রিক্সায় প্যাডেল মারছে আর কানে লাগানো ছিপিতে গান শুনছে । বাবু আমার বড়ে গোলাম আলি খান ! কি মগ্নতা ! যাবার কথা আমড়াতলা আর নিয়ে এলো বেলপুকুরে ! কি ঝামেলা, কিছুতেই মানতে চায় না সে ভুল করেছে !
বাজারে আনাজওয়ালা ছিপি কানে এঁটে পটলের জায়গায় উচ্ছে মাপছে কেজি ভরে ।আরে আরে করিস কি? কি দিচ্ছিস? চাইছি দু’কেজি পটল আর তুই দিচ্ছিস উচ্ছে ? অতো উচ্ছে দিয়ে কি আমার শ্রাদ্ধের শুক্তো রান্না হবে ? কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে– আপনি তো এটাই চাইলেন ! সকাল থেকে এতো মাল বেচলুম কোন ভুল হয়নি আর আপনি বলছেন…
বাসে চলেছি রাতের বেলা । কোথায় এলো জানলা দিয়ে দেখে কিছুই বুঝতে পারছি না । কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করতেই পাশ থেকে একজন জ্যাকশন জ্যাকশন বলতে বলতে হুড় হুড় করে নেমে গেল
আমি তো অবাক ! জ্যাকশন বলে আবার এই দিকে কোন জায়গা ! আগে তো কোনদিন শুনিনি ! তবে কি ভুল বাসে উঠলাম? আবার কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে – শুনেছি শুনেছি, চুপচাপ বসুন ঠিক জায়গা এলেই নামিয়ে দেব ।
বাড়ি ফিরে দেখি আমার গৃহিণীও কানে ছিপি লাগিয়ে বিছানাতে বসে পা দোলাচ্ছেন আর চোখ বন্ধ করে টুক টুক করে ঘাড়টাও নাড়াচ্ছেন ! জিজ্ঞেস করলাম , হ্যাঁগো এটা আবার………
সন্তু এনে দিয়েছে । সারাদিন এফ এম শুনবো । আমি বললাম , কি শুনছো দেখি আমি একটু শুনি … একটা ছিপি আমার কানে দাও …
শুনেই তিনি রে রে করে উঠলেন । ঐ তো তোমার দোষ । আমার কোন কিছুই কি তোমার সহ্য হয় না ? শুনছি একটা গান, সেটাকে দুখানা করে শুনলে আর কিছু থাকবে না বুঝবো ? আর কি বললে, ছিপি ? তোমাকে নিয়ে আর ভদ্র সমাজে চলাই যাবে না । কেন হেড ফোন বলতে পারো না ?
— সে কি ! গান দুভাগ হয়ে যাবে? দুকানের দুটো ছিপিতে কি আধখানা করে গান হচ্ছে?
— আবার বলে ছিপি … ও তুমি বুঝবে না । তুমি বসে বসে খবরের কাগজটা পড়… বলতে বলতে ঘরের বাইরে চলে গেল ।
সেদিন সকালে ছাদে হঠাৎ দুম করে শব্দ হল । কি পড়লো, কে পড়লো করতে করতে ছাদে গিয়ে দেখি নাতনি পায়েল পা চেপে বসে আছে, গলগল করে রক্তও বের হচ্ছে। কি রে কি হল , কি করে হল ?
— দাদু আমার পা টা মনে হয় ভেঙেই গেল …উফ মাগো…কেঁদে কেঁদে বলে পায়েল ।
— তা হল কি করে ?
পাশ থেকে ছোট নাতি টুটুল বলে, কি হয়েছে জানতো দাদু , দিদি না টবের ঐ গোলাপ ফুলটার সঙ্গে সেলফি তুলবে বলে টবটা সরাচ্ছিল আর সেটা পায়ে পড়েছে ।
— সেলফি টবের গাছ নিয়ে?
কাঁদতে কাঁদতে মিনমিনে গলায় পায়েল বলে, আজ ফ্লাওয়ার্স –ডে , তাই ভাবলাম ফুলের সঙ্গে … উফ মাগো…
— ব্যস ! এখন চল ডাক্তারখানায়, সেখানে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে সেলফি তুলবি…
— না দাদু , আগে ছবিটা নিতেই হবে না হলে পোস্ট করতে পারবো না ! প্রেস্টিজ পাংচার হয়ে যাবে! তুমি টবটা একটু তুলে দাও না প্লীজ…দাদু…
— এখনো সখ মেটেনি ? ঐ ভাঙা টব তুলব কি করে?
— প্লীজ…দাদু , যা হোক একটু ম্যানেজ করো । নাতনির আবদারে তুললাম টব । গোলাপের কাঁটায় হাত রক্তারক্তি কিন্তু উপায় নেই ।এমন সময় ছাদে বৌমার প্রবেশ । কি রে পায়েল কিসের যেন শব্দ হল ? ওওওওওমা…… তুই গোলাপের সঙ্গে সেলফি তুলছিস ! বাবা প্লীজ… আর একটু ধরে থাকুন না … আমি একটা শট নিয়ে নি …
কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম টব ধরে । মা মেয়ে কিচ কিচ করে সেলফি তুলছে মত্ত হয়ে ।
— বৌমা হাত যে ব্যথা হয়ে গেল, এবার থামো !
— আর একটা বাবা …প্লীজ আর একটা ! পায়েল তোর ঠাকুমা এসেছে … ও মা, তাড়াতাড়ি আসুন । বাবা আজ কি দারুণ পোজ দিয়েছেন দেখুন…।
থপ থপ করে আমার বাষট্টি বছরের গিন্নিও আসছেন পোজ দিতে ! হায়রে …সেলফি …
এখন নিজেকে মনে হচ্ছে আলিপুর চিড়িয়াখানার সেই শিম্পাঞ্জি “বাবু:” …। সবাই দেখছে আর ছবি নিচ্ছে………সেলফি !!