মাছধরা, খেলেছে সেচ খেলা
খেলছে যৌবন, ফেলেছে মরা-মল, কাঁদছে নদীসুখ।
বরফ গলে গলে বৃষ্টি-ঝরনায় গড়ানো পানিসুখ
বালির অভিশাপে; নদীরা ট্রানজিটে সেজেছে যাযাবর,
হ্যাংলা দেহ নিয়ে হ্যাংলা দেশে ঢোকে, শ্মশান কত দূরে?
নদীরা বুড়ো হলে চিতার দেশ খোঁজে– সাগর ছো’বে বলে!
নদীও কোরামিন খুঁজছে প্রতিদিন, খেলাপী নদী-ঋণ
বাড়ছে বাঙলায়, কাঁশছে বুড়ো নদী মুক্তি কামনায়
সাত মাত্রার মাত্রাবৃত্ত
মেঘবণিকেরা
বর্ষণের চেয়ে শোষণে অধিক পারঙ্গম
আমাদের প্রিয় মেঘের দেবীরা,
প্রকাশ্যের বারিধারা দেখে নাচি,
অদৃশ্যের দুগ্ধচোষী দোহন দেখিনা,
বুঝিনা সূর্যের অপলক তৃষ্ণা,
মেঘেদের তোষামুদে স্বভাব চিনিনা,
জানিনা কোথায়
মেঘবণিকের বাণিজ্য বসত।
মেঘেরা বণিক বটে,
ধান কেনা পাট কেনা হাটুরে স্বভাবে
প্রকাশ্যে বিলায় বৃষ্টি,
গোপনে বাড়ায় কালো হাত–
সিক্ততার কপালে পরায় শুষ্কতার টিপ,
আর্দ্রতায় যেনোবা অধিক সুখী মেঘ-সরীসৃপ।
মেঘেরা মানুষ দ্যাখে : শোষিত-ধনিক,
মেঘেরা সেবক তবে মূলত বণিক।
মেঘের মাদুরে
মেঘ এক বায়বীয় বাস্তবতা,
শিশুরা যেভাবে কাঁদে, ঝর ঝর
তেমনিই শিশুই থেকে গেলো
থোকা থোকা মেঘের বয়েস।
শতাব্দীপ্রাচীন কবি কালিদাস, মেঘদূত
মেঘের বয়েস ধরে টেনে নিয়ে যায়
কবিতার আয়ুমাখা নতুনের দিনে
মেঘ ঝরে, কবিতা ঝরে না–
মেঘ না হয়ে মানুষ হয়ে
কী কী লাভ আর ক্ষতি হলো
আমি হিসাব কষি না।
শুধু জানি, মেঘের মাদুরে বসে
একদা আত্মার পাখি উড়ে যাবে, আর–
আমাকে কামড় দেবে মাটি, পচনের গ্রাস।
আমাকে দু’ভাগ করে নেবে আকাশ জমিন,
মেঘ আর ভূমির ঘনত্ব; কালো অন্ধকার।
এভাবেই মেঘের মাদুরে আনা বৃষ্টির শ্রাবণে তাই
পূর্ব পুরুষের অনঙ্গ আত্মার– অপেরার গন্ধ পাই।
মেঘ-পলায়ন
মেঘ তার হারিয়েছে স্বাধীনাতা,
হারালো নিজস্ব ধারপাত!
মনুষ্য জাতির রোগ : বিজ্ঞানের হাত ধরে
পৃথিবীকে মুঠোবন্দি করা,
প্রকৃতির কানে পালকের সুড়সুড়ি দেওয়া,
খিটমিটে বিরক্তির বাঁশি বাজানোর বিপরীতে
বৈঠা ধরা বেগানা মানুষ!
কৃষ্টি আর বিনোদন খামারের ছুঁতো ধরে কতোকিছু..
দুগ্ধবতী মেঘের ওলান থেকে বৃষ্টিসুখ
শুষে নিচ্ছে বোমারু মানুষ!
অস্ত্রের বৈভবে আজ দেশে দেশে বৃষ্টির বৈষম্য।
অথচ মেঘহত্যার প্রতিবাদে
পরিবেশবিদেরাও শীতনিদ্রায় নিমগ্ন।
তারপর ফলাফল?
মেঘ যেন হারিয়েছে নিজস্ব ক্যালেন্ডার।
উবে যাচ্ছে মানবিক বিবেচনা আর
চন্ডাল কৃষ্ণের কলি হয়ে হাসছে, কাঁদছে।
এই বুঝি মেঘের কবিরা পয়ারে ছড়াবে অভিমান–
‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’
তোমাদের প্রিয় মেঘ অন্য গ্রহে যায়…
পদ্মা এখন পায়ের তলায়
পদ্মা– প্রবল নদী প্রমত্ততায়
কতো যান জলযান নিমজ্জমান,
কতো গান থেমে গেছে ঝড়ো-নৌকায়
কল্যাণ খান খান বিপদসমান।
কখনো গঙ্গাজল, পবিত্রতার
মৎস্যের, মানুষের, প্রকৃতির দেবী,
ভাগীরথী, ভগবান, নদী অবতার,
প্রত্ন প্রথিতযশা, পলি-জলসেবী।
কাঁধভরা বাঁধ আর ক্রোধ পাশবিক,
আসুরিকে খরা ভর, বালু চিক চিক।
মেঘনায় ইলিশিত, পাইথন সাপ
পদ্মার স্রোত-জলে ছোবলের পাপ।
সুগভীর, ডোবে সব, ছিলো নানা হেতু,
‘পদ্মা”তে প্রতিষ্ঠা হলো মহাসেতু।
যমুনা নমুনা সেতু, সমুখে চলায়–
‘পদ্মা’ও মানুষের পায়ের তলায়…।
কতো রোধ, প্রতিরোধ– শ্লেষের গলায়,
পিলারে ধাক্কা-ক্ষয় ছলায় কলায়।
সর্বনাশার নদী এখন আশার–
শতভাগ প্রত্যাশা কী ভালোবাসার।
খুলে গেছে চলাচল, প্রাণ-চঞ্চল
নদীভর বাংলা’র হ্যানো অঞ্চল
এ পিঠ ও পিঠ এক– পথ একাকার,
পারাপার নিয়ে দুখ, পাবে দেখা কার?
‘পঁচিশ জুনে’র গুণে হাসো জনগণ
সেতু মানে কল্যাণ– হেতু অগণন।
স্বাধীনতা ছোঁয়া ভূমি, পরাধীন নয়,
জল-নদী ক্রন্দনে খেলেছে বিজয়।
জাতির পিতার পিতা– পৈতৃকবাস,
সমাধিতে ফুল দিতে ছোটো বারো মাস।
স্বপ্নের মহাসেতু সতত চলায়
‘পদ্মা’– নাগিনজল– পায়ের তলায়।
নারী এক উদ্যমী– সাথে কৃতী শ্বাস..
কতো প্রীত নিবেদিত– স্মৃতি ইতিহাস।
নদী আজ স্বর্গীয়, দিন-রাত ধায়,
পৃথিবী ধন্য হলো ‘সেতু পদ্মায়।’